বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না
৩৮৫ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। আবদুল বাতেন, বীর প্রতীক শত্রুর আক্রমণ রুখে দিলেন তাঁরা ভোররাতে আবদুল বাতেনসহ মুক্তিযোদ্ধারা নিঃশব্দে অবস্থান নিলেন টিলার ওপর। অদূরে বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থান।
সেখানে প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত আছে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের এক কোম্পানি সেনা। আরও আছে ২ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স, ইস্ট পাকিস্তান সিভিল আর্মড ফোর্স ও সহযোগী রাজাকার। সব মিলে বিপুল শক্তি।
সকাল থেকে আবদুল বাতেনদের অবস্থান এলাকায় শুরু হয়ে গেল তুমুল যুদ্ধ। নায়েক শহীদ মেশিনগানম্যান। আবদুল বাতেন তাঁর সহকারী। তাঁরা দুইজন মেশিনগান দিয়ে অবিরাম গুলি করতে থাকলেন পাকিস্তানি সেনাদের লক্ষ্য করে। পাকিস্তানিরাও গুলি করতে থাকল। আবদুল বাতেনদের মেশিনগানের গুলিতে থেমে গেল পাকিস্তানি সেনাদের অগ্রযাত্রা।
এ ঘটনা ছাতকে। ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি। ছাতক সিলেট জেলার অন্তর্গত। সুরমা নদীর তীরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ নদীবন্দর। নদীর পশ্চিম তীরে ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরি। ছাতক শহর ও সিমেন্ট ফ্যাক্টরি ঘিরে ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রতিরক্ষা।
১৪ অক্টোবর মুক্তিযোদ্ধারা ছাতকে আক্রমণ করেন। তারা কয়েকটি দলে বিভক্ত ছিলেন। কাট অফ পার্টিতে ছিলেন আবদুল বাতেন। তাঁর দলের নেতৃত্বে ছিলেন লেফটেন্যান্ট এস আই এম নূরুন্নবী খান (বীর বিক্রম, পরে লে. কর্নেল) তাঁরা ছাতকের অদূরে হাসনাবাদ এলাকায় অবস্থান নেন। যাতে ওই দিক দিয়ে পাকিস্তানিদের ছাতকের অবস্থানে কোনো রিইনফোর্সমেন্ট না পারে।
মুক্তিযোদ্ধাদের মূল দল ছাত্রকে আক্রমণ করার আগেই পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাঁদের উপস্থিতি টের পেয়ে যায়। আবদুল বাতেনরা যেখানে অবস্থান নিয়েছিলেন সেখানে পাকিস্তানি সেনারা কয়েকবার আক্রমণ করে। ভয়াবহ যুদ্ধ হয়।
এই যুদ্ধের ঘটনা শোনা যাক এস আই এম নূরুন্নবী খানের কাছ থেকে। তিনি বলেন, ১৪ অক্টোবর ১৯৭১। তখন সকাল ৯টার মতো হবে। পাকিস্তানিদের দিক প্রতীক্ষিত প্রথম আক্রমণটি এসে গেল। উত্তর কালারুখা গ্রামের দক্ষিণ প্রান্তের সুপারি বাগানে ওদেরকে একত্রিত হতে দেখলাম। দেখতে না দেখতেই পাকিস্তানিরা অ্যাসল্ট লাইন করে আমাদের অবস্থানের দিকে দৌড়ে এগিয়ে আসতে লাগল। নায়েক শহীদের মেশিনগান অবস্থানটি ছিল আমার পাশেই। তাঁর সহকারী ছিল আবদুল বাতেন। শহীদকে মেশিনগানের গুলি ছোঁড়ার নির্দেশ দিলাম। অন্যান্য সব অবস্থান থেকেও এক যোগে গুলি ছোঁড়া শুরু হলো।
‘পাকিস্তানিদের অগ্রযাত্রা থেমে গেল। অনেকগুলো লাশ মাঠে ফেলে রেখে ওরা পেছনে হটে গেল। সকাল ১০টার দিকে পাকিস্তানিরা পুনরায় আক্রমণের চেষ্টা চালাল। এভাবে সারাদিন তারা অন্তত পাঁচ/ছয় বার আমাদের অবস্থানে আক্রমন করে। পাকিস্তানিদের পাল্টা আক্রমণগুলো ছিল ভয়াবহ ধরনের। দুই তিনটি আক্রমণ নায়েক শহীদ ও আবদুল বাতেন দুঃসাহসিকতার সঙ্গে প্রতিহত করেন। তাঁদের বীরত্বে আমরা বিপর্যয় থেকে রক্ষা পাই।’
আবদুল বাতেন চাকরি করতেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। ১৯৭১ সালে এই রেজিমেন্টের অবস্থান ছিল সৈয়দপুর সেনানিবাসে। মার্চের প্রথম দিকে তাঁদের বেশির ভাগকে সেনানিবাসের বাইরে মোতায়েন করা হয়। তবে তিনি হেডকোয়ার্টার কোম্পানির সঙ্গে সেনানিবাসে ছিলেন। ৩০ মার্চ তাঁরা বিদ্রোহ করে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। দিনাজপুর ও সিলেট জেলায় যুদ্ধ করেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য আবদুল বাতেনকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ১৩১।
আবদুল বাতেন ২০০৭ সালে মারা গেছেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি রংপুর জেলার বদরগঞ্জ উপজেলার রামনাথপুর ইউনিয়নের ছিটলক্ষ্মণপুর রাধানগর গ্রামে। তাঁর বাবার নাম আবদুল কুদ্দুস সরকার, মা রাহেলা বেগম, স্ত্রী সাজেদা বেগম। তাঁদের তিন ছেলে ও দুই মেয়ে।
সূত্র: প্রথম আলোর রংপুরের নিজস্ব প্রতিবেদক আরিফুল হক এবং এস আই এম নূরুন্নবী খান বীর বিক্রম।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com
সকাল থেকে আবদুল বাতেনদের অবস্থান এলাকায় শুরু হয়ে গেল তুমুল যুদ্ধ। নায়েক শহীদ মেশিনগানম্যান। আবদুল বাতেন তাঁর সহকারী। তাঁরা দুইজন মেশিনগান দিয়ে অবিরাম গুলি করতে থাকলেন পাকিস্তানি সেনাদের লক্ষ্য করে। পাকিস্তানিরাও গুলি করতে থাকল। আবদুল বাতেনদের মেশিনগানের গুলিতে থেমে গেল পাকিস্তানি সেনাদের অগ্রযাত্রা।
এ ঘটনা ছাতকে। ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি। ছাতক সিলেট জেলার অন্তর্গত। সুরমা নদীর তীরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ নদীবন্দর। নদীর পশ্চিম তীরে ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরি। ছাতক শহর ও সিমেন্ট ফ্যাক্টরি ঘিরে ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রতিরক্ষা।
১৪ অক্টোবর মুক্তিযোদ্ধারা ছাতকে আক্রমণ করেন। তারা কয়েকটি দলে বিভক্ত ছিলেন। কাট অফ পার্টিতে ছিলেন আবদুল বাতেন। তাঁর দলের নেতৃত্বে ছিলেন লেফটেন্যান্ট এস আই এম নূরুন্নবী খান (বীর বিক্রম, পরে লে. কর্নেল) তাঁরা ছাতকের অদূরে হাসনাবাদ এলাকায় অবস্থান নেন। যাতে ওই দিক দিয়ে পাকিস্তানিদের ছাতকের অবস্থানে কোনো রিইনফোর্সমেন্ট না পারে।
মুক্তিযোদ্ধাদের মূল দল ছাত্রকে আক্রমণ করার আগেই পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাঁদের উপস্থিতি টের পেয়ে যায়। আবদুল বাতেনরা যেখানে অবস্থান নিয়েছিলেন সেখানে পাকিস্তানি সেনারা কয়েকবার আক্রমণ করে। ভয়াবহ যুদ্ধ হয়।
এই যুদ্ধের ঘটনা শোনা যাক এস আই এম নূরুন্নবী খানের কাছ থেকে। তিনি বলেন, ১৪ অক্টোবর ১৯৭১। তখন সকাল ৯টার মতো হবে। পাকিস্তানিদের দিক প্রতীক্ষিত প্রথম আক্রমণটি এসে গেল। উত্তর কালারুখা গ্রামের দক্ষিণ প্রান্তের সুপারি বাগানে ওদেরকে একত্রিত হতে দেখলাম। দেখতে না দেখতেই পাকিস্তানিরা অ্যাসল্ট লাইন করে আমাদের অবস্থানের দিকে দৌড়ে এগিয়ে আসতে লাগল। নায়েক শহীদের মেশিনগান অবস্থানটি ছিল আমার পাশেই। তাঁর সহকারী ছিল আবদুল বাতেন। শহীদকে মেশিনগানের গুলি ছোঁড়ার নির্দেশ দিলাম। অন্যান্য সব অবস্থান থেকেও এক যোগে গুলি ছোঁড়া শুরু হলো।
‘পাকিস্তানিদের অগ্রযাত্রা থেমে গেল। অনেকগুলো লাশ মাঠে ফেলে রেখে ওরা পেছনে হটে গেল। সকাল ১০টার দিকে পাকিস্তানিরা পুনরায় আক্রমণের চেষ্টা চালাল। এভাবে সারাদিন তারা অন্তত পাঁচ/ছয় বার আমাদের অবস্থানে আক্রমন করে। পাকিস্তানিদের পাল্টা আক্রমণগুলো ছিল ভয়াবহ ধরনের। দুই তিনটি আক্রমণ নায়েক শহীদ ও আবদুল বাতেন দুঃসাহসিকতার সঙ্গে প্রতিহত করেন। তাঁদের বীরত্বে আমরা বিপর্যয় থেকে রক্ষা পাই।’
আবদুল বাতেন চাকরি করতেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। ১৯৭১ সালে এই রেজিমেন্টের অবস্থান ছিল সৈয়দপুর সেনানিবাসে। মার্চের প্রথম দিকে তাঁদের বেশির ভাগকে সেনানিবাসের বাইরে মোতায়েন করা হয়। তবে তিনি হেডকোয়ার্টার কোম্পানির সঙ্গে সেনানিবাসে ছিলেন। ৩০ মার্চ তাঁরা বিদ্রোহ করে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। দিনাজপুর ও সিলেট জেলায় যুদ্ধ করেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য আবদুল বাতেনকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ১৩১।
আবদুল বাতেন ২০০৭ সালে মারা গেছেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি রংপুর জেলার বদরগঞ্জ উপজেলার রামনাথপুর ইউনিয়নের ছিটলক্ষ্মণপুর রাধানগর গ্রামে। তাঁর বাবার নাম আবদুল কুদ্দুস সরকার, মা রাহেলা বেগম, স্ত্রী সাজেদা বেগম। তাঁদের তিন ছেলে ও দুই মেয়ে।
সূত্র: প্রথম আলোর রংপুরের নিজস্ব প্রতিবেদক আরিফুল হক এবং এস আই এম নূরুন্নবী খান বীর বিক্রম।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com
No comments