অশুদ্ধ ভাষায় বের হচ্ছে গল্প কবিতা উপন্যাস শিশুতোষ বই
কেবল বেতার, টেলিভিশন আর সাইনবোর্ডেই বাংলা সঙ্কটাপন্ন নয়। পুরো বাংলা সাহিত্য, গল্প, কবিতায় চলছে দুর্দিন। বাংলা সাহিত্যে অবদান রাখার মতো লেখক, সাহিত্যিক তথা সৃজনশীল সাহিত্যকমের্র ক্ষেত্রে বিরাজ করছে শূন্যতা।
দেশের প্রবীণ ভাষাসৈনিক ও ভাষা বিজ্ঞানীরা পরিস্থিতিকে অভিহিত করেছেন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের 'দুঃসময়' হিসেবে। তাঁদের অভিমত, আমাদের কবিতা, গল্প, উপন্যাসে আশঙ্কাজনকভাবে ব্যবহার হচ্ছে প্রশ্নবিদ্ধ বাংলা। প্রকাশকরাও গুণের কথা বাদ দিয়ে ব্যবসায়িক মনোভাব নিয়ে কাজ করছেন। বের হচ্ছেন অসংখ্য লেখক, কবি, সাহিত্যিক। কিন্তু আমাদের শ্রদ্ধেয় কয়েক ব্যক্তি ছাড়া অধিকাংশের ভাষা প্রয়োগ অত্যন্ত প্রশ্নবিদ্ধ, নিম্নমানের এবং অশুদ্ধ।বাংলা সাহিত্য কবিতা নিয়ে বিশিষ্টজনের এই ৰোভ আর অভিযোগের বিষয়ে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, বাংলা ভাষার বিকৃত ব্যবহারের চিত্র। ৰোভ আছে পাঠকদের মাঝে। অভিযোগ, বাংলা ভাষার অনেক প্রথিতযশা লেখক, সাহিত্যিক আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করেছেন। কিন্তু এখন রীতিমতো খিচুড়ি ভাষা ব্যবহার হচ্ছে, এটি না বাংলা, না ইংরেজী, না আঞ্চলিক। ব্যঙ্গ করে যাকে বলা হয় 'বাংলিশ।' বাংলা ভাষার একটি পরিশীলিত, সর্বজনগ্রাহ্য, কথ্যরূপ রয়েছে। বিভিন্ন অঞ্চলের যে আঞ্চলিক ভাষা তারও রয়েছে নিজস্ব সৌন্দর্য। আঞ্চলিক ভাষায় অনেক সার্থক নাটক সৃষ্টি করা হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে আঞ্চলিকতার নাম দিয়ে বাংলা ভাষার পরিশীলিত কথ্যরূপকে বিকৃত করার যে প্রবণতা কিছু কিছু েেত্র দৃষ্টিগোচর হচ্ছে, তা অত্যনত্ম আপত্তিকর। আবার দেখা যায়, বাংলা ভাষার কিছু কিছু শব্দের পরিবর্তে জোর করে ইংরেজী শব্দ ব্যবহার করা হচ্ছে। যেমন আঙ্কেল বা আন্টি বলা হচ্ছে চাচা, মামা, চাচি, মামি ও খালার পরিবর্তে। বাংলায় চাচা, চাচি, মামা, মামির মতো সম্পর্ককে বোঝানোর জন্য ভিন্ন ভিন্ন শব্দ রয়েছে। এই শব্দগুলোর পরিবর্তে আঙ্কেল বা আন্টি ব্যবহার করা হচ্ছে অহরহ। ভাষার স্বাভাবিক প্রবাহে চেয়ার, টেবিলের মতো কিছু ইংরেজী শব্দ বাংলা ভাষায় গৃহীত হয়েছে। এতে কোন সমস্যা হয়নি মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু যে বাংলা শব্দগুলো বাংলা ভাষায় দীর্ঘদিন ধরে আপন মহিমায় প্রতিষ্ঠিত তাকে স্থানচু্যত করা মানা যায় না।
এবার আসা যাক এবারের একুশে বইমেলায় আসা বইয়ের অবস্থার দিকে। অধিকাংশ শিশুতোষ বই এমনকি কবিতা, গল্প, উপন্যাসের পাতায় পাতায় বিকৃতি আর ভুল উদ্ধৃতিতে ভরা। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছবির নিচে 'রবীন্দ্রনাথকে' ভেঙ্গে করা হয়েছে 'রবীন্দ্র নাথ।' শিশুদের অধিকাংশ বইয়েই আমাদের জাতীয় সঙ্গীত ব্যবহার করা হয়েছে ভুল উদ্ধৃত করে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্যবহার করা 'ভালোবাসি'কে লেখা হয়েছে 'ভালবাসি' করে। 'আমি কী দেখেছি'র স্থলে কী শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে 'কি' দিয়ে। শিশুদের পাঠ্যবইয়ে সর্বত্রই 'কি' এবং 'কী'র ব্যবহার করা হয়েছে ভুলভাবে। আর সাধু এবং চলিত ভাষার গুরম্নচ-ালী দোষে দুষ্ট এই বইগুলো। মেলার বাইরে বিক্রি হওয়া বাংলাবাজারের দিগনত্ম প্রকাশনী থেকে নার্সারি, কেজির শিশুদের জন্য প্রকাশিত 'দিগনত্ম বাংলা পড়া' ও 'শুনতে শুনতে ছড়া বলা'র মধ্যে আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরম্নল ইসলামের 'ভোর হল' ছড়াটিই ছাপা হয়েছে ভুল বানানে। 'জুই' বানানটি কবি এভাবে লিখলেও এখানে ছাপা হয়েছে 'যুই' এভাবে। আর বিখ্যাত সেই ছড়া ' 'খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো'র 'খোকা'র স্থলে করা হয়েছে 'খোকন।' বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম লেখা হয়েছে 'মুজিবর রহমান।' বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, অসংখ্য বই পাঠকরা পেলেও অধিকাংশের মাধ্যমে বাংলা ভাষার কেবল ৰতিই হচ্ছে। ভাষাসৈনিক অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম বলেন, বিভিন্নভাবে ভাষা বিকৃতি যে পর্যায়ে গেছে, তাতে এর বিরম্নদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলা জরম্নরী। কারণ আমাদের ভাষা, সাহিত্য সঙ্কটের মুখে। তিনি বলেন, এখনও আমাদের ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি যত্নবান এবং শ্রদ্ধাশীল হওয়ার সময় আছে। ভাষার প্রতি অবজ্ঞা এবং অবহেলার এই ধারা চলতে থাকলে আমাদের ভাষার ভবিষ্যত অন্ধকার। বাংলা সাহিত্য, কবিতা উপন্যাসে অশুদ্ধ ও বিকৃত ভাষা প্রয়োগে ুব্ধ বাংলা একাডেমীর সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, আমাদের কবিতা, গল্প, উপন্যাসে আশঙ্কাজনকভাবে ব্যবহার হচ্ছে প্রশ্নবিদ্ধ বাংলা। প্রকাশকরাও গুণের কথা বাদ দিয়ে ব্যবসায়ী মনোভাব নিয়ে কাজ করছেন। প্রতিবছর বের হচ্ছে অসংখ্য লেখক, কবি, সাহিত্যিক। কিন্তু আমাদের নমস্য ব্যক্তিদের ছাড়া অধিকাংশের ভাষা প্রয়োগ অত্যনত্ম প্রশ্নবিদ্ধ,নিম্নমানের এবং অশুদ্ধ। পরিস্থিতিকে সঙ্কটজনক অভিহিত করে সঙ্কটের কবল থেকে বাংলা ভাষা রৰায় বাংলা একাডেমীকে উদ্যোগী হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, বাংলা একাডেমীর দায়িত্ব অনেক। বইমেলায় যে বই আসে তা মানসম্মত কিনা বাংলা একাডেমীকে তা দেখার দায়িত্ব নিতে হবে।
No comments