চিরনিদ্রায় হুমায়ুন ফরীদি-শোক ঢেকে দিয়েছে আলো by জাহীদ রেজা নূর

‘সরেন, সরেন, গরম পানি!’ ধানমন্ডির বাড়িটার সিঁড়িঘর থেকে এই কথা বলতে বলতে দুজন মানুষ বেরিয়ে আসে। জমাট ভিড় ইতস্তত ছড়িয়ে পড়ে। ছ্যাঁত করে ওঠে বুক। গরম পানি! ‘বরই পাতার গরম জলে...’ পঙিক্তটিই মনে পড়ল প্রথম। তাহলে ওই যে সামনে, যেখানে কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে কিছুটা জায়গা, সেখানেই শুয়ে আছেন হুমায়ুন ফরীদি! তবে আর লিফটের তিনে যাওয়ার দরকার নেই! এখানে, এই জনারণ্যেই খুঁজে নিতে হবে তাঁকে!


ভিড়ের মধ্যে শাহীন আর রুবেলকে খুঁজি। শিল্পীর শেষ দিনটা সম্পর্কে ওরাই কিছু বলতে পারবে। ওরাই তো ছিল শেষ সময়ে সার্বক্ষণিক সঙ্গী।
রোববার রাতে ফরীদি শাহীনকে বলেছিলেন, মাগুর মাছ খাবেন। শাহীন মাগুর মাছ কিনতে মোহাম্মদপুরে চলে গিয়েছিল। সেখানেই ওর বাড়ি। সকালে মাছ নিয়ে আসবে। সোমবার সকালে ফোন করে ফরীদিকে পাচ্ছিল না শাহীন। রুবেলকে ফোন করার পর রুবেল বাড়িতে ঢুকে শোবার ঘরে পায়নি ফরীদিকে। তারপর দেখে, বাথরুমে পড়ে আছেন তিনি। পাঁজাকোলা করে তাঁকে নিয়ে আসা হয় বিছানায়। অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়েই আছেন চিকিৎসক। তিনি এসে বলেন, ফরীদি আর নেই।
হাসপাতালে ১১ দিন থেকে এই তো ১১ ফেব্রুয়ারি নিজের বাড়িতে ফিরলেন ফরীদি। সুস্থই তো বলা যায়। হাসপাতালে প্রতিদিন গেছে ফরীদির মেয়ে দেবযানী আর ওর বর। দেবযানীর বরের কাছে যাই। ও নিজের নাম বলল না। বলল, ‘আমার আবার কী পরিচয়! আমি দেবযানীর বর। এটুকুই। কালও (রোববার) রাতে আমরা এসেছিলাম এখানে। সুস্থই ছিলেন। রাতে খাওয়ার আগে আমরা চলে গিয়েছিলাম, ভাবিনি এ রকম কিছু...’—কথা শেষ করা হয় না। ওর ছলছল চোখ অন্যদের চোখকেও সিক্ত করে। ওদের সুহূদ শাহেদ আলী বলেন, ‘শেষ দিনগুলোয় দেবযানী আর মেয়েজামাইয়ের কাছে পুরোনো দিনের কথা বলতেন তিনি। মৃত্যু নিয়ে কথা বলতেন।’ একটু পর দেবযানী আসে, পাশ থেকে ফিসফিস করে শাহেদ আলী বলেন, ‘ওকে ডিস্টার্ব করবেন না।’ আমরা ফরীদির মৌন মেয়েকে দেখি, হূদয়ভরা কান্না নিয়ে নিথর দাঁড়িয়ে আছে।
এ সময় অভিনেতা খলিল আসেন। টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে কথা বলতে গিয়ে হু হু করে কেঁদে ফেলেন। বলেন, প্রথম আলোয় আমার আরোগ্য কামনা করে লিখেছিল ফরীদি। আমি ওর আরোগ্য কামনা করার আগেই ও চলে গেল!’
গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গাটা মানুষে মানুষে ভরে গেছে। বাইরের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। খাটিয়ার পাশে জটলা। সেখানে ফরিদুর রেজা সাগর, শাইখ সিরাজ, হানিফ সংকেত কথা বলছেন। প্রথমে এখানে জানাজার পর ফরীদিকে নিয়ে যাওয়া হবে বিটিভিতে, এফডিসিতে, তারপর রাখা হবে বারডেমের হিমঘরে। কাল সকাল ১০টায় শহীদ মিনার, তারপর বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদে জানাজা। এটুকুই এখন পর্যন্ত পরিকল্পনা।
ফরিদুর রেজা সাগরের পাশে দাঁড়াতেই তিনি অস্ফুটে বলে ওঠেন, ‘আমাদের প্রজন্মের শিল্পীদের মধ্যে প্রথম বিদায় নিল ফরীদি। যে সবকিছুতেই প্রথম ছিল, সবকিছুতেই শ্রেষ্ঠ ছিল, সে-ই বিদায় নিল সবার আগে।’ তৌকীর আহমেদ বেশ স্বাভাবিকভাবেই বলা শুরু করলেন, ‘পঁচাশি সালেই পরিচয়। তাঁর কাছ থেকে মঞ্চে কাজ করা শিখেছি। ভিন্ন নাট্যদলের হলেও যোগাযোগ ছিল। বন্ধুবৎসল ছিলেন, যাদের মধ্যে সম্ভাবনা দেখতেন, তাদের ডেকে নিতেন, পরামর্শ দিতেন। কীত্তনখোলা, কেরামত মঙ্গল নাটকে যে ঔজ্জ্বল্য নিয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন...’ তৌকীর আর বলতে পারেন না। একদলা কান্না এসে তাঁকে বাকরুদ্ধ করে দেয়। রামেন্দু মজুমদারের কাছে যাই। তিনি বলেন, ‘ফরীদির উত্থান মঞ্চে। আমরা একজন শক্তিমান অভিনেতাকে আবিষ্কার করলাম, যিনি অনায়াস দক্ষতায় বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করে মুগ্ধ করেছে সবাইকে। দীর্ঘ সময় দাপটের সঙ্গে অভিনয় করেছে ও। আরেকটু শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবন যাপন করলে আমরা হয়তো দীর্ঘদিন ওকে পেতাম, অভিনয়জগৎ সমৃদ্ধ হতো।’
টিভি ক্যামেরা খুঁজে নিচ্ছে পরিচিত মুখগুলো। মামুনুর রশীদ, আবুল হায়াত, শিমূল ইউসুফ, কাজী আরিফ, আফরোজা বানু, মিতা চৌধুরী, তারিক আনাম খান, নিমা রহমান, শহীদুজ্জামান সেলিম, আজাদ আবুল কালাম, রোকেয়া রফিক, আফসানা মিমি, আনিসুর রহমান মিলন, বন্যা মির্জা, দীপা খন্দকার, আরও কত শিল্পী...ওই তো অধ্যাপক আনু মুহাম্মদও এসেছেন, এসেছেন চিত্রনায়ক আলমগীর...তারাদের মেলা বসেছিল হুমায়ুন ফরীদির বাড়িতে। কিন্তু তারার আলোয় আলোকিত হচ্ছিল না বাড়িটি। শোকের অন্ধকার ঢেকে দিয়েছে আলো।
এরই মধ্যে গোসল শেষ। খাটিয়ায় রাখা হয়েছে হুমায়ুন ফরীদির মরদেহ। মুখের কাপড় সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। সবাই সার বেঁধে এই বাড়িতে শেষবারের মতো দেখছেন হুমায়ুন ফরীদিকে।
দুপুর ১২টা ৪০-এর দিকে এই বাড়ি ছেড়ে চলে গেলেন ফরীদি। থমথমে মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে একবারও স্বভাবজাত কৌতুক করলেন না তিনি। শুধু সুমাইয়া শিমুর চিৎকার করা কান্না থমথমে পরিবেশকে আরও বিষণ্ন করে দিল।
বেলা একটা ২০ মিনিটে এলেন সুবর্ণা মুস্তাফা। থাকলেন অনেকটা সময়।
শেষবার তাঁর ৬০তম জন্মদিন উপলক্ষে যখন ফরীদির কাছে গিয়েছিলাম, তিনি শেক্সপিয়ারের কিং লিয়র নাটকটির কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন, এই নাটকটিতে অভিনয় করার জন্য তিনি উন্মুখ হয়ে আছেন। নাটকটি আর করা হয়নি। কিন্তু জীবনের নানা পথপরিক্রমায় তাঁর জীবনটাও কি রাজা লিয়রের মতো নয়—সুখে-দুঃখে ঘেরা?
কিং লিয়রের মহানুভবতা নিয়েই চলে গেলেন এ যুগের শক্তিমান অভিনয়শিল্পী হুমায়ুন ফরীদি। যিনি নিজেই বলতেন, ‘অভিনয় ছাড়া আর কিছুই আমি শিখিনি।’

No comments

Powered by Blogger.