বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না
৩০৪ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। কে এম আবু বাকের, বীর প্রতীক ভয়ে আত্মসমর্পণ করল পাকিস্তানি সেনারা গভীর রাতে সীমান্ত অতিক্রম করে সামনে এগিয়ে যেতে থাকলেন একদল মুক্তিযোদ্ধা। তাঁরা কয়েকটি দলে বিভক্ত। একটি দলে আছেন কে এম আবু বাকের। তিনিই তাঁদের দলনেতা।
অন্ধকারে হাঁটতে হাঁটতে তাঁরা পথ হারিয়ে ফেললেন। এর মধ্যে ভোর হলো। আবছা আলোয় বুঝতে পারলেন আঁকাবাঁকা পথে তাঁরা বেশি দূর এগোতে পারেননি। খুব সকালে বিশ্রাম নিচ্ছেন। এমন সময় তাঁদের সামনে হঠাৎ হাজির হলো পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর টহল দল। একসঙ্গে এত মুক্তিযোদ্ধা দেখে পাকিস্তানি সেনাদের চক্ষু চড়কগাছ। মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ করার আগেই ভয় পেয়ে তারা আত্মসমর্পণ করল। এ ঘটনা ভানুগাছের সন্নিকটে। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের শুরুতে।
ভানুগাছ মৌলভীবাজার জেলার অন্তর্গত। মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর ‘জেড’ ফোর্সের অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট বৃহত্তর সিলেট মুক্ত করার জন্য সীমান্ত এলাকা থেকে শমসেরনগর-মৌলভীবাজার-সিলেট অক্ষ ধরে অগ্রসর হতে থাকে। ৩০ নভেম্বর মধ্যরাত থেকে তাঁরা অভিযান শুরু করেন। কমলগঞ্জ হয়ে কেরামতনগর মুক্ত করার জন্য তাঁরা এগোতে থাকেন ভানুগাছের দিকে। কিন্তু পথ হারিয়ে ফেলায় মুক্তিযোদ্ধারা সময়মতো ভানুগাছে পৌঁছাতে পারেননি।
কেরামতনগরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থান ছিল বেশ শক্তিশালী। কে এম আবু বাকেরের নেতৃত্বাধীন দলের ওপর দায়িত্ব ছিল কেরামতনগরের আউট পোস্ট দখলের। তিনি তাঁর দল নিয়ে দিনের বেলাতেই সেখানে আক্রমণ করেন। পাকিস্তানি সেনারাও তাঁদের পাল্টা আক্রমণ করে। শুরু হয় রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসিকতা ও বীরত্বে হকচকিত পাকিস্তানি সেনারা একপর্যায়ে পিছু হঠতে বাধ্য হয়। মুক্তিযোদ্ধারা সহজেই কেরামতনগর দখল করেন।
এই যুদ্ধে কে এম আবু বাকের কৌশলী ভূমিকা পালন করে পাকিস্তানি সেনাদের তাক লাগিয়ে দেন। পাকিস্তানিরা ভাবতেই পারেনি দিনের বেলায় এভাবে মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ করবেন। যুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়। মুক্তিবাহিনীর সাতজন আহত হন।
কে এম আবু বাকের ১৯৭১ সালে শিক্ষার্থী ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে যোগ দেন যুদ্ধে। তাঁকে প্রথম বাংলাদেশ ওয়ার ফোর্সে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। প্রশিক্ষণ শেষে ‘জেড’ ফোর্সের অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধীনে যুদ্ধ করেন। ধামাই চা-বাগান, সোনারুপা, ফুলতলা উল্লেখযোগ্য যুদ্ধ।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য কে এম আবু বাকেরকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ২৯।
কে আবু বাকের স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে চাকরি করেন। ১৯৯৬ সালে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হিসেবে অবসর নেন। বর্তমানে তিনি হলিক্রিসেন্ট হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। তাঁর পৈতৃক বাড়ি নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ উপজেলার মাছুমাবাদ গ্রামে। সেখানে তিনি বসবাস করেন না। বর্তমানে বাস করেন ঢাকার উত্তরার তিন নম্বর সেক্টরের ২০ নম্বর সড়কে। তাঁর বাবার নাম কে এম আবদুল্লাহ। মা সুলতানা আবদুল্লাহ। স্ত্রী নাজমা আক্তার। তাঁদের তিন ছেলে।
কে এম আবু বাকের বললেন, যাঁদের বীরত্ব ও ত্যাগের বিনিময়ে আজকে আমরা স্বাধীন দেশের গর্বিত নাগরিক, সেই বীর মুক্তিযোদ্ধাদের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির ঊর্ধ্বে উঠে সবারই সম্মান দেখানো উচিত।
সূত্র: কে এম আবু বাকের বীর প্রতীকের সাক্ষাৎকার; নিয়েছেন মুক্ত আসরের আবু সাঈদ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ ব্রিগেডভিত্তিক ইতিহাস। ছবি স্বর্ণময়ী সরকার।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com
No comments