টেলিভিশন-চিত্রটি কেবল হতাশার নয় by আফসানা মিমি

লিখতে বসেছি টেলিভিশন অনুষ্ঠানের ২০১১ সালের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি আর ২০১২ সালের প্রত্যাশার কথা।
মাথার ভেতর আকুলি-বিকুলি চলছে কোন প্রাপ্তির কথা বলব আর কোন অপ্রাপ্তির? কারণ, টেলিভিশন অনুষ্ঠানের ব্যর্থতা বা সফলতার দায় তো শুধু নির্মাতা, শিল্পী, কলাকুশলী বা প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের নয়। দায় টেলিভিশন চ্যানেলগুলোরও, যারা নীতিমালা প্রণয়নকারীরা এখনো কোনো সঠিক দিক নির্দেশনা দিতে পারেননি।


হাঁটি হাঁটি পা পা করে প্যাকেজ নাটক, প্যাকেজ অনুষ্ঠান বা বেসরকারি পর্যায়ের অনুষ্ঠান নির্মাণের বয়স প্রায় ১৬-১৭ হতে চলল। কিন্তু অনুষ্ঠানের মান দিন দিন কমছে, না বাড়ছে—সে এক জটিল প্রশ্ন।
এ মুহূর্তে অনুমোদন পাওয়া টেলিভিশন চ্যানেলের সংখ্যা ২৩। সংবাদপ্রধান চ্যানেল এটিএন নিউজ, ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভি এবং সময় টিভিকে হিসাব থেকে বাদ রাখলে নিয়মিত সম্প্রচার এবং পরীক্ষামূলক সম্প্রচারসহ বিনোদনমূলক চ্যানেলের সংখ্যা দাঁড়ায় ২০। তার পরও ভারতীয় হিন্দি অথবা ভারতীয় বাংলা চ্যানেলের প্রতি দর্শকদের আগ্রহ আমরা কমাতে পারিনি। দৃষ্টি ফেরাতে পারিনি আমাদের দিকে। এ দায় কি দর্শকদের? নাকি আমাদের, যারা অনুষ্ঠান নির্মাণ করি; নাকি যাঁরা টেলিভিশন চ্যানেল তৈরি করছেন এবং অনুষ্ঠান প্রচার করে চলেছেন নিরন্তর তাঁদের? কয়টি টিভি চ্যানেল স্বমহিমায় উদ্ভাসিত হতে পেরেছে? এ টিভি চ্যানেলগুলো কি আসলে একটি আরেকটির ক্লোন নয়? আমার এসব বাতুল প্রশ্নে টেলিমাধ্যমের মানুষদের ভ্রুকুঞ্চন হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমি কোনো ব্যক্তি বা কোনো প্রতিষ্ঠানকে কটাক্ষ করছি না। আমি নিজেও এই বৃহৎ পরিবারেরই একজন সদস্য বা কর্মী। আমি কেবল বলতে চাইছি, একটি মানদণ্ড বা পলিসি আমাদের খুব দরকার। তাহলে সামনের বছরগুলোতে সালতামামি লিখতে বসলে দেখবেন, প্রাপ্তির ঝুলি উপচে উঠছে আর অপ্রাপ্তিগুলো কমে আসছে।
সেই সুদিনের অপেক্ষায় আছি, যেদিন একজন অনুষ্ঠান নির্মাতাকে রীতিমতো যোগ্যতার পরীক্ষা নিয়ে নির্মাণের দায়িত্ব দেওয়া হবে। এবং যোগ্যতার ভিত্তিতেই তার মূল্যায়ন হবে। যার যা খুশি তা লিখতে পারবে না, যার যা খুশি তৈরি করতে পারবে না, যার যা খুশি তা দেখাতে পারবে না। থাকবে সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় দায়। একইভাবে টিভি চ্যানেলগুলোও মুড়ি ও মিছরি একই দামে কিনতে পারবে না। এবং তাদেরও থাকবে সমান দায়িত্ব।
আমরা ভাষার অবমাননা করি। ইতিহাস ও সংস্কৃতির অবমাননা করি। এই অধিকার আমাদের কে দিয়েছে?
আমাদের পতাকা, আমাদের ভাষা, আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এসব তো ধর্মগ্রন্থের মতোই পবিত্র, যা আমরা মাথায় করে রাখব। পরম ভালোবাসায় বুকের ভেতর লালন করব।
দর্শকেরাই আমাদের কাজের মূল বিচারক। তাঁরা বলেন, নাটকের গল্প ভালো নয়। আপনারা এসব কি ভাষায় কথা বলেন? কী দেখান?
একটা তুলনামূলক আলোচনা হতেই পারে যে বিনোদননির্ভর টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে বছরের ৩৬৫ দিনে যা দেখানো হচ্ছে, তার কত ভাগ অনুষ্ঠান সফল?
আমরা দর্শকদের কাছে এ প্রশ্নের উত্তর জানতে চাইতে পারি।
একটা কথা প্রচলিত আছে, দর্শক ‘খায়’ না। দর্শক যে কী ‘খায়’ আর কী ‘খায়’ না, সেটা আমরা কিসের ভিত্তিতে বলছি? টেলিভিশন অনুষ্ঠানের জনপ্রিয়তা নিরিখের একটি মানদণ্ড আছে—টেলিভিশন রেটিং পয়েন্ট বা টিআরপি। টিআরপি করা হয় কিসের ভিত্তিতে? পিপলস মিটার সংখ্যায় কী পরিমাণ আছে এ দেশে? তার পরও টিআরপি নিয়ে যে আমরা উচ্ছ্বসিত হই! একবার কি খতিয়ে দেখা দরকার নয় আমাদের, কত ভাগ অনুষ্ঠান দর্শক আসলে বর্জন করছে?
দর্শক তার নিজের ভাষা এবং সংস্কৃতিনির্ভর অনুষ্ঠান দেখতেই বেশি আগ্রহী। আমরা সে চাহিদা মেটাতে ব্যর্থ হচ্ছি বলেই তারা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে দেশীয় টিভি চ্যানেলগুলো থেকে। একটা টিভি চ্যানেলের কত ভাগ অনুষ্ঠান শিশুদের জন্য হবে? কত ভাগ অনুষ্ঠান হবে শিক্ষামূলক? কত ভাগ বিজ্ঞাপন প্রচার করা হবে বা কত ভাগ অনুষ্ঠান হবে বিনোদনমূলক তার একটা সুস্পষ্ট নীতিমালা থাকা দরকার। কেন একজন দর্শককে সারাক্ষণ রাজনীতিনির্ভর টক শো, খবর এবং বিজ্ঞাপন দেখতে বাধ্য করা হবে?
সেদিন প্রথম আলোতেই পড়ছিলাম, চীন সরকার টেলিভিশনে অনুষ্ঠান চলাকালে অনুষ্ঠানের মধ্যে বিজ্ঞাপন প্রচার নিষিদ্ধ করেছে। কারণ, দর্শক মহাবিরক্ত।
বারবার মান নিয়ে কথা বলতে গিয়ে একটা কথা উল্লেখ না করে পারছি না।
কথা প্রসঙ্গে একবার এটিএন বাংলার অনুষ্ঠান প্রধান নওয়াজীশ আলী খানকে বলেছিলাম, ‘ভালো অনুষ্ঠানগুলো তো আপনাদেরই প্রমোট করতে হবে নওয়াজীশ ভাই।’ তিনি স্মিত মুখে বলেছিলেন, ‘কোনটাকে ভালো বলব? তোমার অনুষ্ঠানকে ভালো না বললে তোমার মুখ কালো হবে। আমরা আছি মহাযন্ত্রণায়। কাকে ফেরাব? কার অনুরোধ রাখব? কার অনুযোগ শুনব?’
সমষ্টির উন্নয়ন চাইলে ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠতেই হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।
বলতে দ্বিধা নেই, ভালো অনুষ্ঠানের সংখ্যা অপ্রতুল, তার পরও সেগুলো হারিয়ে যাচ্ছে খারাপ অনুষ্ঠানের ভিড়ে। এর থেকে উত্তরণ ঘটানোর দায়িত্ব অবশ্যই টিভি চ্যানেলগুলোর। মানদণ্ড থাকতেই হবে। যোগ্য নতুন সব মানুষ আসছেন নতুন ভাবনা নিয়ে, নতুন স্বপ্ন নিয়ে, তাঁদের কাজগুলো অনেক ক্ষেত্রেই মূল্যায়ন করা হয় না। আমরা যারা পুরনো তারাই অগ্রাধিকার পাচ্ছি। নতুনদের জন্যও জায়গা তৈরি করতে হবে। করতে হবে তাদের সঠিক মূল্যায়ন।
নতুন বছরের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে এই লেখা পড়ে কেউ ভাববেন না যে চিত্রটা কেবলই হতাশার, তা নয়। চাই শুধু ভাবনার পরিবর্তন। চাই উদার দৃষ্টিভঙ্গি। শেষ কথা, দর্শকের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া যাবে না এবং কোনোভাবেই দায় এড়ানো যাবে না।
পুনশ্চঃ শুনতে পাচ্ছি নতুন দু-একটি টিভি চ্যানেল সম্পূর্ণভাবে বিনোদননির্ভর অনুষ্ঠান সম্প্রচার করবে। তাই যদি হয়, তাহলে সুদিন আসছে।

No comments

Powered by Blogger.