ছাত্ররাজনীতি প্রসঙ্গে by শেখ সালাহউদ্দিন আহমেদ
আমরা যদি বাংলাদেশের ইতিহাসের দিকে তাকাই তাহলে দেখব ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনে ছাত্রদের ভূমিকা ছিল সবচেয়ে উজ্জ্বল। আইয়ুববিরোধী শিক্ষা আন্দোলন এবং ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানেও ছাত্রদের ভূমিকাই ছিল।
১৯৭১-এর স্বাধীনতাযুদ্ধের নেতৃত্বেই ছিল ছাত্ররা, এমনকি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পতাকাও উড়িয়েছিলেন ছাত্রনেতারাই। ডাকসু ও মধুর ক্যান্টিনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদের যে রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ভিত্তি, তাই ছিল জাতীয় মুক্তি-আন্দোলনের হাতিয়ার।
এক সময় যেকোনো সরকারি পরিবর্তনের আলোচনা-সমালোচনা শুরুই হতো ছাত্রসংগঠনগুলো থেকে, এমনকি সরকারি সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে গণসচেতনতাও তৈরি করত ছাত্ররাই। ছাত্ররাজনীতি ও ছাত্র আন্দোলনের এরূপ অনেক অবদান ও কার্যক্রমের কথাই উল্লেখ করা যাবে, যা জাতির স্বপ্নের জাল বুনতে শক্তি ও অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল।
আজকের ছাত্ররাজনীতিতে মেধাবীরা সুযোগ পাচ্ছে না, এগিয়ে আসছে অছাত্র-অস্ত্রধারীরা। ছাত্ররাজনীতি ক্রমেই পরিণত হচ্ছে এক অসৎ ব্যবসায়। আমাদের যাঁরা নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাঁরাই এ অস্ত্রধারীদের পোষেণ। তাঁরা এই চাঁদাবাজ-ঠিকাদারদের আশ্রয় দেন, মদদ দেন। আগামী দিনের বাংলাদেশে কারা তবে নেতৃত্ব দেবে? অথচ এই বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতি থেকে বেরিয়ে এসেছেন কত না মেধাবী নেতা!
আমাদের সেই পথ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ভবিষ্যতে তাই এক নেতৃত্বহীন বাংলাদেশের আশঙ্কা দেখছি আমরা। এখনই সচেতন হতে হবে। এখনই নিতে হবে উপযুক্ত পদক্ষেপ। প্রকৃত ছাত্রদের হাতে ফিরিয়ে দিন ছাত্ররাজনীতি। নির্বাচন হোক দলে ও ক্যাম্পাসে। মেধাবীরা এগিয়ে এসে হাল ধরুক প্রতিটি সংগঠনের। দূর হোক টেন্ডার বাঙ্ আর হল দখলের অস্ত্রবাজ গুণ্ডারা। আমাদের রাজনীতিবিদদেরই এ উদ্যোগ নিতে হবে। তা না হলে ইতিহাসের নির্মম বিচার থেকে কেউ রক্ষা পাবে না।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হচ্ছে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ। দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও শিক্ষাগত উন্নয়নে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবদান অনস্বীকার্য। রাজনৈতিক বিশ্লেষণে তা আরো মহিমান্বিত হয়ে ওঠে। জাতির যেকোনো ক্রান্তিলগ্নে, জাতির বিবেকের প্রশ্নে সব সময়ই ঝাঁপিয়ে পড়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা। ১৯৯০ সালে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু এবং সর্বশেষ প্রমাণ ২০০৭ সালের আগস্টের ছাত্রবিক্ষোভ। কিন্তু সময়ের আবর্তে ছাত্ররাজনীতিও কি তার খোলস পরিবর্তন করেছে?
আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষকরা যখন রাজনীতিতে জড়িত হন, ছাত্র কর্তৃক আহূত ধর্মঘটে যোগদান করে ক্লাস বর্জন করেন, তখন আমরা এখান থেকে শেখার মতো অনেক কিছুই খুঁজে পাই। এ ছাত্রনেতাদের রাজনীতিতে আসার মূল কারণ যেন না হয় অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন, যা অন্য কোনো পেশায় এত দ্রুত করা সম্ভব নয়। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিসহ নানা অপকর্মে জড়িত থাকা অবাঞ্ছনীয়। এ জন্য রাজনৈতিক নেতারা দায়ী। ছাত্রনেতাদের অপকর্ম দলীয় ভাবমূর্তির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেললেও দলের নেতৃস্থানীয়দেরও অনেক সময় বিচলিত হতে দেখা যায় না।
একের পর এক অশান্ত হয়ে উঠছে দেশের শিক্ষাঙ্গন, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ক্রমাগত অস্থিরতা সেখানকার শিক্ষার পরিবেশ বিঘি্নত করছে। চলমান ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, এগুলো বর্তমান সরকারের আমলে শিক্ষা ক্ষেত্রে অর্জিত সাফল্যগুলো ম্লান করে দেওয়ার মতো। সিলেটের প্রাচীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমসি কলেজে ছাত্রাবাস পুড়িয়ে দিয়েছে ছাত্র নামধারী কিছু দুর্বৃত্ত। সেই ঘটনা বিবেককে কতটা নাড়া দিয়েছে তার প্রমাণ পাওয়া যায় ঘটনাস্থল পরিদর্শনকালে শিক্ষামন্ত্রীর কান্নায়।
বর্তমান ও অতীতের সব সরকারের আমলে নানা অজুহাতে বিভিন্ন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অস্ত্রধারীদের অস্ত্রবাজি প্রত্যক্ষ করা গেছে। এসব অস্ত্রধারীর কারণে সাধারণ ছাত্রছাত্রীর শিক্ষাজীবন হয়ে উঠেছে অনিশ্চিত ও শঙ্কাময়। শিক্ষাঙ্গন যেখান থেকে আলো ছড়িয়ে পড়বে সমাজে, দেশে; যে আলোয় আলোকিত হয়ে উঠবে সমাজ, মানুষ, সেই শিক্ষাঙ্গন আজ সন্ত্রাসের কালো থাবার নিচে। যেখানে চর্চা হবে জ্ঞানের, যেখানে কলম চলবে, কিন্তু সেখানে বর্তমানে প্রকৃত অর্থে ঘটছে তার উল্টো- কলমের পরিবর্তে ছাত্রদের কারো কারো হাতে অস্ত্র, জাতির সামনে এমন সংকেত উদ্বেগজনক। আশা করি, এ অবস্থার পরিবর্তন হবে। অস্ত্রধারীদের শিক্ষাঙ্গন থেকে বিতাড়িত করতে হবে। তাদের বিচারের সম্মুখীন করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখতে হবে।
এ মুহূর্তে দেশের প্রায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অস্থিরতা বিরাজ করছে, যা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি হুমকি হিসেবে গণ্য। এ পরিস্থিতিকে দ্রুত ইতিবাচক ধারায় নিয়ে আসতে হবে। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করে শিক্ষায়তনগুলোকে শিক্ষা ক্ষেত্র হিসেবেই চলতে দিতে হবে। এর জন্য শিক্ষকদের ভূমিকা যেমন আছে, তেমনি আছে রাজনীতিবিদদেরও। এক সময় শিক্ষাঙ্গনে ছাত্ররাজনীতির কুফল নিয়ে অনেক সমালোচনা হয়েছে। এখন সেখানে যোগ হয়েছে শিক্ষকরাজনীতি। প্রতিষ্ঠানকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা কোনোভাবেই উচিত হবে না।
লেখক : অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট ও সভাপতি,
সাউথ এশিয়ান ল ইয়ার্স ফোরাম
advssahmed@yahoo.com
এক সময় যেকোনো সরকারি পরিবর্তনের আলোচনা-সমালোচনা শুরুই হতো ছাত্রসংগঠনগুলো থেকে, এমনকি সরকারি সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে গণসচেতনতাও তৈরি করত ছাত্ররাই। ছাত্ররাজনীতি ও ছাত্র আন্দোলনের এরূপ অনেক অবদান ও কার্যক্রমের কথাই উল্লেখ করা যাবে, যা জাতির স্বপ্নের জাল বুনতে শক্তি ও অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল।
আজকের ছাত্ররাজনীতিতে মেধাবীরা সুযোগ পাচ্ছে না, এগিয়ে আসছে অছাত্র-অস্ত্রধারীরা। ছাত্ররাজনীতি ক্রমেই পরিণত হচ্ছে এক অসৎ ব্যবসায়। আমাদের যাঁরা নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাঁরাই এ অস্ত্রধারীদের পোষেণ। তাঁরা এই চাঁদাবাজ-ঠিকাদারদের আশ্রয় দেন, মদদ দেন। আগামী দিনের বাংলাদেশে কারা তবে নেতৃত্ব দেবে? অথচ এই বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতি থেকে বেরিয়ে এসেছেন কত না মেধাবী নেতা!
আমাদের সেই পথ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ভবিষ্যতে তাই এক নেতৃত্বহীন বাংলাদেশের আশঙ্কা দেখছি আমরা। এখনই সচেতন হতে হবে। এখনই নিতে হবে উপযুক্ত পদক্ষেপ। প্রকৃত ছাত্রদের হাতে ফিরিয়ে দিন ছাত্ররাজনীতি। নির্বাচন হোক দলে ও ক্যাম্পাসে। মেধাবীরা এগিয়ে এসে হাল ধরুক প্রতিটি সংগঠনের। দূর হোক টেন্ডার বাঙ্ আর হল দখলের অস্ত্রবাজ গুণ্ডারা। আমাদের রাজনীতিবিদদেরই এ উদ্যোগ নিতে হবে। তা না হলে ইতিহাসের নির্মম বিচার থেকে কেউ রক্ষা পাবে না।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হচ্ছে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ। দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও শিক্ষাগত উন্নয়নে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবদান অনস্বীকার্য। রাজনৈতিক বিশ্লেষণে তা আরো মহিমান্বিত হয়ে ওঠে। জাতির যেকোনো ক্রান্তিলগ্নে, জাতির বিবেকের প্রশ্নে সব সময়ই ঝাঁপিয়ে পড়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা। ১৯৯০ সালে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু এবং সর্বশেষ প্রমাণ ২০০৭ সালের আগস্টের ছাত্রবিক্ষোভ। কিন্তু সময়ের আবর্তে ছাত্ররাজনীতিও কি তার খোলস পরিবর্তন করেছে?
আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষকরা যখন রাজনীতিতে জড়িত হন, ছাত্র কর্তৃক আহূত ধর্মঘটে যোগদান করে ক্লাস বর্জন করেন, তখন আমরা এখান থেকে শেখার মতো অনেক কিছুই খুঁজে পাই। এ ছাত্রনেতাদের রাজনীতিতে আসার মূল কারণ যেন না হয় অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন, যা অন্য কোনো পেশায় এত দ্রুত করা সম্ভব নয়। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিসহ নানা অপকর্মে জড়িত থাকা অবাঞ্ছনীয়। এ জন্য রাজনৈতিক নেতারা দায়ী। ছাত্রনেতাদের অপকর্ম দলীয় ভাবমূর্তির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেললেও দলের নেতৃস্থানীয়দেরও অনেক সময় বিচলিত হতে দেখা যায় না।
একের পর এক অশান্ত হয়ে উঠছে দেশের শিক্ষাঙ্গন, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ক্রমাগত অস্থিরতা সেখানকার শিক্ষার পরিবেশ বিঘি্নত করছে। চলমান ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, এগুলো বর্তমান সরকারের আমলে শিক্ষা ক্ষেত্রে অর্জিত সাফল্যগুলো ম্লান করে দেওয়ার মতো। সিলেটের প্রাচীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমসি কলেজে ছাত্রাবাস পুড়িয়ে দিয়েছে ছাত্র নামধারী কিছু দুর্বৃত্ত। সেই ঘটনা বিবেককে কতটা নাড়া দিয়েছে তার প্রমাণ পাওয়া যায় ঘটনাস্থল পরিদর্শনকালে শিক্ষামন্ত্রীর কান্নায়।
বর্তমান ও অতীতের সব সরকারের আমলে নানা অজুহাতে বিভিন্ন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অস্ত্রধারীদের অস্ত্রবাজি প্রত্যক্ষ করা গেছে। এসব অস্ত্রধারীর কারণে সাধারণ ছাত্রছাত্রীর শিক্ষাজীবন হয়ে উঠেছে অনিশ্চিত ও শঙ্কাময়। শিক্ষাঙ্গন যেখান থেকে আলো ছড়িয়ে পড়বে সমাজে, দেশে; যে আলোয় আলোকিত হয়ে উঠবে সমাজ, মানুষ, সেই শিক্ষাঙ্গন আজ সন্ত্রাসের কালো থাবার নিচে। যেখানে চর্চা হবে জ্ঞানের, যেখানে কলম চলবে, কিন্তু সেখানে বর্তমানে প্রকৃত অর্থে ঘটছে তার উল্টো- কলমের পরিবর্তে ছাত্রদের কারো কারো হাতে অস্ত্র, জাতির সামনে এমন সংকেত উদ্বেগজনক। আশা করি, এ অবস্থার পরিবর্তন হবে। অস্ত্রধারীদের শিক্ষাঙ্গন থেকে বিতাড়িত করতে হবে। তাদের বিচারের সম্মুখীন করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখতে হবে।
এ মুহূর্তে দেশের প্রায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অস্থিরতা বিরাজ করছে, যা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি হুমকি হিসেবে গণ্য। এ পরিস্থিতিকে দ্রুত ইতিবাচক ধারায় নিয়ে আসতে হবে। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করে শিক্ষায়তনগুলোকে শিক্ষা ক্ষেত্র হিসেবেই চলতে দিতে হবে। এর জন্য শিক্ষকদের ভূমিকা যেমন আছে, তেমনি আছে রাজনীতিবিদদেরও। এক সময় শিক্ষাঙ্গনে ছাত্ররাজনীতির কুফল নিয়ে অনেক সমালোচনা হয়েছে। এখন সেখানে যোগ হয়েছে শিক্ষকরাজনীতি। প্রতিষ্ঠানকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা কোনোভাবেই উচিত হবে না।
লেখক : অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট ও সভাপতি,
সাউথ এশিয়ান ল ইয়ার্স ফোরাম
advssahmed@yahoo.com
No comments