চারদিক-আকাশবাণীর আবুল হোসেন ফকির
একাত্তরে যুদ্ধের খবর নিতে যাঁরা আকাশবাণীতে কান পাততেন, তাঁদের স্মৃতিপটে হয়তো আজও ভেসে আসে আবুল হোসেন ফকিরের সেই কণ্ঠ, ‘জবাব দাও পাকিস্তানি সরকার। রক্ষক যদি ভক্ষক হয়, মেহনতি মানুষেরা কিসের আশায় সেথায় বাঁধিবে ডেরা...’। ‘জবাব দাও’ শিরোনামে সকাল-সন্ধ্যায় নিয়মিত আকাশবাণীতে আবুল হোসেন ফকির কথিকা পড়তেন। এর পাণ্ডুলিপিও লিখতেন তিনি নিজেই। কথিকা পড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্বুদ্ধ করতেন।
আবুল হোসেনের স্মৃতিশক্তি খুবই প্রখর। বয়স হয়েছে ৭০। তার পরও এখনো খুঁটে খুঁটে সবই মনে করতে পারেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে নিজ এলাকা সাবেক পাবনা জেলার কাজিপুর থেকে তিনি সর্বপ্রথম সাত সদস্যের একটি দল নিয়ে হিলি সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেন। ওপারে সহায়ক সমিতি তাঁদের শুভেচ্ছা জানায়। নাম নিবন্ধন হলো, পরিচয়পত্র তৈরি করে দেওয়া হলো। সাংবাদিকতার সুবাদে কলকাতায় গিয়ে প্রথমেই তাঁর মনে পড়ল অজিত দাসের কথা। তিনি পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকার তৎকালীন কলকাতা ব্যুরোর প্রধান। বসতেন চৌরঙ্গীর টাওয়া হাউসে। আবুল হোসেন চলে গেলেন তাঁর কাছে। অজিত দাস সব শুনে তাঁকে নিয়ে গেলেন আকাশবাণীর সরল গুহর কাছে। সরল গুহ সেখানকার বড় কর্মকর্তা। তিনি একসময় চট্টগ্রামের মানুষ ছিলেন। মাতৃভূমির মানুষ পেয়ে সরল গুহ তাঁকে জড়িয়ে ধরলেন। পরিচয় করিয়ে দিলেন কিংবদন্তি সংবাদ পাঠক দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, পার্থ ঘোষ, প্রণবেশ সেন, অঞ্জন ঘোষসহ আরও অনেকের সঙ্গে। প্রণবেশ সেন সুচিত্রা সেনের বংশধর ছিলেন। পৈতৃক নিবাস ছিল পাবনায়। আবুল হোসেন ফকিরেরও পৈতৃক নিবাস বৃহত্তর পাবনায়। তাঁরা তাঁকে আপন করে নিলেন। সরল গুহ পরিকল্পনা করলেন, আকাশবাণী থেকে আবুল হোসেন ফকির প্রতিদিন ‘জবাব দাও’ শিরোনামে একটি কথিকা পড়বেন। এটি সকালে একবার বাজবে, রাতে আবার পুনঃপ্রচার হবে। প্রথমবার প্রচার হলে সম্মানী পাবেন ২৫ টাকা। আর পুনঃপ্রচার হলে পাবেন ছয় টাকা ২৫ পয়সা। নয় মাসব্যাপী তাঁর এ কাজের জন্য লন্ডন টাইমস-এর তৎকালীন বিশেষ প্রতিনিধি মি. পিটার হ্যাজাল হার্ট আবুল হোসেন ফকিরের একটি বিশেষ সাক্ষাৎকার নেন। এতে সে সময়ের পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও রাজাকারদের নৃশংসতার কাহিনি উঠে আসে। তাঁর সাক্ষাৎকারটি প্রথমে লন্ডন টাইমস-এ ছাপা হয় এবং পরে কলকাতার স্টেটসম্যান পত্রিকায় পুনর্মুদ্রিত হয়। ভারত সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত বাংলাদেশ ডকুমেন্ট বইয়ে সাক্ষাৎকারটি রয়েছে।
আবুল হোসেন ফকির ষাটের দশকের মাঝামাঝি সাংবাদিকতা পেশায় যোগদান করেন। তার পর থেকে বিভিন্ন সময়ে ঢাকার দৈনিক আজাদ, পাকিস্তান অবজারভার, বাংলাদেশ অবজারভার, দৈনিক পূর্বদেশ এবং যুদ্ধ চলাকালে তিনি মুজিবনগর থেকে প্রকাশিত দাবানল, লিবারেশন ও জয়যাত্রা পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি সরকারি মালিকানাধীন সংবাদপত্র ব্যবস্থাপনা বোর্ডের মূল্যায়ন ও গবেষণা বিভাগেরও দায়িত্ব পালন করেন। তিনি শিশু-কিশোর মাসিক ময়ূরপঙ্খী ও সুদীপ্ত পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে তিনি ‘নতুন দা’ ও ‘নতুন ভাই’ হিসেবে ঢাকায় শহীদ স্মৃতি সংঘের দায়িত্ব পালন করেন।
সর্বশেষ রাজশাহী থেকে প্রকাশিত দৈনিক বার্তা পত্রিকায় প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে শুরু করে বন্ধ হওয়া পর্যন্ত সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সেই সুবাদে এখন স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন রাজশাহীতে। এত দিন পরও মুক্তিযুদ্ধের সব স্মৃতিচিহ্ন রেখে দিয়েছেন তিনি। আকাশবাণীর সেই কন্ট্রাক্টপত্র, যাতে আবুল হোসেনের পুরো নাম না লিখে লেখা হয়েছে শ্রী আবুল হোসেন—সব আছে তাঁর কাছে। কোনো কোনোটির কিছু অংশ ছিঁড়ে গেছে। তিনি যত্ন করে আঠা দিয়ে জোড়া দিয়ে রেখেছেন। স্বাধীনতার ৪০ বছর পূর্তির সময় এই ঐতিহাসিক কাগজগুলোয় হাত দিলে শরীরে একধরনের শিহরণ জাগছে। একইভাবে তিনি অসীম মমতায় রেখে দিয়েছেন তাঁর মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের ব্যাপারে তৎকালীন বাংলাদেশ সরকারের যোগাযোগমন্ত্রী এম মনসুর আলী, সিরাজগঞ্জ থেকে নির্বাচিত জাতীয় পরিষদের সদস্য মোতাহার হোসেন তালুকদার, সে সময়ের বাংলাদেশ মিশনের কলকাতার প্রধান, বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রাম সহায়ক সমিতির কলকাতার কেন্দ্রীয় কার্যালয় ও বালুরঘাট শাখা এবং ভারত সরকারের স্বরাষ্ট্র দপ্তরের অনুমতিপত্র, বাংলাদেশ সরকারের সে সময়ের কেন্দ্রীয় সাহায্য ও পুনর্বাসন দপ্তরের প্রত্যয়নপত্র—সবকিছুই। রয়েছে বিদেশি পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর সেই সাক্ষাৎকারের কপিও। কিন্তু এই খেয়ালি মানুষটি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সনদপত্রটি কখনোই সংগ্রহ করার প্রয়োজন মনে করেননি। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন অনেক পরে। দেরিতেই তিনি দুই ছেলে ও এক মেয়ের বাবা হয়েছেন। এখন ছেলেমেয়েরা বলছেন, ‘বাবা, তুমি মারা যাওয়ার পর কোনো প্রমাণ থাকবে না যে তুমি মুক্তিযুদ্ধ করেছিলে। আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে পরিচয় দিতে চাই।’ সন্তানদের কথা ভেবে আবুল হোসেন ফকির তাঁর সব প্রমাণপত্র নিয়ে কয়েকবার মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটির সামনে উপস্থিত হয়েছেন। বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলে জমাকৃত প্রথম তালিকায় সিরাজগঞ্জ জেলার কাজিপুর উপজেলার গান্ধাইল ইউনিয়নের মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় তাঁর নাম রয়েছে, যার সূচক নম্বর ৮৮-৫০-২৫-০১০।
চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর জন্য নয়, জীবনসায়াহ্নে এসে শুধু স্বীকৃতির জন্য আবুল হোসেনের একটা সনদের প্রয়োজন।
আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ
আবুল হোসেন ফকির ষাটের দশকের মাঝামাঝি সাংবাদিকতা পেশায় যোগদান করেন। তার পর থেকে বিভিন্ন সময়ে ঢাকার দৈনিক আজাদ, পাকিস্তান অবজারভার, বাংলাদেশ অবজারভার, দৈনিক পূর্বদেশ এবং যুদ্ধ চলাকালে তিনি মুজিবনগর থেকে প্রকাশিত দাবানল, লিবারেশন ও জয়যাত্রা পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি সরকারি মালিকানাধীন সংবাদপত্র ব্যবস্থাপনা বোর্ডের মূল্যায়ন ও গবেষণা বিভাগেরও দায়িত্ব পালন করেন। তিনি শিশু-কিশোর মাসিক ময়ূরপঙ্খী ও সুদীপ্ত পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে তিনি ‘নতুন দা’ ও ‘নতুন ভাই’ হিসেবে ঢাকায় শহীদ স্মৃতি সংঘের দায়িত্ব পালন করেন।
সর্বশেষ রাজশাহী থেকে প্রকাশিত দৈনিক বার্তা পত্রিকায় প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে শুরু করে বন্ধ হওয়া পর্যন্ত সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সেই সুবাদে এখন স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন রাজশাহীতে। এত দিন পরও মুক্তিযুদ্ধের সব স্মৃতিচিহ্ন রেখে দিয়েছেন তিনি। আকাশবাণীর সেই কন্ট্রাক্টপত্র, যাতে আবুল হোসেনের পুরো নাম না লিখে লেখা হয়েছে শ্রী আবুল হোসেন—সব আছে তাঁর কাছে। কোনো কোনোটির কিছু অংশ ছিঁড়ে গেছে। তিনি যত্ন করে আঠা দিয়ে জোড়া দিয়ে রেখেছেন। স্বাধীনতার ৪০ বছর পূর্তির সময় এই ঐতিহাসিক কাগজগুলোয় হাত দিলে শরীরে একধরনের শিহরণ জাগছে। একইভাবে তিনি অসীম মমতায় রেখে দিয়েছেন তাঁর মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের ব্যাপারে তৎকালীন বাংলাদেশ সরকারের যোগাযোগমন্ত্রী এম মনসুর আলী, সিরাজগঞ্জ থেকে নির্বাচিত জাতীয় পরিষদের সদস্য মোতাহার হোসেন তালুকদার, সে সময়ের বাংলাদেশ মিশনের কলকাতার প্রধান, বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রাম সহায়ক সমিতির কলকাতার কেন্দ্রীয় কার্যালয় ও বালুরঘাট শাখা এবং ভারত সরকারের স্বরাষ্ট্র দপ্তরের অনুমতিপত্র, বাংলাদেশ সরকারের সে সময়ের কেন্দ্রীয় সাহায্য ও পুনর্বাসন দপ্তরের প্রত্যয়নপত্র—সবকিছুই। রয়েছে বিদেশি পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর সেই সাক্ষাৎকারের কপিও। কিন্তু এই খেয়ালি মানুষটি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সনদপত্রটি কখনোই সংগ্রহ করার প্রয়োজন মনে করেননি। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন অনেক পরে। দেরিতেই তিনি দুই ছেলে ও এক মেয়ের বাবা হয়েছেন। এখন ছেলেমেয়েরা বলছেন, ‘বাবা, তুমি মারা যাওয়ার পর কোনো প্রমাণ থাকবে না যে তুমি মুক্তিযুদ্ধ করেছিলে। আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে পরিচয় দিতে চাই।’ সন্তানদের কথা ভেবে আবুল হোসেন ফকির তাঁর সব প্রমাণপত্র নিয়ে কয়েকবার মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটির সামনে উপস্থিত হয়েছেন। বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলে জমাকৃত প্রথম তালিকায় সিরাজগঞ্জ জেলার কাজিপুর উপজেলার গান্ধাইল ইউনিয়নের মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় তাঁর নাম রয়েছে, যার সূচক নম্বর ৮৮-৫০-২৫-০১০।
চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর জন্য নয়, জীবনসায়াহ্নে এসে শুধু স্বীকৃতির জন্য আবুল হোসেনের একটা সনদের প্রয়োজন।
আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ
No comments