কোরাম সংকট-সংসদে সময়ের অপচয় নিত্যদিন by হারুন আল রশীদ

সংসদে কোরাম সংকট প্রায় প্রতিদিনের ঘটনা। গত অষ্টম সংসদের মতো বর্তমান সংসদেও এ সংকট চলছে।
নবম সংসদের আজ তিন বছর পূর্ণ হলো। সংসদ বুলেটিনের হিসাব অনুযায়ী, গত তিন বছরে ১১টি অধিবেশনের ২৫৪ কার্যদিবসে কোরাম সংকটের কারণে সময় অপচয় হয়েছে সাত হাজার ৭৮৫ মিনিট।


আর চারদলীয় জোট সরকারের সময় অষ্টম সংসদের ২৩টি অধিবেশনে একই কারণে সময় অপচয় হয়েছে ১৩ হাজার ৬৩৫ মিনিট। অধিবেশন মুলতবি হয়েছে একাধিকবার।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) হিসাব অনুযায়ী, সংসদ পরিচালনায় প্রতি মিনিটে গড়ে ৪২ হাজার টাকা খরচ হয়। এই হিসাবে বর্তমান সংসদে এখন পর্যন্ত কোরাম সংকটের কারণে সরকারের অতিরিক্ত ব্যয় হয়েছে ৩২ কোটি ৬৯ লাখ টাকা।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, সংসদ পরিচালনার জন্য ২০০৯-১০ অর্থবছরে যে বাজেট বরাদ্দ করা হয়েছিল, তার ওপর ভিত্তি করে এই হিসাব ধরা হয়েছে। এর আগের অষ্টম সংসদের অধিবেশন পরিচালনার ব্যয়ের হিসাবও একইভাবে বের করা হয়েছিল।
তবে কোরাম সংকট হলেও সাংসদদের উপস্থিতি সন্তোষজনক। তবে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা সংসদে আসেন কম। ২০০ দিনের বেশি সময় সংসদে উপস্থিত ছিলেন মাত্র আটজন মন্ত্রী। প্রতি বুধবার প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্নোত্তরের দিন উপস্থিতি বেশি থাকে, কম থাকে বৃহস্পতিবারের বেসরকারি সদস্য দিবসে। বিরোধী দলের সংসদ বর্জনের সূচকও ঊর্ধ্বমুখী।
কোরাম সংকট: সংসদের কার্যপ্রণালি বিধি অনুযায়ী, বৈঠক বা মুলতবি বৈঠক শুরু করা অথবা বৈঠক অব্যাহত রাখার জন্য ন্যূনতম ৬০ জন সদস্যের উপস্থিতি প্রয়োজন। বৈঠক চলাকালে ৬০ জন উপস্থিত নেই, এ মর্মে কোনো সদস্য স্পিকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে স্পিকার বৈঠক মুলতবি অথবা স্থগিত রেখে পাঁচ মিনিট ঘণ্টা বাজানোর নির্দেশ দেবেন। ঘণ্টাধ্বনি বন্ধ হওয়ার পরও যদি কোরাম না হয়, তবে স্পিকার বৈঠক মুলতবি করবেন।
গড়ে ৩০ মিনিট কোরাম সংকট: সংসদের বুলেটিন থেকে জানা গেছে, নবম সংসদের ১১টি অধিবেশনের ২৫৪ কার্যদিবস প্রতিদিন গড়ে ৩০ মিনিট করে কোরাম সংকটে কেটেছে। প্রথম অধিবেশন এক হাজার ৫৪৮ মিনিট (২৫ ঘণ্টা ৪৮ মিনিট), দ্বিতীয় অধিবেশন ৭৯৪ মিনিট (১৩ ঘণ্টা ১৪ মিনিট), তৃতীয় অধিবেশন ৪৬০ মিনিট (সাত ঘণ্টা ৪০ মিনিট), চতুর্থ অধিবেশন এক হাজার ৫৫০ মিনিট (২৫ ঘণ্টা ৫০ মিনিট), পঞ্চম অধিবেশন এক হাজার ৪৮ মিনিট (১৭ ঘণ্টা ২৮ মিনিট), ষষ্ঠ অধিবেশন ৪০৭ মিনিট (ছয় ঘণ্টা ৪৭ মিনিট), সপ্তম অধিবেশন ১৯৬ মিনিট (তিন ঘণ্টা ১৬ মিনিট), অষ্টম অধিবেশন ৭৫৭ মিনিট (১২ ঘণ্টা ৩৭ মিনিট), নবম অধিবেশন ৬৩২ মিনিট (১০ ঘণ্টা ৩২ মিনিট), দশম অধিবেশন ৩৫ মিনিট এবং ১১তম অধিবেশনে ৩৫৮ মিনিট (পাঁচ ঘণ্টা ৫৮ মিনিট) সময় অপচয় হয়।
সংসদ সচিবালয়-সংশ্লিষ্টদের মতে, নবম সংসদের সাংসদদের উপস্থিতি সন্তোষজনক। কিন্তু দিনের বৈঠক শুরু হওয়ার সময় সাংসদেরা বিলম্বে আসেন। এ সময় ৫ থেকে ১৫ মিনিট পর্যন্ত বিলম্ব হয়। তাই স্পিকার বা ডেপুটি স্পিকার প্রস্তুত থাকলেও কোরাম সংকটের কারণে বৈঠক যথাসময়ে শুরু করা যায় না। আসর বা মাগরিবের নামাজের বিরতি থাকে ২০ থেকে ২৫ মিনিট। কিন্তু সেই বিরতি ৩০ থেকে ৪০ মিনিট পর্যন্ত গিয়ে ঠেকে। জানা যায়, এ সময় বেশির ভাগ সাংসদ লাউঞ্জে আড্ডায় ব্যস্ত থাকেন।
সংসদে যথাসময়ে সাংসদদের উপস্থিতি নিশ্চিত করার দায়িত্ব চিফ হুইপ ও হুইপদের। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, হুইপদের অনেকেই যথাসময়ে উপস্থিত থাকেন না। বুলেটিন থেকে জানা যায়, বর্তমান সংসদের ২৫৪ কার্যদিবসের মধ্যে চিফ হুইপ আব্দুস শহীদ ২০৯, হুইপ আ স ম ফিরোজ ২১১, মুজিবুল হক ২২৮, শেখ আবদুল ওহাব ২১১, মির্জা আজম ৭৬, নূর-ই-আলম চৌধুরী ১৯০ দিন উপস্থিত ছিলেন।
অধিবেশন মুলতবি: কোরাম সংকটের কারণে অষ্টম অধিবেশনের ১৪তম কার্যদিবসে (২৪ ফেব্রুয়ারি, বৃহস্পতিবার ২০১১) সংসদের অধিবেশন মুলতবি করার ঘটনাও ঘটে। এদিন সিদ্ধান্ত প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা শুরু হলে জাতীয় পার্টির সাংসদ মুজিবুল হক ডেপুটি স্পিকার শওকত আলীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, সংসদে কোরাম নেই। ডেপুটি স্পিকারের নির্দেশে বিধি অনুযায়ী পাঁচ মিনিট ঘণ্টা বাজানোর পরও কোরাম পূরণ হয়নি। হুইপ আবদুল ওহাব পাঁচ মিনিট চেষ্টা করে কোরাম পূরণ করতে ব্যর্থ হন। তিনি ডেপুটি স্পিকারকে উদ্দেশ করে বললেন, কোরাম হওয়ার সম্ভাবনা নেই। শেষ পর্যন্ত সাংসদ ও হুইপদের সতর্ক করে ডেপুটি স্পিকার অধিবেশন মুলতবি করেন।
২৭ ফেব্রুয়ারি পরের কার্যদিবসে স্পিকার আবদুল হামিদ সাংসদদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, ‘বর্তমান সংসদের মেয়াদ দুই বছর অতিক্রম হয়েছে। বৃহস্পতিবার অধিবেশনের শেষ মূহূর্তে কোরাম সংকটজনিত কারণে অধিবেশন মুলতবি করতে হয়েছে। গতকাল ব্যতীত গত দুই বছরের মধ্যে কোনো দিনই কোরাম সংকটের কারণে অধিবেশন মুলতবি করতে হয়নি। এ বিষয়ে পত্রপত্রিকায়ও খবর ছাপা হয়েছে, ফলে সংসদের মান অনেকাংশে ক্ষুণ্ন হয়েছে। ভবিষ্যতে যাতে আর এ ধরনের পরিস্থিতির সৃষ্টি না হয়, সে জন্য মাননীয় সংসদ সদস্যদের সহযোগিতা কামনা করছি।’
সূত্র জানায়, সাংসদেরা দিনের বৈঠক শেষ হওয়ার আগেই সংসদ ছেড়ে চলে যান বলে বৈঠক চালু অবস্থায় বেশ কয়েক দিন কোরাম সংকট দেখা দেয়। এ ধরনের পরিস্থিতিতে পাঁচ মিনিট ঘণ্টা বাজানোর ফাঁকে চিফ হুইপ ও হুইপরা লাউঞ্জ থেকে সাংসদদের ধরে এনে কোরাম পূরণ করেন। বেশ কয়েক দিন জাতীয় পার্টির মুজিবুল হক এবং স্বতন্ত্র সাংসদ ফজলুল আজিম এ বিষয়ে স্পিকারের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করলে কোরাম সংকটের বিষয়টি জানাজানি হওয়ার আগেই স্পিকার তড়িঘড়ি দিনের অধিবেশন মুলতবি করে দেন।
স্পিকার আবদুল হামিদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোরাম সংকটের ব্যাপারে আমার কিছু করার নেই। আমার কারণে দিনের বৈঠক বিলম্বে শুরু হয়েছে, এমন নজির নেই। আমি তো অপেক্ষায় থাকি কখন কোরাম হবে, কখন ঘণ্টা বাজা বন্ধ হবে। ঘণ্টা বাজা বন্ধ হওয়ার পর হেঁটে যেতে যত সময় লাগে, ঠিক তত সময়ের মধ্যেই হাউসে যাই।’
চিফ হুইপ আব্দুস শহীদ বলেন, কোরাম সংকট রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। তবে বিষয়টি দোষের কিছু নয়। সারা বিশ্বে এমন রেওয়াজ আছে। রাস্তায় যানজট থাকে বলে অনেকে সময়মতো উপস্থিত হতে পারেন না। অনেকে লবিতে থাকলেও হাউসে ঢোকেন বিলম্ব করে। এই রেওয়াজ ভাঙতে সময় লাগবে।
মন্ত্রীদের অনুপস্থিতি: ১১তম অধিবেশন শেষে ২৫৪ কার্যদিবসের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৮৯ দিন সংসদে উপস্থিত ছিলেন। সরকারি দলের সদস্যদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ২৫৩ দিন করে উপস্থিত ছিলেন জহিরুল হক ভূঁইয়া (নরসিংদী-৩) এবং এ এ মারুফ সাকলান (নীলফামারী-৪)।
বুলেটিনের হিসাব অনুযায়ী, দশম অধিবেশন পর্যন্ত ২৪১ কার্যদিবসের হিসাবে দেখা গেছে, সরকারের মন্ত্রীদের মধ্যে ২০০ দিনের বেশি সময় সংসদে উপস্থিত ছিলেন মাত্র আটজন। তাঁরা হলেন পানিসম্পদমন্ত্রী রমেশ চন্দ্র সেন, ভূমি প্রতিমন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান, তথ্যমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ, ভূমিমন্ত্রী রেজাউল করিম, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন, বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী ফারুক খান। মন্ত্রীদের মধ্যে ১০০ দিনেরও কম সময় সংসদে উপস্থিত ছিলেন বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী (৭৬ দিন), পরিবেশ ও বনমন্ত্রী হাছান মাহমুদ (৮৬ দিন) এবং পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী দীপংকর তালুকদার (৮৬ দিন)।
সাধারণত বুধবার প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্নোত্তর থাকে বলে সেদিন মন্ত্রীরা বেশি উপস্থিত থাকেন। বৃহস্পতিবার বেসরকারি সদস্যদের দিবসে উপস্থিতি কম থাকে। বেসরকারি দিবসে মাঝেমধ্যে একজন মন্ত্রীও উপস্থিত থাকেন না। এ নিয়ে স্পিকার একাধিকবার মন্ত্রী-সাংসদদের সতর্ক করেছেন। ১১তম অধিবেশনের ষষ্ঠ কার্যদিবসে (২৭ অক্টোবর, শনিবার ২০১১) তোফায়েল আহমেদ স্পিকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, সরকারের ৫০ জনের বেশি মন্ত্রী রয়েছেন। অথচ এ মুহূর্তে অধিবেশনে উপস্থিত মাত্র ছয়জন। সংসদ সচিবালয় সূত্র জানায়, মন্ত্রীদের অনুপস্থিতির কারণে বেশ কয়েকবার সিদ্ধান্ত প্রস্তাব-সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ নোটিশের কাজ স্থগিত করতে হয়েছে।
হিসাবে আরও দেখা গেছে, সদস্যদের মধ্যে দশম অধিবেশন পর্যন্ত ২০০ দিনের বেশি সংসদে উপস্থিত ছিলেন সুকুমার রঞ্জন ঘোষ (মুন্সিগঞ্জ-১), মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন (ঢাকা-৭), এস কে আবু বাকের (নড়াইল-২), সেগুফতা ইয়াসমীন (মুন্সিগঞ্জ-২), ইলিয়াছ উদ্দিন মোল্লাহ (ঢাকা-১৬), আজিজুল হক চৌধুরী (দিনাজপুর-৬), মুজিবুল হক (কুমিল্লা-১১), আফাজউদ্দিন আহমেদ (কুষ্টিয়া-১), ফরিদুল হক খান (জামালপুর-২), আবদুল মান্নান (বগুড়া-১), হাবিবুন নাহার (বাগেরহাট-৩), ইসহাক হোসেন তালকুদার (সিরাজগঞ্জ-৩) প্রমুখ।
একই দলের সদস্যদের মধ্যে সবচেয়ে কম সময় উপস্থিত ছিলেন চয়ন ইসলাম (সিরাজগঞ্জ-৬) ৬৯ দিন, মিজানুর রহমান খান (ঢাকা-৬) ও শেখ হেলাল উদ্দিন (বাগেরহাট-১) ৭৮ দিন করে, খন্দকার আসাদুজ্জামান (টাঙ্গাইল-২) ৮৬ দিন এবং আ হ ম মুস্তফা কামাল (কুমিল্লা-১০) ৯৫ দিন।
একই সময়ে স্পিকার আবদুল হামিদ ২৩০, ডেপুটি স্পিকার শওকত আলী ২৩১ এবং সংসদ উপনেতা সাজেদা চৌধুরী ২০২ কার্যদিবস সংসদে উপস্থিত ছিলেন।
বিরোধী দলের ৫৪ দিন: বিরোধী দল সংসদ বর্জনের ক্ষেত্রে অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। নবম সংসদে বিরোধী দলের সংসদ বর্জনের হার ৭৮ দশমিক ৭৪ শতাংশ। অষ্টম, সপ্তম ও পঞ্চম সংসদে এ হার ছিল যথাক্রমে ৬০, ৪৩ ও ৩৪ শতাংশ।
সংসদ সচিবালয়ের হিসাব অনুযায়ী বিএনপি, জামায়াত ও বিজেপির জোট ২৫৪ দিনের মধ্যে সংসদে উপস্থিত ছিল মাত্র ৫৪ দিন। দ্বিতীয়, তৃতীয়, ষষ্ঠ, সপ্তম, নবম, দশম ও একাদশ অধিবেশনে তারা পুরোপুরিই অনুপস্থিত ছিল। পঞ্চম অধিবেশনে বিরোধী দল যোগ দেয় মাত্র এক দিন। এরপর টানা ৭৪ কার্যদিবস অনুপস্থিত থাকার পর সংসদ সদস্যপদ রক্ষার স্বার্থে বিরোধী দল সংসদে ফেরে ১৫ মার্চ, যা ছিল অষ্টম অধিবেশনের ২৯তম কার্যদিবস। এদিন বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া সরকারের সমালোচনা করে দীর্ঘ বক্তব্য দেন। আর ওই অধিবেশনের শেষ দিন ২৪ মার্চ তাঁরা ওয়াকআউট করার পর আর সংসদে ফেরেননি।
বিরোধী দলের সদস্যদের মধ্যে খালেদা জিয়া মাত্র ছয় দিন সংসদে উপস্থিত হন। এ দলের আবুল খায়ের ভূঁইয়া (লক্ষ্মীপুর-২) সর্বোচ্চ ৫১ দিন সংসদে উপস্থিত ছিলেন।

No comments

Powered by Blogger.