৪৫ বছরে তাপমাত্রার নতুন রেকর্ড ॥ শীতলতম দিন- ০ দিনাজপুরে ৩.২- ৫৭ বছরের রেকর্ড, ঢাকায় ৭.২- ৪৯ বছরের রেকর্ড ও ঈশ্বরদীতে ৩.৯- ৪২ বছরের রেকর্ড ভঙ্গ- ০ শৈত্যপ্রবাহ চলবে- ০ মৃত আরও ৪২ by শাহীন রহমান
বিগত ৪৫ বছরের মধ্যে দেশে সর্বনিম্ন তাপমাত্রার রেকর্ড ভঙ্গ করেছে এবারের শীত। বুধবার দিনাজপুরে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৩.২ ডিগ্রী সেলসিয়াস।
আবহাওয়াবিদরা বলছেন, ১৯৬৮ সালে শেষবারের মতো শ্রীমঙ্গলে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ২.৮ ডিগ্রী সেলসিয়াস। এরপরে আর তাপমাত্রার রেকর্ডের এত পতন হয়নি। তবে দিনাজপুরে সর্বনিম্ন তাপমাত্রার রেকর্ড ভঙ্গ হয়েছে ৫৭ বছরের। ১৯৫৫ সালের পর দিনাজপুরে তাপমাত্রা এত নিচে নামতে দেখা যায়নি। ঈশ্বরদীতে ৪২ বছরের তাপমাত্রার রেকর্ড ভঙ্গ করে ৩.৯ ডিগ্রীতে নেমেছে। আর ঢাকার তাপমাত্রা ৪৯ বছর পর বুধবার ৭.২ ডিগ্রীতে নেমে আসে।আবহাওয়া অধিদফতরের ঘূর্ণিঝড় সতর্কীকরণ কেন্দ্রের উপ-পরিচালক শাহ আলম জনকণ্ঠকে বলেন, আগামী দুদিনে এ পরিস্থিতির উন্নতির কোন সম্ভাবনা নেই। এ দুদিনে তাপমাত্রা আরও কমে যেতে পারে। তবে দুদিন পর তাপমাত্রা কিছুটা বাড়লেও শৈত্যপ্রবাহ এখনই থামছে না, বরং তা আরও কিছুদিন অব্যাহত থাকতে পারে।
অব্যাহতভাবে তাপমাত্রা কমে যাওয়ার কারণে ভয়াবহ শীতের কবলে পড়েছে দেশ। রীতিমতো একটি দুর্যোগে পরিণত হয়েছে। দেশের সব বিভাগের ওপর দিয়ে তীব্র শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। কনকনে ঠাণ্ডায় পুরো দেশের জীবনযাত্রা একেবারের স্থির হয়ে গেছে। জরুরী প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হওয়া সম্ভব হচ্ছে না। উত্তরাঞ্চলের জীবনযাত্রা পুরোপুরি থেমে গেছে। অব্যাহত শীতের কবলে পড়ে উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় নতুন করে আরও ৪২ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে দিনাজপুরে ৬, নীলফামারীতে ৬, ঠাকুরগাঁওয়ে ৬ জন, জামালপুরে ৫, কুড়িগ্রামে ৫, লালমনিরহাটে ৩, মানিকগঞ্জে ২, রংপুরে ৪ ও নেত্রকোনায় একজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
কনকনে ঠাণ্ডা ও শৈত্যপ্রবাহের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঢাকার তাপমাত্রও হু হু করে নেমে যাচ্ছে। মঙ্গলবার ঢাকার তাপমাত্রা যেখানে ছিল ৯.৬ ডিগ্রী সেলসিয়াস, একদিনের ব্যবধানে তা ২ ডিগ্রী নেমে দাঁড়িয়েছে ৭.২ ডিগ্রী সেলসিয়াসে। আবহাওয়াবিদরা জানিয়েছেন, ১৯৬৪ সালের পর এই প্রথম ঢাকার তাপমাত্রা এত নিচে নেমে গেছে। আগের দিনের চেয়ে বুধবার প্রায় সব বিভাগের তাপমাত্রা রেকর্ড পরিমাণ কমে গেছে। শুধু দিনাজপুরে নয়, দেশের আরও কয়েকটি এলাকায় তাপমাত্রা ৩ ডিগ্রীতে নেমে এসেছে। সম্প্রতি এসব এলাকায় তাপমাত্রা এত নিচে নামার কোন রেকর্ড নেই। এসব এলাকার মধ্যে সৈয়দপুরে তাপমাত্রা নেমে এসেছে ৩.৫ ডিগ্রী সেলসিয়াসে। ঈশ্বরদী ও চুয়াডাঙ্গায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৩.৯ ডিগ্রী সেলসিয়াস। দেশের চারটি এলাকার তাপমাত্রা ৪ ডিগ্রীতে নেমে এসেছে। শ্রীমঙ্গল ও রাজশাহীতে এদিন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৪.৪ ডিগ্রী সেলসিয়াস। যশোরে তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৪.২ ডিগ্রী সেলসিয়াস। বগুড়ায় ৪.৯ ডিগ্রী সেলসিয়াস।
আগের দিন মঙ্গলবার চট্টগ্রাম ও বরিশাল বিভাগের সব এলাকায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা স্বাভাবিক থাকলেও বুধবার সে রেকর্ড আর ধরে রাখতে সক্ষম হয়নি। একমাত্র টেকনাফ এলাকা বাদে এ দুটি বিভাগের প্রায় সব এলাকার তাপমাত্রাও স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক নিচে নেমে গেছে। একমাত্র টেকনাফে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রয়েছে ১৩.৩ ডিগ্রী সেলসিয়াস। টেকনাফ, কুতুবদিয়া ও কক্সবাজার বাদে দেশের আর কোথাও তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রীর মধ্যে নেই। সব এলাকার তাপমাত্রা নেমে গেছে ৮ ডিগ্রীর নিচে।
ঢাকায় বুধবার তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৭.২ ডিগ্রী সেলসিয়াস। আগের দিন ছিল ৯.৬ ডিগ্রী সেলসিয়াস। ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল ও মাদারীপুরের তাপমাত্রা আগের দিনে চেয়ে কয়েক ডিগ্রী নিচে নেমে গেছে। ময়মনসিংহে বুধবার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৬.৭ ডিগ্রী সেলসিয়াস, টাঙ্গাইলে ৫.৫ ডিগ্রী এবং মাদারীপুরে ৬ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে।
এদিকে চট্টগ্রাম বিভাগেরও সব এলাকার তাপমাত্রা আগের দিনের চেয়ে ৫ থেকে ৭ ডিগ্রী পর্যন্ত নিচে নেমে গেছে। চট্টগ্রামের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৯.৬ ডিগ্রী সেলসিয়াস, সন্দ্বীপে ৮.১ ডিগ্রী, সীতাকুণ্ডে ৫.৭ ডিগ্রী, রাঙ্গামাটি ৫.৭, কুমিল্লা ৬.৫, চাঁদপুরে ৭.২ ডিগ্রী, মাইজদীকোর্টে ৮.৫ ডিগ্রী, ফেনীতে ৬.৪ ডিগ্রী, হাতিয়ায় ১২ ডিগ্রী, কক্সবাজার ১১.৮ ডিগ্রী, কুতুবদিয়ায় ১১.৪ ডিগ্রী এবং টেকনাফে ১৩.৩ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রাও টেকনাফে ২৭.৩ ডিগ্রী সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে।
রংপুর বিভাগের সব জেলার তাপমাত্রা ৪ ডিগ্রীর মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে আছে। সিলেট বিভাগের একমাত্র সিলেটে তাপমাত্রা রয়েছে ৮.৪ ডিগ্রী। এ বিভাগের অন্য এলাকায় তাপমাত্রা ৪ ডিগ্রীর মধ্যে অবস্থান করছে। খুলনা বিভাগের সব এলাকার তাপমাত্রা ৭ ডিগ্রীর নিচে অবস্থান করছে। এ বিভাগের খুলনায় তাপমাত্রা রয়েছে ৭ ডিগ্রী, মংলাতে ৭.২ ডিগ্রী, সাতক্ষীরা ৬.৬ ডিগ্রী, যশোর, চুয়াডাঙ্গায় যথাক্রমে ৪.২ এবং ৩.৯ ডিগ্রী সেলসিয়াস।
স্টাফ রিপোর্টার দিনাজপুর থেকে জানান, তাপমাত্রা ক্রমান্বয়ে নিচে নেমে যাওয়ায় জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে। অসহনীয় শীতের কারণে গত ২৪ ঘণ্টায় এই জেলায় শিশু-বৃদ্ধসহ ৬ জনের মৃত্যু ঘটেছে। দিনাজপুরে এবার শীতের তীব্রতা গত ৩ দশকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অনুভূত হচ্ছে। এ কারণে সাধারণ মানুষ তীব্র শীতে নাজেহাল হচ্ছেন। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান শীতবস্ত্র নিয়ে মাঠে নামলেও প্রয়োজনের তুলনায় তা অনেক কম বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। ঘন কুয়াশার কারণে শাক-সবজির উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে। মিল চাতালে রোদের অভাবে ধান শুকানোর কাজ স্তিমিত হয়ে পড়েছে। শীতে ছিন্নমূল মানুষের দুর্ভোগ চরমে উঠেছে। বিশেষ করে শহরের রেলস্টেশন, বাসস্ট্যান্ড, বস্তিবাসী ও ছিন্নমূল নিম্ন আয়ের শীতার্ত মানুষের কষ্ট বেড়েছে সীমাহীন। বাড়ছে শীতজনিত রোগও।
স্টাফ রিপোর্টার রাজশাহী থেকে জানান, রাজশাহীতে স্মরণকালের কম তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে বুধবার। ফলে তীব্র শীতে রীতিমতো কাঁপছে রাজশাহীবাসী। বেলা ১১টার পর ঝলমলে রোদের দেখা মিললেও শীতের তীব্রতা দমাতে পারেনি এতটুকুও। শীতের তীব্রতার কারণে মানুষ স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে পারছে না। শীতের তীব্রতায় ক্ষেত-খামারেও নামতে পারছে না শ্রমজীবী মানুষ। এদিকে কনকনে শীতে অস্থির মানুষের জন্য এখনও সরকারীভাবে পর্যাপ্ত কম্বল বিতরণ শুরু হয়নি। আদিবাসী পল্লীর বৃদ্ধা সুন্দরী হেমব্রন বলেন, ‘দিনে তো বাবু আগুন জেলে পার করছি, রাতে ঠা-ায় ঘুম আসে না। চট বস্তা আর কাঁথা গায়ে জড়িয়েও ঠা-া যাচ্ছে না বাবু।’
স্টাফ রিপোর্টার যশোর অফিস থেকে জানান, চলতি বছর দ্বিতীয় দফা শৈত্যপ্রবাহে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জনজীবন। বাতাসের কারণে সারাদিনই প্রচ- শীত অনভূত হচ্ছে। শীতের প্রকোপে জনজীবনে স্থবিরতা নেমে এসেছে। পাশাপাশি ছিন্নমূল মানুষের দুর্ভোগ চরমে উঠেছে। যশোর রেলস্টেশনের পাশে ফুটপাথে মোটা চট জড়িয়ে শুয়ে থাকা বৃদ্ধ নেসার উদ্দিন বলেন, ‘শিতির বাতাসে হাড় কাঁপায়ে যাচ্ছে বাবা। মুটা বস্তা গায় দিয়েও শিতিত্তে বাঁচতিচিনে। এইরাম আর কয়দিন যাবে, বেশি দিন গেলি বাঁচপোনানে।’
স্টাফ রিপোর্টার কুড়িগ্রাম থেকে জানান, টানা তিন দিনের তীব্র শৈত্যপ্রবাহে স্থবির হয়ে পড়েছে জনজীবন। এ দিকে শীত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে শীতজনিত রোগের প্রকোপ। গত ২৪ ঘণ্টায় শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে আরও ৫ জনের মৃত্যু সংবাদ পাওয়া গেছে। মৃতরা হলেন কুড়িগ্রাম পৌরসভার বাগডোবাপাড় এলাকার আব্দুর রহমান (৫৮), সেনের খামার গ্রামের আছিয়া বেওয়া (৬৮), উলিপুর উপজেলার পাণ্ডল এলাকার রহিমা বেওয়া (৬৫) ও গুনাইগাছ এলাকার মঞ্জু মিয়া (৪৫), রাজীবপুর উপজেলার ব্রহ্মপুত্র নদবিচ্ছিন্ন সাজাই গ্রামের আজগার আলী (৭০) ।
স্টাফ রিপোর্টার রংপুর থেকে জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় নিউমোনিয়া রোগে আক্রান্ত হয়ে আরও ৪ শিশু মারা গেছে। জেলার ২ লাখ সহায় সম্বলহীন ও ছিন্নমূল মানুষ শীতবস্ত্রের অভাবে আগুন জ্বালিয়ে বিনিদ্র রাত কাটাচ্ছে। অন্যদিকে শৈত্যপ্রবাহের কারণে বাড়ি থেকে কাজে বের হতে না পারায় ২ লাখ শ্রমজীবী পরিবার অনাহারে, অর্ধাহারে মানবেতর দিন কাটাচ্ছে। শীতার্ত মানুষ নিউমোনিয়া, কোল্ড ডায়রিয়া, শ্বাসকষ্টজনিত রোগে ব্যাপকভাবে আক্রান্ত হচ্ছে। আক্রান্তদের অধিকাংশই শিশু ও বয়োবৃদ্ধ। সন্ধ্যা ৬টায় এ রিপোর্ট লেখার সময় কুয়াশার চাদরে ঢাকা পড়ে যায় এ অঞ্চলের প্রকৃতি, সঙ্গে কনকনে ঠাণ্ডা।
নিজস্ব সংবাদদাতা ঈশ্বরদী থেকে জানান, প্রচ- শীত ও ঠা-া বাতাসে মানুষ ও পশুকুলে জবুথবু অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। মঙ্গলবার সন্ধ্যা থেকে তাপমাত্রা কমে যাওয়ায় এবং প্রচ- ঠা-া বাতাস ও শীতের তীব্রতা বাড়তে থাকায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। প্রচ- শীতের কারণে ঈশ্বরদী হাসপাতালসহ বিভিন্ন ক্লিনিকে অন্তত ৫০ শিশু ও প্রায় ১শ’ বৃদ্ধের ডায়রিয়াসহ নানা অসুখে আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
নিজস্ব সংবাদদাতা জামালপুর থেকে জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় জেলায় শীতজনিত রোগে শিশু-বৃদ্ধসহ ৫ জন মারা গেছে। এরা হচ্ছে দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার সানন্দবাড়ী পশ্চিমপাড়ার রোস্তম আলী (৮০), বকশিগঞ্জ উপজেলার সওদাগরপাড়ার লাল মিয়া (৫৫), জামালপুর জেনারেল হাসপাতালে মারা গেছে আশা (১৭), কোহিনূর বেগম (৩০) ৬ মাসের শিশু বেবী।
নেত্রকোনা থেকে নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, প্রচ- শীতের কারণে পৌরসভার সাধুপাড়ায় মোহনদাসের স্ত্রী সারদা দাসের মৃত্যু হয়। তাঁর বয়স হয়েছিল ১১০ বছর।
নিজস্ব সংবাদদাতা লালমনিরহাট থেকে জানান, লালমনিরহাটে গত ২৪ ঘণ্টায় শীতজনিত রোগে ৩ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এরা হলেন উপজেলার কুলাঘাট ইউনয়নের বড়ুয়া গ্রামের জগেত চন্দ্র (৬৩), মোগলহাট ইউনিয়নের কুর্ণপুর এলাকার আবু তাহের (৬৭) ও আদিতমারী উপজেলার পলাশী এলাকার সিরাজুল ইসলামের পুত্র সোহেল রানা (৪)।
নিজস্ব সংবাদদাতা মানিকগঞ্জ থেকে জানান, প্রচ- শীতে মঙ্গলবার রাতে মানিকগঞ্জের দৌলতপুর উপজেলায় দুই কৃষকের মৃত্যু হয়েছে। এরা হলেন বাচামারা ইউনিয়নের বাচামারা গ্রামের কৃষক আব্দুল মালেক (৪০) ও চকমীরপুর ইউনিয়নের মীরপুর গ্রামের কৃষক আয়নাল দে (৪৮)।
No comments