সংবাদ বিশ্লেষণ-বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা ঢেলে সাজাতে হবে by অরুণ কর্মকার

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি বক্তব্য বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের পুরো দৃশ্যপট পাল্টে দেবে। গতকাল শনিবার একটি অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, দেশের খনি থেকে কয়লা না তুলে তা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য জমা রাখা হবে। আর বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা কয়লা দিয়ে এখন বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে। প্রধানমন্ত্রী এমন একসময় এই বক্তব্যটি দিলেন, যখন কয়লাভিত্তিক কেন্দ্র থেকে বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদনের মহাপরিকল্পনা সরকার চূড়ান্ত করেছে।


সেই মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে ১৯ হাজার ৬৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কয়লা দিয়ে উৎপাদন করার কথা। এর মধ্যে ২০১৬ সাল নাগাদ প্রায় সাত হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কয়লাভিত্তিক কেন্দ্র থেকে উৎপাদন করার কথা। প্রতিদিন সাত হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কয়লা লাগে অন্তত ৭০ হাজার মেট্রিক টন। প্রতিদিন এই পরিমাণ কয়লা আমদানির জন্য সমুদ্রবন্দরের যে ক্ষমতা ও সুযোগ-সুবিধা দরকার তার কিছু এখন পর্যন্ত দেশে নেই।
বন্দরের সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, কয়লার জাহাজ সাধারণত ৩০ হাজার টনের কম ধারণক্ষমতার হয় না। এ ধরনের জাহাজ বন্দরে আসার জন্য পানির যে গভীরতা দরকার তা মংলা কিংবা চট্টগ্রামেও নেই। মূল জাহাজ বহির্নোঙরে রেখে ছোট ছোট জাহাজে (লাইটারিং) করে কয়লা খালাস করতে হলে বন্দরে শুধু কয়লার জাহাজেরই লাইন থাকবে।
তা ছাড়া, কয়লা খালাস করে রাখার জন্য বিশাল জায়গা লাগবে। সেখানে কয়লার স্তূপে যাতে আগুন না লাগে সে জন্য বিশেষ প্রস্তুতি এবং পানি ছিটানোর ব্যবস্থা লাগবে। এরপর আসে নিয়মিত রেলপথে কয়লাগুলো বিদ্যুৎকেন্দ্রে পৌঁছানোর প্রশ্ন। এ জন্য দরকার হবে ‘ডেডিকেটেড’ রেললাইন।
বিদ্যুৎকেন্দ্র যদি বন্দরসংলগ্ন স্থানেই করা হয় তাহলে দীর্ঘ রেল পরিবহনের দরকার হবে না। কিন্তু সমুদ্রের ধারে এত বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় মিঠাপানির সমস্যা হবে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য প্রচুর পরিমাণ ঠান্ডা ও মিঠাপানি দরকার হয়।
২০১৬ সাল—এখন থেকে পাঁচ বছর সময়। বড় একটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণেও এর চেয়ে বেশি সময় লাগে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এ রকম কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ শুরু করা যায়নি।
কাজেই কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন তথা দীর্ঘ মেয়াদে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সরকারি পরিকল্পনা সরকারকে বদলাতে হবে। আমদানি করা কয়লা দিয়ে ওই পরিকল্পনার বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী আমদানির কথাই বলেছেন। বিষয়টি সম্পর্কে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ নূরুল ইসলামের মতামত জানতে চাইলে গতকাল রাতে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সম্পূর্ণ আমদানি করা কয়লায় সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন বোধ হয় বাস্তবসম্মত নয়। এতে অনেক প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হবে।
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে কয়লানীতি প্রণয়ন, একের পর এক কমিটি গঠন—এসব বিষয়ও অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ল। কয়লানীতি প্রণয়নের কাজ প্রথম শুরু করা হয় ২০০৬ সালে। এরপর সাতবার সংশোধন-পরিমার্জনের পর নীতিকাঠামোটি চূড়ান্ত করার জন্য গঠন করা হয় একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সাবেক উপাচার্য আবদুল মতিন পাটোয়ারীকে প্রধান করে গঠিত ওই কমিটি খসড়া নীতিটির প্রতিটি লাইন ধরে আলোচনা করে একটি চূড়ান্ত খসড়া তৈরি করে সরকারকে দেয়। এরপর সেটি নিয়ে সরকারি পর্যায়েও কিছু কাজ করে চূড়ান্ত করা হয়।
ওই পর্যায়ে সুশীল সমাজের একাংশ দাবি করে, অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার এ ধরনের একটি জাতীয় নীতি চূড়ান্ত করতে পারে না। এর পরিপ্রেক্ষিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নীতিটি ওই অবস্থায়ই রেখে দেয়। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে সেটি নিয়ে আরও কাজ করে। গত মাসেও (ডিসেম্বর ১১) সরকারের একাধিক নীতিনির্ধারক বলেছেন, কয়লানীতিটি তাঁরা শিগগিরই চূড়ান্ত করবেন।
গত পাঁচ সেপ্টেম্বর পেট্রোবাংলার সাবেক চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেনকে আহ্বায়ক করে পাঁচটি কাজের দায়িত্ব দিয়ে ১৫ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। কাজগুলো হলো: দেশের খনি থেকে কয়লার উত্তোলন পদ্ধতি নির্ধারণ, উন্মুক্ত পদ্ধতির ক্ষেত্রে পানি ব্যবস্থাপনা, পরিবেশ ব্যবস্থাপনা, অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ ও পুনর্বাসন পদ্ধতি। কমিটি আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে প্রতিবেদন দেওয়ার লক্ষ্যে কাজ করছে।
এ ছাড়া ২০১০ সালের ১২ এপ্রিল অর্থমন্ত্রী আবুল মাল অবদুল মুহিত এক চিঠিতে জ্বালানি মন্ত্রণালয়কে কয়লানীতি চূড়ান্ত করতে বলেন। পাশাপাশি উন্মুক্ত পদ্ধতির খনি বিষয়ে গণসচেতনতা সৃষ্টি ও খনি এলাকার মানুষের বিকল্প জীবন-জীবিকার ব্যবস্থা নিশ্চিত করার পদক্ষেপ নিতে হবে বলেও ওই চিঠিতে নির্দেশনা ছিল।
প্রধানমন্ত্রীর গতকালের বক্তব্যের পর এসব প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত অনেকেই বিস্মিত হয়েছেন। তাঁদের একাধিকজন বলেছেন, সরকারের তিন বছর চলে যাওয়ার পর দেশের খনি থেকে অধিক হারে কয়লা তোলার জটিল সিদ্ধান্তটি তাঁরা নিতে চাইছেন না।
অথচ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে বলা হয়েছিল, ‘এ পর্যন্ত প্রাপ্ত কয়লার অর্থনৈতিক ব্যবহার এবং কয়লাভিত্তিক শিল্প নির্মাণে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হবে। নতুন কয়লা ও অন্যান্য খনিজ সম্পদ অনুসন্ধান ও আহরণে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হবে।’

No comments

Powered by Blogger.