নিসর্গ চিত্রকরের বিদায়! by ফখরুজ্জামান চৌধুরী

মাস তিনেক আগে শেষবার তার সঙ্গে দেখা। বাংলামটরে এক ব্যাংকে। এই ব্যাংকেই বছর কয়েক আগে তার সঙ্গে আরেকবার দেখা হয়েছিল অনেক বছর পর। তিনি অপেক্ষা করছিলেন ব্যাংকে কর্মরত তার এক নিকটাত্মীয়ের জন্য। আমাকে দেখে মনে হলো, অপেক্ষা করার ক্লান্তি কাটিয়ে তার স্বভাবসুলভ প্রশান্ত হাসির দীপ্তি ছড়িয়ে হাত বাড়িয়ে দিলেন।
কুশলাদি বিনিময়ের পর নতুন করে ঠিকানা, ফোন নম্বর আদানপর্ব শেষ হলো। তিনি তার পূর্ব-ঠিকানা গ্রিন রোডের বাসায়ই আছেন। এরই মধ্যে যাযাবর আমি বহু ঠিকানা বদল শেষে থিতু হয়েছি উত্তরায়। তিনি উত্তরার কথা শুনে খুশি হলেন। বললেন, ওদিকটা এখনও কিছুটা খোলামেলা আছে। তবে আর কত দিন থাকবে, কে জানে!
বললাম, বেশিদিনের স্বপ্ন দেখিনা। উত্তরাকে আমি বলি ডেভেলপার কবলিত জনপদ। এখানে এক দিন একতলা, দোতলা বাড়ির অস্তিত্ব থাকবে ছবিতে, বাস্তবে ছ’তলা বিল্ডিংয়ের সারি!
শুনে তিনি মনে হয় দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। বললেন, নগরায়ন গ্রাস করে নিচ্ছে নিসর্গকে। বাড়ি বানানোর প্রয়োজনে বৃক্ষ উজাড় করা হচ্ছে নির্বিচারে। বন কেটে এই যে বসত, এর ফল ফলবে অচিরে।
এ জাতীয় কথাবার্তার এক পর্যায়ে তিনি আমার কন্যাদের খোঁজখবর নিলেন। ওদের বর্তমান অবস্থানের কথা শুনে তিনি হাসলেন। বললেন, মনে হয় এই তো সেদিন ফ্রক পরা স্কুলছাত্রী দুই মেয়ের ছবি তুলেছি। তিনি জানালেন, নেগেটিভ রয়েছে ওদের ছবির তার কাছে।
আমি শুনে অবাক হলাম। বিশ-পঁচিশ বছর আগের কথা। ছবি তুলেছিলেন, এ কথাও আমি ভুলে গেছি।
বললাম, ওদের জানাব। আপনার তোলা ছবির কপি ওদের জন্য বিরাট কিছু। সঞ্চয় করে রাখার মতো মহামূল্যবান সম্পদ। কারণ এই ছবি তুলেছেন এমন এক মানুষ, যিনি শিল্পের সন্ধানে নিরলস গতিতে পথ হাঁটছেন।
তিনি যেমন স্বভাবের মানুষ, বিব্রত হলেন আমার প্রশংসাসূচক কথা শুনে। কথা সংক্ষিপ্ত করে বললেন, আমি ওদের জন্য কপি দেব। তবে শর্ত হলো, আপনাদের এক বিকালে চা খেতে আসতে হবে। জানেন তো, চা তৈরিতে আমার দক্ষতা কেমন!
বছরের শেষদিকে প্রতি বছর ডিসেম্বর মাসে তাদের পৈতৃক বাড়ি মানিকগঞ্জের পারিল নওয়াধা গ্রামে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। দিনব্যাপী এ অনুষ্ঠানে ঢাকা থেকে শিল্প-সংস্কৃতিসেবীদের সমাগম ঘটে। তিনি ফোন করে অনুষ্ঠানে শামিল হতে আহ্বান জানালেন এবং তার নিকটাত্মীয় শিল্পী মাসুদ আলী খান আমাদের যাওয়ার ব্যাপারে সহায়তা করবেন এমনটাও জানালেন। ঢাকার অদূরে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো, সুতরাং আমাদের যাওয়ার ব্যাপারে মোটামুটি তিনি কথা আদায় করেই নিয়েছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের। কী এক আকস্মিক অসুবিধার কারণে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও যাওয়া হলো না। পরে দুঃখ প্রকাশ করে তাকে ফোন করলে তিনি শুধু বললেন, গেলে ভালোই লাগত!
মিতভাষী মানুষটি কথা বলতেন কম।
তার সঙ্গে প্রথম পরিচয় মংমনসিংহে। গত শতকের ষাটের দশকের শেষভাগে ময়মনসিংহে বদলি হয়ে যাই হঠাত্ই। সেই প্রথম ঢাকার বাইরে যাওয়া। মন খারাপ করে ময়মনসিংহে গিয়ে অচিরেই সেখানে মন বসে যায়। সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক জীবন ছিল ময়মনসিংহ নামক ঘুমন্ত এই জেলা শহরটির। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিল একঝাঁক পণ্ডিত মানুষের সমাহার।
বিশ্ববিদ্যালয়ের গণসংযোগ বিভাগে তখন কর্মরত ছিলেন নাইবউদ্দীন আহমেদ। আলোকচিত্রশিল্পী হিসেবে তার খ্যাতি ছিল তখন পাকিস্তানজুড়ে।
নাইবউদ্দীনের আলোকচিত্রের প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছিল তত্কালীন পাকিস্তান কাউন্সিলের ময়মনসিংহ কেন্দ্রে। পিন্ডি, লাহোরেও আয়োজন করা হয়েছিল তার ফটো প্রদর্শনীর।
নাইবউদ্দীন আহমেদের কনিষ্ঠ ভ্রাতা নওয়াজেশ আহমেদের সঙ্গে সেই যে ময়মনসিংহে পরিচয়, তা অব্যাহত ছিল এই সেদিন পর্যন্ত।
মনে-প্রাণে যাকে বলে পরিপূর্ণ বাঙালি, তাই ছিলেন তিনি। বিদেশে থেকেছেন অনেক বছর, কিন্তু তার মন ছিল বাংলাদেশের নিসর্গ, নদী, বৃক্ষরাজিতে নিমগ্ন। বাংলাদেশের স্বরূপ অন্বেষা ছিল তার সারাজীবনের সাধনা। ‘ছিন্নপত্র’ কিংবা ‘ধানসিড়ি নদীটির পাশে’ অ্যালবামে শুধু কতগুলো আলোকচিত্রই নেই, আছে আবহমান বাংলার চিরন্তন রূপ।
আজীবন চিরকুমার এ মানুষটির অন্বেষা ছিল বাংলার চিরন্তন এক নারীর!
সুন্দরতা-বুভুক্ষু মানুষটি নদীকে জেনেছেন আপনজন হিসেবে।
নদীর সঙ্গে সখ্য সবার হয় না। তার জন্য দরকার বিবাগী মনের, যা প্রাত্যহিক প্রয়োজনের ঊর্ধ্বে জীবনের অর্থ খোঁজে।
আর নিসর্গ! নিসর্গ তো মুখরিত হয় শুধু তার প্রেমীর কাছেই। জাগতিক লোভলালসায় মলিন মানুষ বৃক্ষকে দেখে অর্থকরী সম্পদ হিসেবে, যা উজাড় করলে বিত্তবান হওয়া যায়।
নওয়াজেশ আহমেদ বৃক্ষের আত্মার সন্ধানে ছিলেন ব্যাপৃত।
‘মহাবনস্পতির পদাবলী’ কিংবা ‘অশ্বত্থের সন্ধানে’, ‘বাংলার বুনোফুল’, ‘গৌতম’—সেই অন্বেষারই দলিল চিত্র।
পারিল গ্রামের শিথানে নলগোলা নদী। সেই গ্রামে নিসর্গের মাঝে শেষ শয্যায় শুয়ে আছেন তিনি।
লেখক : কথাসাহিত্যিক, অনুবাদক ও প্রাবন্ধিক

No comments

Powered by Blogger.