রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়-হত্যা-সংঘর্ষ ঘটছেই, বিচার হয় না by শরিফুল হাসান ও কুদরাত-ই-খুদা

০১২ সালের ১ জানুয়ারি। সবাই যখন নতুন বছরকে স্বাগত জানাচ্ছে, তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে চলছে ছাত্রলীগের তাণ্ডব। প্রতিপক্ষের কর্মীরা ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে লোহার রড ও হাতুড়ি দিয়ে পেটান চতুর্থ বর্ষের ছাত্র খালিদ হাসানকে।


প্রাণে বেঁচে গেলেও ১৩ দিন ধরে ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন খালিদ। তাঁর ডান হাত ভেঙে গেছে। ব্যবসায় প্রশাসনের (বিবিএ) ব্যবস্থাপনা বিভাগের ছাত্র খালিদ গতকাল শনিবার কান্নাজড়িত কণ্ঠে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার জীবন শেষ। ওরা আমাকে পঙ্গু করে দিল। সেদিন হলে কোনো সংঘর্ষ হয়নি। আমি ঘুমাচ্ছিলাম। হঠাৎ এসে ওরা আমাকে পেটাতে থাকে। আমি কোনো বিচার পেলাম না। পুলিশ আমার মামলাও নেয়নি।’
একইভাবে ২০১০ সালের আগস্টে শাহ মখদুম (এসএম) হলে ছাত্রলীগের হামলায় আহত হয়ে নয় দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর মারা যান ইতিহাস বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র নাসরুল্লাহ নাসিম। ওই ঘটনারও বিচার হয়নি। এ ছাড়া ছাত্রলীগের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গত তিন বছরে অন্তত ৩০ বার ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে বড় ধরনের সংঘর্ষ হয়েছে। এসব ঘটনায় শতাধিক আহত হলেও একটি ঘটনারও বিচার হয়নি।
ক্যাম্পাসে এখন শিবির নেই। ছাত্রলীগ নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষেই ব্যস্ত। কেবল সংঘর্ষই নয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের নতুন উৎপাত হচ্ছে ছিনতাই ও হলে হলে চাঁদাবাজি। গত এক বছরে শতাধিক শিক্ষার্থীর মোবাইল ছিনতাই হয়েছে। আর চাঁদা দিতে না পারায় হল ছাড়তে হয়েছে অন্তত ৫০০ জনকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০টি আবাসিক হলের সবগুলোতেই ছাত্রলীগের একক আধিপত্য। ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরাই ঠিক করে দেন, কে কোন সিটে থাকবেন। বিনিময়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের যেতে হয় ছাত্রলীগের মিছিলে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি শিপন আহমেদ প্রথম অলোকে বলেন, ‘সাধারণ শিক্ষার্থীরা ছাত্রলীগের ছিনতাই ও হলে হলে চাঁদাবাজির কারণে অতিষ্ঠ। ছাত্রলীগের নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষ তো আছেই। হলগুলোতে ছাত্রলীগই প্রশাসন, তারাই আসন-বাণিজ্য করে। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, প্রশাসন কখনোই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় না।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সভাপতি আহমেদ আলী এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘অতীতে ছাত্রলীগ যা-ই করুক, বর্তমান কমিটি হওয়ার পর আমরা ছিনতাই, চাঁদাবাজি এসব বন্ধের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘ছাত্রলীগে খারাপ নেই বলছি না। তবে আমরা চেষ্টা করছি তাদের ঠিক পথে ফিরিয়ে আনার।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর চৌধুরী মোহাম্মদ জাকারিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘সারা দেশে যা ঘটছে, রাজশাহী তো তার বাইরে নয়। তবে আমরা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার জন্য সব সময় চেষ্টা করি। ছাত্রলীগের যারা ভালো ছেলে, তারা তো আমাদের কথা শোনে। কিন্তু যারা বেয়াদব, তাদের নিয়েই সমস্যা।’
কান্না থামেনি নাসিমের পরিবারের: বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রথম বছর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা ব্যস্ত ছিলেন শিবিরের সঙ্গে সংঘর্ষে। শিবিরের হাতে ছাত্রলীগের কর্মী ফারুক হোসেন নিহত হওয়ার পর তারা ক্যাম্পাসছাড়া। ক্যাম্পাসে এখন ছাত্রলীগের একক আধিপত্য।
ছাত্রলীগের সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘ ছয় বছর পর আওয়াল কবিরকে সভাপতি ও মাজেদুল ইসলামকে সাধারণ সম্পাদক করে ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নতুন কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটি গঠন করার পর থেকেই ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা চাঁদাবাজি, ছিনতাই, অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে।
বারবার সংঘর্ষ ও মারামারি, সর্বশেষ নাসিমের মৃত্যুর ঘটনার পর ছাত্রলীগের ওই কমিটি বাতিল এবং সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে স্থায়ীভাবে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়। এর বছর খানেক পর গত বছরের জুনে আহমেদ আলীকে সভাপতি ও আবু হুসাইনকে সাধারণ সম্পাদক করে নতুন কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটি গঠনের পর ১ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু হলে সংঘর্ষে আহত হন খালিদ।
ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের সবচেয়ে বড় ঘটনা ঘটে ২০১০ সালের ১৫ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহ মখদুম (এসএম) হলে। ওই দিন জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে বিশেষ খাবারের টোকেন সংগ্রহ করাকে কেন্দ্র করে আওয়াল কবিরের সমর্থকেরা প্রতিপক্ষের কর্মী নাসরুল্লাহ নাসিমকে মারধর ও ছুরিকাঘাত করে ওই হলের দোতলা থেকে নিচে ফেলে দেয়। গত ২৩ আগস্ট ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নাসিম মারা যান।
এস এম হলের ছাত্রলীগের কর্মী জহিরুল ইসলাম, লুৎফর রহমান, জাহিদুল ইসলাম, তৌফিকুল ইসলাম, রুহুল আমিন ও মশিউর রহমানের বিরুদ্ধে নাসিমকে মারধরের অভিযোগ ছিল। ঘটনার পর তাঁদের গ্রেপ্তার করা হলেও এখন জামিন নিয়ে বহাল তবিয়তেই ক্যাম্পাসে আছেন সবাই।
নাসিমের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জে। স্কুলশিক্ষক বাবা মোসলেম উদ্দিন গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার তিন মেয়ে। একটাই ছেলে। অনেক আশা নিয়ে ছেলেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু সব শেষ। এখন আমি ছেলে হত্যার বিচারের আশায় আছি। কিন্তু রাজনৈতিক একটি মহল এ বিচার বাধাগ্রস্ত করতে চাইছে। মূল যারা আসামি, তাদের বাদ দেওয়ার চেষ্ট চলছে।’
বারবার সংঘর্ষ: ২০১০ সালের ১৮ এপ্রিল চাঁদা না দেওয়ায় ছাত্রলীগের কর্মী পারভেজ জনকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলের একটি কক্ষে নিয়ে সিগারেটের আগুন দিয়ে শরীরের বিভিন্ন অংশ পুড়িয়ে দেয়। ওই বছরের মার্চে বঙ্গবন্ধু হলে ক্যারম খেলা নিয়ে ছাত্রলীগের যুগ্ম সম্পাদক ফুয়াদ হোসেনকে পিটিয়ে আহত করেন ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি আওয়াল কবিরের পক্ষের ফারুক ও সোহেল। ওই বছরের ১ জুন গভীর রাতে তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাদার বখ্শ হলে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে পাঁচজন আহত হন।
সাইকেল চুরির ঘটনায় ২০১০ সালের ১৭ জুন বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহ মখদুম হলে রাতে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে তিনজন কর্মী আহত হন। ছাত্রশিবিরকে প্রশ্রয় দেওয়া-না দেওয়ার ঘটনায় একই বছরের ২৬ জুন বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন স্থানীয় যুবলীগের কর্মীদের সঙ্গে ছাত্রলীগের সংঘর্ষে চারজন আহত হন। আবার প্রেমের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় ২০১০ সালের ১ এপ্রিল ছাত্রলীগের কর্মী কাউসার আলম বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রীকে ক্যাম্পাসে প্রকাশ্যে পিটিয়ে আহত করেন।
কেবল নিজেরা মারামারি করেই থেমে থাকেনি ছাত্রলীগ। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ২০১০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের কর্মীদের হামলায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর মুসতাক আহমেদ, আলোকচিত্রী আজাহার উদ্দিনসহ আটজন সাংবাদিক গুরুতর আহত হন। তৎকালীন সভাপতি আওয়াল কবিরকে হলে ঢুকতে না দেওয়ার ঘটনায় ২০১০ সালের ৮ এপ্রিল রাতে শহীদ শামসুজ্জোহা হলের প্রাধ্যক্ষ মর্ত্তুজা খালিদকে লাঞ্ছিত হতে হয়।
২০১০ সালের ১ জুন গভীর রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাদার বখ্শ হলে ফাও খাওয়া নিয়ে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
‘শিবির’ আখ্যা দিয়ে মারধর: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৯১তম জন্মদিন উপলক্ষে গত বছরের ১৭ মার্চ ক্যাম্পাসে শোভাযাত্রা বের করে ছাত্রলীগ। ওই কর্মসূচির ছবি তোলার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের কর্মী শামীম আহমেদ বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের গবেষক মশিউর রহমানকে ডেকে নিয়ে আসেন। ছবি তোলার একপর্যায়ে ছাত্রলীগের কয়েকজন কর্মী মশিউরকে ‘শিবির’ আখ্যা দিয়ে বেধড়ক মারধর করেন এবং তাঁর সঙ্গে থাকা একটি দামি ক্যামেরা ও মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেন। তাঁর বিরুদ্ধে ছাত্রশিবিরের রাজনীতি করার কোনো তথ্য-প্রমাণ না পাওয়ায় পরে ছেড়ে দেওয়া হয়।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, ক্যাম্পাসে এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। কাউকে মারধরের জন্য ছাত্রলীগের নতুন অজুহাত হচ্ছে শিবির বলে প্রচারণা। বিশ্ববিদ্যালয়ে গত এক বছরে অন্তত ৫০ জন ছাত্র এভাবে মার খেয়েছেন।
চাঁদাবাজি ও ছিনতাই: ছাত্রলীগের চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ হয়ে গত বছর শাহ মখদুম হল থেকে ৬৮ জন, সৈয়দ আমীর আলী হল থেকে ৩০, নবাব আবদুল লতিফ হল থেকে ৩৩, শহীদ শামসুজ্জোহা হল থেকে ৪৮, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী হল থেকে ৮৪, মাদার বখ্শ হল থেকে ৬৯, জিয়াউর রহমান হল থেকে ৩৭, শহীদ হবিবুর রহমান হল থেকে ৩৮ এবং শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক হল থেকে ২৫ জন সাধারণ ছাত্র আবাসিকতা বাতিল করে চলে গেছেন।
ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ ছিনতাই। গত বছরের ১৫ মার্চ রাতে ছিনতাই করতে গিয়ে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন ছাত্রলীগের তিনজন কর্মী। তাঁরা হলেন: রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের আবু হানিফ, তৃতীয় বর্ষের মনজুরুল আলম ও রাজশাহী কলেজ শাখা ছাত্রলীগের কর্মী ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগের প্রথম বর্ষের নাহারুল কাওসার। তবে আটক করার পরপরই পুলিশ ছেড়ে দিলে তাঁরা এখন বহাল তবিয়তে ক্যাম্পাসে আছেন।
ক্যাম্পাসের সাধারণ শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, সন্ধ্যার পর ক্যাম্পাসের জুবেরী মাঠ, প্রথম বিজ্ঞান ভবন, পানির ট্যাংক, পশ্চিম পাড়াসহ ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থানে মোবাইল ও টাকাপয়সা ছিনতাই হয়। ছাত্রলীগের মাদকাসক্ত নেতা-কর্মীরাই এর সঙ্গে জড়িত। এ ব্যাপারে প্রক্টর চৌধুরী মোহাম্মদ জাকারিয়া বলেন, ‘ক্যাম্পাসে মাঝেমধ্যে ছিনতাই হয়। তবে কারা এর সঙ্গে জড়িত, তা আমরা জানি না।’
ছাত্রলীগই প্রশাসন: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে ছাত্রদের জন্য আবাসিক হল রয়েছে ১০টি। এসব হলের আসন বণ্টন হয় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের ইচ্ছানুযায়ী। ‘ছাত্রলীগ করলে আসন মিলবে’—ঠিক এ নীতিতেই চলছে হলগুলোর আসন বণ্টন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের ১২ জন ছাত্র গতকাল প্রথম আলোর কাছে স্বীকার করেছেন, হলে আসন পাওয়ার জন্য তাঁদের ছাত্রলীগের মিছিলে যেতে হয়।
ছাত্রলীগের তদন্ত কমিটি: ১ জানুয়ারি সংঘর্ষের ঘটনাসহ অন্যান্য বিষয়ে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। ওই কমিটি বিষয়ে জানতে চাইলে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সম্পাদক হাসানুজ্জামান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের এ কমিটির মেয়াদ মাত্র সাত মাস। তারা সংগঠনকে যখন গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে, তখন কেউ কেউ সমস্যা সৃষ্টির চেষ্টা করছে। আমরা বলে এসেছি, যারাই এসব নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকবে, তাদের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

No comments

Powered by Blogger.