পুলিশ সপ্তাহ- প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছা ও বাস্তবতা
রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত মঙ্গলবার রাজারবাগে পুলিশ সপ্তাহের উদ্বোধনকালে দেওয়া বক্তৃতায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন। এর মধ্যে বিশেষভাবে আমাদের উদ্বুদ্ধ করেছে পুলিশ বাহিনীকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার না করতে তার সরকারের সদিচ্ছা।
একাত্তরে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রহরে প্রতিরোধযুদ্ধ থেকে শুরু করে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ে স্বাধীনতার জন্য পুলিশ বাহিনীর অনন্য ত্যাগের ইতিহাসও প্রধানমন্ত্রী তার বক্তৃতায় স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। তিনি জনগণের বন্ধু হিসেবে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা, সন্ত্রাস দমনসহ জনগণের সেবায় আত্মনিয়োগের জন্য পুলিশ সদস্যদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, 'পুলিশ রাজনৈতিক হাতিয়ার নয়। এই বাহিনীকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের কোনো ইচ্ছা সরকারের নেই।' গণতান্ত্রিক সমাজে সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও বিকাশে প্রধানমন্ত্রীর এই আকাঙ্ক্ষা বা মনোভাব যে অত্যন্ত সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। প্রধানমন্ত্রী অপরাধ দমনে দল-মত বা পরিচয়ের ঊধর্ে্ব উঠে অপরাধীদের দমনের জন্যও পুলিশকে সক্রিয় ভূমিকা পালনের আহ্বান জানিয়েছেন। তবে পুলিশের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর এই আহ্বান ও বাস্তবতার মধ্যে এখনও অনেক পার্থক্য রয়ে গেছে। পুলিশ কখনও নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করে না অথবা করতে পারে না, এটাই আমাদের সামাজিক বাস্তবতা। দুর্ভাগ্যের বিষয়, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলের ধারাবাহিকতায় আমলাতন্ত্র ও পুলিশ আকাঙ্ক্ষিত মাত্রায় পরিবর্তিত হয়নি। স্বাধীন দেশের মানসম্পন্ন বাহিনীতেও এখন পর্যন্ত পুলিশ উত্তীর্ণ হতে পারেনি। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য যে জাতির বিপুলসংখ্যক পুলিশ সদস্য আত্মত্যাগ করেছেন, সেই জাতিরাষ্ট্রের পুলিশ হবে সত্যিকার অর্থেই সৎ, নিষ্ঠাবান এবং গণসম্পৃক্ত এমন বাহিনী, যাদের ওপর সাধারণ মানুষ নির্ভর করবে নির্ভাবনায়। পুলিশ বাহিনী হবে দেশের সব মানুষের জন্য সমান আশ্রয় ও ভরসার স্থল। কিন্তু অতীতের তুলনায় অনেক ক্ষেত্রে পুলিশের অগ্রগতি হলেও পুলিশকে স্বাধীনতার ৪০ বছর পরও জনগণের সত্যিকার বন্ধু হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা যায়নি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুলিশই মানবাধিকার লঙ্ঘনে অপরাধীদের সহায়ক শক্তি হয়ে ওঠে। বিগত চারদলীয় জোট শাসনামলে এই বাহিনীর কোনো কোনো কর্মকর্তা 'বাংলাভাই', শায়খ আবদুুর রহমানের মতো জঙ্গি নেতাদের পৃষ্ঠপোষকের ভূমিকা পালন করেছেন এবং সম্পূর্ণ রাজনৈতিকভাবে ব্যবহৃত হয়েছেন। বর্তমান সরকারের আমলেও অপরাধ দমনে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। বিরোধী দলের চিফ হুইপকে রাজপথের কর্মসূচিতে নাজেহালকারী এক পুলিশ কর্মকর্তার পুলিশ পদক লাভ এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অবিশ্বাস্য অন্ধদলীয় দৃষ্টিভঙ্গির উক্তি দেশবাসীকে উদ্বিগ্ন না করে পারে না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উক্তি প্রধানমন্ত্রীর আকাঙ্ক্ষার পরিপন্থী। পুলিশকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার বন্ধ না হলে এই বাহিনী জনগণের সত্যিকার বন্ধু হয়ে উঠতে পারবে না। পুলিশের মানোন্নয়নে শুধু বরাদ্দ বাড়ানো আর প্রযুক্তিগত অগ্রগতিই আমরা যথেষ্ট মনে করি না। আমরা মনে করি, প্রধানমন্ত্রীর যে মহৎ আকাঙ্ক্ষা, তার সঙ্গে বাস্তবতার মিল থাকা দরকার। বাস্তবে পুলিশ যখন যে দল ক্ষমতায়, তাদের হয়ে কাজ করে। প্রধানমন্ত্রীর যে আকাঙ্ক্ষা, তার আলোকে পুলিশ দলীয় প্রভাবমুক্ত হয়ে কাজ করবে, সেটাই দেশবাসীর প্রত্যাশা।
No comments