জেএমবির আদলে সংগঠন চালাচ্ছে হিযবুত তাহ্রীর by টিপু সুলতান ও প্রশান্ত কর্মকার

নিষিদ্ধ হওয়ার পর হিযবুত তাহ্রীর আরেক জঙ্গি সংগঠন জেএমবির মতো ছোট ছোট ভাগে বিভক্ত হয়ে (কাট-আউট পদ্ধতি) গোপন তৎপরতা চালাচ্ছে। এদের এক অংশ আরেক অংশের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য জানে না বলে দাবি করছে।
তবে কারাগারে থেকে হিযবুতের কেন্দ্রীয় নেতারা এখনো সংগঠনটিকে দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন বলে তথ্য পাওয়া গেছে।


অবশ্য এই মুহূর্তে মাঠপর্যায়ে কারা এই গোপন সংগঠনটিকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, সে ব্যাপারে এখনো অন্ধকারে আছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সংগঠনটির আটক নেতা-কর্মীদের জিজ্ঞাসাবাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
২০০৯ সালের অক্টোবরে সরকার উগ্রপন্থী এই আন্তর্জাতিক সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এরপর হিযবুত তাহ্রীরের প্রথম সারির প্রায় সব নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
পুলিশের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে গ্রেপ্তার হওয়া সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদ করে তাঁরা জানতে পেরেছেন, কারাগার থেকে কেন্দ্রীয় নেতারা এখনো দলটিকে নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের কাছে আসা দর্শনার্থীদের মাধ্যমে এবং অন্য একাধিক উপায়ে তাঁরা বাইরে থাকা নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছেন। আবার অনেকে জামিনে বের হয়ে আসার সময়ও প্রয়োজনীয় নির্দেশনা নিয়ে আসছেন।
নজরদারির অভাব, জামিনে মুক্ত ৫০: সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, শুরুর দিকে গ্রেপ্তার হওয়া হিযবুত তাহ্রীরের নেতা-কর্মীদের ভালোভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়নি। এমনকি কারাগারে যাওয়ার পর তাঁদের কাছে কারা আসেন, তাঁদের মামলাগুলোর কী অবস্থা—এসব ব্যাপারে পর্যাপ্ত নজরদারিও ছিল না।
আদালতের নথিপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, গত দুই বছরে হিযবুত তাহ্রীরে প্রায় ২৭০ জন নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছেন র‌্যাব-পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা। তাঁদের মধ্যে ৫০ জন ইতিমধ্যে আদালত থেকে জামিন নিয়ে বের হয়েছেন। জামিনে বের হয়ে আবার গোপন তৎপরতায় যুক্ত হচ্ছেন, এমন তথ্য-প্রমাণও পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
দুর্বল নজরদারির বিষয়ে জানতে চাইলে একজন পদস্থ পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অনেক কর্মকর্তা হিযবুত তাহ্রীরকে এখনো পুরোপুরি জঙ্গি সংগঠন বলে মনে করছেন না। তাই জেএমবির জঙ্গিদের যেভাবে জিজ্ঞাসাবাদ ও নজরদারি করা হয়, হিযবুতের ক্ষেত্রে তেমনটা হয়নি।
জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারের মুখপাত্র ও গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) উপকমিশনার মনিরুল ইসলাম শুরুর দিকে নজরদারির ঘাটতির কথা স্বীকার করেছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে বিডিআর বিদ্রোহের বার্ষিকীতেও উগ্রপন্থী এই সংগঠনটি সেনাবাহিনীকে লক্ষ্য করে উসকানিমূলক বক্তব্য-সংবলিত পোস্টার ও প্রচারপত্র ছেড়েছিল। তখন থেকে পুলিশ-র‌্যাব ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা এই সংগঠনের প্রতি বাড়তি নজরদারি শুরু করে। যার ফলে এবারের বড় ধরনের চক্রান্ত নস্যাৎ করা গেছে।
মনিরুল ইসলাম বলেন, গ্রেপ্তার হওয়া হিযবুত সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদ করেও খুব বেশি তথ্য পাওয়া যায় না। তাঁরা জেএমবির (জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ) জঙ্গিদের মতো ‘কাট-আউট সিস্টেমে’ কার্যক্রম পরিচালনা করেন। ফলে ধরা পড়লেও তাঁরা একটা পর্যায়ের পর আর কিছু বলতে পারেন না।
নিষিদ্ধ হয়ে বেশি সংগঠিত: ধর্মভিত্তিক উগ্রপন্থী সংগঠনগুলোর তৎপরতা নজরদারির দায়িত্বে থাকা একাধিক গোয়েন্দা কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেছেন, ২০০৯ সালের অক্টোবরে নিষিদ্ধ ঘোষণা এবং ধরপাকড় করার পরও উগ্রপন্থী এই সংগঠনের কার্যক্রম থামানো যায়নি। বরং তারা আরও বেশি সংগঠিত হয়েছে। তারা শুধু সদস্য সংগ্রহ কার্যক্রমই নয়, সরকার উৎখাতের জন্য গোপন তৎপরতায়ও জড়িয়ে পড়েছে। সম্প্রতি ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানের প্রক্রিয়ায়ও জড়িত বলে অভিযোগ ওঠা কারও কারও সঙ্গে হিযবুত তাহ্রীরের সম্পৃক্ততার কথা সেনা সদরের সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়েছে। অভ্যুত্থানের প্রক্রিয়া ব্যর্থ হওয়ার পরও সংগঠনটি সরকার উৎখাতে সেনাবাহিনীতে উসকানিমূলক পোস্টার সাঁটায়। গত শুক্রবার এমন তৎপরতা চালানোর সময় উত্তরার একটি মসজিদের সামনে থেকে পাঁচ হিযবুত তাহ্রীরের সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। তবে একই দিন আরও একাধিক স্থানে জুমার নামাজের পর প্রচারপত্র বিলি ও সংক্ষিপ্ত মিছিল-সমাবেশ করেছে বলে দাবি করে ছবিসহ সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়েছে সংগঠনটি।
এসব পোস্টার কোথায় ছাপা হচ্ছে, কারা সদস্যদের হাতে পৌঁছাচ্ছে—এ ব্যাপারে গ্রেপ্তার হওয়া হিযবুত সদস্যদের কাছ থেকে এখনো বিস্তারিত তথ্য জানতে পারেনি বলে দাবি করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
র‌্যাব-১-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল রাশেদুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা যে পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছেন, তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করে এর শিকড় বের করার চেষ্টা করছেন।
র‌্যাবের অপর একজন পদস্থ কর্মকর্তা বলেন, হিযবুত তাহ্রীর যেভাবে সরকার উৎখাতে সেনাবাহিনীকে উসকানি দিয়ে পোস্টারে, ইন্টারনেটে প্রচারণা চালাচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে, এর নেপথ্যে আরও কোনো শক্তি যুক্ত রয়েছে।
শিক্ষকতা ছদ্মবেশে হিযবুতের কার্যক্রম: হিযবুত সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদে যুক্ত ছিলেন, এমন এক কর্মকর্তা বলেছেন, ঢাকার নামকরা অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে হিযবুত তাহ্রীরের কোনো কোনো সদস্য শিক্ষকতা করেন। তাঁরা শিক্ষকতার আড়ালে মূলত সদস্য সংগ্রহ, উদ্বুদ্ধকরণসহ সংগঠনের বিভিন্ন গোপন কর্মকাণ্ডে যুক্ত আছেন। তাঁরা সচ্ছল পরিবারের ছেলেমেয়েদের লক্ষ্য করে সংগঠনের সদস্য সংগ্রহ কর্মসূচি চালাচ্ছেন এবং তাঁদের মধ্যে পবিত্র ধর্মের নাম ব্যবহার করে উগ্র মতবাদ ছড়িয়ে দিচ্ছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) হিযবুতের তৎপরতা রয়েছে। সংগঠনটি একটি মাদ্রাসা ও একটি কোচিং সেন্টার পরিচালনা করে বলে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো জানতে পেরেছে।
ডিবির উপকমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, এসব শিক্ষকই হিযবুতের এখন মূল চালিকাশক্তি। তিনি বলেন, শুরুর দিকে যাঁরা হিযবুতের সদস্য ছিলেন, তাঁদের বড় একটা অংশ পাস করে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আর মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করা ব্যক্তিরা হাসপাতালে চাকরি নিয়েছেন সাংগঠনিক সিদ্ধান্তে। তাঁরা তাঁদের আয়ের এক অংশ সংগঠনের কাজে ব্যয় করেন। তিনি বলেন, ‘এসব হোয়াইট কলার হিযবুত সদস্যদের শনাক্ত করার কাজ চলছে।’
জ্যেষ্ঠ আরেক গোয়েন্দা কর্মকর্তার মতে, অতীতে মাওবাদী নকশালপন্থী বা গণবাহিনী যেভাবে তরুণদের দলে ভিড়িয়েছিল, অনেকটা সেভাবে হিযবুত তাহ্রীরও কোমলমতি মেধাবী তরুণদের মগজ ধোলাই করছে। এ ক্ষেত্রে তারা ধর্মকে ব্যবহার করছে।
২০০১ সালে সংগঠনটি এ দেশে আত্মপ্রকাশের পর থেকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ‘কুফর’ আখ্যায়িত করে তাদের ভাষায় ‘খিলাফত রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠার কথা বলত। তারা বিপুল অর্থ ব্যয়ে বিভিন্ন শীততাপ নিয়ন্ত্রিত মিলনায়তনে সভা-সেমিনার এবং প্রচারপত্রের মাধ্যমে কার্যক্রম চালাত। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় থেকে বিভিন্ন অজুহাতে রাস্তায় মিছিল-সমাবেশ করে শক্তিমত্তার মহড়া দিতে শুরু করে সংগঠনটি। এমনকি জরুরি অবস্থা ভঙ্গ করে রাজপথে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষেও লিপ্ত হয়েছিল তারা। ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রয়ারি পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহের পর সংগঠনটি সেনাবাহিনীকে উসকানি দিয়ে প্রচারণা চালায়।
২০ কর্ণধার: সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রমতে, আন্তর্জাতিক সংগঠন হিযবুত তাহ্রীরের বাংলাদেশের ২০ জন কর্ণধারের নাম পাওয়া গেছে। তাঁদের মধ্যে প্রধান সমন্বয়কারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মহিউদ্দিন আহমদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক গোলাম মাওলা (জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা), কাজী মোরশেদুল হক (যুগ্ম সমন্বয়কারী), মাওলানা মামুনুর রশীদ (গণসংযোগ সচিব), উপদেষ্টা মাহমুদুল বারী, আইন উপদেষ্টা এ এস এম আলাউদ্দিন, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মাওলানা রাকিব গ্রেপ্তার আছেন। রাজনৈতিক সচিব শেখ তৌফিক, কেন্দ্রীয় সংগঠক রাকিব (আইবিএ থেকে পাস করা), আল মামুন, আবদুল্লাহ, মনির হোসেন বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। মিডিয়া ও প্রচারসচিব মুস্তফা মিনহাজ বর্তমানে যুক্তরাজ্যে আছেন। কার্যকরি সদস্য সাখাওয়াত হোসেন, মামুনুর রশীদ আনছারী, আহমদ জামান, সাইদ, গোলাম মোস্তফা, ঢাকা মহানগর সমন্বয়কারী মো. শাহজালাল মিয়া। মহিলা শাখার সমন্বয়ক স্থপতি ফাহমিদা খানম। তাঁর স্বামী আমিনুল ইসলাম আবাসন ব্যবসা করেন। মহাখালী ডিওএইচএসে তাঁর কার্যালয়। সংগঠনের উপদেষ্টা মাহমুদুল বারী তাঁর ব্যবসায়িক অংশীদার।
সেনা যোগাযোগের মধ্যস্থতাকারী: মাহমুদুল বারী হিযবুত তাহ্রীরের সঙ্গে কতিপয় সেনা কর্মকর্তার যোগসূত্র গড়ে তোলার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন বলে অভিযোগ আছে। তিনি মালয়েশিয়ায় যাওয়ার সময় গত বছরের ১৭ জুলাই বিমানবন্দরে গ্রেপ্তার হন। ৩১ জুলাই ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। হাইকোর্ট থেকে জামিন নিয়ে গত ১৯ জানুয়ারি তিনি কারাগার থেকে বের হন।
৩১ জুলাই আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে মাহমুদুল বারী জানান, তাঁর মধ্যস্থতায় গত বছরের এপ্রিল অথবা মে মাসে গুলশানের থাই হাউস রেস্টুরেন্টে কয়েকজন অবসরপ্রাপ্ত ও কর্মরত সেনা কর্মকর্তার সঙ্গে হিযবুত তাহ্রীরের নেতাদের বৈঠক হয়। ওই কর্মকর্তাদের কেউ কেউ ওই সময়ে আটক হলে জুলাই মাসে বারী গা ঢাকা দেন এবং মালয়েশিয়ায় যাওয়ার পথে বিমানবন্দরে আটক হন।
মাহমুদুল বারীর জবানবন্দি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, একটি বেসরকারি বিমা কোম্পানির অবসরপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ইউএনডিপিতে চাকরি করে এমন এক ব্যক্তি, একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের উপদেষ্টা, ধানমন্ডির আরেকটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের অধ্যক্ষা, একটি বেসরকারি ব্যাংকের আইটি শাখার কর্মকর্তাও হিযবুত তাহ্রীরের সঙ্গে যুক্ত আছেন।
মাহমুদুল বারী জবানবন্দিতে বলেছেন, হিযবুত সদস্যরা যোগাযোগের ক্ষেত্রে ই-মেইল ও ইন্টারনেটে সামাজিক যোগাযোগ সাইট ও চ্যাট রুম ব্যবহার করেন।

No comments

Powered by Blogger.