যে ভালোবাসার জবাব নেই by আনিসুল হক

অনুষ্ঠানের আগের রাতে পর পর দুটো স্বপ্ন দেখলাম। একটা হলো, অনুষ্ঠান হচ্ছে পাহাড়ের ঢালে। ওপরে মঞ্চ। নিচে দর্শকেরা বসে আছেন। একটা নাচের দৃশ্যে পাহাড় থেকে ঝরনা নামবে। রিমোট কবির বকুলের হাতে। বকুল রিমোট চাপলেন। ঝরনার প্রবল তোড় সব দর্শককে ভাসিয়ে নিয়ে গেল।


এমনকি গাড়িবহর সব ভেসে যেতে লাগল বন্যার পানিতে। আরেকটায় দেখলাম, ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান অনুষ্ঠানস্থলের বাইরে ঘুরছেন। তাঁর পরনে গেরুয়া। আমি বললাম, সাকিব, যান, আপনার না অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার কথা। তিনি বললেন, আমি বৈরাগী হয়ে গেছি।
ঘুম ভাঙার পর দুবারই খুব শান্তি পেলাম। যাক, এটা স্বপ্ন। বাস্তবে এ রকম কিছু ঘটছে না।
মেরিল-প্রথম আলো অনুষ্ঠানটা খুব বড়। আমাদের নির্ভর করতে হয় বিচিত্র ধরনের মানুষ আর প্রযুক্তির ওপর, যাদের ওপর আমাদের সরাসরি নিয়ন্ত্রণ নেই। ধরা যাক, বিদ্যুতের লাইন চলে গেল! আমাদের কিছুই করার নেই। কোনো একজন শিল্পী অনুষ্ঠানের দিন অসুস্থ হয়ে পড়লেন। আপনি কী করবেন?
গত ২৫ এপ্রিল রাতে ঝড় হলো। আমাদের উদ্বোধনী গানের বিদেশি শিল্পীদের বহনকারী গাড়ির ওপর গাছ পড়ল। তাঁরা সামান্য আহতও হলেন। কিন্তু অনুষ্ঠানে তাঁরা এসেছেন। নিজ নিজ ভাষায় গান গেয়েছেন, ‘ওরা আমার মুখের কথা কাইড়া নিতে চায়’।
চঞ্চল চৌধুরী, তিশা, মোশাররফ করিম প্রথম আলোর নিকটজন। মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর নতুন ছবির তিন অভিনেতা। ওই ছবির পাণ্ডুলিপি প্রণয়নে আমার অংশগ্রহণ আছে। কাজেই মতি ভাই যখন বললেন, চঞ্চল, মোশাররফ তো সেবার ভালোই করেছিলেন। আমি জানতাম, এই তিনজনকে রাজি করানো আমাদের পক্ষে কঠিন হবে না। তাঁদের ধন্যবাদ। তাঁরা আমাদের যন্ত্রণা দিয়েছেন সবচেয়ে কম। এঁরা তিনজনই গান জানেন, অভিনয় জানেন, সম্ভবত নাচও জানেন। মাতিয়ে দিয়েছিলেন আমাদের অনুষ্ঠান।
স্কয়ার টয়লেট্রিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অঞ্জন চৌধুরী নিপাট ভদ্রলোক। তিনি অনুষ্ঠানে থাকতে পারেননি কিন্তু টেলিফোনে সর্বক্ষণ যোগাযোগ রেখেছিলেন সিঙ্গাপুর থেকে। তিনি কোনো দিনও জানতে চাননি কে পুরস্কার পাবেন, কে পাবেন না। এমনকি অনুষ্ঠানের ব্যাপারেও কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ কখনো করেননি। আমরা যা চেয়েছি, তা-ই তিনি দিয়ে গেছেন। আমাদের হেলিকপ্টার দরকার, তিনি ব্যবস্থা করে দিলেন। নৃত্যাঞ্চলের শিবলী মহম্মদ আর শামীম আরা নীপা প্রথম নৃত্য-আলেখ্য ভাষার গানটাকে নিয়েছিলেন চ্যালেঞ্জ হিসেবে। রিহার্সেল দেখে তো আমি মুগ্ধ। মিনু হক আপাকে বলেছিলাম, আমরা একটা নাচ চাই, যাতে মনে হবে, সবকিছু উড়ে যাচ্ছে। সত্যি, তাঁর দল দর্শকদের উড়িয়ে দিতে পেরেছে বলেই আমার বিশ্বাস। তানজিল আর তাঁর ইগলস ডান্স কোম্পানি চলচ্চিত্রের নৃত্যগুলোকে মন-প্রাণ ঢেলে দিয়ে সুন্দরতম করার চেষ্টা করেছেন, তাঁরা বলেছেন, প্রথম আলোর অনুষ্ঠানে তাঁরা সেরাটা দেখাতে চান। বিদেশি পার্লামেন্টের হইচইয়ের সঙ্গে প্যারোডি গানটা কবির বকুল লিখে দিয়েছেন, আর ডাকামাত্রই শহীদুল আলম সাচ্চুই বলুন, তুষার খানই বলুন, নামীদামি শিল্পীরা প্রথম আলো অফিসে এসে মহড়ায় অংশ নিয়েছেন।
বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের খেলোয়াড়দের আমি খুব বড় ভক্ত। আশরাফুল আর নাসির এসে মহড়ায় অংশ নিয়েছেন। মাশরাফি অনুষ্ঠানের দিন এসে বুঝে নিয়েছেন তাঁকে কী করতে হবে। তিনজনই মুখে লজ্জা ফুটিয়ে বারবার বলেছেন, না না, আমরা পারব না। আমি বলি, এই কথাটাই আপনারা মাইক্রোফোনে বলবেন। স্বর্ণা যখন মাশরাফিকে বললেন, তোমার চরণে আমি নিজেকে সঁপে দিলাম। মাশরাফি বললেন, আমার পায়ে অনেক ইনজুরি, গোটা মিলনায়তন তখন সহর্ষ করতালিতে মুখরিত হয়ে উঠেছিল।
কত জ্যেষ্ঠ শিল্পী, শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব এসেছিলেন। বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান থেকে শুরু করে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। রাজ্জাক-কবরী থেকে এ প্রজন্মের মোস্তফা সরয়ার ফারুকী-অমিতাভ রেজা। উপস্থিতির পাল্লা ছিল সত্যি বিচিত্র আর ভারী। আর কাজটা ছিল সত্যি কঠিন। কিন্তু সবার সহযোগিতায় আমরা উতরে গেছি বলে আমার বিশ্বাস। ইকবাল হোসাইন চৌধুরীর কাজ ছিল পাণ্ডুলিপি রচনা করা আর এলইডি পর্দায় যা দেখা যাবে, সব শুটিং করা, জোড়া লাগানো। পরিচালক রেদওয়ান রনি ছিলেন তাঁর সঙ্গে। কামরুজ্জামান বাবু তিনটা গান-নাচের তত্ত্বাবধান করছেন, কবির বকুল দুটোর। আমার হাতে ক্রিকেটারদের পর্ব। মেহেদি মাসুদ আর পল্লব মোহাইমেন এনে দেবেন পুরস্কারদাতাদের আর মনোনয়নপ্রাপ্তদের। তারও আগে বিচারকমণ্ডলীকে দিনের পর দিন ডেকে এনে ছবি আর নাটক দেখানোর কাজও তত্ত্বাবধান করেছেন পল্লব। সুমনা শারমীন মূল অনুষ্ঠানের পরিকল্পনার সভায় আসল বুদ্ধিগুলো জুগিয়েছেন। ক্রিকেটারদের আনার বুদ্ধি তাঁরই। অরূপ ঘোষ আর জাবেদ সুলতান প্রথম আলোর ইভেন্ট টিমের কর্তা, তাঁদের ঘুম তো কবে থেকেই হারাম। কবির বকুল আর মাছরাঙা টিভি বানিয়েছেন আজীবন পুরস্কারের তথ্যচিত্র আর মনোনয়নের ক্লিপিংস। রুম্মান রশীদ খান আমাদের রেড কার্পেটের বাঁধা উপস্থাপক, অনুরুদ্ধ হয়ে তাঁর সঙ্গে যোগ দিলেন মুনমুন। আর আমাদের প্রথম আলোর প্রদায়ক ও বন্ধুসভার কর্মীদের কোনো তুলনাই নেই। শফিক আল মামুন খেটেছেন প্রচণ্ড। কাকে রেখে কার কথা বলব। সব শিল্পী—যাঁদের কারও কারও নাম এই আনন্দে কোথাও না কোথাও ছাপা হচ্ছে, আর যাঁদের নাম ছাপা হচ্ছে না; সব কর্মী—যাঁদের নাম কোথাও ছাপা হবে না—কত জনের ছোট-বড় অংশগ্রহণের মাধ্যমে একটা অনুষ্ঠান সফল হয়। এটা সম্ভব হয়েছে টিমওয়ার্কের কারণে। এশিয়াটিক ইভেন্টসের দ্রাবিড়, সাউন্ডের শামীম, মঞ্চের মুকিম, কাকে রেখে কাকে ধন্যবাদ জানাব।
এককথায় বলি, সবাইকে ধন্যবাদ। এত আমন্ত্রণপত্র বিলি করা থেকে শুরু করে বেলা তিনটা থেকে রোদের মধ্যে লাইনে দাঁড়িয়ে যাঁরা এই অনুষ্ঠান দেখেছেন, না খেয়ে, না দেয়ে, বসতে জায়গা পেয়েছেন, কি পাননি, তাঁদের আমরা কী বলে কৃতজ্ঞতা জানাব। কী করে প্রতিদান দেব এই ভালোবাসার।
ভুল-ত্রুটি অনেক হয়েছে। আমরা ক্ষমাপ্রার্থী। কাজ করলেই ভুল হবে। নিশ্চয়ই আপনারা আমাদের ত্রুটিগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতেই দেখবেন।
আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ।

No comments

Powered by Blogger.