অপরাধ সভার তথ্য-৭৬ শতাংশ মামলায় আসামি খালাস পায় by কামরুল হাসান
দেশে প্রতিদিন গড়ে ১১টি খুন, ৫৫টি নারী ও শিশু নির্যাতন, ৮৭টি মাদকের মামলা থানায় নথিভুক্ত হচ্ছে। তবে পুলিশ অভিযোগ প্রমাণ করতে না পারায় এ ধরনের ৭৬ শতাংশ মামলার ক্ষেত্রে আসামিরা খালাস পেয়ে যাচ্ছে। গতকাল সোমবার পুলিশ সদর দপ্তরে পুলিশের অপরাধবিষয়ক সভায় দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির এ চিত্র তুলে ধরা হয়।
সভায় অপরাধ কমিয়ে আনা এবং আসামিদের বিচারের মুখোমুখি করার বিষয়ে পুলিশ কর্মকর্তারা আলোচনা করেন। দুই দিনের সভা গতকাল শেষ হয়। তবে সভা শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আগের চেয়ে ভালো বলে উল্লেখ করা হয়।
জানতে চাইলে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) হাসান মাহমুদ খন্দকার প্রথম আলোকে বলেন, সার্বিক বিচারিক কাজ দ্রুত শেষ করা সম্ভব হলেই সাজার হার বাড়তে পারে। কিন্তু বিচারিক কার্যক্রম শেষ হতে অনেক সময় লাগে। এতে করে মামলা-সংশ্লিষ্ট সবাই একপর্যায়ে হতাশ হয়ে পড়ে। তাদের আগ্রহও কমে যায়। তবে বর্তমান অবস্থা আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় ভালো।
পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, এর আগে পুলিশ সপ্তাহের নিয়মিত কর্মসূচিতে অপরাধবিষয়ক সভা অন্তর্ভুক্ত ছিল। কিন্তু এ বছর এই সভা আলাদা করা হয়। গতকালের সভায় দেশের অপরাধ পরিস্থিতি নিয়ে মাঠ পর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তারা খোলামেলা কথা বলেন। আইজিপি হাসান মাহমুদ খন্দকারের সভাপতিত্বে সভায় সব অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (এডি. আইজি), উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি), সাত মহানগরের কমিশনার, গোয়েন্দা পুলিশসহ সব মহানগরের উপকমিশনার, ৬৪ জেলার পুলিশ সুপাররা উপস্থিত ছিলেন।
সভায় উপস্থিত কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, সিআইডির অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মোখলেসুর রহমান গত পাঁচ বছরের তুলনামূলক অপরাধচিত্র তুলে ধরেন। বলা হয়, ২০১১ সালে দেশের সব থানায় এক লাখ ৬৯ হাজার ৬৬৭টি মামলা হয়েছে। এ হিসাবে প্রতিদিন গড়ে ৪৬৫টি মামলা হয়েছে। এর আগের বছরের তুলনায় মামলা বেড়েছে ৬ শতাংশ। ২০০৯ সালে প্রতিদিন গড়ে ৪৩০টি করে মামলা হয়। তবে এ সংখ্যা ২০০৮ সালের তুলনায় সামান্য কম হলেও ২০০৬ ও এর আগের বছরগুলোর তুলনায় অনেক বেশি। এতে বলা হয়, গত বছর দেশে ৩১ হাজার ৬৯৬টি মাদক-সংশ্লিষ্ট অপরাধ হয়েছে। মোট মামলার ১৮ শতাংশ মাদকের অপরাধ।
তদন্ত ও সাজা: সিআইডির প্রকাশিত তথ্যে দেখা গেছে, ২০১১ সালে সারা দেশে বিভিন্ন মামলায় ২৪ শতাংশ অপরাধীর সাজা হয়েছে। ৭৬ শতাংশ মামলার ক্ষেত্রে আসামির বিরুদ্ধে পুলিশ অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি। তবে ২০০৯ সালে সাজার হার ছিল ২৩ শতাংশ। এ সময় পুলিশ তদন্ত করে ৪১ শতাংশ মামলায় অভিযোগপত্র দিয়েছে। বাকি মামলার আসামিরা তদন্ত পর্যায়েই অব্যাহতি পেয়েছে। আবার যেসব মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে, সেগুলোর ৬১ শতাংশের তদন্ত করেছে সিআইডি।
সভায় মামলার তদন্ত ও তদারকির ব্যাপারে গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলা হলেও সিআইডিপ্রধান তদন্তের বেহাল চিত্র তুলে ধরেন। তিনি সভায় বলেন, সিআইডিতে কর্মরত বেশির ভাগ কর্মকর্তা এ সংস্থায় কাজ করতে অনীহা দেখান। কাজের ব্যাপারে তাঁরা আন্তরিক নন। এ ছাড়া তাঁদের দাপ্তরিক কাজের পরিবেশ ভালো না। নতুন নতুন প্রযুক্তি গ্রহণেও তাঁদের মধ্যে অনীহা দেখা যায়। ভালো প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় সিআইডির কর্মকর্তারা ভালো তদন্ত করতে পারেন না।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সিআইডির প্রধান মোখলেসুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, তদন্তের মান উন্নত করা না গেলে আসামির সাজার হার বাড়বে না। মামলার কার্যক্রম শেষ হতে বেশি সময় লাগার কারণে আসামির সাজার হার বাড়ে না। তদন্ত থেকে শুরু করে বিচারিক কার্যক্রম কম সময়ে শেষ করা সম্ভব হলে সাজার হার বাড়বে।
যোগাযোগ করা হলে আইনজ্ঞ শাহ্দীন মালিক বলেন, পর্যাপ্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ না থাকার কারণে অপরাধীদের খালাস দেওয়া ছাড়া বিচারকদের আর কিছু করার থাকে না। মৌখিক ও চাক্ষুষ সাক্ষীর ওপর নির্ভরতা কমিয়ে প্রযুক্তিনির্ভর সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করতে হবে। না হলে সাজার হার বাড়বে না। তিনি বলেন, পুলিশের কাছে উন্নত প্রযুক্তি থাকলে সাংবাদিক দম্পতি খুনের মতো ঘটনায় আঙুলের ছাপ মিলিয়ে সহজেই আসামি শনাক্ত করা যেত।
সাবেক আইজিপি মুহাম্মদ নুরুল হুদা এ প্রসঙ্গে বলেন, বিজ্ঞানসম্মত তদন্ত না হওয়ার অনেক কারণ আছে। তদন্ত ভালো না হলে ভালো ফল আসবে না। তবে সাজার বর্তমান হার খুব উদ্বেগজনক নয় বলে মন্তব্য করেন তিনি।
নারী নির্যাতন: অপরাধ সভায় বলা হয়, ২০১১ সালে ২১ হাজার ৩৮৯টি নারী ও শিশু নির্যাতনের অপরাধ হয়েছে। সারা দেশে মোট অপরাধের ১২ শতাংশই নারী ও শিশু নির্যাতনের অপরাধ। ২০০৯ সালে দেশে মোট অপরাধের ৯ শতাংশই নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলা। নারী নির্যাতনের মামলার ব্যাপারে পুলিশের অভিমত হলো, ছোট ছোট ঘটনায় আদালতে মামলা হয় বলে পরিসংখ্যান ভারী হয়।
খুন: পুলিশের ভাষায় মানবদেহ-সংক্রান্ত অপরাধের মধ্যে রয়েছে খুন, দাঙ্গা ও দাঙ্গায় খুন। গত বছরে দেশে তিন হাজার ৯৬৯টি খুনের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে দাঙ্গায় খুন হয় ৩৬ জন। গত বছর দেশে চার হাজার ১৬৮টি খুন ও ১১২টি দাঙ্গা হয়েছে।
খুনের মামলার ব্যাপারে সিআইডিপ্রধান সভায় বলেন, অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনতে না পারা, সঠিকভাবে সাক্ষ্যপ্রমাণ আদালতে উপস্থাপন করতে না পারা, বিচারে সময়ক্ষেপণ, জমিজমা-সংক্রান্ত বিরোধ বেড়ে যাওয়া এবং অনৈতিক সম্পর্কের কারণে খুনের ঘটনা ঘটছে।
মারাত্মক অপরাধ: বৈঠকে উপস্থিত একজন পুলিশ কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, আগের বছরের তুলনায় দেশে ছিনতাই, ডাকাতি, দস্যুতা, সাধারণ চুরি ও সিঁধেল চুরি বেড়েছে। বলা হয়, মাদক সেবনের জন্য অতিরিক্ত অর্থের জোগান দেওয়া, কিছু পেশাদার গাড়িচালকের অসৎ তৎপরতা ও ভাসমান মানুষদের আইনের আওতায় আনতে না পারার কারণে এ ধরনের অপরাধ কমছে না।
অপহরণ: গুরুতর অপরাধের মধ্যে ২০১১ সালে দেশে ৭৯২টি অপহরণের মামলা হয়েছে। এর আগের বছর এ সংখ্যা ছিল এক হাজার ৩১। আর ২০০৯ সালে ৮০৩টি অপহরণের মামলা হয়েছে। বৈঠকে সিআইডিপ্রধান বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষার্থীদের স্বেচ্ছায় পালিয়ে যাওয়া, সম্পত্তি-সংক্রান্ত বিরোধ, অল্প সময়ে ধনী হওয়ার প্রবণতা ও চাকরির প্রলোভনের কারণে এ ধরনের অপরাধ হচ্ছে। তিনি বলেন, সহজে সীমান্ত অতিক্রম করার সুযোগ থাকার কারণে অপধারীরা পার পেয়ে যাচ্ছে।
সংবাদ সম্মেলন: অপরাধ সভার পর পুলিশের আইজি সংবাদ সম্মেলনে বলেন, দেশের অপরাধ পরিস্থিতি আগের তুলনায় অনেক ভালো। আগের বছরের তুলনায় মারাত্মক অপরাধ কম হয়েছে। তবে রাতারাতি সব পরিবর্তন হয়েছে সেটা বলা যাবে না। তিনি বলেন, ছিনতাই-ডাকাতি-রাহাজানি নিয়ে অপরাধ সভায় আলোচনা হয়েছে। এসব অপরাধ আরও কীভাবে কমিয়ে আনা যায়, তা নিয়ে আলোচনা করা হয়।
No comments