বলা হয় না ভালোবাসি by রুহিনা তাসকিন

হট, এক্সট্রা হট, তার চেয়েও হট হয় না? পেরি পেরি চিকেন খাওয়ার প্রতিযোগিতা চলছে বন্ধুদের যেন। দলের একজনের মুখ শুকিয়ে কাঠ। ঝাল তো সে একদমই খেতে পারে না, বন্ধুদের সামনে বলতেও লজ্জা লাগছে। সবার চিকেন টেবিলে আসতেই ছেলেটি অবাক, একটার ওপর ঝুলছে নীল পতাকা মানে মাইল্ড চিকেন।


এটা তো সে অর্ডার দেয়নি! সামনে চোখ পড়তেই মুচকি হেসে বুঝিয়ে দিল মেয়েটি, তার হয়ে মেয়েটিই চুপি চুপি বলে দিয়েছে ওয়েটারকে।
হল থেকে কলাভবন, সেখান থেকে রেজিস্টার বিল্ডিং, তারপর আবার কলাভবন। পরীক্ষার ফরম পূরণের ছোটাছুটি চলছে মেয়েটির। বন্ধুরাও যার যার মতো ব্যস্ত। কিন্তু ছায়াসঙ্গী হয়ে রয়েছে একটি ছেলে। সে কি শুধু্ই বন্ধু? কই, অন্য বন্ধুরা তো এল না। রিকশায় পাশাপাশি বসে যে হঠাৎই চুপ হয়ে যাচ্ছে ছেলেটি, কথা খুঁজে পাচ্ছে না মেয়েটিও। হঠাৎ এই নীরবতা তো মোটেও অস্বস্তিকর মনে হচ্ছে না। বরং এ মৌনতায় যেন রয়েছে অনেক না-বলা কথা।
বন্ধুরা সবাই মিলে সিনেপ্লেক্সে যাবে। সবার ভোট মিশন ইম্পসিবল ফোর-এর ঘরে। শুধু একটি ছেলে বলে উঠল, ‘এম আই ফোর না, আমরা দেখব কুংফু পান্ডা।’ সবাই অবাক, তুই আবার অ্যাকশন ছেড়ে অ্যানিমেশনের ভক্ত হলি কবে থেকে? বাকিরা না বুঝলেও একটি মেয়ের মন একটু দুলে উঠল। তার মনের কথা কীভাবে পড়ে ফেলল ছেলেটি? সবার মতের কাছে তার চাওয়াটা যে চাপা পড়ে যাচ্ছে, এটা বুঝল কী করে সে? সবাই তার বন্ধু, তবু অন্যরা তো জানল না যে সে কুংফু পান্ডাই দেখতে চায়।
সবাই তো বন্ধু। সবার ভালো লাগা, মন্দ লাগার খেয়াল রাখছে সবাই। কিন্তু এর মধ্যেই বিশেষ দুজনের যেন পরস্পরের প্রতি একটু বেশি নজর। একজন মুখ না খুলতেই বুঝে যাচ্ছে অপরজন। মেয়েটির বন্ধুদের কাছে ছেলেটি খোঁজ নিচ্ছে সে কী খেতে ভালোবাসে। ছেলেটির জন্য গোটা আজিজ সুপার মার্কেট ঘুরে মেয়েটি খুঁজে বের করছে বিশেষ একটি টি-শার্ট। বিদেশফেরত আত্মীয়কে দিয়ে ছেলেটি হয়তো আনাচ্ছে মেয়েটির পছন্দের পারফিউম। কেন রাতে একজনের ফোন ওয়েটিং পাওয়া গেল এ নিয়ে অরেকজনের অভিমান। পরীক্ষার আগে কেন ও পড়ছে না, এ নিয়ে বাড়তি উদ্বেগ। এ কি শুধু বন্ধুত্ব? নাকি বন্ধুত্বটা যে পরের ধাপে যেতে চলেছে তারই ইঙ্গিত?
বুঝে নিতে হবে দুজনকেই।
সরাসরি বলে ফেলার আগে দুই পক্ষই কি পরস্পরকে এমন ইঙ্গিত দেয় না? একজনের এমন বিশেষ মনোযোগে সাড়া দিয়ে আরেকজনও কি আরেক ধাপ এগোয় না? সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যাওয়ার আগে এই যে একটু লুকোচুরি, এ তো ভালোবাসারই অন্য রূপ। এমন কিছু যদি ঘটতে থাকে আপনার জীবনে, তবে কী করবেন? সাড়া দেবেন, নাকি চুপচাপ বয়ে যেতে দেবেন সেই বিশেষ আবেগের স্রোতটাকে, যতক্ষণ পর্যন্ত না সেটা এমনিতেই শুকিয়ে যায়।
শেষের কাজটা করা বোধ হয় ভুলই হবে। কারও মনোযোগ, ভালোবাসা পাওয়াটা এত হেলায় দেখা কি ঠিক? বরং এই অনুভূতিরই তো জয়জয়কার করেন কবি-সাহিত্যিকেরা।
কবি নির্মলেন্দু গুণ মনে করেন, এটা এমনই সুন্দর পবিত্র একটা অনুভূতি, যা শুধু কবিতাতেই প্রকাশ করা যায়। ‘এই সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলো আমি দারুণ উপভোগ করি। এটা আমি কবিতায় প্রকাশ করি। পাঠকেরা সেখান থেকেই বুঝে নেবেন। এটা নিয়ে আসলে মুখে বলার কিছু নেই। এটা একান্ত অনুভবের জন্য, বলে বেড়ানোর মতো নয়,’ বলেন তিনি।
তাহলে একটু ভেবে দেখুন। আপনি কি সত্যিই উপভোগ করছেন এই বাড়তি মনোযোগ? সেটা কি আপনার ভালো লাগছে? এই মানুষটিকে নিয়ে আপনি ভবিষ্যতের কথা ভাবতে পারছেন? যদি সবগুলো না হয়, তাহলে তো কথাই নেই। এখনই সরাসরি জানিয়ে দিন তাকে।
শুধু শুধু ভালো লাগার ভান করাটা তো বন্ধুর সঙ্গে প্রতারণারই শামিল। অথবা আপনার ভালো লাগছে, কিন্তু আপনি ভবিষ্যতের কথা ভাবছেন না। সে ক্ষেত্রে কি তাকে সরাসরি কিছু বলা ঠিক হবে? তার দিক থেকে এখনো তো কোনো প্রস্তাব আসেনি। এ ক্ষেত্রে বোধ হয় আর একটু সময় নেওয়া ভালো।
আবার আপনি উপভোগ করছেন এবং আপনার দিক থেকেও যথেষ্ট সাড়া আছে, আপনি চাইছেন সম্পর্কটা আরও এগিয়ে নিতে। তখন তো একজনকে মুখে বলে ফেলতেই হবে, ভালোবাসি।
সংগীতশিল্পী দম্পতি তাহসান-মিথিলা দুজনই ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। গানের সূত্রেই পরিচয়, বন্ধুত্ব। তারপর প্রেম, বিয়ে।
তাহসানের মুখেই শুনুন: ‘কেউ কাউকে পছন্দ করলে সে চাইবে তার সঙ্গে সবচেয়ে বেশি সময় কাটাতে। সব সময় সুযোগ খুঁজবে কীভাবে আরও বেশি কাছে থাকা যায়। আমি যেমন মিথিলাকে বাড়ি পৌঁছে দিতাম, ক্যাম্পাসে সব সময় ওর সঙ্গে থাকতাম। ওর প্রয়োজনগুলোর দিকে খেয়াল রাখতাম। তবে ওর দিক থেকেও যে সাড়া আছে তা বুঝলাম কথোপকথন অ্যালবামটি করার সময়। ও ভালো আবৃত্তি করে। ওকে বললাম, তুমি আমার সঙ্গে একটা গান গাও। ও রাজি হয়ে গেল। বললাম, এখনই চলে আসো স্টুডিওতে। ও এল। এসবই তো ওর পক্ষ থেকেও ভালো লাগার ইঙ্গিত। গান লেখার সময়ও দেখলাম আমরা পরস্পরের অনুভূতিগুলো সহজেই বুঝতে পারছি। আমি কী চাইছি, সেটা বুঝেই ও লিখছে। এই যে পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস, এটাই তো ভালোবাসা।’

No comments

Powered by Blogger.