সপ্তাহজুড়ে ঢাকা ও বাইরের মঞ্চ
রমনার পৌষ উৎসব-বিগত দিনের ধারাবাহিকতায় শুক্রবার থেকে শুরু হয়েছে এবারের পৌষ উৎসব। ভোরে রমনা বটমূলে মেলার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন উদযাপন পরিষদের সভাপতি কুদ্দুছ।
তার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আলোচনা করেন ঝুনা চৌধুরী, হাসান আরিফ প্রমুখ। তিন দিনব্যাপী আয়োজনের প্রথম দিনটি ছিল যথারীতি উৎসবমুখর। ছিল গান, নাচ, কবিতা ও যাত্রাপালা। সব মিলিয়ে চমৎকার আয়োজন। শুরু হয় গ্রামীণ ঐতিহ্যের চুলা জ্বালিয়ে। মিষ্টি এ আগুনে হাত-পা ছেকে নিতে ভুল করেনি অনেকে। শীতের সকালে প্রায় সব গ্রামেই এ দৃশ্য দেখা যায়। এরই মধ্যে সরব হয় অনুষ্ঠান মঞ্চ। ওস্তাদ মোমতাজ আলী খান সংগীত একাডেমির শিল্পীরা গান ধনের- পৌষে যাও পাহাড়ী/মাঠে নতুন তরকারি/শাক সবজির সবুজ রঙে মন ভরিয়ে যায়....শহরে মানুষদের গ্রামে ফেরায় আহ্বান জানান স্বভূমি লেখক। সুরে সুরে তারা বলেন, ফিরে চলো ফিরে চলো মাটির টানে....। একক পরিবেশনার মধ্য দিয়ে এ দিন পৌষ বন্দনা করেন শিল্পী মিনা বড়–য়া, খায়রুল আনাম শাকিল, সুতপা রায়, খগেন্দ্রনাথ সরকার প্রমুখ। রবীন্দ্রনাথ থেকে আবৃত্তি করেন ডালিয়া আহাম্মেদ। পৌষ ফাগুনের পালা পরিবেশন করেন মুক্তধারা আবৃত্তি চর্চা কেন্দ্র। প্রথম পর্বের অনুষ্ঠানে তামান্না রহমানের পরিচালনায় নৃত্য পরিবেশন করে নৃত্যনের শিল্পীরা। এই পরিবেশনা দারুণ উপভোগ করেন দর্শক।শিল্পকলায় বারামখানা ত্রপার হাতে লালনের একতারা-গত রবিবার বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর মূল হলে মঞ্চায়িত হয় থিয়েটার বেইলী রোডের প্রযোজনা, পান্থ শাহরিয়ারের রচনা ও অভিনেত্রী ত্রপা মজুমদারের নির্দেশনায় পরিবেশিত হয় নাটক ‘বারামখানা’। এর বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেন ত্রপা মজুমদার, রামেন্দু মজুমদার, ফেরদৌসী মজুমদার, মারুফ কবির, তামান্না ইসলাম, শাওন প্রমুখ। বারামখানা নাটকের মূল কাহিনী বাউল সম্রাট ফকির লালন সাঁইকে নিয়ে। কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়া লালনের আখড়াবাড়ি। কোন দাওয়াত নেই, পত্র নেই, তবু দূরদূরান্ত থেকে প্রাণের টানে হাজার হাজার লালন ভক্ত ছুটে আসে লালন আখড়ায়। লালনের জন্ম, মৃত্যু, জাতপাত নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। তবে এই নিয়ে মাথাব্যথা নেই বাউলদের। তারা সাঁইজির গ্রামে আসেন সাধু-সংঘে অংশ নেন ভালবাসার টানে। অনুষ্ঠান শেষে আবার চলে যান নিজ ঠিকানায়। ফকির লালন সাঁইর জন্ম হিন্দু কায়স্থ পরিবারে। তার পিতা মাধব কর, মা পদ্মাবতী। যৌবনে তিনি তীর্থ ভ্রমণে বের হয়ে বসন্ত রোগে আক্রান্ত হন এবং ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন। তার সঙ্গীরা তাকে মৃত ভেবে নদীতে ফেলে দেয়। তিনি ভাসতে ভাসতে গড়াই নদীর অববাহিকায় কালীগঙ্গায় আসেন। এরপর স্থানীয় কারিগর সম্প্রদায়ের এক বুজুর্গ ব্যক্তি তাকে উদ্ধার করেন। মুসলমানদের বাড়িতে অন্নগ্রহণ করায় তিনি নিজ বাড়িতে ফিরলেও তাকে মেনে নেয়নি তার পরিবার ও হিন্দু সমাজ। ফিরে এসে ছেঁউড়িয়ার কারিগর সম্প্রদায়ের সহযোগিতায় তিনি এখানে আখড়াবাড়ি স্থাপন করেন। ফকীর লালন শাহের অনুসারীরা মুলত সহজিয়া। তাঁরা যা পেতে চান তাও সহজ আনন্দ। তাদের সাধন প্রণালী বক্র নয়। সহজ দেহ। তারা মনে করেন আত্মার মাঝে পরমাত্মার স্থিতি। যেহেতু আত্মার স্বরূপ বিশ্লেষণ সম্ভব নয়, তাই দেহযন্ত্র বিশ্লেষণ করে পরমাত্মার সন্ধান লাভ করা হয়। অহিংস লালন ভক্তদের পরমনীতি। অর্থাৎ লালনের সমগ্র জীবনকাহিনী তুলে ধরা হয়েছে বারামখানা নাটকে। লালন সাঁইয়ের একতারা ত্রপার হাতে। তার অভিনয় দক্ষতা দর্শক প্রাণভরে উপভোগ করেন গত রবিবার বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর জাতীয় নাট্যশালার মূল হলে।
সরিষাবাড়ির কেন্দুয়ায় ভিন্ন রকম যাত্রাপালা মঞ্চস্থ-গত সোমবার জামালপুর সরিষাবাড়ি কেন্দুয়ায় আয়োজন করে সপ্তাহব্যাপী পৌষ উৎসব। এ উৎসবের আয়োজক তোফা ম-ল ও সরিষাবাড়ি কলেজের সাবেক জিএস রনি। এরা জানান, এ উৎসবের মুল আকর্ষণ সপ্তাহব্যাপী মৌলিক যাত্রাপালা মঞ্চায়ন। উৎসবের চতুর্থ দিন মঞ্চায়িত হয় যাত্রাপালা ঈশা খাঁ। ঐতিহাসিক এ পালাটি রচনা করেছেন ভৈরব নাথ গঙ্গোপাধ্যায় এবং নির্দেশনা দিয়েছেন মিলন কান্দি দে। ঈশা খাঁর জীবননাট্যে দেখা যায় তার পিতা ছিলেন হিন্দু, কালীদাস গজদানী। পাঠান রাজদরবারে চাকরি করতেন। হিন্দু মৌলবাদীরা তার বিরুদ্ধে কুৎসা ছড়াল। অপপ্রচার করল এই বলে যে, কালীদাস মুসলিম পাঠানের সঙ্গে একপাত্রে আহার করেছেন। তার জাত গেছে। কোন হিন্দু পিতা যেন তাদের মেয়েকে কালীদাসের সঙ্গে বিবাহ না দেয়। সনাতন ধর্মের গোঁড়ামি ও কুসংস্কার কালীদাসকে বিদ্রোহী করে তোলে। জীবনযুদ্ধের টানাপোড়েনে এক সময় তাঁকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে হয়। নাম হয় সোলেমান খাঁ। এক পাঠানের মেয়েকে তিনি বিয়ে করেছিলেন। তাদের পুত্র ঈশা খাঁ। বহু ঘাত-প্রতিঘাত ও দুঃখ কষ্টের পর ঈশা খাঁ বসতি স্থাপন করেন নারায়ণগঞ্জের অদূরে খিজিরপুরে। কর্ম নৈপুণ্যে তিনি এক বিশাল ভূখ-ের অধিকারী হন। বাংলার বার ভুঁইয়াদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম প্রধান শক্তিশালী পুরুষ। ঈশা খাঁ যখন নিজেকে খিজিরপুরের স্বাধীন নবাব বলে ঘোষণা করলেন, সেই সময় দিল্লীর মোগল সম্রাট আকবর রাজস্ব আদায়ের জন্য বাংলায় সুবেদার করে পাঠান সেনাপতি শাহবাজ খাঁকে। শাহবাজ খাঁ বাংলার গ্রামগঞ্জে অত্যাচারের বন্যা বইয়ে দেয়। তা-ব চালায় নিরীহ মানুষের ঘরে ঘরে। ঈশা খাঁ সাম্রাজ্যবাদী চক্রের মোকাবেলায় গড়ে তোলেন দেশ রক্ষার এক বিশাল বাহিনী। শত্রু সংহারে উদ্যত তলোয়ার হাতে ছুটে যায় সোনারগাঁয়ের হাজার হাজার মানুষ। ভবানী সর্দার, গিয়াস যাদব, মহুয়া এমনকি বহু সংগ্রামী চরিত্র ঝলসে উঠে মোঘল বাহিনীর মোকাবেলায়। দুর্ধর্ষ শাহবাজ খাঁ নিহত হন বাংলার মাটিতে। এরপর সম্রাট আকবরের প্রধান সেনাপতি মানসিংহ আসেন বাংলা অভিযানে। তুমুল যুদ্ধ হয় দুই পক্ষের। সোনারগাঁ, জঙ্গলবাড়ি ও একডালা দুর্গ রক্ষা করতে মরিয়া হয়ে ওঠে বাংলার আমজনতা। অবশেষে ক্লান্ত-শ্রান্ত মানসিংহ দ্বন্দ্ব যুদ্ধে আহ্বান জানালেন ঈশা খাঁকে। মুহূর্তে আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে ঐতিহাসিক সেই ঘটনাটি। ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে রণস্থলে যুদ্ধসাজে সজ্জিত দুই সমরনায়ক বাংলার ঈশা খাঁ এবং দিল্লীর মানসিংহ। শুরু হয়ে গেল যুদ্ধ। বাংলার আকাশ-বাতাস ফুলে ফেটে উঠল। হঠাৎ তলোয়ার পড়ে গেল মানসিংহের হাত থেকে। এভাবেই এগিয়ে চলল এ যাত্রাপালা। একটু ভিন্নতা লক্ষ করা গেল, তাহলো দর্শক গ্যালারিতে দেখা যায় পুরুষ দর্শকের চাইতে মহিলা দর্শকই বেশি। আয়োজক কমিটি জানায় এখানে মঞ্চায়িত হবে এ রকম ৭টি মৌলিক যাত্রাপালা। যা সকল বয়সের দর্শক-শ্রোতা প্রাণভরে উপভোগ করবে।
No comments