আওয়ামী লীগের কোন প্রকৃত বন্ধু নেই by সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল

১৯৭৭ সালে আমি এইচএসসির ছাত্র। সেই শিাথর্ী অবস্থায় দৈনিক ইত্তেফাকের জামালপুরস্থ নান্দিনার মফস্বল সংবাদদাতা হিসেবে সাংবাদিকতায় যাত্রা শুরু করি। সেই সময় এক বিপর্যয় নেমে আসে আমার ছাত্র জীবনে।
চলে আসি ঢাকায়। ঢাকায় আসার পর শুরু হয় লেখালেখি, সেই সূত্রে পত্রিকা পাড়ায় যাওয়া-আসা। তখন ল্য করি, দৈনিক কিষাণের সম্পাদক জয়নুল আবেদীন তার পত্রিকার সম্পাদকীয়র পৃষ্ঠায় ব্যানার ব্যবহার করতেন। তাতে ব্ল্যাক রিভার্সে হোয়াই লেখা থাকত, একজন সাংবাদিকের কোন প্রকৃত বন্ধু নেই। আজ ৩২ বছর পর কথাটি একটু ঘুরিয়ে বলতে চাই আওয়ামী লীগের প্রকৃত কোন বন্ধু নেই। যদিও বর্তমানে আওয়ামী লীগ তাদের ঐক্য জোট নিয়ে সরকার গঠন করেছে। শুধু এবারই নয়, ১৯৯৬ সালেও শেখ হাসিনা উদারতা দেখিয়ে জাসদের আসম রব, জাতীয় পার্টির আনোয়ার হোসেন মঞ্জুকে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে পূর্ণ মন্ত্রিত্বের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। অথচ এই আসম রব স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুকে নিয়েও কটূক্তি করতে দ্বিধাবোধ করেননি।
এবারের সরকারের অংশীদার হিসেবে রয়েছে জাতীয় পার্টি এবং বাম দলের বৃহৎ অংশ। হাসানুল হক ইনু, রাশেদ খান মেনন এখন পর্যন্ত মন্ত্রিত্ব না পেলেও সংসদ কমিটির চেয়ারপার্সন হয়েছেন। মন্ত্রী হচ্ছেন, হবেন বলে বেশ ক'বার উচ্চারিত হয়েছে। অবশ্য জাতীয় পার্টির জিএম কাদের এবং বাম দলের দিলীপ বড়ুয়া মন্ত্রিসভায় স্থান পেয়েছেন। অথচ আওয়ামী লীগের অনেক গুরুত্বপূর্ণ শীর্ষ নেতা বঞ্চিত হয়েছেন। আওয়ামী লীগ শক্তিশালী এত বড় একটি রাজনৈতিক দলের যেসব যোগ্য নেতাকে সাংসদ বানানো বা মন্ত্রিত্ব দেয়া কিংবা গুরুত্বপূর্ণ পদে সম্মান দেয়া কঠিন কাজ। এ বিষয়টি দলের নেতাকমর্ীদের ভাবতে হবে। কারণ ব্যক্তির চেয়ে দল আর দলের চেয়ে দেশ বড়। তাই দেশের স্বার্থে ব্যক্তি স্বার্থকে কিছুটা ছাড় দেয়া একান্ত প্রয়োজন। কারণ আওয়ামী লীগের কাছেই দেশের মানুষের প্রত্যাশা অনেক বেশি।
অথচ আমি মনে করি, আওয়ামী লীগের প্রকৃত কোন বন্ধু নেই। জাতীয় পার্টির হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের রাজনৈতিক চরিত্র এবং ব্যক্তিচরিত্র সম্পর্কে কমবেশি সকলেই অবগত। নির্বাচনের আগে তিনি নিজেকে যেভাবে বেচাকেনা করেছেন, তাও সবার জানা। আর ঐক্য জোটের বাম দলগুলোও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঐকমত্য থাকলেও অন্যান্য রাজনৈতিক মতবাদে মতানৈক্য রয়েছে, জল ও তৈলের মতো। তার মধ্যে জাতীয় পার্টির সঙ্গেও স্নায়ুযুদ্ধ রয়েছে। কিন্তু ছোটদল হিসেবে তাদের কিছুই করার নেই। রাজাকার ও স্বৈরাচার বিষয়ে তারা নীরব।
আওয়ামী লীগ উদারতার দৃষ্টিতে বা রাজনৈতিক কৌশলগত কারণে কখনও কখনও ধমর্ীয় বিষয়ে একটু ছাড় দিয়েছে। যেমন তথাকথিত ফতোয়া চুক্তি, মওলানা মান্নানের ইনকিলাবের সঙ্গে সখ্য, বিষয়গুলো ইনু-মেননদের নীতিবহির্ভূত। আবার যখন বামদল তেল-গ্যাস নিয়ে আন্দোলনে রাজপথে নামে তখনও ইনু-মেননরা কিংকর্তব্যবিমূঢ়। স্বাধীনতার পর তাদের দলের যে ভূমিকা ছিল, সে কথা বাদই দিচ্ছি।
সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি এখন 'একলা চলো নীতি'তে বিশ্বাসী এবং তারা একা একাই চলছে। বিগত নির্বাচনে প্রায় সকল বাম দল আওয়ামী লীগের ছত্রছায়ায় এলেও কমিউনিস্ট পার্টি খোলা আকাশের নিচে বৃষ্টিতে ভিজছে রৌদ্রে পড়ছে। অথচ তুলনামূলকভাবে আওয়ামী লীগ আর কমিউনিস্ট পার্টি রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে খুবই কাছাকাছি। এখন দু'দলের দূরত্ব দীর্ঘ।
এদিকে চির প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি সব সময় সরাসরি আওয়ামী লীগের মুখোমুখি। বিরোধী দলের নেত্রী খালেদা জিয়া তো ঘোষণাই দিয়েছেন এ সরকারকে আর সময় দেয়া যায় না। অথচ বিএনপি বর্তমান সরকারকে সময় দেয়নি বা মতা গ্রহণের রায় দেয়নি, দিয়েছে ভোট আর ব্যালট অর্থাৎ রাষ্ট্রের মালিক জনগণ। বিরোধী দল যেন সরকারের বিরোধিতার জন্য রাজনীতি করে এটাই তাদের মূল ল্য, যা খুবই দুঃখজনক। সরকারকে সহযোগিতা করাও বিরোধী দলের গণতান্ত্রিক নীতি তা সকল বিরোধী দলই ভুলে যায়।
বিএনপি ছাড়াও জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের সমমনা মৌলবাদী দলগুলোর সঙ্গেও আওয়ামী লীগের নানামুখী দূরত্ব। বিশেষ করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে আওয়ামী লীগ জামায়াত সরাসরি মুখোমুখি। এছাড়াও জামায়াতের পেছনে রয়েছে অসংখ্য জঙ্গীদল, যারা বহুবার শেখ হাসিনাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছে। এভাবে পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, আওয়ামী লীগের কোন প্রকৃত শুভাথর্ী সতীর্থ নেই। বড় দল হিসেবে নিজের দলের ভেতরও রয়েছে নানা ধরনের কোন্দল, ােভ এবং নীরবতা। এই অভ্যন্তরীন সমস্যা বাদ দিলেও রাষ্ট্রপরিচালনার েেত্র সরকারকে প্রচুর বড় ধরনের সঙ্কটের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। যেমন বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, বিডিআর বিদ্রোহের বিচার, ২১ আগস্টের বোমা হামলাসহ অন্যান্য বোমা হামলার বিচার, আন্তর্জাতিক চাপ, বিএনপি আমলের দুনর্ীতি অরাজকতার অবসান, বিগত তত্বাবধায়ক সরকারে বিতর্কিত কর্মকাণ্ড, দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতি, সন্ত্রাস-চাঁদাবাজি দমন, যানজট অবসান, নিজ দলের নেতাকমর্ীদের নিয়ন্ত্রণ প্রভৃতি সরকারের জন্য এক একটা বিশাল চ্যালেঞ্জ।
উলি্লখিত সমস্যা বা সঙ্কট শুধু আওয়ামী লীগের জন্য নয় সমস্যা জনগণের জন্যও। সমস্যাসমূহ যদি দূর করতে পারে আওয়ামী লীগ পাবে সুশাসনে কৃতিত্ব, সার্বিক মঙ্গল হবে দেশের এবং দেশের মানুষের।
তাই, আওয়ামী লীগকে নয় বা হাসিনা সরকারকে নয় দেশের বৃহত্তর সার্থে সকলকেই যার যার অবস্থান থেকে সহযোগিতা করা একান্ত প্রয়োজন। এ সরকার ব্যর্থ হলে তিগ্রস্ত হবে জনগণ।
প্রয়াত বুদ্ধিজীবী আহমদ ছফা প্রায়ই বলতেন, আওয়ামী লীগ জিতলে শুধু আওয়ামী লীগই বিজিত হয় আর আওয়ামী লীগ পরাজিত হলে, পুরো বাংলাদেশ হেরে যায়।
তাঁর এই বক্তব্যটি নেতিবাচক হলেও তাৎপর্যপূর্ণ, সেইভাবে লেখার শিরোনামটি অপ্রিয় সত্য হলেও গুরুত্বপূর্ণ বলে আমার বিশ্বাস।

্রটধতলফফটদঢলফটফআথবটধফ.ডমব
লেখক : কানাডা প্রবাসী কবি ও গবেষক এবং টরন্টো থেকে প্রকাশিত অধুনালুপ্ত সাপ্তাহিক বাংলা রিপোর্টারের প্রধান সম্পাদক।

No comments

Powered by Blogger.