পদ-পদবি ও মজুরিতে নারী পদে পদে বৈষম্যের শিকার- লিঙ্গবৈষম্য ৩ by শাহ আলম খান
শ্রমিকের ঘাম সীমাহীন ত্যাগ ও তিক্ততার। এ
সত্যটি অস্বীকার করার উপায় নেই। পুরুষ শ্রমের চেয়ে নারী শ্রমের উপাখ্যান
আরও করুণ। অনন্যোপায় হয়েই একজন নারী তার শরীর থেকে ঘাম ঝড়াতে বাধ্য হয়।
তবে নারীর ঘামে ভেজা শ্রমের অর্জিত আয়ে তার ওপর নির্ভরশীল বৃদ্ধ বাবা-মা,
সন্তান কিংবা অৰম স্বামীকে সমৃদ্ধির ছোঁয়া দিতে না পারলেও মালিক হয়েছে আরও
তাজা। দেশকে দিচ্ছে সমৃদ্ধি। কর্মৰেত্রে দেশ গড়ার হাতিয়ার নারী শ্রমিকের
সান্তনা এখানেই।
বিদ্যমান হাজারও বাধা-বিপত্তি উপেৰা করে তাই সাহসী নারী প্রতিনিয়ত ঘর ছেড়ে অংশ নিচ্ছে বাইরের কর্মকাণ্ডে। ইদানীং নারী ছাড়া ঘুরছে না কোন শিল্প-কারখানার চাকা। পুরম্নষের পাশাপাশি এরাও জীবন-জীবিকার তাগিদে সমানতালে এগিয়ে চলেছে স্বনির্ভরতার লড়াইয়ে। বিনিময়ে তারা কর্মৰেত্রে নানাভাবে হচ্ছে লাঞ্ছিত। থাকছে না চাকরির নিরাপত্তা। পদ ও পদবি এবং মজুরি প্রাপ্তিতেও পদে পদে হচ্ছে পাহাড়সম বৈষম্যের শিকার। তবু পিছিয়ে নেই নারী শ্রমিকরা।
তবে এটি সত্য, পুরম্নষ-মহিলাদের কর্মকাঠামো অনুযায়ী মহিলাদের কর্মপরিসর অতি সীমিত। লেবার ফোর্স সার্ভে ১৯৯০-৯১ অনুযায়ী দেখা গেছে সে সময়ে শহরে ৬৪% গ্রামে ৮৭% এবং কৃষিতে ৮.৮% ও শিল্পে ৮.৫% মহিলা নিযুক্ত ছিল। এর পর থেকে অবশ্য সামগ্রিক নারী কর্মসংস্থান বছর বছরই বেড়েছে। লেবার ফোর্স সার্ভে ১৯৯৯-২০০০ অনুযায়ী মোট নারী কর্মসংস্থান ছিল ৮.৬ মিলিয়ন। ২০০২-০৩ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০.৩ মিলিয়ন। লেবার ফোর্স সার্ভের সর্বশেষ পরিচালিত জরিপ অনুযায়ী ২০০৫-০৬ সালে সামগ্রিক নারী কর্মসংস্থান ছিল ১২.১ মিলিয়ন। সংশিস্নষ্ট সূত্রমতে, বর্তমানে তা দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়ে ২৫ মিলিয়নে উন্নীত হয়েছে।
জরিপে দেখা গেছে, ৪০.৭ শতাংশ কারখানার নারী শ্রমিকদের সমমজুরি প্রদান করা হয় না। ৬০.৫ শতাংশ কারখানায় নারী শ্রমিকদের পদোন্নতি প্রদানের সময় বৈষম্যের শিকার হতে হয়। ৯৮.৬৪ শতাংশ কারখানায় নূ্যনতম মজুরি দেয়া হচ্ছে মাত্র ১৬শ' ৬২ টাকা।
এই কঠিন বাসত্মবতা সত্ত্বেও স্রোতের মতোই নারীরা ভিড়ছে এসব কর্মযজ্ঞে। প্রতিদিন, সপ্তাহ, মাস ও বছর কোন সময়ই থেমে থাকছে না তাদের কর্মযজ্ঞে ভেড়ার এই স্রোত।
বাংলাদেশের শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী ১৯৯০-২০০০ সালে নারী শ্রমশক্তি ছিল মোট ৮০ লাখ ৬০ হাজার জন। মোট শ্রমশক্তির মধ্যে এই হার ছিল ২১ শতাংশ। ২০০২-০৩ সালে নারী শমিকের সংখ্যা বেড়ে মোট ১ কোটি ৩০ লাখে উন্নীত হয়। এ সময় বাংলাদেশে ১৫ বছরের উর্ধে মোট ৪ কোটি ৪৩ লাখ শ্রমশক্তি বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত ছিল। এর মধ্যে ৩ কোটি ৪৫ লাখ পুরম্নষ। আর নারী শ্রমিকের সংখ্যা ছিল মোট ৯৮ লাখ। আনত্মর্জাতিক শ্রম সংস্থার তথ্যানুযায়ী নারী শ্রমিকের এই হার আরও বেশি ছিল। সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী বর্তমানে এই নারী শ্রমিকের সংখ্যা আড়াই কোটিতে উন্নীত হয়েছে। এই পরিসংখ্যান থেকেই সহজে অনুমেয়, প্রতিনিয়ত কিভাবে কর্মসংস্থানে যোগ হচ্ছে নারী শ্রম।
নারী শ্রমের অপ্রতিরোধ্য এই শ্রমবাজারেও নেই কাঙ্ৰিত পদ, পদবি ও প্রাপ্তি। পাহাড়সম নারী শ্রমের এই হাটেও মাত্র ১০ হাজার নারী নিয়োজিত রয়েছে প্রশাসনিক ও ব্যবস্থাপনা পেশায়। বাকি নারী শ্রমের প্রায় সবাই অধঃসত্মন কিংবা শ্রমিক হিসেবে কর্মরত । সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে, ৭৯ শতাংশ নারী কাজ করে কৃষি খাতে (মৎস্য ও বনায়নসহ)। ৯.৯ শতাংশ নারী ম্যানুফ্যাকচারিং ও পরিবহন খাতে, ২.২ শতাংশ নারী বিপণন কাজে ও ০.৬ শতাংশ নারী নিয়োজিত করণিক পর্যায়ের কাজে। ৰুদ্র ও কুটির শিল্পে কর্মরতদের প্রায় ৩৪ শতাংশ নারী। শহরকেন্দ্রিক শ্রমনির্ভর বিশেষ করে পোশাক শিল্পের ৮০ শতাংশ কাজ করে নারী শ্রমিক।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্ট্যাডিজের (বিআইডিএস) অধিকাংশ গবেষকের এ ব্যাপারে মনত্মব্য 'আনত্মর্জাতিক প্রতিযোগিতা, নারী শ্রমঘন রফতানিমুখী শিল্পের প্রসার ও অভ্যনত্মরীণ নীতিমালার প্রভাব, নারী শ্রমবাজারে চাহিদা এবং যোগান পরিস্থিতির ফলেই মহিলাদের কর্মসংস্থানের ব্যাপক সুযোগ ঘটেছে।'
তাদের মতে, রফতানিমুখী শিল্পের গুরম্নত্ব বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অধিকাংশ এশীয় দেশের মতো আনত্মর্জাতিকীকরণ এবং নারীয়ায়নের দিকগুলো বাংলাদেশের জন্যও গুরম্নত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কিন্তু শিল্পে নারীয়ায়নের মূল কারণ হচ্ছে মহিলাদের কম মজুরি, অধিকতর বাধ্যতা ও তাদের গৌণ রোজগারকারীর ভূমিকা। মূলত এ কারণেই কাজের ৰেত্রে পাহাড়সম লিঙ্গ বৈষম্য তৈরি হয়েছে। কারখানা মালিকরা না চাইতেই অধিক শ্রমিকের যোগান খুব সহজেই পেতে শুরম্ন করায় নারীরা পদ, পদবি ও মজুরির ৰেত্রে এই বৈষম্যের শিকার হচ্ছে।
এদিকে নারী শ্রমিকের মজুরি কম প্রদান করেও পরিতৃপ্ত নয় কারখানার মালিক কিংবা তার উর্ধতন পরিচালক ও কর্মকর্তারা। পদ ও পদবির অপব্যবহার ঘটিয়ে কারণে-অকারণে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে দুর্ব্যবহার করা হয় নারী শ্রমিকের সঙ্গে। ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, উদ্দেশ্য একটাই আর তা হচ্ছে- বিকৃত চিনত্মা ও উদ্দেশ্যের বাসত্মব প্রয়োগ ঘটানো।
এ বিষয়ে কর্মজীবী নারী পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, রাজধানী ও তার আশপাশ এলাকার ৪৬.১ শতাংশ কারখানার মালিক কিংবা পরিচালক অথবা তাদের উর্ধতন কর্মকর্তা-কর্মচারী নারী শ্রমিকদের মারধর, চড়-থাপ্পড়, জিনিসপত্র ছুঁড়ে মারা, অতিরিক্ত কাজ প্রদান, কর্ম সময়ের বাইরে অতিরিক্ত কাজ প্রদান, অযথা শরীরে হাত দেয়ার মাধ্যমে শারীরিক নির্যাতন করে থাকে। এ ব্যাপারে ভুক্তভোগী ৭৫.৯ শতাংশ কারখানার নারী শ্রমিকের মনত্মব্য, দোষ না পাওয়া সত্ত্বেও উর্ধতনরা শুধুমাত্র অসৎ উদ্দেশে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ, চিৎকার করে গালি দেয়া ও অশোভন ইঙ্গিত করে নারী শ্রমিকদের মানসিকভাবে নির্যাতন করার চেষ্টা করেন; যাতে তাদের উদ্দেশ্যটি সহজেই বাগে পাওয়া যায়।
প্রতিকূলতার এখানেই শেষ নয়। কম মজুরিও সময়মতো প্রদান করা হয় না। ওই জরিপে দেখা গেছে, ৪৭.৫ শতাংশ মালিক পরবতর্ী মাসের সাত কর্মদিবসের মধ্যে বেতন প্রদান করে। বাকিরা নেয় দীর্ঘসূত্রতার পথ। কিন্তু ৪৬.৬ শতাংশ শ্রমিকেরই তাতে ঘোরতর অভিযোগ, মাসিক মজুরির সঙ্গে ওভারটাইম মজুরি এক সঙ্গে প্রদান করা হয় না।
অথচ শ্রম আইন-২০০৬-এর ১২৩(১) ধারায় বলা হয়েছে- প্রত্যেক শ্রমিককে পরবতর্ী মাসের ৭ কর্মদিবসের মধ্যে বকেয়া মজুরি পরিশোধ করতে হবে। এই ধারা লঙ্ঘন করা হলে একজন শ্রমিক তার বকেয়া মজুরি আদায় করার জন্য এখতিয়ারাধীন শ্রম আদালতে দরখাসত্ম করতে পারবেন।
শ্রম আইন-২০০৬-এর শ্রমিকদের সাপ্তাহিক, নৈমিত্তিক ও মাতৃত্বকালীন ছুটির সুযোগ-সুবিধার ব্যাপারেও জোর দিয়েছে। কিন্তু কারখানাগুলোতে বাসত্মবতা একেবারেই ভিন্ন। আইন মানার প্রবণতা কারও মধ্যেই চোখে পড়ে না। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, অধিক মুনাফার লৰ্যে মালিকদের মানবতা ও বিবেক অন্ধ হয়ে গেছে। জরিপে জানা যায়, ৪১.৮০ শতাংশ কারখানা শ্রমিকদের সাপ্তাহিক ছুটি, ২৮.৯০ শতাংশ কারখানা নৈমিত্তিক ছুটি এবং অসুস্থতাজনিত ছুটি মঞ্জুর করে থাকে। কিন্তু তাতেও রয়েছে গলদ। এ ব্যাপারে ৫৮.২ শতাংশ শ্রমিকের মনত্মব্য, কাজের চাপ থাকলে বিশেষ করে শিপমেন্টের সময় কোন সাপ্তাহিক ছুটি দেয়া হয় না। নৈমিত্তিক ছুটির বিষয়ে ৭০.৯ শতাংশ শ্রমিকের মনত্মব্য, এই ছুটি শুধুমাত্র উচ্চপদে কর্মরতরাই ভোগ করেন। সাধারণ শ্রমিকদের তা প্রদান করা হয় না। অসুস্থতার ছুটির বিষয়ে ৪৬.১ শতাংশ শ্রমিকের মনত্মব্য, কর্মরত অবস্থায় গুরম্নতর অসুস্থ হলেই কেবল ছুটি পাওয়া যায়। কিন্তু বাসায় অসুস্থ হলে কিংবা অসুস্থতাজনিত কারণে অনুপস্থিত থাকলে বেতন কেটে নেয়া হয়।
মাতৃত্বকল্যাণ সুবিধার ৰেত্রে মাতৃত্বজনিত ছুটি প্রদানের ৰেত্রে মাত্র ৪৭ শতাংশ কারখানা একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ মজুরি মাতৃকল্যাণ সুবিধা হিসেবে নারী শ্রমিকদের প্রদান করে। এই ৰেত্রে ১৩.৯ শতাংশ শ্রমিকের মনত্মব্য, কারখানা কর্তৃপৰ কোন নারী শ্রমিক গর্ভবতী হয়েছে জানতে পারলে যেকোন কারণ দেখিয়ে তাকে চাকরিচু্যত করে; যাতে মালিককে মাতৃত্বকল্যাণ সুবিধা প্রদান করতে না হয়।
এ ব্যাপারে শ্রম আইনের ৪৫(১) ধারায় বলা হয়েছে- কোন মালিক কোন নারী শ্রমিককে সনত্মান প্রসবের পরবতর্ী ৮ সপ্তাহের মধ্যে কোনরূপ কাজ করাতে পারবেন না। ৪৫(২) ধারানুযায়ী অনুরূপ ৰেত্রে কোন মহিলা কাজ করবেন না। কোন মালিক আইনের এই বিধান লঙ্ঘন করলে ৫ হাজার টাকা পর্যনত্ম অর্থদ-ে দ-িত হবেন (ধারা ২৮৬)।
বাংলাদেশ লিগ্যাল এ্যাইড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (বস্নাস্ট) উপ-পরিচালক এ্যাডভোকেট ফরিদা ইয়াসমিন জানান, নারী শ্রমিকদের জন্য দেখা যায় আইন অকার্যকর। নতুন শ্রম আইনেও তারা বঞ্চিত। মাতৃত্বকালীন ছুটি তারা ঠিকমতো পায় না। আইন থাকলেও বাসত্মবায়নের কোন পদৰেপ নেই।
কর্মপরিবেশ ও পরিচ্ছন্নতাও নারী শ্রমিকের জন্য বড় বাধা। মাত্র ৪৭.৭ শতাংশ কারখানার নারী ও পুরম্নষ শ্রমিকের জন্য আলাদা আলাদা টয়লেট ব্যবস্থা রয়েছে। বাকি কারখানাগুলো নারী-পুরম্নষ এক সঙ্গেই ব্যবহার করে থাকে। এ ৰেত্রে আলাদা টয়লেট সুবিধা থেকে বঞ্চিত নারী শ্রমিকরা প্রতিনিয়তই থাকে আতঙ্কের মধ্যে। অন্যদিকে ৭৪.৮ শতাংশ কারখানার টয়লেট পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকে না। এমনকি কোন সাবান রাখারও ব্যবস্থা থাকে না। আর মাত্র ৪৭.৭ শতাংশ কারখানায় বিশুদ্ধ খাবার পানি সরবরাহ করে। এছাড়া ৫৪.১ শতাংশ কারখানা শ্রমিকদের খাবারের জন্য আলাদা কৰের ব্যবস্থা রেখেছে।
তবে বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ সংশিস্নষ্টরা এ কথা মানতে নারাজ। তাদের মতে, সারাদেশে প্রায় ৯ হাজার গার্মেন্ট শিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এ দু'টি সংগঠনের অনত্মভর্ুক্ত সকল সদস্যই তাদের কারখানায় যাবতীয় কমপস্নায়েন্স সচল রেখেছেন। বিচ্ছিন্ন কিছু প্রতিষ্ঠান থাকতে পারে। অবশ্য এর জন্য ওই সকল প্রতিষ্ঠানের খেসারতও দিতে হচ্ছে।
বিদ্যমান হাজারও বাধা-বিপত্তি উপেৰা করে তাই সাহসী নারী প্রতিনিয়ত ঘর ছেড়ে অংশ নিচ্ছে বাইরের কর্মকাণ্ডে। ইদানীং নারী ছাড়া ঘুরছে না কোন শিল্প-কারখানার চাকা। পুরম্নষের পাশাপাশি এরাও জীবন-জীবিকার তাগিদে সমানতালে এগিয়ে চলেছে স্বনির্ভরতার লড়াইয়ে। বিনিময়ে তারা কর্মৰেত্রে নানাভাবে হচ্ছে লাঞ্ছিত। থাকছে না চাকরির নিরাপত্তা। পদ ও পদবি এবং মজুরি প্রাপ্তিতেও পদে পদে হচ্ছে পাহাড়সম বৈষম্যের শিকার। তবু পিছিয়ে নেই নারী শ্রমিকরা।
তবে এটি সত্য, পুরম্নষ-মহিলাদের কর্মকাঠামো অনুযায়ী মহিলাদের কর্মপরিসর অতি সীমিত। লেবার ফোর্স সার্ভে ১৯৯০-৯১ অনুযায়ী দেখা গেছে সে সময়ে শহরে ৬৪% গ্রামে ৮৭% এবং কৃষিতে ৮.৮% ও শিল্পে ৮.৫% মহিলা নিযুক্ত ছিল। এর পর থেকে অবশ্য সামগ্রিক নারী কর্মসংস্থান বছর বছরই বেড়েছে। লেবার ফোর্স সার্ভে ১৯৯৯-২০০০ অনুযায়ী মোট নারী কর্মসংস্থান ছিল ৮.৬ মিলিয়ন। ২০০২-০৩ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০.৩ মিলিয়ন। লেবার ফোর্স সার্ভের সর্বশেষ পরিচালিত জরিপ অনুযায়ী ২০০৫-০৬ সালে সামগ্রিক নারী কর্মসংস্থান ছিল ১২.১ মিলিয়ন। সংশিস্নষ্ট সূত্রমতে, বর্তমানে তা দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়ে ২৫ মিলিয়নে উন্নীত হয়েছে।
জরিপে দেখা গেছে, ৪০.৭ শতাংশ কারখানার নারী শ্রমিকদের সমমজুরি প্রদান করা হয় না। ৬০.৫ শতাংশ কারখানায় নারী শ্রমিকদের পদোন্নতি প্রদানের সময় বৈষম্যের শিকার হতে হয়। ৯৮.৬৪ শতাংশ কারখানায় নূ্যনতম মজুরি দেয়া হচ্ছে মাত্র ১৬শ' ৬২ টাকা।
এই কঠিন বাসত্মবতা সত্ত্বেও স্রোতের মতোই নারীরা ভিড়ছে এসব কর্মযজ্ঞে। প্রতিদিন, সপ্তাহ, মাস ও বছর কোন সময়ই থেমে থাকছে না তাদের কর্মযজ্ঞে ভেড়ার এই স্রোত।
বাংলাদেশের শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী ১৯৯০-২০০০ সালে নারী শ্রমশক্তি ছিল মোট ৮০ লাখ ৬০ হাজার জন। মোট শ্রমশক্তির মধ্যে এই হার ছিল ২১ শতাংশ। ২০০২-০৩ সালে নারী শমিকের সংখ্যা বেড়ে মোট ১ কোটি ৩০ লাখে উন্নীত হয়। এ সময় বাংলাদেশে ১৫ বছরের উর্ধে মোট ৪ কোটি ৪৩ লাখ শ্রমশক্তি বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত ছিল। এর মধ্যে ৩ কোটি ৪৫ লাখ পুরম্নষ। আর নারী শ্রমিকের সংখ্যা ছিল মোট ৯৮ লাখ। আনত্মর্জাতিক শ্রম সংস্থার তথ্যানুযায়ী নারী শ্রমিকের এই হার আরও বেশি ছিল। সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী বর্তমানে এই নারী শ্রমিকের সংখ্যা আড়াই কোটিতে উন্নীত হয়েছে। এই পরিসংখ্যান থেকেই সহজে অনুমেয়, প্রতিনিয়ত কিভাবে কর্মসংস্থানে যোগ হচ্ছে নারী শ্রম।
নারী শ্রমের অপ্রতিরোধ্য এই শ্রমবাজারেও নেই কাঙ্ৰিত পদ, পদবি ও প্রাপ্তি। পাহাড়সম নারী শ্রমের এই হাটেও মাত্র ১০ হাজার নারী নিয়োজিত রয়েছে প্রশাসনিক ও ব্যবস্থাপনা পেশায়। বাকি নারী শ্রমের প্রায় সবাই অধঃসত্মন কিংবা শ্রমিক হিসেবে কর্মরত । সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে, ৭৯ শতাংশ নারী কাজ করে কৃষি খাতে (মৎস্য ও বনায়নসহ)। ৯.৯ শতাংশ নারী ম্যানুফ্যাকচারিং ও পরিবহন খাতে, ২.২ শতাংশ নারী বিপণন কাজে ও ০.৬ শতাংশ নারী নিয়োজিত করণিক পর্যায়ের কাজে। ৰুদ্র ও কুটির শিল্পে কর্মরতদের প্রায় ৩৪ শতাংশ নারী। শহরকেন্দ্রিক শ্রমনির্ভর বিশেষ করে পোশাক শিল্পের ৮০ শতাংশ কাজ করে নারী শ্রমিক।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্ট্যাডিজের (বিআইডিএস) অধিকাংশ গবেষকের এ ব্যাপারে মনত্মব্য 'আনত্মর্জাতিক প্রতিযোগিতা, নারী শ্রমঘন রফতানিমুখী শিল্পের প্রসার ও অভ্যনত্মরীণ নীতিমালার প্রভাব, নারী শ্রমবাজারে চাহিদা এবং যোগান পরিস্থিতির ফলেই মহিলাদের কর্মসংস্থানের ব্যাপক সুযোগ ঘটেছে।'
তাদের মতে, রফতানিমুখী শিল্পের গুরম্নত্ব বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অধিকাংশ এশীয় দেশের মতো আনত্মর্জাতিকীকরণ এবং নারীয়ায়নের দিকগুলো বাংলাদেশের জন্যও গুরম্নত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কিন্তু শিল্পে নারীয়ায়নের মূল কারণ হচ্ছে মহিলাদের কম মজুরি, অধিকতর বাধ্যতা ও তাদের গৌণ রোজগারকারীর ভূমিকা। মূলত এ কারণেই কাজের ৰেত্রে পাহাড়সম লিঙ্গ বৈষম্য তৈরি হয়েছে। কারখানা মালিকরা না চাইতেই অধিক শ্রমিকের যোগান খুব সহজেই পেতে শুরম্ন করায় নারীরা পদ, পদবি ও মজুরির ৰেত্রে এই বৈষম্যের শিকার হচ্ছে।
এদিকে নারী শ্রমিকের মজুরি কম প্রদান করেও পরিতৃপ্ত নয় কারখানার মালিক কিংবা তার উর্ধতন পরিচালক ও কর্মকর্তারা। পদ ও পদবির অপব্যবহার ঘটিয়ে কারণে-অকারণে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে দুর্ব্যবহার করা হয় নারী শ্রমিকের সঙ্গে। ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, উদ্দেশ্য একটাই আর তা হচ্ছে- বিকৃত চিনত্মা ও উদ্দেশ্যের বাসত্মব প্রয়োগ ঘটানো।
এ বিষয়ে কর্মজীবী নারী পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, রাজধানী ও তার আশপাশ এলাকার ৪৬.১ শতাংশ কারখানার মালিক কিংবা পরিচালক অথবা তাদের উর্ধতন কর্মকর্তা-কর্মচারী নারী শ্রমিকদের মারধর, চড়-থাপ্পড়, জিনিসপত্র ছুঁড়ে মারা, অতিরিক্ত কাজ প্রদান, কর্ম সময়ের বাইরে অতিরিক্ত কাজ প্রদান, অযথা শরীরে হাত দেয়ার মাধ্যমে শারীরিক নির্যাতন করে থাকে। এ ব্যাপারে ভুক্তভোগী ৭৫.৯ শতাংশ কারখানার নারী শ্রমিকের মনত্মব্য, দোষ না পাওয়া সত্ত্বেও উর্ধতনরা শুধুমাত্র অসৎ উদ্দেশে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ, চিৎকার করে গালি দেয়া ও অশোভন ইঙ্গিত করে নারী শ্রমিকদের মানসিকভাবে নির্যাতন করার চেষ্টা করেন; যাতে তাদের উদ্দেশ্যটি সহজেই বাগে পাওয়া যায়।
প্রতিকূলতার এখানেই শেষ নয়। কম মজুরিও সময়মতো প্রদান করা হয় না। ওই জরিপে দেখা গেছে, ৪৭.৫ শতাংশ মালিক পরবতর্ী মাসের সাত কর্মদিবসের মধ্যে বেতন প্রদান করে। বাকিরা নেয় দীর্ঘসূত্রতার পথ। কিন্তু ৪৬.৬ শতাংশ শ্রমিকেরই তাতে ঘোরতর অভিযোগ, মাসিক মজুরির সঙ্গে ওভারটাইম মজুরি এক সঙ্গে প্রদান করা হয় না।
অথচ শ্রম আইন-২০০৬-এর ১২৩(১) ধারায় বলা হয়েছে- প্রত্যেক শ্রমিককে পরবতর্ী মাসের ৭ কর্মদিবসের মধ্যে বকেয়া মজুরি পরিশোধ করতে হবে। এই ধারা লঙ্ঘন করা হলে একজন শ্রমিক তার বকেয়া মজুরি আদায় করার জন্য এখতিয়ারাধীন শ্রম আদালতে দরখাসত্ম করতে পারবেন।
শ্রম আইন-২০০৬-এর শ্রমিকদের সাপ্তাহিক, নৈমিত্তিক ও মাতৃত্বকালীন ছুটির সুযোগ-সুবিধার ব্যাপারেও জোর দিয়েছে। কিন্তু কারখানাগুলোতে বাসত্মবতা একেবারেই ভিন্ন। আইন মানার প্রবণতা কারও মধ্যেই চোখে পড়ে না। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, অধিক মুনাফার লৰ্যে মালিকদের মানবতা ও বিবেক অন্ধ হয়ে গেছে। জরিপে জানা যায়, ৪১.৮০ শতাংশ কারখানা শ্রমিকদের সাপ্তাহিক ছুটি, ২৮.৯০ শতাংশ কারখানা নৈমিত্তিক ছুটি এবং অসুস্থতাজনিত ছুটি মঞ্জুর করে থাকে। কিন্তু তাতেও রয়েছে গলদ। এ ব্যাপারে ৫৮.২ শতাংশ শ্রমিকের মনত্মব্য, কাজের চাপ থাকলে বিশেষ করে শিপমেন্টের সময় কোন সাপ্তাহিক ছুটি দেয়া হয় না। নৈমিত্তিক ছুটির বিষয়ে ৭০.৯ শতাংশ শ্রমিকের মনত্মব্য, এই ছুটি শুধুমাত্র উচ্চপদে কর্মরতরাই ভোগ করেন। সাধারণ শ্রমিকদের তা প্রদান করা হয় না। অসুস্থতার ছুটির বিষয়ে ৪৬.১ শতাংশ শ্রমিকের মনত্মব্য, কর্মরত অবস্থায় গুরম্নতর অসুস্থ হলেই কেবল ছুটি পাওয়া যায়। কিন্তু বাসায় অসুস্থ হলে কিংবা অসুস্থতাজনিত কারণে অনুপস্থিত থাকলে বেতন কেটে নেয়া হয়।
মাতৃত্বকল্যাণ সুবিধার ৰেত্রে মাতৃত্বজনিত ছুটি প্রদানের ৰেত্রে মাত্র ৪৭ শতাংশ কারখানা একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ মজুরি মাতৃকল্যাণ সুবিধা হিসেবে নারী শ্রমিকদের প্রদান করে। এই ৰেত্রে ১৩.৯ শতাংশ শ্রমিকের মনত্মব্য, কারখানা কর্তৃপৰ কোন নারী শ্রমিক গর্ভবতী হয়েছে জানতে পারলে যেকোন কারণ দেখিয়ে তাকে চাকরিচু্যত করে; যাতে মালিককে মাতৃত্বকল্যাণ সুবিধা প্রদান করতে না হয়।
এ ব্যাপারে শ্রম আইনের ৪৫(১) ধারায় বলা হয়েছে- কোন মালিক কোন নারী শ্রমিককে সনত্মান প্রসবের পরবতর্ী ৮ সপ্তাহের মধ্যে কোনরূপ কাজ করাতে পারবেন না। ৪৫(২) ধারানুযায়ী অনুরূপ ৰেত্রে কোন মহিলা কাজ করবেন না। কোন মালিক আইনের এই বিধান লঙ্ঘন করলে ৫ হাজার টাকা পর্যনত্ম অর্থদ-ে দ-িত হবেন (ধারা ২৮৬)।
বাংলাদেশ লিগ্যাল এ্যাইড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (বস্নাস্ট) উপ-পরিচালক এ্যাডভোকেট ফরিদা ইয়াসমিন জানান, নারী শ্রমিকদের জন্য দেখা যায় আইন অকার্যকর। নতুন শ্রম আইনেও তারা বঞ্চিত। মাতৃত্বকালীন ছুটি তারা ঠিকমতো পায় না। আইন থাকলেও বাসত্মবায়নের কোন পদৰেপ নেই।
কর্মপরিবেশ ও পরিচ্ছন্নতাও নারী শ্রমিকের জন্য বড় বাধা। মাত্র ৪৭.৭ শতাংশ কারখানার নারী ও পুরম্নষ শ্রমিকের জন্য আলাদা আলাদা টয়লেট ব্যবস্থা রয়েছে। বাকি কারখানাগুলো নারী-পুরম্নষ এক সঙ্গেই ব্যবহার করে থাকে। এ ৰেত্রে আলাদা টয়লেট সুবিধা থেকে বঞ্চিত নারী শ্রমিকরা প্রতিনিয়তই থাকে আতঙ্কের মধ্যে। অন্যদিকে ৭৪.৮ শতাংশ কারখানার টয়লেট পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকে না। এমনকি কোন সাবান রাখারও ব্যবস্থা থাকে না। আর মাত্র ৪৭.৭ শতাংশ কারখানায় বিশুদ্ধ খাবার পানি সরবরাহ করে। এছাড়া ৫৪.১ শতাংশ কারখানা শ্রমিকদের খাবারের জন্য আলাদা কৰের ব্যবস্থা রেখেছে।
তবে বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ সংশিস্নষ্টরা এ কথা মানতে নারাজ। তাদের মতে, সারাদেশে প্রায় ৯ হাজার গার্মেন্ট শিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এ দু'টি সংগঠনের অনত্মভর্ুক্ত সকল সদস্যই তাদের কারখানায় যাবতীয় কমপস্নায়েন্স সচল রেখেছেন। বিচ্ছিন্ন কিছু প্রতিষ্ঠান থাকতে পারে। অবশ্য এর জন্য ওই সকল প্রতিষ্ঠানের খেসারতও দিতে হচ্ছে।
No comments