আয়-ব্যয়ের ভারসাম্যটা জরুরি-টাকা ছাপিয়ে চলা আর কত দিন?

রকার ব্যয় মেটানোর জন্য প্রয়োজনে নতুন টাকা ছাপিয়ে নেয়। সরকারের পক্ষে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই কাজটি করে। এটা নতুন কোনো ঘটনা নয়। পৃথিবীর সব অর্থনীতিতেই কমবেশি ঘটে থাকে। বাংলাদেশে অতীতেও ঘটেছে, এখনো ঘটছে। তবে সাম্প্রতিককালে টাকা ছাপিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরাসরি ঋণ করার প্রবণতাটি একটি বড় ধরনের অশনিসংকেত হিসেবে দেখা দিয়েছে। কেননা, বিভিন্ন ধরনের ব্যয় মেটাতে পর্যাপ্ত আয়-উপার্জন সরকারের নেই।


এ অবস্থায় নির্বিচারে টাকা ছাপিয়ে অনেকটা ব্যয় মেটানো হয়তো যায়, কিন্তু তা কোনো টেকসই সমাধান নয়। বরং তাতে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার বাড়তি ঝুঁকি তৈরি হয়। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এখন সেই অবস্থাই দেখা দিয়েছে।
সর্বশেষ, গত সোমবার সংসদীয় কমিটির বৈঠকেও এ রকম কথাই বলা হলো। অবশ্য বেশ অনেক দিন ধরেই অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা এই কথাগুলো বলে আসছেন। তাতে সরকারের দিক থেকে তেমন একটা কর্ণপাত করা হয়নি। হওয়ার কথাও নয়; কেননা, বিভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক বিবেচনায় ও লোকদেখানো প্রচেষ্টায় সরকার অনেকগুলো প্রকল্পে হাত দিয়েছে, যার মধ্যে আছে কিছু বিরাট নির্মাণ-প্রকল্প। এগুলোর ব্যয়ভার মেটাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে। ফ্লাইওভার আর দ্রুত ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র নির্মাণের জন্য উচ্চহারে ব্যয় মেটানোও এর অন্যতম কারণ। আবার হাতে নেওয়া হয়েছে কিছু অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পও। এভাবে ব্যয়ভার বেড়ে গেছে। নিয়মিত প্রশাসনিক ব্যয় মেটানোর চাপ তো রয়েছেই। এ রকম একটা পরিস্থিতিতে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে রাজস্ব আয়, বিশেষত আয়কর ও মূল্য সংযোজন কর যা বাড়ছে, তা এসব ব্যয়ভার মেটানোর জন্য পর্যাপ্ত নয়। আবার উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যয় মেটানোর জন্য যে বিদেশি সহায়তার প্রত্যাশা ছিল, তা বাস্তবে মেলেনি। আর তাই ক্রমাগত ঋণ সৃষ্টি করছে সরকার।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরাসরি ঋণ নেওয়ার ঝুঁকির দিকটি হলো মূল্যস্ফীতি। মাসওয়ারি মূল্যস্ফীতির হার ছয় মাস ধরে ১০ শতাংশের ওপরে রয়েছে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে সরকার একদিকে ভর্তুকির চাপ কমানোর চেষ্টা করলেও অন্যদিকে জনজীবনে বড় বিপর্যয় তৈরি করা হয়েছে। বেড়ে গেছে পরিবহন ব্যয়। মানুষের যাতায়াত যেমন ব্যয়বহুল হয়ে পড়েছে, তেমনি বেড়েছে বিভিন্ন নিত্যপণ্যের দাম। প্রকট আয়বৈষম্যের এই দেশে কিছু মানুষের হাতে এত অর্থ যে, কোনো চাহিদা-ব্যবস্থাপনাই তাদের জন্য কার্যকর নয়। আর তাই দাম বাড়তে থাকলেও তাতে চাহিদার সংকোচন ঘটে না। এই অবস্থায় সরকার টাকা ছাপিয়ে যখন ঋণ নিচ্ছে, তখন তা অনিবার্যভাবে বাজারে টাকার সরবরাহ তিন-চার গুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। এই টাকা যাচ্ছে বিভিন্ন হাতে, যা অনেক ক্ষেত্রে চাহিদা বাড়াচ্ছে। অথচ বাংলাদেশ ব্যাংক মুদ্রানীতিকে ক্রমাগত নিয়ন্ত্রণমূলক করে মূল্যস্ফীতি প্রশমনের চেষ্টা করছে। অর্থাৎ, মূল্যস্ফীতি প্রশমনে সরকারের পদক্ষেপগুলো সমন্বয়হীন হয়ে পড়েছে বলে প্রতীয়মান হয়।
কিছুদিন আগে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত অর্থনীতিতে বিভিন্ন ঝুঁকির কথা স্বীকার করেছেন এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তাতে মনে হয়েছে যে সরকার অবশ্যই পরিস্থিতির গুরুত্ব সম্যকভাবে উপলব্ধি করছে; আর তাই এখন কিছু দৃঢ় ও পরিকল্পিত পদক্ষেপ নেওয়া হবে। তবে সংসদীয় কমিটির বৈঠকের মধ্য দিয়ে বোঝা গেল, সার্বিক অর্থনীতি নিয়ে সবাই কমবেশি উদ্বিগ্ন; যদিও বৈঠক শেষ হওয়ার আগে অর্থমন্ত্রীর চলে যাওয়া ছোট্ট একটি প্রশ্ন রেখে দিয়েছে। কালক্ষেপণ না করে আয়-ব্যয়ের ভারসাম্য আনতে অর্থবহ পদক্ষেপই এখন কাম্য, যা অনেক ক্ষেত্রেই অজনপ্রিয় হতে পারে।

No comments

Powered by Blogger.