নেপাল ও ভুটান বছরে ২০ লাখ টন পণ্য নিতে পারবে মংলা থেকে
কাওসার রহমান আমদানি-রফতানি পণ্যের কন্টেনারের অভাবে চট্টগ্রাম বন্দরের ৪৩ শতাংশ মতা অব্যবহৃত থেকে যাচ্ছে। অন্যদিকে মংলা বন্দরের মতা ২০ শতাংশও ব্যবহার করা যাচ্ছে না।
যে গতিতে বাংলাদেশের উন্নয়ন অব্যাহত আছে তা আরও বৃদ্ধি পেলেও কখনই বন্দর দু'টির পূর্ণ মতা ব্যবহার করা সম্ভব নয়। ফলে দেশের মধ্যে কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রাখলে অর্থনৈতিক বিবেচনায় বন্দর দু'টি সম্পদের 'অনুৎপাদনশীল ব্যবহার' হিসেবেই পরিগণিত হবে। অন্যদিকে প্রতিবেশী দেশ ভারতের বন্দরবিহীন উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য এবং নেপাল ও ভুটানের মালামাল এ দু'টি বন্দরের মাধ্যমে পরিবহনের সুযোগ সৃষ্টি করা গেলে শুধু সরকারের রাজস্ব আয়ই বৃদ্ধি পাবে না, বন্দর ব্যবহারকারী শিপিং এজেন্ট, সি এ্যান্ড এফ এজেন্ট, নৌপরিবহন মালিক গ্রম্নপ এবং স্টিভেডরস হ্যান্ডলিং শ্রমিকরা কাজের সুযোগ পাবে। তারা লাভবান হবে আর্থিকভাবে।নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশ বিভাগের আগে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর সঙ্গে চট্টগ্রাম অঞ্চলের সম্পর্ক ছিল অবিচ্ছেদ্য। দেশ বিভাগের পর ওই অঞ্চলগুলো যেমন চট্টগ্রাম বন্দরের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, তেমনি চট্টগ্রাম বন্দরও সম্ভাব্য আর্থিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। উভয় দেশের মধ্যে বন্দর ব্যবহারের চুক্তি না থাকার কারণে ওই অঞ্চলের সঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দরও আর্থিকভাবে তিগ্রসত্ম হচ্ছে।
বার্ষিক ৬৫ লাখ টন পণ্য হ্যান্ডলিং মতার মংলা বন্দরে গত ২০০৮-০৯ অর্থবছরে মাত্র ১১ লাখ টন মাল হ্যান্ডলিং করতে পেরেছে। কন্টেনারের অভাবে এ বন্দরটি তার মতার ২০ ভাগেরও কম মতা ব্যবহার করতে পারছে। ফলে বিদ্যমান সুবিধা দিয়েই এ বন্দর অনায়াসে বছরে নেপাল ও ভুটানের ১৫ থেকে ২০ লাখ টন মাল হ্যান্ডলিং করা সম্ভব। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রাম বন্দর সৃষ্টির পর থেকে এ পর্যনত্ম সর্বোচ্চ কন্টেনার ও পণ্য হ্যান্ডলিং করে এর সুবিধাদির মাত্র ৫৭ শতাংশ ব্যবহার করা সম্ভব হয়েছে। বর্তমানে এ বন্দরের হ্যান্ডলিং মতা ৩১ লাখ টিইইউএস। বন্দরটিতে নবনির্মিত এক হাজার মিটার দীর্ঘ নিউমুরিং কন্টেনার টার্মিনাল পরিচালনার জন্য প্রাইভেট অপারেটর নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে। এ টার্মিনাল ব্যবহার শুরম্ন হলে এর কন্টেনার ধারণ মতা আরও ১০ লাখ টিইইউএস বৃদ্ধি পাবে। অন্যদিকে পুরনো ছয় শ' মিটার দীর্ঘ ১১, ১২ ও ১৩ নং জেটি আধুনিকীকরণের কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে। এ কার্যক্রম সম্পন্ন হলে এর মতা আরও চার লাখ টিইইউএস বৃদ্ধি পাবে। বর্তমানে ১৭টি জেটি সংবলিত এ বন্দরের মাত্র চারটি জেটি আধুনিক যন্ত্রপাতি সজ্জিত। অন্য জেটিসমূহে পর্যায়ক্রমে আধুনিক যন্ত্রপাতি স্থাপন করা হলে ২০২০ সাল নাগাদ এর কন্টেনার ও পণ্য হ্যান্ডলিংয়ের মতা প্রায় তিনগুণ বৃদ্ধি পাবে। এ ছাড়া বর্তমানে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের সহায়তায় চট্টগ্রাম বন্দর ট্রেড ফ্যাসিলিটেশন প্রকল্পের কাজ চলছে। এ কাজ সম্পন্ন হলে বন্দরের মতা আরও বৃদ্ধি পাবে। অন্যদিকে ঢাকার অদূরে পানগাঁওয়ে অভ্যনত্মরীণ নৌ কন্টেনার টার্মিনালের নির্মাণকাজ শেষ হলে চট্টগ্রাম বন্দরের কাজ উলেস্নখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস পাবে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের বর্তমান আমদানি-রফতানির গতিধারা অব্যাহত থাকলেও বন্দরটিকে কখনও পূর্ণ মতায় ব্যবহার করা সম্ভব হবে না। ফলে এটি সম্পদের অনুৎপাদনশীল ব্যবহার হিসেবে পরিগণিত হবে।
বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর বন্দর ব্যবহার কার্যক্রম পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ইউরোপের সর্ববৃহৎ রটারডাম বন্দর এবং বেলজিয়ামের এন্টিয়ান বন্দর দু'টি নিজ দেশের আমদানি-রফতানি কার্যক্রম পরিচালনা করে মাত্র এক-তৃতীয়াংশ মতা ব্যবহার করতে পারছে। ফলে দু'টি বন্দরই এখন নিজ দেশের সীমারেখার বাইরে সমগ্র ইউরোপের বন্দর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। একইভাবে এশিয়ার সর্ববৃহৎ বন্দর সিঙ্গাপুর তার নিজ দেশের আমদানি-রফতানি কার্যক্রম করে মতার মাত্র ১০ শতাংশ ব্যবহার করছে। বাকি ৯০ শতাংশ মতা ব্যবহৃত হচ্ছে এশিয়ার অন্যান্য দেশের আমদানি-রফতানি কার্যক্রম করে। একই অবস্থা হংকংয়ের েেত্রও। এশিয়ার মধ্যে সিঙ্গাপুর হংকং কলম্বো প্রভৃতি বন্দর তাদের কার্যক্রম নিজ দেশের গ-ির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেনি। এখানে রাজনৈতিক বিবেচনার বাইরে অর্থনৈতিক বিবেচনাই প্রাধান্য পেয়েছে। কেনিয়ার মোম্বাসা ও তাঞ্জানিয়ার দারম্নসসালাম বন্দর দু'টিও সমগ্র আফ্রিকার ৯০ শতাংশ আমদানি-রফতানি কার্যক্রম সম্পন্ন করছে।
ভারতে ত্রিপুরা অঞ্চলে বছরে প্রায় ১৫ হাজার কন্টেনারবাহী মালামাল আমদানি-রফতানির প্রয়োজন হয়। অঞ্চলটি চট্টগ্রাম থেকে মাত্র ২৫০ কিলোমিটারের মধ্যে রয়েছে। অথচ ভারতে সঙ্গে চুক্তি না থাকার কারণে ত্রিপুরা রাজ্য এ বন্দর ব্যবহার করতে পারছে না। এতে ত্রিপুরার চেয়ে চট্টগ্রাম বন্দরই বেশি তিগ্রসত্ম হচ্ছে। এ ছাড়া সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর চালুর আগেই চট্টগ্রাম বন্দরের পশ্চাদভূমি বাড়ানোর কোন বিকল্প নেই।
নেপাল ও ভারতের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী ১৯৯৭ সালে কাঁকরভিটা (নেপাল), নক্সালবাড়ি (ভারত) ও বাংলাবান্ধার (বাংলাদেশ) সীমানত্মপথে সড়ক পরিবহনের মাধ্যমে নেপালী ট্রানজিট পণ্য পরিবহন শুরম্ন হয়। ১৯৯৭ সালের ডিসেম্বর থেকে ১৯৯৮ সালের নবেম্বর মাস পর্যনত্ম ৬০ হাজার ৩০০ টন নেপালী ট্রানজিট পণ্য সড়ক ও রেলপথে নেপালে পরিবাহিত হয়েছে। এতে মংলা বন্দরের ৯৬ লাখ টাকা আয় হয়। নেপাল বছরে ১০ লাখ টন মাল মংলা বন্দরের মাধ্যমে আমদানি করতে আগ্রহী। এ মাল হ্যান্ডলিং করা গেলে বন্দরের বছরে প্রায় ১৬ কোটি টাকা আয় হবে। মংলা বন্দরের মাধ্যমে এখন পর্যনত্ম ভুটানে কোন মালামাল হ্যান্ডলিং হয়নি। ভুটানও তাদের ট্রানজিট পণ্য মংলা বন্দরের মাধ্যমে হ্যান্ডলিং করতে আগ্রহী। এ দু'টি দেশের ট্রানজিট পণ্য হ্যান্ডলিং করা গেলে শুধু সরকারের রাজস্ব আয়ই বৃদ্ধি পাবে না, বন্দর ব্যবহারকারী শিপিং এজেন্ট, সিএ্যান্ডএফ এজেন্ট, নৌপরিবহন মালিক গ্রম্নপ ও স্টিভেডরস হ্যান্ডলিং শ্রমিকরা কাজের সুযোগ পাবে এবং তারা আর্থিকভাবে লাভবান হবে।
মংলা বন্দরকে পুনরায় লাভজনকভাবে পরিচালনার জন্য প্রতিবেশী বন্দরবিহীন দেশ নেপাল ও ভুটানের মালামাল এ বন্দরের মাধ্যমে পরিবহনের সুযোগ সৃিষ্ট করা গেলে তা দেশের সার্বিক উন্নয়নে বিশেষ অবদান রাখবে। এতে আনত্মর্জাতিক অঙ্গনেও বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে।
No comments