শিক্ষক মহাসমাবেশে আনন্দ-উচ্ছ্বাস- ২৬ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারি হলো
২৬ হাজার ১৯৩টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর মধ্য দিয়ে এসব বিদ্যালয়ে কর্মরত এক লাখ তিন হাজার ৮৪৫ জন শিক্ষকের চাকরি সরকারি হলো।
গতকাল বুধবার রাজধানীর জাতীয় প্যারেড স্কয়ারে শিক্ষকদের এক বিশাল সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী এ ঘোষণা দেন। সারা দেশ থেকে হাজার হাজার শিক্ষক অংশ নেন এই সমাবেশে। প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে শিক্ষকদের দীর্ঘ দুই দশকের আন্দোলন সফল হলো। ১৯৯১ সাল থেকে জাতীয়করণের দাবিতে আন্দোলন করছিলেন বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা।প্রধানমন্ত্রী সমাবেশে বলেন, ‘শিক্ষকদের এ দাবি কতটা যৌক্তিক, আমি সেটা উপলব্ধি করেছি। ওনারা শুধু রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জাতীয়করণ চেয়েছিলেন। কিন্তু আমরা স্থায়ী-অস্থায়ী নিবন্ধনপ্রাপ্ত, পাঠদানের অনুমতিপ্রাপ্ত, কমিউনিটি, সরকারি অর্থায়নে এনজিও পরিচালিত, পাঠদানের অনুমতির সুপারিশপ্রাপ্ত এবং পাঠদানের অনুমতির অপেক্ষাধীন সবগুলোরই সরকারীকরণের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এখন সরকারীকরণের আশায় নতুন করে যত্রতত্র বিদ্যালয় করলে অনুমোদন দেওয়া হবে না। প্রয়োজন হলে সরকারিভাবেই বিদ্যালয় স্থাপন করা হবে। তবে যে বেসরকারি বিদ্যালয়গুলো এখন আছে, সেগুলো থাকবে।
শেখ হাসিনা এ উদ্যোগের আর্থিক দিকটি তুলে ধরে বলেন, ‘এই জাতীয়করণের ফলে অনেক টাকা প্রয়োজন। কিন্তু নিয়ত ভালো থাকলে সবকিছু করা সম্ভব।’
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব এম এম নিয়াজউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পর জাতীয়করণ হয়েই গেছে। তবে আনুষ্ঠানিকতার জন্য দু-এক দিনের মধ্যেই গেজেট প্রকাশ করা হবে।
যেভাবে কার্যকর: জাতীয়করণের এ সিদ্ধান্ত তিন স্তরে কার্যকর হবে। এর মধ্যে চলতি মাসের ১ জানুয়ারি থেকে ২২ হাজার ৯৮১টি রেজিস্টার্ড (এমপিওভুক্ত) বিদ্যালয়ের ৯১ হাজার ২৪ জন শিক্ষক এ সুবিধা পাবেন। আগামী ১ জুলাই থেকে স্থায়ী-অস্থায়ী নিবন্ধনপ্রাপ্ত, পাঠদানের অনুমতিপ্রাপ্ত কমিউনিটি এবং সরকারি অর্থায়নে এনজিও পরিচালিত দুই হাজার ২৫২টি বিদ্যালয়ের নয় হাজার ২৫ জন শিক্ষক সুবিধা পাবেন। আর তৃতীয় স্তরে ২০১৪ সালের ১ জানুয়ারি থেকে পাঠদানের অনুমতির সুপারিশপ্রাপ্ত ও পাঠদানের অনুমতির অপেক্ষাধীন ৯৬০টি বিদ্যালয়ের তিন হাজার ৭৯৬ শিক্ষক এ সুবিধা পাবেন। জাতীয়করণ হওয়া বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকেরা এখন সরকারি প্রাথমিক শিক্ষকদের মতো বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য সুবিধা পাবেন।
জাতীয়করণের ঘোষণা উপলক্ষে বাংলাদেশ বেসরকারি প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি ‘মহাসমাবেশের’ আয়োজন করে। এ উপলক্ষে সকাল থেকেই সারা দেশ থেকে হাজার হাজার শিক্ষক কনকনে শীত উপেক্ষা করে সমাবেশস্থলে আসতে থাকেন। দুপুর সাড়ে ১২টায় প্রধানমন্ত্রী বক্তব্য দিতে শুরু করে জাতীয়করণের ঘোষণা দিলে শিক্ষকেরা করতালি ও স্লোগান দিয়ে এ ঘোষণাকে স্বাগত জানান।
স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একসঙ্গে ৩৬ হাজার ১৬৫টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করেছিলেন। তখন এক লাখ ৫৫ হাজার ২৩ জন শিক্ষক সরকারি হন।
প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তৃতায় বিষয়টি উল্লেখ করে বলেন, ‘আমি মনে করি, পিতার স্বপ্ন পূরণ করতে পারলাম।’ শিক্ষকদের জাতি গড়ার কারিগর হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘শিক্ষকেরাই একটি জাতিকে গড়ে তুলতে পারেন। শুধু পড়ালেই হবে না, শিক্ষার মানও বাড়াতে হবে।’
বেসরকারি প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি আমিনুল ইসলাম চৌধুরীর সভাপতিত্বে মহাসমাবেশে আরও বক্তব্য দেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী আফছারুল আমীন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও সমিতির উপদেষ্টা মহীউদ্দীন খান আলমগীর, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মোতাহার হোসেন, ভারপ্রাপ্ত সচিব এম এম নিয়াজ উদ্দিন, সমিতির মহাসচিব মুনছুর আলী।
বেতন-ভাতা কত বাড়বে: প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয়করণ হওয়া বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা এখন সরকারি শিক্ষকদের সমান হবে। এত দিন তাঁরা শুধু সরকারি শিক্ষকদের মতো মূল বেতন পেয়ে আসছেন। এর মধ্যে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের মূল বেতন পাঁচ হাজার ৫০০ টাকা ও প্রশিক্ষণবিহীনদের পাঁচ হাজার ২০০ টাকা। আর প্রশিক্ষণ করা সহকারী শিক্ষকদের মূল বেতন চার হাজার ৯০০ টাকা ও প্রশিক্ষণবিহীনদের চার হাজার ৭০০ টাকা। এর বাইরে বেসরকারি শিক্ষকেরা বাড়িভাড়া মাসে সর্বসাকল্যে ২০০ ও চিকিৎসা ভাতা ২০০ টাকা করে পান। আর বছরে একটি উৎসব ভাতা দুবারে ভাগ করে দেওয়া হয়। তাঁরা কোনো পেনশন পান না।
বিপরীতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা মূল বেতনের পাশাপাশি বাড়িভাড়া এলাকাভেদে মূল বেতনের ৫৫ থেকে ৬৫ শতাংশ, চিকিৎসা ভাতা মাসে ৭০০, নাশতা ভাতা ১৫০, যাতায়াত ১৫০ টাকা ও উৎসব ভাতা পান বছরে দুটি। এ ছাড়া, আছে চাকরিজীবনে তিনটি টাইম স্কেল ও প্রতিবছর বেতন প্রবৃদ্ধি। মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন তিন স্তরে জাতীয়করণের জন্য বছরে অতিরিক্ত খরচ হবে ৬৫১ কোটি টাকা।
খুশি মনে শিক্ষকদের বাড়ি ফেরা: প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা শোনার জন্য হাজারো শিক্ষক অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন। প্রধানমন্ত্রী যখন জাতীয়করণের কথাটি ঘোষণা করেন, শিক্ষকদের চোখে-মুখে তখন অশেষ খুশির ঝলক। তুমুল করতালি ও স্লোগান দিয়ে তাঁরা প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণাকে স্বাগত জানান।
সমাবেশ শেষে কয়েকজন শিক্ষক প্রথম আলোকে তাঁদের প্রতিক্রিয়ায় বলেন, এটা তাঁদের জন্য বিশাল আনন্দের বিষয়। কারণ, এখন তাঁরাও পুরোপুরি সরকারি শিক্ষক হলেন।
২৮ বছর ধরে চাকরিরত ভোলার সদর উপজেলার শিক্ষক মু. শাহ আলম বলেন, ‘আমার জীবনের শেষ মুহূর্তে এটা হবে, কল্পনা করতে পারিনি। এখন নিজেকে গর্বিত মনে হচ্ছে।’
কুমিল্লার বুড়িচংয়ের শিক্ষক ফয়জুন্নেসা বলেন, ‘এটা আমাদের জন্য এক বিশাল পাওয়া।’
অনেক শিক্ষক গতকালই তাঁর পরিচয় দেওয়ার সময় নিজের বিদ্যালয়ের নামের আগে ‘সরকারি’ শব্দটি জুড়ে দেন। এ রকমই ছিল তাঁদের খুশির মাত্রা।
উল্লেখ্য, গত বছরের ১৫ মে শাহবাগ মোড়ে আন্দোলনরত বেসরকারি শিক্ষকদের বেদম প্রহার করে পুলিশ। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ২৭ মে শিক্ষকদের সঙ্গে বৈঠক করে জাতীয়করণের নীতিগত ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী। এরপর জাতীয়করণের প্রস্তুতি শুরু করে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়।
No comments