জাবি ছাত্র জুবায়ের হত্যাকারীদের শাস্তি হয়নি এক বছরেও- খুনীরা ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়ায় by আহমেদ রিয়াদ, জাবি
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জুবায়ের হত্যার এক বছর পূর্ণ হয়েছে। কিন্তু দীর্ঘ এক বছরেও চিহ্নিত খুনীদের শাস্তি হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটের শাস্তির ওপর কোর্টের স্থগিতাদেশের ফলে ইতোপূর্বে হত্যাকারীরা পরীক্ষায় অংশ নেয়।
এদিকে প্রক্টর ড. সোহেল আহমেদ বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ওই স্থগিত আদেশের বিরুদ্ধে আপীল করলে স্থগিত আদেশ বাতিল হয় এবং সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত বলবৎ হয়। তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন সময় হত্যাকারীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থান করছে এমন অভিযোগের ভিত্তিতে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিয়েছে প্রশাসন। অন্যদিকে জুবায়েরের পরিবার অভিযোগ করেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রশাসন হত্যার সঙ্গে জড়িতদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিভিন্ন মেয়াদে বহিষ্কার করলেও হত্যার ইন্দনদাতারা প্রভাবশালী হওয়ায় পার পেয়ে যায়। আর যাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয় তারাও আইনের ফাঁক আর প্রশাসনের ঔদাসীন্যে পার পেয়ে যাচ্ছে। জুবায়েরের বড় ভাই আবদুল্লাহ আল মামুন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, শুনেছি হত্যাকারীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর আন্দোলনকারীরা আতঙ্কে রয়েছে। আদালত থেকে হত্যাকারীরা শুধু পরীক্ষা দেয়ার অনুমতি পেলেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ঔদাসীন্যে ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়ায়। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উচিত ছিল আদালতকে বিষয়টি অবহিত করা। বিশ্ববিদ্যালয়ের সচেতন শিক্ষকরাও ক্ষুব্ধ জুবায়ের হত্যার বিচার না হওয়ায়।নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জ্যেষ্ঠ শিক্ষক বলেন, ‘আমি আমার এই বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে দেখিনি, হত্যাকা-ের একটি ঘটনার বিচার হয়েছে।’ ‘আমি আমার ২৪-২৫ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, একটি হত্যাকা-েরও বিচার হয়নি। ঠিকমতো বিচার চাওয়াও হয়নি, বরং লাশের রাজনীতি হয়েছে। সব বিশ্ববিদ্যালয়ে একই ঘটনা ঘটেছে।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বশেষ ছাত্র হত্যার ঘটনা ঘটে ২০১২ সালের ৮ জানুয়ারি। ওদিন ছাত্রলীগের কিছু কর্মী পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর তাকে ডেকে নিয়ে পূর্বশত্রুতার জের ধরে পিটিয়ে আহত করে। পরদিন বেসরকারী একটি হাসপাতালে মৃত্যু হয় জুবায়েরের। হত্যার ঘটনায় বছর পেরিয়ে গেলেও ওই ঘটনার বিচার হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন দেয়ার পর সিন্ডিকেটের রায়ের শাস্তি আসামিদের রিট আপীলে স্থগিত হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র হত্যাকা-ের বিচার সম্পর্কে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান একে আজাদ চৌধুরী মনে করেন, ছাত্র হত্যাকাণ্ডগুলোর বিচার না হওয়ার অন্যতম কারণ ‘রাজনৈতিক’। এই প্রবণতা ছাত্র হত্যাকাণ্ডকে উৎসাহিত করে।
তিনি বলেন, স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের সাত ছাত্র হত্যা মামলায় আসামিদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু হত্যা এবং রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর তাঁরা মুক্তি পান এবং রাজনীতি শুরু করেন। এর পর থেকেই ছাত্র হত্যাকা-ের বিচার না হওয়ার প্রবণতা শুরু হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা জুবায়ের হত্যাকারীদের বিচার না হওয়ায় চরম ক্ষুব্ধ। ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর’ ব্যানারে সাধারণ শিক্ষার্থীরা মঙ্গলবার দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবেশ বিক্ষোভ ও উপাচার্য অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেনকে স্মারকলিপি দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারের পাদদেশে এক প্রতিবাদী সমাবেশে ক্ষোভের বহির্প্রকাশ ঘটিয়েছে শিক্ষার্থীরা। বক্তারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, জুবায়ের হত্যার পর শিক্ষার্থীদের নিয়মতান্ত্রিক এবং নৈতিক আন্দোলনের চাপে সেদিন বিচার হলেও আজ সেই সন্ত্রাসীরা ক্যাম্পাসেই ঘুরে বেড়ায়। মাত্র এক বছরের মধ্যেই কীভাবে যেন সব পরিবর্তন হয়ে গেল।
সেদিন যা ঘটেছিল ॥ ২০১২ সালের ৮ জানুয়ারি ইংরেজী বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী জুবায়ের আহমেদ স্নাতক সম্মান শেষ বর্ষের শেষ পরীক্ষাটি দিয়ে বের হলে তার কথিত বন্ধু ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের হাতে গুরুতরভাবে জখম হন। পরদিন রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে মারা যান জুবায়ের। তার এই নির্মম হত্যাকা- কোনভাবেই মেনে নিতে পারেনি ক্যাম্পাসের সচেতন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। তারা দোষীদের চূড়ান্ত শাস্তির দাবিতে নামে আন্দোলনে। আন্দোলনরত শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে দায়িত্বে অবহেলার কারণে তৎকালীন প্রশাসন পর্যায়ক্রমে পুরো প্রক্টরিয়াল বডিকে পরিবর্তন করে। অন্যদিকে আন্দোলনরত শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে বিশ্ববিদ্যালয় বাদী হয়ে থানায় একটি মামলা দায়ের করে এবং একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ১৩ শিক্ষার্থীকে দোষী সাব্যস্ত করে। এদের মধ্যে ৭ শিক্ষার্থীকে ক্যাম্পাসে অবাঞ্ছিতসহ আজীবনের জন্য বহিষ্কার এবং ৬ শিক্ষার্থীকে ২ বছরের জন্য অবাঞ্ছিতসহ বহিষ্কার করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
এদের মধ্যে ৮ জন গ্রেফতার হলেও বর্তমানে সবাই হাইকোর্ট থেকে জামিনের মাধ্যমে তাদের শিক্ষার স্বাভাবিক কার্যক্রম চালাতে শুরু করেছে। চিহ্নিত এই খুনীদের এখনও বিচার না হওয়ায় হতাশ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।
এদিকে জুবায়েরের খুনীদের চূড়ান্ত বিচারের দাবিতে আন্দোলনে নেমেছে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর’ ব্যানারে শিক্ষার্থীরা এবং শিক্ষক সমাজে’র ব্যানারে প্রগতিশীল ও সাধারণ শিক্ষকরা। বুধবার ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল ও ৬ দফা দাবিতে উপাচার্য বরাবর স্মারকলিপি পেশ করে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে খুন হয়, সাজা হয় না ॥ অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত ৪২ বছরে দেশের সরকারী ও স্বায়ত্তশাসিত এ প্রতিষ্ঠানটিতে রাজনৈতিক কোন্দলসহ নানা কারণে সংঘর্ষে প্রাণ হারিয়েছেন ছয়জনের মতো শিক্ষার্থী। ক্যাম্পাস ও হলে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা, টেন্ডারবাজি নিয়ন্ত্রণের মতো ঘটনায় এসব প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। এর একটি ঘটনারও বিচার হয়নি।
প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনার পরপরই বিশ্ববিদ্যালয় প্রথা মেনে তদন্ত কমিটি করেছিল। থানাতেও মামলা হয়। কিন্তু শেষপর্যন্ত রাজনৈতিক ডামাডোলে হারিয়ে গেছে এসব মামলা। তাই বিচারের অপেক্ষায় থাকা স্বজনদের আহাজারি কখনই শেষ হয় না।
No comments