নির্বাচন কমিশন গঠন-অনুসন্ধান কমিটি ভালো, তবে যথেষ্ট নয় by শাহ্দীন মালিক
২৩ জানুয়ারির অনেকগুলো—বোধ হয় সব কয়টি, তবে সব দেখা বা পড়া তো সম্ভব নয়—পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠার অন্যতম প্রধান খবর হলো নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনে অনুসন্ধান কমিটি সংক্রান্ত। দু-চারটা পত্রিকায় তাৎক্ষণিক মন্তব্যও ছাপা হয়েছে। বিএনপির পক্ষ থেকে যথারীতি ‘প্রত্যাখ্যান’ বা ওই গোছের কিছু ‘করা’ হয়েছে। মওদুদ সাহেবও আবার যথারীতি এটাকে ‘অসাংবিধানিক’ বলেছেন।
বেচারা সংবিধান। আজকাল কারও না কারও মতে, প্রায় সবকিছুই অসাংবিধানিক। অর্থাৎ দেশে কোনো কিছুই সংবিধান অনুযায়ী চলছে না। জামায়াতিরা যেমন বলেন, যুদ্ধাপরাধের বিচারসংক্রান্ত সবকিছুই নাকি আন্তর্জাতিক মানের পরিপন্থী। বাকস্বাধীনতার দেশে সবাই সবকিছু বলতে পারে। যে দেশে বাকস্বাধীনতা নেই সে দেশে ‘পাগলে কি না বলে ছাগলে কি না খায়’ প্রসঙ্গটি অপ্র্রযোজ্য। বর্তমানে সিরিয়ার নাগরিক হলে বিষয়টি আমরা টের পেতাম, বাকস্বাধীনতা চর্চা করার জন্য গুলিবিদ্ধ হয়ে।
সিরিয়া অবশ্য মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য অনেক দেশের তুলনায় অতটা ‘ধর্মপ্রাণ’ না। মধ্যপ্রাচ্যের যে দেশ যতটা বেশি ‘ধর্মপ্রাণ’ সে দেশে বাকস্বাধীনতা ততটা কম। আর ওসব ভীষণভাবে ধর্মপ্রাণ দেশের মহিলা হলে তো ‘বাক’ই না, স্বাধীনতা অনেক দুরস্ত।
আমাদের দেশে বাকস্বাধীনতা চর্চার সুযোগ এন্তার। তবে মাঝেমধ্যে অনুজপ্রতিম আসিফ নজরুলের মতো অনেককে বাকস্বাধীনতা চর্চার ‘ঠেলা’ সামলাতে হয়। যাঁরা দিনের পর দিন—সরি, রাতের পর রাত—টেলিবাক্সে কথা বলেন, তাঁদের দু-একটা অসতর্ক মুহূর্তে পাঁচ-সাত-দশটা শব্দ মুখ থেকে বেরিয়ে যেতে পারে যেগুলোকে বিচ্ছিন্নভাবে উদ্ধত করে বক্তা যে অর্থ বলেছেন তার সম্পূর্ণ ভিন্ন অর্থ দাঁড় করিয়ে বক্তাকে নাস্তানাবুদ করার জন্য মাঝেমধ্যে নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তির অভাব হয় না। এসব ক্ষেত্রে বাকস্বাধীনতাটা হয়ে যায় ধর্মপ্রাণ দেশগুলোর মতো। রাজার শুধু প্রশংসাই করা যাবে।
এত বড় ভূমিকা সম্পূর্ণ কারণবিহীন নয়। অনুসন্ধান কমিটি সম্পর্কে প্রথমেই যা বলতে চাই তা হলো—সার্চ কমিটিতে দুজন বিচারপতির অন্তর্ভুক্তি কাম্য নয়। অন্য কথায় অনুসন্ধান কমিটিতে বিচারকদের থাকা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক।
ওয়াকিবহাল পাঠকমাত্রই অবগত আছেন যে মহামান্য রাষ্ট্রপতি ইসি গঠনে চার সদস্যের একটি সার্চ বা অনুসন্ধান কমিটি গঠন করেছেন। এই কমিটিতে থাকবেন আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগের একজন করে দুজন বিচারপতি, বাংলাদেশে মহা হিসাবনিরীক্ষক ও কর্মকমিশনের চেয়ারম্যান। কোন দুই বিচারপতি থাকবেন, সেটা নির্দিষ্ট করবেন প্রধান বিচারপতি। সে অনুযায়ী প্রধান বিচারপতি সোমবার দুজন বিচারপতিকে মনোনয়ন দিয়েছেন। তথাস্তু নির্বাচন কমিশন গঠনসংক্রান্ত একটা আইন না করে, রাষ্ট্রপতি শুধু একটা প্রজ্ঞাপন জারি করে অনুসন্ধান কমিটি না করলেই পারতেন। অর্থাৎ আপাতত একটা অধ্যাদেশ জারি করে নির্বাচন কমিশনের সব কয়টি প্রাসঙ্গিক দিক এই অধ্যাদেশ অর্থাৎ আইনটিতে অন্তর্ভুক্ত করা যেত। বিশেষ করে দুটো প্রাসঙ্গিক ব্যাপার—প্রধান ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারের ন্যূনতম যোগ্যতার ব্যাপারে আইনটিতে বিস্তারিত থাকতে পারত। এবং কারা সম্ভাব্য প্রার্থীর নাম প্রস্তাব করবেন। দ্বিতীয়ত, প্রাসঙ্গিক বিষয়টা হতে পারত এই সার্চ কমিটির কার্যপদ্ধতি। এখন প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে যে সার্চ কমিটি খোদ তার কার্যপ্রণালি বা কার্যপদ্ধতি নির্ধারণ করবে।
গণতন্ত্র, স্বচ্ছতা আর জবাবদিহি আমরা যদি সত্যিই বিশ্বাস করি অর্থাৎ এগুলো যদি লোক দেখানো বুলি না হয়, তাহলে অনুসন্ধান কমিটি বৈঠক উন্মুক্ত হওয়া উচিত। কমিটি দিন-তারিখ-সময় ঘোষণা করে বৈঠকে বসা উচিত। আমজনতা না হলেও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে যেমন প্রধান, প্রধান রাজনৈতিক দল—যে দলগুলো মহামান্য রাষ্ট্রপতির সঙ্গে এ ব্যাপারে সংলাপে অংশ নিয়েছে অন্তত তাদের পক্ষ থেকে একজন করে প্রতিনিধি সার্চ কমিটির মিটিংয়ে থাকতে পারে। সুশীল সমাজ, সংবাদমাধ্যম এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্য থেকে জনা পঞ্চাশেক লোকের উপস্থিতিতে একটা বড় হলরুমে অনুসন্ধান কমিটি বৈঠক করবে। হলরুমের অন্য প্রান্তে ওপরে উল্লিখিত ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে কমিটি মাইকের সামনে অনুসন্ধান কমিটি তাদের আলোচনা চালাক। মাইকের মাধ্যমে হলে উপস্থিত সবাই শুনবে, জানবে, বুঝবে—কমিটি কেন অমুক ব্যক্তির নাম বিবেচনা করছে।
অনেক গণতান্ত্রিক দেশে অনুসন্ধান কমিটির এ ধরনের সভায় আড়ালে-আবডালে হয় না। আমেরিকায় লাইভ টেলিভিশন অর্থাৎ অনুসন্ধান কমিটির বৈঠক টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। আমরা অত দূর এখনই না-ই বা গেলাম, কিন্তু ৫০ জনের উপস্থিতিতে তো সার্চ কমিটি তার আলোচনা চালাতে পারে। বলা বাহুল্য, এই ৫০ জন উপস্থিত থেকে শুধু শুনবেন, কিছু বলবেন না।
সার্চ কমিটিকে করজোড়ে অনুনয়-বিনয় করবে—যদি সাহস থাকে তাহলে আপনাদের সভার উন্মুক্ত কার্যপদ্ধতি নির্ধারণ করুন। এ দেশে ভবিষ্যতে নির্বাচন সুষ্ঠু, স্বচ্ছ ও সঠিক হবে কি না সেটা প্রধানত নির্ভর করবে নতুন নির্বাচন কমিশনের ওপর। বর্তমান নির্বাচন কমিশন তার সর্বোৎকৃষ্ট প্রমাণ। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদকালে সবগুলো নির্বাচনই সুষ্ঠু ও ভালো হয়েছে। এ রকমই যোগ্য, সাহসী ও নিরপেক্ষ লোক খুঁজে পেতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে অত্যন্ত উচ্চমানের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতাও থাকতে হবে। অর্থাৎ নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের ব্যাপারে অনুসন্ধান কমিটির যে সুপারিশ, তা দেশ ও জাতির জন্য বর্তমান সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর একটা। সঠিক ব্যক্তির নাম প্রস্তাবের জন্য স্বচ্ছ ও খোলামেলা প্রক্রিয়া গোপন ও আড়াল-আবডালের প্রক্রিয়ার চেয়ে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য ও ফলপ্রসূ হবে।
নির্বাচন কমিশনের জন্য যোগ্য ব্যক্তিদের বাছাইপ্রক্রিয়া যদি উন্মুক্তভাবে করতে না পারেন, তাহলে অন্তত সার্চ কমিটির বাছাই করা ১০ জনের তালিকা জনসম্মুখে প্রচার বা উন্মুক্ত করতে হবে। রাষ্ট্রপতি চূড়ান্ত নিয়োগ দেওয়ার আগে সার্চ কমিটি কাদের নাম রাষ্ট্রপতির কাছে প্রস্তাব করেছেন, সেটা জানার অধিকার আমাদের সব নাগরিকের আছে। আর নামগুলো জনসমক্ষে চলে এলে অনুসন্ধান কমিটি যদি না জানার কারণে কোনো অযোগ্য বা দলীয় লোকের নাম প্রস্তাব করে থাকে, তাহলে সেটা বেরিয়ে আসবে বা প্রকাশিত হবে এবং সবারই একটা সুযোগ থাকবে ভুল শুধরে নেওয়ার। অর্থাৎ সার্চ কমিটি সব খবরাখবর না পেয়ে জনাব ‘ক’ নাম প্রস্তাব করল। খসড়া তালিকায় জনাব ‘ক’ নাম দেখে যারা তাকে অতীতে চিনত, তারা তখন বলতে পারবে যে ছাত্র-যুবক বয়সে উনি তো অমুক রাজনৈতিক দল করতেন। এই তথ্যটা হয়তো সার্চ কমিটির জানা ছিল না। আর রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা সম্পর্কে তথ্য প্রকাশ হলে দেখা যাবে জনাব ‘ক’ নিজেই খসড়া তালিকা থেকে তাঁর নাম প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। অথবা খসড়া তালিকা সংসদেও আলোচিত হতে পারে।
মোদ্দাকথা, এই সার্চ কমিটির পর দিন ১০-১২ বাদে হঠাৎ এক সকালে যদি দেখি বা শুনি যে রাষ্ট্রপতি অমুক পাঁচ ব্যক্তির সমন্বয়ে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠিত করেছেন, তাহলে সেটা মোটেও গ্রহণযোগ্য হবে না।
কাদের নাম কেন বিবেচনায় আনা হচ্ছে এবং কোন যোগ্যতার ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দিচ্ছেন, সেটা আগেভাগে জানার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের আছে।
আগেই বলেছি, আবার বলছি, এই সার্চ কমিটিতে বিচারপতির অন্তর্ভুক্তি কাম্য নয়। নির্বাচন কমিশনার খুঁজে বের করা মাননীয় বিচারপতিদের কর্তব্য নয়। বিশেষত করে নির্বাচন কমিশন গঠন সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক ইস্যু। অন্যান্য বিচারক নিয়োগে সার্চ কমিটিতে বিচারপতিরা থাকেন না, কিন্তু নির্বাচন কমিশনার খুঁজতে হবে বিচারপতিদের এ কেমনতর ব্যাপার। পঞ্চদশ সংশোধনীর আলোচনায় সবাই বলেছিলেন যে সাবেক প্রধান বিচারপতিকে প্রধান উপদেষ্টা করার বিধান বিচার বিভাগের রাজনৈতিকীকরণের অন্যতম প্রধান কারণ। এ জন্যই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিচারপতিদের যুক্ত হওয়ার বিপক্ষে মত দিয়েছিলেন। একইভাবে বা একই ধরনের মাপকাঠিতে সার্চ কমিটিতে বিচারপতিদের সম্পৃক্ততা বিচার বিভাগকে রাজনৈতিক পঙ্কিলতায় আবার জড়িয়ে ফেলতে পারে। এখন সার্চ কমিটির চারজনের মধ্যে দুজনই বিচারপতি। তদুপরি সিদ্ধান্তে সংখ্যাগরিষ্ঠতা না হলে চেয়ারম্যান অর্থাৎ আপিল বিভাগের বিচারপতির নির্ণায়ক ভোট থাকবে। অন্য কথায় দুই বিচারপতি, যাঁদের চাইবেন তাঁদেরই নাম থাকবে, যাঁদের চাইবেন না, তাঁদের নাম সার্চ কমিটি, রাষ্ট্রপতির কাছে যাবে না।
বিচার বিভাগকে আবারও প্রশ্নবিদ্ধ করা মোটেও কাম্য নয়। তাই বিচারপতিদের এ ধরণের সার্চ কমিটিতে রাখা কোন ভাবেই উচিত নয়।
বাকস্বাধীনতার চর্চাটা কি খুব বেশি হয়ে গেল? জানি না। তবে এটা নিশ্চিত যে বিচারপতিরা যদি আড়ালে-আবডালে নাম প্রস্তাব করেন এবং হঠাৎ করে একটা নির্বাচন কমিশনের আবির্ভাব হয়, তাহলে দেশ অশান্ত হয়ে পড়বে।
অতীতের তুলনায় বর্তমান প্রক্রিয়াটা নিঃসন্দেহে উত্তম। সবাই মিলে এই প্রক্রিয়াকে আরও বেশি অংশীদারিমূলক স্বচ্ছ ও উন্মুক্ত করলে আমরা সবাই যোগ্যতাসম্পন্ন ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন পাব।
ড. শাহ্দীন মালিক: জ্যেষ্ঠ আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট। পরিচালক, স্কুল অব ল, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি।
সিরিয়া অবশ্য মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য অনেক দেশের তুলনায় অতটা ‘ধর্মপ্রাণ’ না। মধ্যপ্রাচ্যের যে দেশ যতটা বেশি ‘ধর্মপ্রাণ’ সে দেশে বাকস্বাধীনতা ততটা কম। আর ওসব ভীষণভাবে ধর্মপ্রাণ দেশের মহিলা হলে তো ‘বাক’ই না, স্বাধীনতা অনেক দুরস্ত।
আমাদের দেশে বাকস্বাধীনতা চর্চার সুযোগ এন্তার। তবে মাঝেমধ্যে অনুজপ্রতিম আসিফ নজরুলের মতো অনেককে বাকস্বাধীনতা চর্চার ‘ঠেলা’ সামলাতে হয়। যাঁরা দিনের পর দিন—সরি, রাতের পর রাত—টেলিবাক্সে কথা বলেন, তাঁদের দু-একটা অসতর্ক মুহূর্তে পাঁচ-সাত-দশটা শব্দ মুখ থেকে বেরিয়ে যেতে পারে যেগুলোকে বিচ্ছিন্নভাবে উদ্ধত করে বক্তা যে অর্থ বলেছেন তার সম্পূর্ণ ভিন্ন অর্থ দাঁড় করিয়ে বক্তাকে নাস্তানাবুদ করার জন্য মাঝেমধ্যে নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তির অভাব হয় না। এসব ক্ষেত্রে বাকস্বাধীনতাটা হয়ে যায় ধর্মপ্রাণ দেশগুলোর মতো। রাজার শুধু প্রশংসাই করা যাবে।
এত বড় ভূমিকা সম্পূর্ণ কারণবিহীন নয়। অনুসন্ধান কমিটি সম্পর্কে প্রথমেই যা বলতে চাই তা হলো—সার্চ কমিটিতে দুজন বিচারপতির অন্তর্ভুক্তি কাম্য নয়। অন্য কথায় অনুসন্ধান কমিটিতে বিচারকদের থাকা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক।
ওয়াকিবহাল পাঠকমাত্রই অবগত আছেন যে মহামান্য রাষ্ট্রপতি ইসি গঠনে চার সদস্যের একটি সার্চ বা অনুসন্ধান কমিটি গঠন করেছেন। এই কমিটিতে থাকবেন আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগের একজন করে দুজন বিচারপতি, বাংলাদেশে মহা হিসাবনিরীক্ষক ও কর্মকমিশনের চেয়ারম্যান। কোন দুই বিচারপতি থাকবেন, সেটা নির্দিষ্ট করবেন প্রধান বিচারপতি। সে অনুযায়ী প্রধান বিচারপতি সোমবার দুজন বিচারপতিকে মনোনয়ন দিয়েছেন। তথাস্তু নির্বাচন কমিশন গঠনসংক্রান্ত একটা আইন না করে, রাষ্ট্রপতি শুধু একটা প্রজ্ঞাপন জারি করে অনুসন্ধান কমিটি না করলেই পারতেন। অর্থাৎ আপাতত একটা অধ্যাদেশ জারি করে নির্বাচন কমিশনের সব কয়টি প্রাসঙ্গিক দিক এই অধ্যাদেশ অর্থাৎ আইনটিতে অন্তর্ভুক্ত করা যেত। বিশেষ করে দুটো প্রাসঙ্গিক ব্যাপার—প্রধান ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারের ন্যূনতম যোগ্যতার ব্যাপারে আইনটিতে বিস্তারিত থাকতে পারত। এবং কারা সম্ভাব্য প্রার্থীর নাম প্রস্তাব করবেন। দ্বিতীয়ত, প্রাসঙ্গিক বিষয়টা হতে পারত এই সার্চ কমিটির কার্যপদ্ধতি। এখন প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে যে সার্চ কমিটি খোদ তার কার্যপ্রণালি বা কার্যপদ্ধতি নির্ধারণ করবে।
গণতন্ত্র, স্বচ্ছতা আর জবাবদিহি আমরা যদি সত্যিই বিশ্বাস করি অর্থাৎ এগুলো যদি লোক দেখানো বুলি না হয়, তাহলে অনুসন্ধান কমিটি বৈঠক উন্মুক্ত হওয়া উচিত। কমিটি দিন-তারিখ-সময় ঘোষণা করে বৈঠকে বসা উচিত। আমজনতা না হলেও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে যেমন প্রধান, প্রধান রাজনৈতিক দল—যে দলগুলো মহামান্য রাষ্ট্রপতির সঙ্গে এ ব্যাপারে সংলাপে অংশ নিয়েছে অন্তত তাদের পক্ষ থেকে একজন করে প্রতিনিধি সার্চ কমিটির মিটিংয়ে থাকতে পারে। সুশীল সমাজ, সংবাদমাধ্যম এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্য থেকে জনা পঞ্চাশেক লোকের উপস্থিতিতে একটা বড় হলরুমে অনুসন্ধান কমিটি বৈঠক করবে। হলরুমের অন্য প্রান্তে ওপরে উল্লিখিত ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে কমিটি মাইকের সামনে অনুসন্ধান কমিটি তাদের আলোচনা চালাক। মাইকের মাধ্যমে হলে উপস্থিত সবাই শুনবে, জানবে, বুঝবে—কমিটি কেন অমুক ব্যক্তির নাম বিবেচনা করছে।
অনেক গণতান্ত্রিক দেশে অনুসন্ধান কমিটির এ ধরনের সভায় আড়ালে-আবডালে হয় না। আমেরিকায় লাইভ টেলিভিশন অর্থাৎ অনুসন্ধান কমিটির বৈঠক টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। আমরা অত দূর এখনই না-ই বা গেলাম, কিন্তু ৫০ জনের উপস্থিতিতে তো সার্চ কমিটি তার আলোচনা চালাতে পারে। বলা বাহুল্য, এই ৫০ জন উপস্থিত থেকে শুধু শুনবেন, কিছু বলবেন না।
সার্চ কমিটিকে করজোড়ে অনুনয়-বিনয় করবে—যদি সাহস থাকে তাহলে আপনাদের সভার উন্মুক্ত কার্যপদ্ধতি নির্ধারণ করুন। এ দেশে ভবিষ্যতে নির্বাচন সুষ্ঠু, স্বচ্ছ ও সঠিক হবে কি না সেটা প্রধানত নির্ভর করবে নতুন নির্বাচন কমিশনের ওপর। বর্তমান নির্বাচন কমিশন তার সর্বোৎকৃষ্ট প্রমাণ। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদকালে সবগুলো নির্বাচনই সুষ্ঠু ও ভালো হয়েছে। এ রকমই যোগ্য, সাহসী ও নিরপেক্ষ লোক খুঁজে পেতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে অত্যন্ত উচ্চমানের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতাও থাকতে হবে। অর্থাৎ নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের ব্যাপারে অনুসন্ধান কমিটির যে সুপারিশ, তা দেশ ও জাতির জন্য বর্তমান সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর একটা। সঠিক ব্যক্তির নাম প্রস্তাবের জন্য স্বচ্ছ ও খোলামেলা প্রক্রিয়া গোপন ও আড়াল-আবডালের প্রক্রিয়ার চেয়ে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য ও ফলপ্রসূ হবে।
নির্বাচন কমিশনের জন্য যোগ্য ব্যক্তিদের বাছাইপ্রক্রিয়া যদি উন্মুক্তভাবে করতে না পারেন, তাহলে অন্তত সার্চ কমিটির বাছাই করা ১০ জনের তালিকা জনসম্মুখে প্রচার বা উন্মুক্ত করতে হবে। রাষ্ট্রপতি চূড়ান্ত নিয়োগ দেওয়ার আগে সার্চ কমিটি কাদের নাম রাষ্ট্রপতির কাছে প্রস্তাব করেছেন, সেটা জানার অধিকার আমাদের সব নাগরিকের আছে। আর নামগুলো জনসমক্ষে চলে এলে অনুসন্ধান কমিটি যদি না জানার কারণে কোনো অযোগ্য বা দলীয় লোকের নাম প্রস্তাব করে থাকে, তাহলে সেটা বেরিয়ে আসবে বা প্রকাশিত হবে এবং সবারই একটা সুযোগ থাকবে ভুল শুধরে নেওয়ার। অর্থাৎ সার্চ কমিটি সব খবরাখবর না পেয়ে জনাব ‘ক’ নাম প্রস্তাব করল। খসড়া তালিকায় জনাব ‘ক’ নাম দেখে যারা তাকে অতীতে চিনত, তারা তখন বলতে পারবে যে ছাত্র-যুবক বয়সে উনি তো অমুক রাজনৈতিক দল করতেন। এই তথ্যটা হয়তো সার্চ কমিটির জানা ছিল না। আর রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা সম্পর্কে তথ্য প্রকাশ হলে দেখা যাবে জনাব ‘ক’ নিজেই খসড়া তালিকা থেকে তাঁর নাম প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। অথবা খসড়া তালিকা সংসদেও আলোচিত হতে পারে।
মোদ্দাকথা, এই সার্চ কমিটির পর দিন ১০-১২ বাদে হঠাৎ এক সকালে যদি দেখি বা শুনি যে রাষ্ট্রপতি অমুক পাঁচ ব্যক্তির সমন্বয়ে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠিত করেছেন, তাহলে সেটা মোটেও গ্রহণযোগ্য হবে না।
কাদের নাম কেন বিবেচনায় আনা হচ্ছে এবং কোন যোগ্যতার ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দিচ্ছেন, সেটা আগেভাগে জানার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের আছে।
আগেই বলেছি, আবার বলছি, এই সার্চ কমিটিতে বিচারপতির অন্তর্ভুক্তি কাম্য নয়। নির্বাচন কমিশনার খুঁজে বের করা মাননীয় বিচারপতিদের কর্তব্য নয়। বিশেষত করে নির্বাচন কমিশন গঠন সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক ইস্যু। অন্যান্য বিচারক নিয়োগে সার্চ কমিটিতে বিচারপতিরা থাকেন না, কিন্তু নির্বাচন কমিশনার খুঁজতে হবে বিচারপতিদের এ কেমনতর ব্যাপার। পঞ্চদশ সংশোধনীর আলোচনায় সবাই বলেছিলেন যে সাবেক প্রধান বিচারপতিকে প্রধান উপদেষ্টা করার বিধান বিচার বিভাগের রাজনৈতিকীকরণের অন্যতম প্রধান কারণ। এ জন্যই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিচারপতিদের যুক্ত হওয়ার বিপক্ষে মত দিয়েছিলেন। একইভাবে বা একই ধরনের মাপকাঠিতে সার্চ কমিটিতে বিচারপতিদের সম্পৃক্ততা বিচার বিভাগকে রাজনৈতিক পঙ্কিলতায় আবার জড়িয়ে ফেলতে পারে। এখন সার্চ কমিটির চারজনের মধ্যে দুজনই বিচারপতি। তদুপরি সিদ্ধান্তে সংখ্যাগরিষ্ঠতা না হলে চেয়ারম্যান অর্থাৎ আপিল বিভাগের বিচারপতির নির্ণায়ক ভোট থাকবে। অন্য কথায় দুই বিচারপতি, যাঁদের চাইবেন তাঁদেরই নাম থাকবে, যাঁদের চাইবেন না, তাঁদের নাম সার্চ কমিটি, রাষ্ট্রপতির কাছে যাবে না।
বিচার বিভাগকে আবারও প্রশ্নবিদ্ধ করা মোটেও কাম্য নয়। তাই বিচারপতিদের এ ধরণের সার্চ কমিটিতে রাখা কোন ভাবেই উচিত নয়।
বাকস্বাধীনতার চর্চাটা কি খুব বেশি হয়ে গেল? জানি না। তবে এটা নিশ্চিত যে বিচারপতিরা যদি আড়ালে-আবডালে নাম প্রস্তাব করেন এবং হঠাৎ করে একটা নির্বাচন কমিশনের আবির্ভাব হয়, তাহলে দেশ অশান্ত হয়ে পড়বে।
অতীতের তুলনায় বর্তমান প্রক্রিয়াটা নিঃসন্দেহে উত্তম। সবাই মিলে এই প্রক্রিয়াকে আরও বেশি অংশীদারিমূলক স্বচ্ছ ও উন্মুক্ত করলে আমরা সবাই যোগ্যতাসম্পন্ন ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন পাব।
ড. শাহ্দীন মালিক: জ্যেষ্ঠ আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট। পরিচালক, স্কুল অব ল, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি।
No comments