হাইতির ভূমিকম্প_ এ দেশেও সতর্কতা গড়ে তুলুন- পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের by শাহীন রহমান
হাইতিতে ঘটে যাওয়া ভূমিকম্প দেশের জন্য বড় ধরনের সতর্ক সঙ্কেত মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে সাম্প্রতিক ভূমিকম্পে হাইতিতে ব্যাপক ধ্বংসলীলা ও যে মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে, দেশের অভ্যনত্মরের যে কোন চু্যতি থেকে একই মাত্রার ভূমিকম্প হলে ৰয়ৰতি হবে এর ৫ গুণ বেশি।
তাঁদের আশঙ্কা দেশের অভ্যনত্মরে যে চারটি চু্যতি রেখা সক্রিয় রয়েছে এসব চু্যতিরেখা থেকে হাইতির মতো ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না। গত এক বছরে দেশে যে অর্ধশতাধিক ভূমিকম্প হয়েছে তার বেশিরভাগের উৎপত্তিস্থল অনেক দূরে এবং কম্পনের মাত্রাও ছিল অনেক কম। ফলে জানমালের ৰয়ৰতি তেমন হয়নি। তবে দূরে উৎপত্তি হওয়া ভূমিকম্পের মাত্রা ৬ বা ৭ এর বেশি হলে ঝুঁকির মধ্যে পড়বে দেশ। এ ৰেত্রে বহুতল ভবনের ওপর প্রভাব পড়বে বেশি। আর নিকটে দেশের অভ্যনত্মর থেকে একই মাত্রার ভূমিকম্পে স্বল্প উচ্চতার ভবনের ৰতি হবে বেশি। ভূতাত্তি্বক, টেকটোনিক ও সাইসমিক কাঠামো বিবেচনায় আনলে দেশের প্রায় রাজধানীসহ ৬০ শতাংশ এলাকা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।বিশেষজ্ঞদের মতে, ভূমিকম্পের ঝুঁকি এড়াতে হলে অবশ্যই হাইতির ভূমিকম্প থেকে শিৰা গ্রহণ করতে হবে। ভূমিকম্প ঝুঁকি মোকাবেলায় সরকারের পদৰেপ প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই নগণ্য এবং তা ভূমিকম্প পরবর্তী উদ্ধার তৎপরতার জন্য অপ্রতুল কিন্তু ভূমিকম্পের সময় কিভাবে নিজেদের নিরাপত্তায় রেখে জানমালের ৰয়ৰতি থেকে রৰা করা যাবে সে বিষয়ে সরকার এখনও প্রস্তুতি নেয়নি। শুধু ব্যাপক জনসচেতনতা গড়ে তুলতে পারলে ৫০ ভাগ ৰয়ৰতি এড়ানো সম্ভব হবে। ভূমিকম্পে মানুষের আতঙ্কিত হওয়া স্বাভাবিক; কিন্তু এর আগে মানসিক প্রস্তুতি থাকলে নিজেকে কিছুটা হলে নিরাপদ রাখা সম্ভব। পূর্বপ্রসুত্মতি হিসেবে প্রতিবছর অনত্মত ২ বার মহড়ার আয়োজন করা যেতে পারে। এ ছাড়া গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে সচেতনতা গড়ে তোলা যাবে।
তাঁদের মতে, জনগণকে সচেতন করে তুলতে না পারলে একই মাত্রার ভূমিকম্পে আমাদের অবস্থাও হাইতির মতো হতে পারে। বিশেষজ্ঞরা অনেক আগেই হাইতির ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। কিন্তু সে অনুযায়ী হাইতির সরকার তেমন কোন ব্যবস্থা নেয়নি। ২০০৮ সালে ভূতাত্তি্বক সমিতির এক সেমিনারে বিজ্ঞানীরা হাইতিতে ৭ দশমিক ২ মাত্রার ভূমিকম্পের আশঙ্কা করেছিলেন এবং এ ব্যাপারে হাইতি সরকারকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। কিন্তু হাইতি সরকার এ আশঙ্কার কোন গুরম্নত্ব দেয়নি। সে অনুযায়ী কোন প্রস্তুতি গ্রহণ করেনি বিধায় এই মানবিক বিপর্যয়ের শিকার হতে হয়েছে। প্রস্তুতি নিয়ে জনগণকে সচেতন করে তুলতে পারলে জানমালের ৰয়ৰতি এড়ানো যেত। হাইতির আয়তন বাংলাদেশের ৫ ভাগের এক ভাগ। দ্বীপটির রাজধানী পোর্ট অব প্রিন্স ঢাকা শহরের মতো ঘনবসতিপূর্ণ ও অপরিকল্পিত। তাঁদের মতে ঢাকা শহর হাইতির রাজধানীর চেয়ে বেশি ঘনবসতিপূর্ণ হওয়ায় ঝুঁকির আশঙ্কাও দেশটির চেয়ে বেশি।
তাঁদের মতে, বাংলাদেশে ভূমির গঠন নিম্ন বা অপেৰাকৃত পলিমাটিতে। ভূতাত্তি্বক ও টেকটোনিক কাঠামার প্রেৰাপটে বড় ধরনের ভূমিকম্প হওয়ার উৎস চু্যতি বিরাজমান রয়েছে। এসব চু্যতি বা ফাটল রেখা থেকে অতীতে বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়েছে। ১১৩ বছর আগে সিলেটের ডাউকি ফল্ট থেকে এবং ১২৫ বছর আগে ঢাকার কাছে মধুপুর থেকে বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়। আর এই মধুপুর ফল্টের কারণে ঢাকা শহর বেশি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এ ফল্টটি উত্তর দৰিণে ১শ' কিলোমিটার পর্যনত্ম বিসত্মৃত এবং ঢাকার অতি নিকটে পূর্ব পাশে অবস্থিত। ঢাকা সিটি থেকে ১৫ থেকে ৫০ কিলোমিটারের মধ্যে এর অবস্থান।
তাঁদের মতে ভূতাত্তি্বক টেকটোনিক কাঠামোর দিক দিয়ে হাইতির অবস্থান অনেকটা বাংলাদেশের মতো। তবে আয়তনের দিক দিয়ে বাংলাদেশের ৫ গুণ ছোট। ভূতাত্তি্বক ও টেকটোনিক দিক দিয়ে হাইতির অবস্থান ক্যারিবিয়ান মাইক্রো পেস্নটের উত্তরাংশে এবং নর্থ আমেরিকান পেস্নটের সংযোগস্থলে। দ্বীপটির অভ্যনত্মরে পেস্নট বাউন্ডারির দৰিণে দু'টি বড় ধরনের ভূ-চু্যতি পূর্ব থেকে পশ্চিমে বিসত্মৃত। গত ১২ জানুয়ারি যে ভয়াবহ ভূমিকম্প ঘটল তার উৎসস্থল ছিল এই অভ্যনত্মরীণ ভূ-চু্যতি। যা ভূপৃষ্ঠ থেকে ১০ কিলোমিটার নিচে। যাকে বিশেষজ্ঞরা শ্যালো ফোকাস আর্থ-কোয়েক হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এ ছাড়া যে দুু'টি পেস্নটের সংযোগস্থলে হাইতির অবস্থান, এ দু'টি পেস্নটের ট্রান্সক্রিয়েন্ট মুভমেন্ট বছরে ২২ সে.মি.। যার মাধ্যমে একে অপরের দিকে ধাবিত হচ্ছে। আবার যে চু্যতি থেকে এই ভূমিকম্পের উৎপত্তি সে চু্যতি রেখাও বছরে ৭ সে.মি. বেগে ধাবিত হচ্ছে। তাঁদের মতে হাইতির এই চু্যতিরেখা থেকেই ২শ' থেকে আড়াই শ' বছর আগে বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়েছিল। ওই সময় হাইতিতে যে সভ্যতা গড়ে উঠেছিল তা ওই ভূমিকম্পের ফলে বিলীন হয়ে যায়।
ঠিক একইভাবে পর্যালোচনা করলে দেখা যায় আমাদের দেশের অভ্যনত্মরে যে চু্যতিরেখাগুলো সক্রিয় রয়েছে, এসব চু্যতি থেকে অতীতে বহুবার বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়েছে। তখন এর ৰয়ৰতির মাত্রাও ছিল ব্যাপক। যে নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে একটি চু্যতিরেখা সক্রিয় হয়ে ওঠে, বর্তমানে প্রত্যেকটি চু্যতিরেখা সে সময় অতিক্রম করেছে। সিলেটের ডাউকি ফল্ট থেকে সর্বশেষ ১১৩ বছর আগে এবং মধুপুর ফল্ট থেকে ১২৫ বছর আগে ভূমিকম্প হয়েছিল। এরপর আর এখান থেকে কোন বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়নি। এ ছাড়া দেশের অবস্থান ভারত পেস্নটের সংযোগস্থলে। উত্তরে ইউরেশিয়া পেস্নট এবং পূর্বে বর্মা পেস্নট। ভারত পেস্নট উত্তরে ইউরেশিয়া পেস্নট এবং পূর্বে বর্মা পেস্নটের নিচে বছরে ৬ সে.মি. করে তলিয়ে যাচ্ছে। আবার বর্মা পেস্নট বছরে ২ সে.মি. করে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। দেশের অভ্যনত্মরের গতি নির্ণয় করে দেখা গেছে দেশের ভূখ-ও বছরে ৩ থেকে ৫ সেন্টিমিটার উত্তর-পূর্বদিকে অগ্রসর হচ্ছে। ফলে ভূত্বকে প্রচুর শক্তি বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থ অবজারভেটরি কেন্দ্রের পরিচালক ও ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ন আকতার বলেন, দু'ধরনের উৎসের কারণে বাংলাদেশ ভূমিকম্প ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। দূরবর্তী উৎসের কারণে রাজধানীর বহুতল ভবনগুলো বেশি ৰতির আশঙ্কা রয়েছে। এ ছাড়া অভ্যনত্মরীণ কোন উৎস থেকে বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে তা স্বল্প উচ্চতার ভবনগুলোর বেশি ৰতি করবে। তিনি বলেন, আমাদের যে ভূমিকম্পের জোন ম্যাপ বা রিস্ক ম্যাপ রয়েছে তা ১৯৭২ সালে ভূমি জরিপ অধিদফতর প্রণয়ন করে। সেখানে দেশে মাত্র ২৬ শতাংশ এলাকা ভূমিকম্প ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে দেখানো হয়েছে। ১৯৯৩ সালে তা আপডেট করে বিল্ডিং কোড প্রণয়ন করা হয়। সেখানেও ঝুঁকির পরিমাণ একই রয়েছে। কিনত্ম বর্তমানে দেশে ৬০ ভাগ এলাকা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। তিনি বলেন, সরকার এখন পর্যনত্ম ঝুঁকি মোকাবেলায় যে পদৰেপ নিয়েছে তা উদ্ধার তৎপরতার ওপর। কিন্তু জনগণকে সচেতন করে তোলার ব্যাপারে এখনও কোন পদৰেপ নেয়া হয়নি। জনগণ সচেতন হলে প্রায় ৫০ ভাগ ৰতি এড়ানো যাবে।
No comments