কল্পকথার গল্প-মন সহজে কি সই হবা!' by আলী হাবিব

ইংরেজিতে যেটা 'চেঞ্জ'_বাংলায় সেটাই তো পরিবর্তন। আরো সহজ করে বললে, বদল। বদল মানে বদলে ফেলা। তো, এই বদল কত প্রকার ও কী কী? যৌথ পরিবার ভেঙে যাওয়ার এই সময়ে সুযোগ পেলেই হাঁড়ি বদল। মাস পহেলা বাড়ি বদল। দোকানে গিয়ে শাড়ি বদল। পয়সা হলে গাড়ি বদল। আড়ালে-আবডালে...! না, থাক।


ও এলাকায় প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত। তা বলে বদলের তো আর এখানেই শেষ নয়। আরো আছে। সে আমলে হাওয়া-বদল বলে একটা ব্যাপার ছিল। ভগ্নস্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের অনিবার্য উপায়। একালে, যুগের হাওয়ায় কেতা বদল। হাওয়া বুঝে নেতা বদল। অ্যাকুরিয়ামের জল বদলের মতো সকাল-বিকেল দলবদল। আরো আছে। বাজারদরে আশা বদল। মিঙ্ড কালচারে ভাষা বদল। যত বাড়ছে ইংরেজি বা হিন্দিপ্রীতি_ততই বদলে যাচ্ছে কথা বলার রীতি। বাট-কিন্তু-হোয়াট-কী, হরহামেশাই বলছি। খাওয়া বদলেও অনেকে করিৎকর্মা। আজ নন্দুজ, তো কাল শর্মা। কারো আবার ফ্রায়েড চিকেন বা পিৎজায় মন। মূল বিষয়টা হচ্ছে পরিবর্তন। বদলে ফেলতে হবে যাপিতজীবন। তাই, চলো বদলাই। বললেই হলো? সহজে কি নিজেকে বদলে ফেলা যায়?
এর পরও সব কিছু নাকি বদলে যাচ্ছে আজকাল। এমনকি বছরের শুরুতে যে কালবৈশাখী ঝড় হয়, সেই কালবৈশাখীর রকমও নাকি বদলে যাচ্ছে। নির্দিষ্ট সময়ের আগেই চলে আসছে কালবৈশাখী। চারদিকে যখন পরিবর্তনের আওয়াজ, তখন ঋতু পরিবর্তনের সূচক কালবৈশাখীই বা থেমে থাকবে কেন? বদলে গেছে। আগেও কালবৈশাখী আসছে। প্রতিবছরের মতো এ বছরও এসেছে, তবে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই।
সব কিছু কি আসলেই বদলে যায়? নাকি বদলে দিতে হয়? সময়ের প্রয়োজনেই পরিবর্তন করতে হয়। প্রয়োজন ছাড়া পরিবর্তন হয় না। বারাক ওবামার নির্বাচনের পর থেকে তো 'পরিবর্তন' একটি বিপ্লবী শব্দ। পরিবর্তন এখন সবারই চাওয়া। পরিবর্তন হোক_মন্দ থেকে ভালোর দিকে। পরিবর্তনের আগে বুঝতে হবে পরিবর্তনটা কী হতে হবে। কেমন করে পরিবর্তন হবে। কয়েকটা মানুষের পরিবর্তন যে পরিবর্তন নয়, সেটা আগে বুঝে নিতে হবে। বুঝে না চাইলে পরিবর্তন হয়তো হবে, কিন্তু সেটা কতটুকু কাজে দেবে তা নিয়ে সংশয় থেকে যায়। রাজা মাইডাসের গল্প দিয়েই শুরু করা যাক। গ্রিক পুরাণের রাজা মাইডাস। না বুঝে পরিবর্তন চাইতে গিয়ে নির্বুদ্ধিতার জন্য তাঁকে দিতে হয়েছিল চরম মূল্য। ফ্রাইজিয়া দেশের রাজা ছিলেন মাইডাস। চমৎকার গোলাপের জন্য বিখ্যাত ছিল দেশটি। রাজার প্রাসাদের কাছেও ছিল বড় গোলাপবাগান। সেই আমলে এক মদ্যপ বৃদ্ধ ছিল। তার নাম সাইলেনাস। মদের দেবতা বাক্কাসের অনুসারী বৃদ্ধ সাইলেনাস একদিন মদ পান করে রাজার বাগানে ঢুকে ঘুমিয়ে যায়। রাজার প্রহরীরা তাকে আবিষ্কার করে। মজা করার জন্য তাকে ফুল দিয়ে সাজিয়ে নিয়ে যায় রাজার দরবারে। রাজা মাইডাস রাজদরবারের নতুন এ অতিথিকে বেশ সমাদর করলেন। দিন দশেক রেখে দিলেন অতিথিশালায়। পান-ভোজনের কোনো অভাব নেই। ১০ দিন পর তাকে নিয়ে যাওয়া হলো দেবতা বাক্কাসের কাছে। অনুসারীকে অনেক আদর-আপ্যায়ন করা হয়েছে দেখে দেবতা বাক্কাস রাজা মাইডাসকে জিজ্ঞেস করলেন, 'বলো, তুমি কী বর চাও আমার কাছে। তুমি যা চাইবে তা-ই হবে।' রাজা এক মূহূর্ত চিন্তা না করে বললেন, 'আমি যা স্পর্শ করব তা-ই যেন সোনায় রূপান্তরিত হয়।' দেবতা বাক্কাস বললেন, 'তথাস্তু।'
এই নির্বোধ ও লোভী বাসনার ফল অচিরেই টের পেলেন রাজা। ভোজন টেবিলে খাবার খেতে বসে যেই না খাবারে হাত দেওয়া অমনি তা সোনা হয়ে গেল। একটি আপেল তুলে মুখে দেওয়ার আগেই সেটা সোনা হয়ে গেল। ক্ষুধার্ত ও বিড়ম্বিত রাজা ছুটলেন দেবতা বাক্কাসের কাছে। অনুরোধ করলেন তাঁর দেওয়া বর ফিরিয়ে নিতে। দেবতা জানালেন, পেক্টোলাস নদীর উৎসস্থলে গিয়ে স্নান করতে হবে। তাহলেই এই স্বর্ণঘটিত দোষ থেকে মুক্ত হওয়া যাবে। রাজা মাইডাস তা-ই করলেন। শাপমুক্ত হলেন। কিন্তু এখানেই থেমে থাকলে চলত। রাজা নিজের নির্বুদ্ধিতার জন্য এরপর পড়লেন দেবতা অ্যাপোলোর কোপানলে। কোনো একসময় অ্যাপোলো ও বন্য দেবতা প্যানের মধ্যে সংগীত প্রতিযোগিতা হয়েছিল। রাজা মাইডাসকে এ প্রতিযোগিতার একজন বিচারক নির্বাচন করা হয়। প্যান বাজিয়েছিলেন নলখাগড়ার বাঁশি। আর অ্যাপোলো বাজিয়েছিলেন বীণা। অন্য যাঁরা বিচারক ছিলেন তাঁরা সবাই অ্যাপোলোকে বিজয়ী ঘোষণা করলেন। কিন্তু মাইডাসের সংগীত সম্পর্কে তেমন কোনো জ্ঞান ছিল না। তিনি প্যানকে বিজয়ী ঘোষণা করে দিলেন। অ্যাপোলো রুষ্ট হয়ে রাজা মাইডাসের কানকে গাধার কানে রূপান্তরিত করে দিলেন এই বলে যে তাঁর সংগীত বিচার গর্দভসুলভই হয়েছে।
পরিবর্তন আবার কারো কারো জন্য বেশ সুদিন বয়ে আনে। যেমন বয়ে এনেছিল পরশুরামের গল্পের মীনেন্দ্র মাইতির জন্য। বন্ধুর কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে মীনেন্দ্র মাইতি উধাও। কিছুকাল পরে কলকাতার খবরের কাগজে ছাপা হতে লাগল বড় বড় বিজ্ঞাপন। গ্রিস থেকে এক বিখ্যাত জ্যোতিষী এসেছেন। তিনি ইজিপ্টে বহুদিন গবেষণা করে গুপ্তবিদ্যা আয়ত্ত করেছেন, কামরূপ-কামাখ্যায় তন্ত্রমন্ত্র শিখেছেন ইত্যাদি। তাঁর নাম ডক্টর মিনান্ডার মাইটি। অনেক বিশেষণ তাঁর। তিনি হস্তরেখাবিশারদ, ত্রিকালজ্ঞ জ্যোতিষী, রত্নবিধায়ক, ললাটলিপি পাঠক ইত্যাদি। দলে দলে লোক যেতে শুরু করল সেই জ্যোতিষীয় কাছে। ব্যবসা বেশ ফুলে ও ফেঁপে উঠতে শুরু করল। নাম ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। কাগজে একদিন তাঁর ছবিও ছাপা হলো। মাথায় মুকুটের মতো টুপি। দুই ইঞ্চি ঝোলা গোঁফ। ছয় ইঞ্চি লম্বা দাড়ি। গলায় রাশিচক্র মার্কা হার। বন্ধু চিনে ফেলল যে এ সেই মীনেন্দ্র মাইতি না হয়ে পারে না। আগে থেকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট না করে বন্ধুটি কোনো এক সন্ধ্যায় হাজির সেই মহাজ্যোতিষের দরবারে। অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর সেক্রেটারির দেখা মিলল। সেক্রেটারি একটি কাগজ এগিয়ে দিয়ে নাম-ঠিকানাসহ সমস্যার কথা লিখে দিতে বলতেই বন্ধুটি লিখে দিল। লিখল সহসাই কোনো অর্থ প্রাপ্তিযোগ আছে কি না সেটাই তাঁর জানার ইচ্ছা। কিছুক্ষণের মধ্যেই ভেতর থেকে পাওয়া গেল ভবিষ্যদ্বাণী। সহসা অর্থ প্রাপ্তিযোগের সম্ভাবনা নেই। বছরখানেক পর পাওয়া যাবে। বন্ধুটি বুঝলেন, ধার নেওয়া টাকা ফেরত পেতে তাঁর আরো একটি বছর লাগবে।
আমরা স্বপ্নের জাল বুনি। আমাদের ঘরের কোণে জাল বোনে মাকড়সা। এই মাকড়সা এল কেমন করে? গ্রিক পুরাণে খুঁজে পাওয়া যায় মজার এক গল্প। দেবতাদের মধ্যে বয়নকৌশলে পারদর্শিনী দেবী মিনার্ভা। ওদিকে আরাকনি নামের এক কৃষককন্যারও বস্ত্র বয়নে খ্যাতি ছিল। একদিন দুজনের মধ্যে প্রতিযোগিতা হলো। মিনার্ভা কিছুতেই কৃষককন্যা আরাকনিকে হারাতে পারেন না। ক্রুদ্ধ হয়ে একসময় আরাকনির বানানো বস্ত্র ছিঁড়ে ফেলে মাকু দিয়ে তার মাথায় আঘাত করেন। রাগে-অপমানে কৃষককন্যা আরাকনি গলায় সুতো পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করে। এবার করুণা হয় মিনার্ভার। এক জাদুকরী তরল পদার্থ আরাকনির গায়ে লাগিয়ে দেন। আরাকনি রূপান্তরিত হলো মাকড়সায়। অপরূপ বয়নকুশলতায় সে এখনো বুনে চলেছে তার জাল।
স্বপ্নের জাল বুনে চলেছি আমরাও। কিন্তু পরিবর্তন হচ্ছে না। পরিবর্তন আমাদের দেশে খুব প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। আমাদের ঘরে ও বাইরে পরিবর্তন দরকার। সহজে কি পরিবর্তন হবে আমাদের? ওই যে লালন সাঁই তাঁর গানে বলেছেন, আইল ডিঙিয়ে ঘাস খাওয়ার স্বভাব যাবে না সহজে। তাহলে তো আর পরিবর্তনটা সহজে হওয়ার নয়। দেশটার আমূল বদলাতে হলে সবার আগে বদলে ফেলতে হবে আমাদের মানসিকতা। কিন্তু তা কি আর সহজে হবে। আমাদের মন ও মানসিকতার পরিবর্তন কি এতই সহজ? আমরা কি সহজে মেনে নিতে পারি পরিবর্তন। লালনের গানেই তো রয়েছে সে প্রশ্ন, 'মন সহজে কি সই হবা!'
সহজে কি আমরা বদলে ফেলতে পারব আমাদের মানসিকতা?
লেখক : সাংবাদিক
habib.alihabib@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.