বিব্রত, বিভক্ত আদেশ, হইচই, মিছিল

এক বেঞ্চে কনিষ্ঠ বিচারপতির বিব্রতবোধ। ‘এখতিয়ার নেই’ বলে আরেক বেঞ্চের ফিরিয়ে দেওয়া। শেষে একজনের বিষয়ে অন্য বেঞ্চের বিভক্ত আদেশ। সেই সঙ্গে এজলাসকক্ষে হইচই, আদালত প্রাঙ্গণে মিছিল। আইনজীবী সমিতির সম্মেলনকক্ষে আলোচনা। গুলশানে গিয়ে খালেদা জিয়ার সঙ্গে জ্যেষ্ঠ আইনজীবীদের বৈঠক।


দলের শীর্ষস্থানীয় পর্যায়ের নেতাদের আগাম জামিনের আবেদন নিয়ে গতকাল বুধবার সারা দিন এই ছিল বিএনপির তত্পরতা আর হাইকোর্টের চিত্র।
গত ২৯ এপ্রিল হরতাল চলাকালে সচিবালয়ে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনায় শাহবাগ থানায় এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কাছে গাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় তেজগাঁও থানায় মামলা করে পুলিশ। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরীসহ কেন্দ্রীয় নেতাদের এসব মামলায় আসামি করা হয়। বিএনপির নেতা রিজভীকে এ মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়।
গতকাল সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বিচারপতি ছিদ্দিকুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি এ কে এম সাহিদুল হকের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের বেঞ্চে বিএনপির নেতাদের আগাম জামিনের আবেদন দাখিলের জন্য যান বিএনপির আইনজীবীরা। মওদুদ আহমদ আদালতকে বলেন, ‘বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের হয়রানি করতে দুটি মামলা করা হয়েছে। তাই আমরা জামিন চাইতে এসেছি।’ এ পর্যায়ে বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি বলেন, ‘অনেক মোশন (নতুন মামলা) জমা রয়েছে। রোববার দিন আবেদন দাখিল করেন।’ মওদুদ আহমদ বলেন, ‘বিষয়টি অত্যন্ত জরুরি। আজকে শুনানি করা দরকার।’
ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল জাহিদ সারওয়ার কাজল সাংবাদিকদের জানান, একপর্যায়ে বেঞ্চের কনিষ্ঠ বিচারপতি বিব্রতবোধ করেন। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বিএনপির নেতাদের জন্য পৃথক ছয়টি আবেদন দাখিলের অনুমতি চাওয়া হয়েছিল এই বেঞ্চে।
বেলা পৌনে ১১টার দিকে বিএনপির আইনজীবীরা একই বিষয় নিয়ে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও শেখ মো. জাকির হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের বেঞ্চে যান। আদালত বলেন, এই বেঞ্চের জামিন আবেদন গ্রহণের এখতিয়ার নেই। জবাবে মওদুদ আহমদ বলেন, ‘আমরা শুনেছি, আপনাদের জামিন শুনানির এখতিয়ার দেওয়া হয়েছে।’ আদালত বলেন, ‘আমরা এ বিষয়ে “অফিশিয়ালি” কিছু জানি না।’
ওখান থেকে ফিরে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্মেলনকক্ষে আলোচনায় বসেন বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা। এতে খন্দকার মাহবুব হোসেন, রফিকুল ইসলাম মিয়া, জমিরউদ্দিন সরকার, আবদুর রাজ্জাক, জয়নুল আবেদীন, এম বদরুদ্দোজা বাদল প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
দুপুর ১২টার দিকে এক ব্রিফিংয়ে আইনজীবী মওদুদ আহমদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা একটি ডিভিশন বেঞ্চে গিয়েছিলাম। সেই বেঞ্চের একজন বিচারপতি আমাদের আবেদন শুনতে বিব্রতবোধ করেছেন। আইনের শাসন অনুযায়ী একজন নাগরিকের আদালতে এসে জামিন চাওয়ার অধিকার রয়েছে। আমাদের সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।’ তিনি বলেন, পরবর্তী পদক্ষেপ আলোচনা করে জানানো হবে।
খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাত্: এরপর জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করার জন্য তাঁর গুলশানের বাসভবনে যান। দুপুরের ওই বৈঠকের বিষয়ে আইনজীবী জয়নুল আবেদীন প্রথম আলোকে বলেন, ‘হাইকোর্টের আগাম জামিন আবেদনসহ দলের নেতাদের বিরুদ্ধে করা মামলার বিষয় নিয়ে চেয়ারপারসনের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। আদালত আবার বসলে আমরা নেতাদের জামিনের বিষয় নিয়ে অগ্রসর হব।’
খোকনের জামিন নিয়ে বিভক্ত আদেশ: তেজগাঁও থানায় করা মামলায় গতকাল বেলা দুইটার দিকে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব মাহবুব উদ্দিন খোকনের জামিন আবেদন অপর একটি বেঞ্চে দাখিল করা হয়। বিচারপতি মোহাম্মদ আনোয়ার উল হক ও বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়ার সমন্বয়ে গঠিত এই বেঞ্চে আবেদনের ওপর শুনানি হয়। বিকেল তিনটায় শুনানিকালে আদালতে হাজির ছিলেন মাহবুব উদ্দিন। তাঁর পক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী রফিক-উল হক এবং রাষ্ট্রপক্ষে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এম কে রহমান শুনানি করেন। জামিনের প্রশ্নে বিভক্ত আদেশ দেন আদালত। জ্যেষ্ঠ বিচারপতি আগামী ৯ মে পর্যন্ত জামিন দিয়ে এ সময়ের মধ্যে নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন। অপর বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া জামিন আবেদন খারিজ করে দেন।
শুনানিতে এজাহারের অংশবিশেষ উল্লেখ করে রফিক-উল হক বলেন, এজাহারে অপরাধ সংঘটনের সময় উল্লেখ করা হয়েছে রাত সাড়ে নয়টা। আর হরতাল শেষ হয়েছে সন্ধ্যা ছয়টায়। এ ঘটনায় গাড়িচালকও মামলা করেননি। মামলার বাদী পুলিশ। তিনি বলেন, আবেদনকারী বারের সদস্য ও সংসদের সদস্য। এসব দিক বিবেচনায় আদালত জামিন দিতে পারেন।
রাষ্ট্রপক্ষে এম কে রহমান বলেন, মামলায় ৩৬ জনকে আসামি করা হয়েছে। যদি আবেদনকারীকে জামিন দেওয়া হয়, তাহলে অন্যরা এই সুযোগ নেবে। তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা বিঘ্নকারী দ্রুত বিচার আইনের ১০ (ক) ধারায় সাত কার্যদিবসের মধ্যে পুলিশ প্রতিবেদন দাখিলের কথা। ইতিমধ্যে চার দিন পার হয়ে গেছে। পরে আদালত আদেশ দেন।
আদেশের পর রফিক-উল হক আদালতকে বলেন, ‘প্রধান বিচারপতি তৃতীয় বেঞ্চ গঠন পর্যন্ত আবেদনকারীকে যেন গ্রেপ্তার বা হয়রানি না করা হয়, এ সংক্রান্ত নির্দেশনা চাচ্ছি।’ এ পর্যায়ে আদালত অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্য জানতে চান। তিনি এ বিষয়ে আশ্বস্ত করেন। বিষয়টি আদেশে উল্লেখের আরজি জানান আইনজীবীরা। আদালত লিখিত আদেশ দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে আইনজীবীরা হইচই শুরু করেন। এ সময় বিচারপতিরা এজলাস ত্যাগ করেন। এজলাস ত্যাগের পর হইচই আরও বেড়ে যায়। একপর্যায়ে আদালতকক্ষ থেকে বের হয়ে আইনজীবীরা স্লোগান দেন এবং পরে মিছিল করেন।
আইনজীবী রফিক-উল হক প্রথম আলোকে বলেন, জ্যেষ্ঠ বিচারপতি জামিন মঞ্জুর করেছেন আর কনিষ্ঠ বিচারপতি আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন। বিভক্ত আদেশের ফলে নিয়ম অনুযায়ী আবেদনটি প্রধান বিচারপতির কাছে যাবে। প্রধান বিচারপতি তৃতীয় বেঞ্চ গঠন করে দিলে সেখানে আবেদনটি নিষ্পত্তি হবে। এর আগ পর্যন্ত মাহবুব উদ্দিন খোকনকে হয়রানি বা গ্রেপ্তার করা হবে না বলে রাষ্ট্রপক্ষ আশ্বস্ত করেছে।
সন্ধ্যায় যোগাযোগ করা হলে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের সুপ্রিম কোর্ট ইউনিটের সভাপতি জয়নুল আবেদীন প্রথম আলোকে বলেন, বৃহস্পতিবার (আজ) সকালে জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা জামিনের বিষয় নিয়ে আলোচনায় বসবেন। আলোচনা করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে। কতজনের জামিনের আবেদন করা হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, দুটি মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিরা বাদে সবার জন্য জামিনের আবেদন করা হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.