জ্যোতি বসুর জীবনাবসান, শেখ হাসিনা যাচ্ছেন শেষকৃত্যে
দু'দশকেরও বেশি সময় পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের নেতৃত্বদানকারী স্বনামধন্য বষর্ীয়ান কমিউনিস্ট নেতা জ্যোতি বসু আর নেই। দীর্ঘ ১৭ দিন মৃতু্যর সঙ্গে লড়ে অবশেষে কলকাতার এক হাসপাতালে তাঁর জীবনাবসান ঘটে রবিবার সকালে।
১১টা ৪৭ মিনিটে তিনি মারা যান। বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জ জেলার বারদি গ্রাম জ্যোতি বসুর পৈতৃক নিবাস। ১৯৭৭ সালে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হন এবং নিরবচ্ছিন্নভাবে ২৩ বছর রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর মৃতু্যর সংবাদে কলকাতাসহ গোটা ভারত এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন মহলে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরম্ন করে শীর্ষ পর্যায়ের মন্ত্রী, সব রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ, বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ তাঁর মৃতু্যতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। পৃথক পৃথক বিবৃতিতে তাঁরা এই শোক প্রকাশ করেন। মঙ্গলবার প্রয়াতের শেষ শ্রদ্ধা জানানো হবে। ভারত সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ, পেশাজীবী নেতৃবৃন্দ এই শ্রদ্ধা নিবেদন অনুষ্ঠানে অংশ নেয়ার কথা জানিয়েছেন। এদিকে জ্যোতি বসুর প্রতি সম্মান জানাতে পশ্চিমবঙ্গ সরকার আজ সোমবার ছুটি ঘোষণা করেছে। ভারতবর্ষে রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রজ্ঞা মেধা মনন বিচৰণতা নেতৃত্বের দৃঢ়তা এবং দূরদৃষ্টি বিবেচনায় তিনি কেবল তাঁরই তুলনা। এককথায় অতুলনীয়। জ্যোতি বসুর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে কলকাতা যাবেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।মৃতু্যর সংবাদ
বেলা ১২টা ১০ মিনিট নাগাদ সিপিএমের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক বিমান বসু হাসপাতাল থেকে বের হয়ে উপস্থিত সংবাদকর্মীসহ সকলকে জানান, 'আপনাদের একটা দুঃসংবাদ দিচ্ছি। জ্যোতি বসু আর আমাদের মধ্যে নেই। ১১টা ৪৭ মিনিটে তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। আমি আর কিছু বলতে পারছি না।' এর পরই তিনি অঝোর ধারায় কেঁদে ফেলেন। হাসপাতালে ততৰণ চলে এসেছেন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাট এবং সিপিএম রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সত্মরের অন্যান্য নেতা। মৃতু্যর কিছুৰণ আগে হাসপাতাল ঘুরে গেছেন কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদম্বরম। বসুর অবস্থা ক্রমেই চিকিৎসকদের আয়ত্তের বাইরে চলে যাওয়ার খবর পেয়ে ততৰণে হাসপাতালের সামনে জড়ো হয় হাজার হাজার সাধারণ মানুষ। বিমান বসুর ঘোষণা টিভিতে দেখামাত্রই হাসপাতালের সামনে মানুষের ঢল নেমে আসে।
উলেস্নখ্য, গত ১ জানুয়ারি ফুসফুসের সংক্রমণ নিয়ে সল্টলেকের এক বেসরকারী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন ৯৬ বছরের ওই কমিউনিস্ট নেতা। তার পর গত ১৭ দিন ধরে একের পর এক তাঁর অঙ্গ বিকল হতে থাকে। শেষ চেষ্টা হিসেবে দুপুরেই চিকিৎসকরা তাঁকে টানা ডায়ালিসিস দেয়ার পরিকল্পনা নেন। রাতে অস্থায়ী পেসমেকারও বসানো হয়। কিন্তু সব লড়াই শেষ হয়ে গেল রবিবার সকালে।
জ্যোতিবাবুর শেষকৃত্যানুষ্ঠান চোখ ও মরদেহ আগেই দান করে গেছেন
জ্যোতিবাবুর চোখ দান করা ছিল। একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ওই চোখ গ্রহণ করার পর বেলা দু'টা নাগাদ সল্টলেকের হাসপাতাল থেকে মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় পিস ভবনে। সেখানে ডিপ ফ্রিজারে রাখা হয়েছে প্রয়াত এই নেতার মরদেহ। আজ সোমবার মরদেহ এখানেই থাকবে। আগামীকাল সকাল ১০টায় মরদেহ নিয়ে যাওয়া হবে (মহাকরণ) রাজ্য সচিবালয়ে। সেখান থেকে নেয়া হবে বিধানসভায়। এখানে চার ঘণ্টার জন্য থাকবে মৃতু্যঞ্জয়ী জননেতা জ্যোতি বসুর মরদেহ। এখানে দেশ-বিদেশের সরকারপ্রধান, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, দলের নেতাকমর্ী, সাধারণ মানুষ ফুলেল শ্রদ্ধায় অভিষিক্ত করবেন প্রয়াত জ্যোতি বসুকে। এখান থেকে মরদেহ নিয়ে যাওয়া হবে আলিমুদ্দিন স্ট্রীটের পার্টি সদর দফতরে। সেখান থেকে তাঁর মরদেহ নিয়ে যাওয়া হবে হাসপাতালে। জ্যোতিবাবুর দেহও মেডিক্যাল সায়েন্সের গবেষণার জন্য দান করা রয়েছে। জীবদ্দশায় তিনি দান করে গেছেন। আনুষ্ঠানিকভাবে হাসপাতাল কর্তৃপৰের কাছে এই জননেতার মরদেহ হসত্মানত্মর করা হবে।
জ্যোতিবাবু যেখানে অবিস্মরণীয়
সমাজতন্ত্র আর গণতন্ত্রের মেলবন্ধন তৈরিতে জ্যোতিবাবু অনেক বাসত্মব পদৰেপ নিয়েছিলেন। কমিউনিস্ট নেতা হয়েও সংস্কার আন্দোলনের অগ্রযাত্রায় তিনি পশ্চিমবঙ্গে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তা ঠিক পঞ্চায়েত কমিটি হোক আর ভূমি সংস্কারই হোক_ কোথায় তাঁর হাতের ছাপ নেই? দীর্ঘ ২৩ বছর মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করার পর স্বেচ্ছায় তাঁর ৰমতা ত্যাগ বিরল ঘটনা। শুধু তাই নয়, দলীয় সিদ্ধানত্ম মেনে নিয়ে তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রীর পদ ছাড়তেও দ্বিধা করেননি। দলীয় সিদ্ধানত্মের বাইরে যেতে হবে বলে দিলস্নীর মসনদ তাঁকে টানতে পারেনি। সর্বভারতীয় রাজনীতিতে তিনি ছিলেন জীবনত্ম কিংবদনত্মি। তিনি জনসাধারণের কাছে প্রিয়তম পিতা, অভিভাবক, নেতা, কল্যাণেষু আর সাধারণের জীবনধারণ মান অর্জনের এক দিকপাল। তাঁর মৃতু্যতে দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সতীর্থ সোমনাথ মুখোপাধ্যায় বলেছেন, তিনি আমাদের মানুষের রাজনীতি করতে শিখিয়েছেন। তাঁর মৃতু্যতে দ্বিতীয়বারের মতো পিতৃ বিয়োগের মতো ব্যথিত হয়েছি। মৃতু্যর খবর শুনে যারা হাসপাতালের সামনে জড়ো হয়েছেন তাদের অনেকেই কেঁদেছেন। কেউবা শোকে বিলাপ করেছেন। অনেকে বাষ্পরম্নদ্ধ হয়ে নীরব অশ্রম্ন বিসর্জনে অনুভব করেছেন তাদের প্রিয় নেতার পরলোক গমনের বেদনা। তবে দলের নেতাকর্মী ও অনেক সাধারণ মানুষ বলেছেন, আদর্শিক নেতার মৃতু্য নেই। জ্যোতি বসু ভারতবর্ষের একজন পথপ্রদর্শক। রাজনীতি ভোগের নয়_ ত্যাগের, সেখানে নীতি দর্শনই হচ্ছে চূড়ানত্ম সত্য_ জ্যোতিবাবুর এই শিৰার শীলন তাঁকে আমাদের মধ্যে মৃতু্যঞ্জয়ী করে রাখবে। বয়স হয়েছে। তিনি মারা যেতে পারেন। কিন্তু তাঁর আদর্শের মৃতু্য নেই_ এমন কথা বলতে বলতে জনৈক ভদ্রমহিলা কেঁদেই ফেলেন।
জ্যোতিবাবুর জ্যোতির্ময় জীবনের এক ঝলক
১৯১৪ সালে কলকাতায় এক সম্ভ্রানত্ম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন জ্যোতি বসু। ছোটবেলায় তাঁর নাম রাখা হয় জ্যোতিন্দ্র বসু। কিন্তু স্কুলে ভর্তি হওয়ার সময় তাঁর নাম ছোট করে রাখা হয় জ্যোতি বসু। তাঁর বাবা নিশিকানত্ম বসু পেশায় ডাক্তার ছিলেন। কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজিয়েট স্কুলে প্রাথমিক শিৰার পর জ্যোতি বসু প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে কলা বিভাগে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন ১৯৩৫ সালে। এর পর তিনি আইন পড়ার জন্য যুক্তরাজ্যে যান এবং সেখানেই কমরেড ভূপেশ গুপ্তের হাত ধরে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। ১৯৪০ সালে ব্যারিস্টারি পাস করে তিনি কলকাতায় ফিরে আসেন। ১৯৪৪ সালে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৪৬ সালে তিনি প্রাদেশিক আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৫৭ সাল থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যনত্ম পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিধানসভার বিরোধী দলের নেতার দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৪ সালে তিনি প্রথম পলিটবু্যরোর সদস্য নিযুক্ত হন। ১৯৬৭ সালে তিনি পশ্চিমবঙ্গে যুক্তফ্রন্ট সরকারের উপমুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন ১৯৭৭ সালের ২১ জুন। ১৯৯৬ সালে জ্যোতি বসুর ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ নিশ্চিত হলেও পার্টি ও পলিটবু্যরোর সদস্যরা রাজি না থাকায় তিনি প্রধানমন্ত্রী হননি। জ্যোতি বসুর পরিবর্তে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হন জনতা দলের এইচ ডি দেবগৌড়া। ভারতের প্রধানমন্ত্রী না হলেও ভারতের রাজনীতির ইতিহাসে একটানা দীর্ঘ সময় মুখ্যমন্ত্রী থাকার রেকর্ড গড়েছেন জ্যোতিবাবু। ২০০০ সালে স্বাস্থ্যগত কারণে জ্যোতি বসু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়ান। দায়িত্ব বুঝিয়ে দেন সতীর্থ রাজনীতিক বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে। মুখ্যমন্ত্রীর পদ ছাড়লেও তিনি রাজনৈতিক কর্মকা-ের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। ২০০৬ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর বয়সের ভারে নু্যব্জ জ্যোতি বসুকে দল থেকে অবসর দেয়া হলেও পরে আবার এ সিদ্ধানত্ম প্রত্যাহার করে নেয়া হয়।
রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও
বিরোধীদলীয় নেতার শোক
ভারতের প্রবীণ কমিউনিস্ট নেতা ও পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর মৃতু্যতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ জিলস্নুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ ছাড়া পৃথক পৃথক বিবৃতিতে জাতীয় সংসদের স্পীকার মোঃ আব্দুল হামিদ ও বিরোধীদলীয় নেতা ও বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া গভীর শোক প্রকাশ করেছেন।
রাষ্ট্রপতি তাঁর বিবৃতিতে বলেন, প্রগতিশীল রাজনীতিক জ্যোতি বসু পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ব্যাপক অবদান রেখেছেন। তাঁর আদর্শ রাজনীতিকদের অনুপ্রেরণা যোগাবে বলে আশা প্রকাশ করেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অপর এক বিবৃতিতে বলেন, বাংলাদেশের জনগণের অকৃত্রিম বন্ধু জ্যোতি বসু উপমহাদেশের সব রাজনৈতিক কমর্ীর কাছে অনুকরণীয় দৃষ্টানত্ম হয়ে থাকবেন। জ্যোতি বসুর মৃতু্যতে গভীর শোক প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভারত হারিয়েছে একজন মহান রাজনীতিককে। বাংলাদেশের জনগণ হারিয়েছে তাদের অকৃত্রিম শুভাকাঙ্ৰীদের আর আমি হারিয়েছি একজন অভিভাবক। জ্যোতি বসুর মৃতু্যতে অন্যান্যের মধ্যে শোক প্রকাশ করেছেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী, জাতীয় সংসদের চীফ হুইপ উপাধ্যৰ মোঃ আব্দুস শহীদ, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ সভাপতি ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি হাসানুল হক ইনু। গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন, সাংসদ এ্যাডভোকেট তালুকদার মোঃ ইউনুস।
এ ছাড়া বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনও শোক প্রকাশ করেছে। সংগঠনগুলো হচ্ছে : আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি (এরশাদ), বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ), বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি (ঋণগঠিত), জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি, বাংলাদেশ সাম্যবাদী দল (এমএল), জাতীয় পার্টি (জেপি), বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপ (ভাসানী), জাতীয় শ্রমিক লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ, ছাত্রলীগ, বাংলাদেশ ৰেতমজুর সমিতি, বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন, ছাত্র ইউনিয়ন, শ্রমিক কর্মচারী ঐক্যপরিষদ, চা-শ্রমিক ইউনিয়ন, বঙ্গবন্ধু নাগরিক সংহতি পরিষদ, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্ট, বাংলাদেশ শানত্মি পরিষদ, সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন, বাংলাদেশ আফ্রো এশীয় গণসংহতি পরিষদ ও ফোর্স অব বঙ্গবন্ধু।
No comments