বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না
৩৭৮ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। শহীদ মোহাম্মদ উল্লাহ, বীর বিক্রম মুখোমুখি যুদ্ধে শহীদ হন তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরক্ষা অবস্থানে আকস্মিক আক্রমণ চালিয়েছে পাকিস্তানি সেনারা। সেখানে নিমেষে শুরু হয়ে গেল তুমুল যুদ্ধ। মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে।
এক স্থানে আছেন মোহাম্মদ উল্লাহসহ কয়েকজন। তাঁরা সাহসিকতার সঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমণ মোকাবিলা করতে থাকলেন। সমানতালে যুদ্ধ চলছে। চারদিকে বারুদের উৎকট গন্ধ। গোলাগুলিতে প্রকম্পিত।
একটু পর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমণের তীব্রতা প্রচণ্ডভাবে বেড়ে গেল। বিপুল শক্তি নিয়ে এসেছে তারা। মুহুর্মুহু শেল ও রকেট এসে পড়ছে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানে। ছুটে আসছে বৃষ্টির মতো গুলি। শত শত গুলি মুক্তিযোদ্ধাদের মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে। গুলিতে আহত হলেন কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা। তাঁদের আর্তনাদ ছড়িয়ে পড়ল সহযোদ্ধাদের মধ্যে।
আক্রমণের প্রচণ্ডতায় বেশির ভাগ মুক্তিযোদ্ধা বিশৃঙ্খল হয়ে পড়লেন। তাঁরা কেউ কেউ পিছু হটে যেতে থাকলেন। মোহাম্মদ উল্লাহ ও তাঁর কয়েকজন সহযোদ্ধা এতে বিচলিত হলেন না। সাহসিকতার সঙ্গে তাঁরা যুদ্ধ করতে থাকলেন। তাঁদের বীরত্বে থেমে গেল পাকিস্তানি সেনাদের অগ্রযাত্রা। তবে বেশিক্ষণ পারলেন না। গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন মোহাম্মদ উল্লাহসহ তিনজন মুক্তিযোদ্ধা। শহীদ হলেন তাঁরা।
এরপর ভেঙে পড়ল মুক্তিযোদ্ধাদের সব প্রতিরোধ। পাকিস্তান সেনাবাহিনী দখল করে নিল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরক্ষা অবস্থান। এ ঘটনা ১৯৭১ সালের নভেম্বরের শেষ দিকে। শেষ রাতে। মোহাম্মদপুরের পাশে গোয়ালহাটে। যশোর জেলার চৌগাছা উপজেলার অন্তর্গত মোহাম্মদপুর। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত। সেখানে ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরক্ষা অবস্থান। পাকিস্তান সেনাবাহিনী সেখানে হঠাৎ আক্রমণ করে। সেদিন ছিল ঈদের দিন।
চৌগাছা এলাকা ছিল মুক্তিবাহিনীর ৮ নম্বর সেক্টরের বয়রা সাব-সেক্টরের আওতাধীন এলাকা। এই এলাকায় যুদ্ধ করেন মুক্তিযোদ্ধা অলীক কুমার গুপ্ত বীর প্রতীক (পরে মেজর)। মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দলের (কোম্পানি) নেতৃত্বে ছিলেন তিনি। এই দলেই ছিলেন মোহাম্মদ উল্লাহ। অলীক কুমার গুপ্তের ১৯৭৩ সালে দেওয়া বয়ানে আছে এই যুদ্ধের সংক্ষিপ্ত বিবরণ।
তিনি বলেন, ‘...গুলবাগপুর গোয়ালহাট নামক স্থানে পাকিস্তানি সেনারা আমার দলের ওপর ঈদের দিন আক্রমণ করে তা দখল করে নেয়। এই যুদ্ধে নয়জন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। তিনজন মুক্তিযোদ্ধাসহ তিনজন সাধারণ মানুষও শহীদ হন। জনসাধারণ আহত মুক্তিযোদ্ধাদের নিরাপদ স্থানে নিয়ে যায়। জনসাধারণ সেই সময় এই এলাকায় কাজ করেন মুক্তিবাহিনীর জন্য। সেদিন কর্নেল মঞ্জুর (এম এ মঞ্জুর বীর উত্তম) ছয়-সাত ঘণ্টার মধ্যে ওই এলাকা পুনরুদ্ধার করার হুকুম দেন। পাল্টা আক্রমণকালে পাকিস্তানি বিমান আমাদের আক্রমণ করে। পরে ভারতীয় সেনাদের সাহায্যে ওই এলাকা আমরা পুনরায় দখল করি।’
মোহাম্মদ উল্লাহ চাকরি করতেন ইপিআরে। ১৯৭১ সালে সেপাই হিসেবে কর্মরত ছিলেন যশোর ইপিআর সেক্টরের অধীনে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে যুদ্ধ করেন বয়রা সাব-সেক্টরে। অনেক যুদ্ধে তিনি অংশ নেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য শহীদ মোহাম্মদ উল্লাহকে মরণোত্তর বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ১২১।
শহীদ মোহাম্মদ উল্লাহর আদি পৈতৃক নিবাস লক্ষ্মীপুর জেলায়। বর্তমান নিবাস যশোর জেলার সদর উপজেলার রামনগর ইউনিয়নের কামালপুর গ্রামে। তাঁর বাবার নাম খলিলুর রহমান পাটোয়ারী। মা আলিজান বানু। স্ত্রী জাহানারা বেগম। তাঁদের তিন ছেলে।
সূত্র: প্রথম আলোর যশোর প্রতিনিধি মনিরুল আলম এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র, দশম খণ্ড। ছবি: এহসান মিথুন।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com
একটু পর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমণের তীব্রতা প্রচণ্ডভাবে বেড়ে গেল। বিপুল শক্তি নিয়ে এসেছে তারা। মুহুর্মুহু শেল ও রকেট এসে পড়ছে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানে। ছুটে আসছে বৃষ্টির মতো গুলি। শত শত গুলি মুক্তিযোদ্ধাদের মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে। গুলিতে আহত হলেন কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা। তাঁদের আর্তনাদ ছড়িয়ে পড়ল সহযোদ্ধাদের মধ্যে।
আক্রমণের প্রচণ্ডতায় বেশির ভাগ মুক্তিযোদ্ধা বিশৃঙ্খল হয়ে পড়লেন। তাঁরা কেউ কেউ পিছু হটে যেতে থাকলেন। মোহাম্মদ উল্লাহ ও তাঁর কয়েকজন সহযোদ্ধা এতে বিচলিত হলেন না। সাহসিকতার সঙ্গে তাঁরা যুদ্ধ করতে থাকলেন। তাঁদের বীরত্বে থেমে গেল পাকিস্তানি সেনাদের অগ্রযাত্রা। তবে বেশিক্ষণ পারলেন না। গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন মোহাম্মদ উল্লাহসহ তিনজন মুক্তিযোদ্ধা। শহীদ হলেন তাঁরা।
এরপর ভেঙে পড়ল মুক্তিযোদ্ধাদের সব প্রতিরোধ। পাকিস্তান সেনাবাহিনী দখল করে নিল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরক্ষা অবস্থান। এ ঘটনা ১৯৭১ সালের নভেম্বরের শেষ দিকে। শেষ রাতে। মোহাম্মদপুরের পাশে গোয়ালহাটে। যশোর জেলার চৌগাছা উপজেলার অন্তর্গত মোহাম্মদপুর। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত। সেখানে ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরক্ষা অবস্থান। পাকিস্তান সেনাবাহিনী সেখানে হঠাৎ আক্রমণ করে। সেদিন ছিল ঈদের দিন।
চৌগাছা এলাকা ছিল মুক্তিবাহিনীর ৮ নম্বর সেক্টরের বয়রা সাব-সেক্টরের আওতাধীন এলাকা। এই এলাকায় যুদ্ধ করেন মুক্তিযোদ্ধা অলীক কুমার গুপ্ত বীর প্রতীক (পরে মেজর)। মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দলের (কোম্পানি) নেতৃত্বে ছিলেন তিনি। এই দলেই ছিলেন মোহাম্মদ উল্লাহ। অলীক কুমার গুপ্তের ১৯৭৩ সালে দেওয়া বয়ানে আছে এই যুদ্ধের সংক্ষিপ্ত বিবরণ।
তিনি বলেন, ‘...গুলবাগপুর গোয়ালহাট নামক স্থানে পাকিস্তানি সেনারা আমার দলের ওপর ঈদের দিন আক্রমণ করে তা দখল করে নেয়। এই যুদ্ধে নয়জন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। তিনজন মুক্তিযোদ্ধাসহ তিনজন সাধারণ মানুষও শহীদ হন। জনসাধারণ আহত মুক্তিযোদ্ধাদের নিরাপদ স্থানে নিয়ে যায়। জনসাধারণ সেই সময় এই এলাকায় কাজ করেন মুক্তিবাহিনীর জন্য। সেদিন কর্নেল মঞ্জুর (এম এ মঞ্জুর বীর উত্তম) ছয়-সাত ঘণ্টার মধ্যে ওই এলাকা পুনরুদ্ধার করার হুকুম দেন। পাল্টা আক্রমণকালে পাকিস্তানি বিমান আমাদের আক্রমণ করে। পরে ভারতীয় সেনাদের সাহায্যে ওই এলাকা আমরা পুনরায় দখল করি।’
মোহাম্মদ উল্লাহ চাকরি করতেন ইপিআরে। ১৯৭১ সালে সেপাই হিসেবে কর্মরত ছিলেন যশোর ইপিআর সেক্টরের অধীনে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে যুদ্ধ করেন বয়রা সাব-সেক্টরে। অনেক যুদ্ধে তিনি অংশ নেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য শহীদ মোহাম্মদ উল্লাহকে মরণোত্তর বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ১২১।
শহীদ মোহাম্মদ উল্লাহর আদি পৈতৃক নিবাস লক্ষ্মীপুর জেলায়। বর্তমান নিবাস যশোর জেলার সদর উপজেলার রামনগর ইউনিয়নের কামালপুর গ্রামে। তাঁর বাবার নাম খলিলুর রহমান পাটোয়ারী। মা আলিজান বানু। স্ত্রী জাহানারা বেগম। তাঁদের তিন ছেলে।
সূত্র: প্রথম আলোর যশোর প্রতিনিধি মনিরুল আলম এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র, দশম খণ্ড। ছবি: এহসান মিথুন।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com
No comments