বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না
৩৮৩ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। শহীদ মো. সানা উল্লাহ, বীর বিক্রম রাধানগর যুদ্ধে শহীদ হন তিনি মো. সানা উল্লাহ চাকরি করতেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। ১৯৭১ সালে এই রেজিমেন্টের অবস্থান ছিল সৈয়দপুর সেনানিবাসে।
জানুয়ারি মাসে তিনি ছুটিতে বাড়িতে আসেন। ফেব্রুয়ারি মাসের শেষে আবার চাকরিতে যোগ দেন। এর কিছু দিন পর শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ।
এরপর পরিবারের সঙ্গে মো. সানা উল্লাহর আর কোনো যোগাযোগ ছিল না। স্বাধীনতার দু-তিন মাস পর তারা জানতে পারেন, তিনি মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। কোথায়, কোন যুদ্ধে তিনি শহীদ হন, সেটা তাঁদের জানানো হয়নি।
১৯৭১ সালের মার্চে সম্ভাব্য ভারতীয় আগ্রাসনের কথা বলে তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বেশিরভাগ সদস্যকে সেনানিবাসের বাইরে মোতায়েন করা হয়। কিছু অংশ থাকে সেনানিবাসে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তারা ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। দিনাজপুর জেলার বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধ করেন। এরপর ভারতে যান। সেখানে তারা পুনর্গঠিত হন।
এ সময় তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক নিযুক্ত হন মেজর শাফায়াত জামিল (বীর বিক্রম, পরে কর্নেল)। একটি কোম্পানির (ডেলটা [ডি]) অধিনায়ক নিযুক্ত হন লেফটেন্যান্ট এস আই এম নূরুন্নবী খান (বীর বিক্রম, পরে কর্নেল)।
এস আই এম নূরুন্নবী খান তাঁর জীবিত সহযোদ্ধাদের কাছে খোঁজ নিয়ে জানালেন, মো. সানা উল্লাহ সিলেট জেলার রাধানগরসংলগ্ন ছোটখেল যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। মো. সানা উল্লাহ ছিলেন চার্লি (‘সি’) কোম্পানিতে। রাধানগরে চার্লি কোম্পানির একটি প্লাটুন ও ডেলটা কোম্পানির সঙ্গে যুদ্ধে অংশ নেয়। ওই প্লাটুনেই ছিলেন মো. সানা উল্লাহ।
নভেম্বরের শেষে রাধানগরে ভয়াবহ যুদ্ধ হয়। রাধানগরের বিভিন্ন স্থানে ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবস্থান। তাদের একটি অবস্থান ছিল ছোটখেলে। ২৬ নভেম্বর মিত্রবাহিনীর ৫/৫ গোর্খা রেজিমেন্ট রাধানগরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সব অবস্থানে একযোগে আক্রমণ করে। মুক্তিযোদ্ধারাও তাদের সঙ্গে যুদ্ধে অংশ নেন। এই যুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পাল্টা আক্রমণে গোর্খা রেজিমেন্টের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। তাদের কোম্পানি কমান্ডারসহ ৬৭ জন শহীদ হন। মুক্তিযোদ্ধা কয়েকজন আহত হন। তবে কেউ এদিন শহীদ হননি।
মিত্রবাহিনীর ২৬ নভেম্বরের আক্রমণ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হওয়ার পর মুক্তিবাহিনীর ওপর দায়িত্ব পড়ে রাধানগর দখলের। ২৮ নভেম্বর ভোরে মুক্তিযোদ্ধারা প্রথমে ছোটখেল আক্রমণ করেন। এই যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর পক্ষে নেতৃত্ব দেন শাফায়াত জামিল। যুদ্ধে তিনি আহত হলে নেতৃত্ব দেন এস আই এম নূরুন্নবী খান।
মুক্তিযোদ্ধারা সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করে ছোটখেল দখল করেন। পাকিস্তানি সেনারা তাদের অবস্থান ছেড়ে পিছু হটে যায়। সকাল আটটার দিকে তারা পুনর্গঠিত হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর পাল্টা আক্রমণ শুরু করে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একের পর এক আক্রমণ মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিহত করেন। সেদিন যুদ্ধে মো. সানা উল্লাহসহ বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ও অনেকে আহত হন।
রাধানগর যুদ্ধ সম্পর্কে এস আই এম নূরুন্নবী খান বলেন, ‘২৮ নভেম্বর ১৯৭১। তখন সকাল সাতটা ৩০ মিনিটের মতো হবে। ব্যাপক আর্টিলারি গোলা নিক্ষেপের পরপরই তিন দিক থেকে স্থল হামলা শুরু হলো। পাকিস্তানিরা তিন দিক থেকে নারায়ে তাকবির, আল্লাহু আকবর, ইয়া আলী, ইয়া হায়দার ধ্বনি দিয়ে আমাদের ওপর আক্রমণ চালাল। উত্তরে রাধানগর এবং দক্ষিণে গোয়াইনঘাট থেকে আসা ওদের কাউন্টার অ্যাটাক ছিল খুবই মারাত্মক ধরনের। মুক্তিযোদ্ধারা সাহসের সঙ্গে প্রতিহামলা প্রতিহত করলেন। দুপুর ১২টার দিকে পুনরায় পাকিস্তানিদের একটি ব্যাপক প্রতিহামলা আসে। এবারও তিন দিক থেকে এ হামলা আসে। এবারের প্রতিহামলায় ওদের জনবলের সংখ্যা পূর্বের চেয়ে অনেক বেশি ছিল।’
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য শহীদ মো. সানা উল্লাহকে মরণোত্তর বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ৭১।
মো. সানা উল্লাহর পৈতৃক বাড়ি লক্ষ্মীপুর জেলার সদর উপজেলার নন্দনপুর ইউনিয়নের নন্দনপুর গ্রামে। তাঁর বাবার নাম সোলায়মান মিয়া, মা সাদিয়া খাতুন। স্ত্রী মনোয়ারা বেগম। তাঁদের এক মেয়ে। শহীদ মো. সানা উল্লাহর ছবি পাওয়া যায়নি।
সূত্র: ফখরুল ইসলাম (নোয়াখালী) এবং অপারেশন রাধানগর, লে. কর্নেল এস আই এম নূরুন্নবী খান বীর বিক্রম।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com
এরপর পরিবারের সঙ্গে মো. সানা উল্লাহর আর কোনো যোগাযোগ ছিল না। স্বাধীনতার দু-তিন মাস পর তারা জানতে পারেন, তিনি মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। কোথায়, কোন যুদ্ধে তিনি শহীদ হন, সেটা তাঁদের জানানো হয়নি।
১৯৭১ সালের মার্চে সম্ভাব্য ভারতীয় আগ্রাসনের কথা বলে তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বেশিরভাগ সদস্যকে সেনানিবাসের বাইরে মোতায়েন করা হয়। কিছু অংশ থাকে সেনানিবাসে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তারা ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। দিনাজপুর জেলার বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধ করেন। এরপর ভারতে যান। সেখানে তারা পুনর্গঠিত হন।
এ সময় তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক নিযুক্ত হন মেজর শাফায়াত জামিল (বীর বিক্রম, পরে কর্নেল)। একটি কোম্পানির (ডেলটা [ডি]) অধিনায়ক নিযুক্ত হন লেফটেন্যান্ট এস আই এম নূরুন্নবী খান (বীর বিক্রম, পরে কর্নেল)।
এস আই এম নূরুন্নবী খান তাঁর জীবিত সহযোদ্ধাদের কাছে খোঁজ নিয়ে জানালেন, মো. সানা উল্লাহ সিলেট জেলার রাধানগরসংলগ্ন ছোটখেল যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। মো. সানা উল্লাহ ছিলেন চার্লি (‘সি’) কোম্পানিতে। রাধানগরে চার্লি কোম্পানির একটি প্লাটুন ও ডেলটা কোম্পানির সঙ্গে যুদ্ধে অংশ নেয়। ওই প্লাটুনেই ছিলেন মো. সানা উল্লাহ।
নভেম্বরের শেষে রাধানগরে ভয়াবহ যুদ্ধ হয়। রাধানগরের বিভিন্ন স্থানে ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবস্থান। তাদের একটি অবস্থান ছিল ছোটখেলে। ২৬ নভেম্বর মিত্রবাহিনীর ৫/৫ গোর্খা রেজিমেন্ট রাধানগরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সব অবস্থানে একযোগে আক্রমণ করে। মুক্তিযোদ্ধারাও তাদের সঙ্গে যুদ্ধে অংশ নেন। এই যুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পাল্টা আক্রমণে গোর্খা রেজিমেন্টের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। তাদের কোম্পানি কমান্ডারসহ ৬৭ জন শহীদ হন। মুক্তিযোদ্ধা কয়েকজন আহত হন। তবে কেউ এদিন শহীদ হননি।
মিত্রবাহিনীর ২৬ নভেম্বরের আক্রমণ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হওয়ার পর মুক্তিবাহিনীর ওপর দায়িত্ব পড়ে রাধানগর দখলের। ২৮ নভেম্বর ভোরে মুক্তিযোদ্ধারা প্রথমে ছোটখেল আক্রমণ করেন। এই যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর পক্ষে নেতৃত্ব দেন শাফায়াত জামিল। যুদ্ধে তিনি আহত হলে নেতৃত্ব দেন এস আই এম নূরুন্নবী খান।
মুক্তিযোদ্ধারা সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করে ছোটখেল দখল করেন। পাকিস্তানি সেনারা তাদের অবস্থান ছেড়ে পিছু হটে যায়। সকাল আটটার দিকে তারা পুনর্গঠিত হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর পাল্টা আক্রমণ শুরু করে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একের পর এক আক্রমণ মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিহত করেন। সেদিন যুদ্ধে মো. সানা উল্লাহসহ বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ও অনেকে আহত হন।
রাধানগর যুদ্ধ সম্পর্কে এস আই এম নূরুন্নবী খান বলেন, ‘২৮ নভেম্বর ১৯৭১। তখন সকাল সাতটা ৩০ মিনিটের মতো হবে। ব্যাপক আর্টিলারি গোলা নিক্ষেপের পরপরই তিন দিক থেকে স্থল হামলা শুরু হলো। পাকিস্তানিরা তিন দিক থেকে নারায়ে তাকবির, আল্লাহু আকবর, ইয়া আলী, ইয়া হায়দার ধ্বনি দিয়ে আমাদের ওপর আক্রমণ চালাল। উত্তরে রাধানগর এবং দক্ষিণে গোয়াইনঘাট থেকে আসা ওদের কাউন্টার অ্যাটাক ছিল খুবই মারাত্মক ধরনের। মুক্তিযোদ্ধারা সাহসের সঙ্গে প্রতিহামলা প্রতিহত করলেন। দুপুর ১২টার দিকে পুনরায় পাকিস্তানিদের একটি ব্যাপক প্রতিহামলা আসে। এবারও তিন দিক থেকে এ হামলা আসে। এবারের প্রতিহামলায় ওদের জনবলের সংখ্যা পূর্বের চেয়ে অনেক বেশি ছিল।’
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য শহীদ মো. সানা উল্লাহকে মরণোত্তর বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ৭১।
মো. সানা উল্লাহর পৈতৃক বাড়ি লক্ষ্মীপুর জেলার সদর উপজেলার নন্দনপুর ইউনিয়নের নন্দনপুর গ্রামে। তাঁর বাবার নাম সোলায়মান মিয়া, মা সাদিয়া খাতুন। স্ত্রী মনোয়ারা বেগম। তাঁদের এক মেয়ে। শহীদ মো. সানা উল্লাহর ছবি পাওয়া যায়নি।
সূত্র: ফখরুল ইসলাম (নোয়াখালী) এবং অপারেশন রাধানগর, লে. কর্নেল এস আই এম নূরুন্নবী খান বীর বিক্রম।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com
No comments