আমি আর মামুনঃ যুদ্ধে যাবার শ্রেষ্ঠ সময়ে by মনজুর আহমদ
যৌবন যদি হয় যুদ্ধে যাবার শ্রেষ্ঠ সময়, তবে আমরা আমাদের সেই শ্রেষ্ঠ সময়ে একে অপরের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলাম। জীবনকে সামনে এগিয়ে নেয়ার কঠিন যুদ্ধে আমরা একে অপরের ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলাম, যদিও আমাদের অবস্থানগত ব্যবধান ছিল বিস্তর।
সম্পর্কের দিক দিয়ে আমরা খুব কাছের কেউ ছিলাম না, তবু ছিলাম নিকটজন। পেশাগত জীবনে কিংবা তার বাইরেও আমরা ছিলাম পরস্পরের সুখে-দুঃখের অংশীদার দুই অন্তরঙ্গ বন্ধু।
আমি আর মামুন। নাট্যকার-নির্দেশক, সাংস্কৃতিক অঙ্গনের এক অনন্য প্রতিভা, আবদুল্লাহ আল মামুন। আমাদের দুজনের ছিল দুই পৃথক জগত্। বরাবরই মামুন ছিল নাটক নিয়ে। আমি সাংবাদিকতায়। তবু সেই যে আমরা উত্তীর্ণ তারুণ্যে হাতে হাত মিলিয়ে একসঙ্গে চলতে শুরু করেছিলাম সেখান থেকে আর বিচ্ছিন্ন হইনি। পায়ে পা মিলিয়ে আমরা শুধু সামনের দিকে এগিয়েই গেছি। মামুনের তিরোধানে মনটা শুধু হিসাব নিতে চাইছে, পায়ে পা মিলিয়ে পৃথিবীর পথে কতটা হেঁটেছি আমরা? মহাকালের কতটা অংশ আমরা ধরে রাখতে পেরেছি আমাদের সঙ্গে?
পঁয়তাল্লিশ বছর তো বটেই। সঠিক হিসাবে আরও কিছু বেশিই হবে। কবে মঞ্চস্থ হয়েছিল ঢাকা বিম্ববিদ্যালয়ে ‘ক্রীতদাসের হাসি’? বোধ হয় বাষট্টিতে। এই নাটকের সূত্রেই আমার স্কুল জীবনের বন্ধু ষাটের দশকের গল্পকার অকালপ্রয়াত শহীদুর রহমানের সঙ্গে গিয়েছিলাম মামুনের কাছে তার ঢাকা হলে। হলের পশ্চিম দিকের যে ছোট দরজাটা দিয়ে ক্যান্টিনে যাওয়া-আসা চলত, সেখানেই দেখা হয়েছিল মামুনের সঙ্গে। মামুন ও শহীদ ঢাকা কলেজ জীবনের বন্ধু। সেখানে মামুনের লেখা এক নাটকে শহীদ একটিমাত্র নারী চরিত্রে অভিনয় করে প্রশংসা কুড়িয়েছিল। মামুন তার আত্মকথন ‘আমার আমি’-তে শহীদের কথা উল্লেখ করেছে। মামুনের সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে শহীদ বলেছিল, সংবাদের সাব-এডিটর। আর আমাকে বলেছিল, আবদুল্লাহ আল মামুন। আমি চিনি। মামুনের হাতে তখন দেখেছিলাম তার নাটকের একটি স্ক্রিপ্ট। নামটি মনে পড়ে ‘বিন্দু বিন্দু রং’। মামুন বলেছিল, নাজিমুদ্দিন রোড এলাকার কারা যেন এই নাটকটি মঞ্চস্থ করছে।
তখনও না। মামুনের সঙ্গে তখনও আমার তেমন যোগাযোগ গড়ে ওঠেনি। আমরা কাছাকাছি হলাম মামুন সংবাদে যোগ দেয়ার পর। শহীদ তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং সংবাদে আমার সহকর্মী। সংবাদে আমার সহকর্মী ছিল একাত্তরের শহীদ আ ন ম গোলাম মোস্তফা। মোস্তফাও তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ পড়ছে। নাটকের সুবাদে মামুনের সঙ্গে ওর ঘনিষ্ঠতা। মোস্তফাই একদিন এসে বলল, মামুনের একটা চাকরি দরকার। সংবাদে ওকে ঢোকানোর ব্যবস্থা করা যায় কিনা। আমি, শহীদ, মোস্তফা তিনজনই উত্সাহী হয়ে উঠলাম সংবাদে মামুনের একটা চাকরির ব্যবস্থা করতে। সফলও হলাম। মামুন ঢুকল তখনকার নিয়ম অনুযায়ী প্রথমে অ্যাপ্রেন্টিস হিসেবে। ওকে ঢোকানো গেলেও আমার মনে কিন্তু কেমন এক অস্বস্তি রয়ে গেল। কেন যেন মনে হয়েছিল এটা ওর ক্ষেত্র নয়, ওর ক্ষেত্র অন্যতর। মনে হয়েছিল, নিউজ টেবিলে বসে অনুবাদ করা কিংবা রিপোর্টার হিসেবে সারাদিন খবরের পেছনে দৌড়ানোর জন্য ও নিজেকে তৈরি করেনি। ও তৈরি হয়েছে ভিন্ন কিছুর জন্য। কথাটা অবশ্য ওকে কখনও বলিনি। দ্বিধা ছিল, ওর সম্পর্কে আমার এমন ধারণা ও সহজভাবে নেবে কিনা।
সংবাদে মামুন আমার সহকর্মী হয়ে গেল। একই টেবিলে বসে কাজ করতে করতে আমরা খুব কাছাকাছি চলে এলাম। দুজনে ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠলাম। এ সম্পর্ক আরও গাঢ় হয়েছিল একটি বিশেষ কারণে। মাঝে মাঝে মামুন আর আমার ডিউটি পড়ত বিকালের পালায়। বিকালের পালা মানে দুপুর দুটা থেকে রাত আটটা। এই পালায় মূলত দেড় পাতার কাজ আমাদের করতে হতো। তুলনামূলকভাবে কম কাজ বলে এই পালায় মাত্র দুজন সাব-এডিটরকেই রাখা হতো। যেদিন আমাদের দুজনের একসঙ্গে এই পালায় ডিউটি পড়ত, সেদিন সিনিয়র হিসেবে আমাকেই পালাপ্রধানের দায়িত্ব পালন করতে হতো। আমার কাছে মামুন একটাই অনুরোধ জানিয়ে রেখেছিল। ও বলেছিল, আমাকে যা কাজ দেবেন একবারে দিয়ে দেবেন। আমি কাজগুলো শেষ করেই কেটে পড়ব।
আমি তার প্রস্তাব মেনে নিয়েছিলাম। কাজ শেষ করে দিয়ে চলে যাবে তাতে আমার অসুবিধা হওয়ার কোনো কারণ নেই। কিন্তু কেন? শিফট শেষ না করেই কেন চলে যেতে হবে? মামুন আমাকে খোলাখুলিই বলেছিল। বলেছিল, ও একটা মেয়েকে পছন্দ করেছে। তাকে বিয়ে করবে। বিকালে একটু আগেভাগে বেরোতে পারলে মেয়েটার সঙ্গে দেখা করতে যেতে পারে। তার সেই পছন্দের মেয়েটি ফরিদা, পরে তার স্ত্রী। ফরিদাকে কেন্দ্র করে আমাদের সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হলো। ফরিদা থাকত নারায়ণগঞ্জে নদীর ওপারে। একটু সময় বের করে নিয়ে মামুন ছুটত সেখানেই। দ্রুত লেখার আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল মামুনের। দ্রুত অনুবাদ করতে পারত। বিকালের পালার সব কাজ ওকে একসঙ্গেই ধরিয়ে দিতাম। ঝড়ের মতো সব কাজ সে শেষ করে ফেলত। দুই বা তিন ঘণ্টার মধ্যে। তারপরই ছুট। একদিন দেরি হয়ে গেল। সেদিন কপি লাগছিল বেশি। পাতায় বিজ্ঞাপন কম থাকলে কপির চাহিদা বেড়ে যায়। এদিন কাজ যেন শেষ হচ্ছিল না। ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে চলছিল। এরই মধ্যে টেলিফোন। টেলিফোনে ফরিদা। মামুনের সঙ্গে কথা শেষ করে আমাকে ধরল। প্রথম কথাটাই তার ছিল, আর কতক্ষণ আটকে রাখবেন ওকে? ছাড়েন না।
এভাবেই ফরিদা আমার পরিচিত হয়ে গেল। খুব ভালো লাগল। প্রথম আলাপটাই এত আন্তরিক, এত স্বচ্ছন্দ। এই আন্তরিকতাটাই অক্ষুণ্ন ছিল তার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। হ্যাঁ, শেষ দিন। মাত্র কুড়ি বছরের বিবাহিত জীবন কাটিয়ে ফরিদা আমাদের চোখের সামনেই ইহজগত ত্যাগ করল।
মামুন বিয়ে করেছিল ১৯৬৪ সালের শেষ দিকে। ওর মাস দুয়েক আগে আমি বিয়ে করেছি। হঠাত্ এক সকালে মামুনের ছোট ভাই হারুন আমার শান্তিবাগের বাসায় এসে হাজির। জানাল, সেই দিনই মামুনের বিয়ে। আমি যেন ওর বাসায় যাই। আর আমার পাঞ্জাবিটা দরকার বিয়েতে মামুনের পরার জন্য। অফিসের কাজ ফেলে ওর বিয়েতে যেতে পারিনি। আর বিয়েতে পরার জন্য পাঞ্জাবিটাও দিতে পারিনি, কারণ ওটা ধোয়ানো ছিল না। সংবাদে একটা অনুবাদের ভুলের জন্য ওর চাকরি নিয়ে টানাটানি পড়ে। ঠিক অনুবাদের ভুল নয়। মওলানা ভাসানীর একটি বক্তৃতার অনুবাদে ‘ইম্পিরিয়ালিস্ট’ শব্দটির বাংলা অসতর্কতাবশত ও লিখেছিল ‘সমাজতন্ত্রী’। ফলে মওলানার বক্তব্যের অর্থই একেবারে বিপরীত হয়ে যায়। তখন আমাদের বার্তা সম্পাদক ছিলেন তোয়াব খান। অত্যন্ত সহৃদয়, অত্যন্ত সহানুভূতিশীল ব্যক্তি। আমাদের হাতে ধরে কাজ শিখিয়ে সাংবাদিক বানিয়েছেন। তাকে আমরা বলি সাংবাদিক গড়ার কারিগর। তোয়াব ভাইয়ের সঙ্গে এক পালায় একসঙ্গে কাজ করা ছিল আমাদের জন্য এক বড় আকর্ষণ। মামুনও তার কাছে সাংবাদিকতার শিক্ষা পেয়েছে। কিন্তু এই ভুলটা তোয়াব ভাই কিছুতেই মেনে নিতে পারলেন না। কাজের ব্যাপারে কোনো গাফিলতি তিনি সহ্য করতে পারতেন না। অফিসের ডিসিপ্লিনের ব্যাপারে তিনি ছিলেন অত্যন্ত কড়া। ব্যাপারটা নিয়ে মামুনকে কয়েকটা দিন বেশ ধকল পোহাতে হয়েছিল। পরে সংবাদের তখনকার যুগ্ম-সম্পাদক শহীদুল্লাহ কায়সারের হস্তক্ষেপে একটা সুরাহা হলো। শহীদুল্লাহ কায়সার লক্ষ্য করেছিলেন মামুনকে। খুব পছন্দ করেছিলেন তাকে। তিনিই একদিন মামুনকে নিউজ টেবিল থেকে সরিয়ে নিয়ে গেলেন সম্পাদকীয় বিভাগে। টেলিভিশনে যোগ দেয়ার আগে পর্যন্ত মামুন সংবাদের সম্পাদকীয় বিভাগেই ছিল।
টেলিভিশনই ছিল মামুনের সত্যিকার জগত্। এখানে যোগ দেয়ার পর থেকেই মামুন দিনে দিনে খ্যাতিমান হয়ে উঠল। নাটক অন্তপ্রাণ মামুন মঞ্চ, টেলিভিশন, চলচ্চিত্র, বেতার প্রতিটি মাধ্যমেই নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করে গেল। ও টেলিভিশনে যোগ দেয়াতে আমি খুব খুশি হয়েছিলাম। ওর সাংবাদিকতা করা নিয়ে আমার মনে যে একটু দ্বিধা ছিল, টেলিভিশনে যাওয়ায় তা দূর হয়ে গেল। মামুনকে বলেছিলাম, এতদিনে আপনি ঠিক জায়গাতে পৌঁছালেন।
টেলিভিশনে নাটক প্রয়োজনায় মামুন দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। ১৯৬৭-তে মামুন আমার দুটি নাটকও টেলিভিশনে প্রযোজনা করেছিল। ছাদ আর চোরা ছাদ-এ অভিনয় করেছিলেন মোস্তফা আর চোর-এ আনোয়ার হোসেন। সে সময় ডিআইটি ভবনের স্টুডিও থেকে সরাসরি প্রচারিত নাটক প্রযোজনা যে কত কষ্টকর ছিল, আজকের দিনের শিল্পী বা কলাকুশলীরা তা কল্পনাও করতে পারবেন না। স্টুডিওর ভেতরে ছাদের সেট তৈরি করা ছিল একটা দুরূহ কাজ। এই সময় আমার স্ত্রী রেখা মঞ্চে অভিনয় করছিল। মামুনের বিপরীতেও মঞ্চে মামুনেরই লেখা ‘উজান পবন’-এ গ্রাম্য রমণীর ভূমিকায় অভিনয় করে প্রশংসা পেয়েছিল। ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট মঞ্চে অভিনীত নাটকটি পরিচালনা করেছিলেন কামাল লোহানী। নাগরিকের আতাউর রহমানও এই নাটকে অভিনয় করেছিলেন। মামুনই এদিন রেখাকে টেলিভিশনে নাটকের জন্য অডিশন দিতে বলল। অডিশনের পর টেলিভিশনে মামুনের নাটকেই রেখার প্রথম অভিনয়। স্বাধীনতার পর গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনের সূচনায় মামুন রেখাকে বলেছিল থিয়েটার নাট্যগোষ্ঠী গঠনের চিন্তা-ভাবনার কথা, এই গ্রুপে তাকে যোগ দেয়ার কথা। তখন থেকেই রেখা থিয়েটারে।
রেখার সঙ্গে সঙ্গে আমিও অল্প-স্বল্প জড়িয়ে পড়েছিলাম থিয়েটারের সঙ্গে। সদস্য ছিলাম না, তবে থিয়েটারের সবাই আমাকে তাদের এক আপনজন বলেই গ্রহণ করেছিল। আপনজন হিসেবেই তাদের কিছু কিছু কথা বলতাম। কিছু সুপারিশ-পরামর্শ দিতাম। মামুনের স্ত্রী ফরিদার মৃত্যুর পর তার নামে থিয়েটারের পরবর্তী উত্সবটি উত্সর্গ করার একটি প্রস্তাব আমি দিয়েছিলাম। তারা আমার প্রস্তাবটি গ্রহণ করে উত্সবটি ফরিদার নামে উত্সর্গ করেছিলেন।
এভাবেই এগিয়ে চলেছিল মামুনের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা। দুজন ছিলাম দুই জগতে, দুই মাধ্যমে। তবুও নানান সূত্রে ছিল আমাদের যোগাযোগ। সুযোগ-সুবিধামত চলে যেতাম মামুনের বাসায়। মামুন এসেছে আমার বাসায়। এসেছে ফরিদাও। অনেক মজার মজার ঘটনা আছে মামুনের পরিবারের সঙ্গে আমাদের। মামুনের ছেলের জন্মদিনে গেছি ওর সিদ্ধেশ্বরীর বাসায়। মামুন বাসায় ছিল না। টেলিভিশনে কাজ শেষ করে আসতে দেরি হচ্ছিল। দোতলার সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়েছিল ফরিদা আমাদের অভ্যর্থনা জানাতে। কোলে ছিল তার ছেলে। অদ্ভুত এক ঘটনা ঘটাল ওই ছেলে। আমাকে দেখেই আব্বা আব্বা করে হাত বাড়িয়ে মায়ের কোল থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার কোলে। ফরিদা তো লজ্জায় লাল। বাবার চেহারার সঙ্গে আমার চেহারার মিল পেয়েছিল ছোট্ট ছেলেটি। আরও একটি কারণ ছিল তার বিভ্রান্তির। আমার গায়ে যে জামাটি ছিল, হুবহু তেমনই একটা জামা ছিল মামুনের। ঠিক এর বিপরীত ঘটনা ঘটেছিল আমার বাসায়। টেলিভিশনে একটি নাটকে অভিনয় করছিল মামুন আর আমার স্ত্রী রেখা। আমার ছেলে তখন খুব ছোট। টেলিভিশনের পর্দায় রেখার সঙ্গে মামুনকে দেখে আমার ছেলে আব্বা আব্বা বলে চিত্কার দিয়ে উঠেছিল। অবুঝ শিশুদের এই বিভ্রান্তিতে আমাদের এটা বিশ্বাস করার কারণ ঘটেছিল যে আমাদের চেহারায় কোথাও মিল আছে।
মামুন চলে গেছে এক বছরের বেশি হয়ে গেল। শরীরে চেপে বসা একের পর এক রোগের ধকল ও আর সামাল দিতে পারেনি। আসলে রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করে বলতে হয়, ‘জীবনেরে কে রাখিতে পারে, আকাশের প্রতি তারা ডাকিছে তাহারে।’ ওই ডাকে আমাদের সবাইকে তো একদিন সাড়া দিতে হবে। কেউ আগে, কেউ পরে। যারা আগে যায় তাদের স্মৃতি আঁকড়ে অন্যদের শুধু অপেক্ষা করতে হয়। মামুন এখন আমাদের কাছে শুধুই স্মৃতি। এই স্মৃতি রোমন্থন করেই আমাদের এখন জীবনের অবশিষ্ট দিনগুলোর দিকে এগিয়ে যাওয়া।
নিউ ইয়র্ক থেকে
আমি আর মামুন। নাট্যকার-নির্দেশক, সাংস্কৃতিক অঙ্গনের এক অনন্য প্রতিভা, আবদুল্লাহ আল মামুন। আমাদের দুজনের ছিল দুই পৃথক জগত্। বরাবরই মামুন ছিল নাটক নিয়ে। আমি সাংবাদিকতায়। তবু সেই যে আমরা উত্তীর্ণ তারুণ্যে হাতে হাত মিলিয়ে একসঙ্গে চলতে শুরু করেছিলাম সেখান থেকে আর বিচ্ছিন্ন হইনি। পায়ে পা মিলিয়ে আমরা শুধু সামনের দিকে এগিয়েই গেছি। মামুনের তিরোধানে মনটা শুধু হিসাব নিতে চাইছে, পায়ে পা মিলিয়ে পৃথিবীর পথে কতটা হেঁটেছি আমরা? মহাকালের কতটা অংশ আমরা ধরে রাখতে পেরেছি আমাদের সঙ্গে?
পঁয়তাল্লিশ বছর তো বটেই। সঠিক হিসাবে আরও কিছু বেশিই হবে। কবে মঞ্চস্থ হয়েছিল ঢাকা বিম্ববিদ্যালয়ে ‘ক্রীতদাসের হাসি’? বোধ হয় বাষট্টিতে। এই নাটকের সূত্রেই আমার স্কুল জীবনের বন্ধু ষাটের দশকের গল্পকার অকালপ্রয়াত শহীদুর রহমানের সঙ্গে গিয়েছিলাম মামুনের কাছে তার ঢাকা হলে। হলের পশ্চিম দিকের যে ছোট দরজাটা দিয়ে ক্যান্টিনে যাওয়া-আসা চলত, সেখানেই দেখা হয়েছিল মামুনের সঙ্গে। মামুন ও শহীদ ঢাকা কলেজ জীবনের বন্ধু। সেখানে মামুনের লেখা এক নাটকে শহীদ একটিমাত্র নারী চরিত্রে অভিনয় করে প্রশংসা কুড়িয়েছিল। মামুন তার আত্মকথন ‘আমার আমি’-তে শহীদের কথা উল্লেখ করেছে। মামুনের সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে শহীদ বলেছিল, সংবাদের সাব-এডিটর। আর আমাকে বলেছিল, আবদুল্লাহ আল মামুন। আমি চিনি। মামুনের হাতে তখন দেখেছিলাম তার নাটকের একটি স্ক্রিপ্ট। নামটি মনে পড়ে ‘বিন্দু বিন্দু রং’। মামুন বলেছিল, নাজিমুদ্দিন রোড এলাকার কারা যেন এই নাটকটি মঞ্চস্থ করছে।
তখনও না। মামুনের সঙ্গে তখনও আমার তেমন যোগাযোগ গড়ে ওঠেনি। আমরা কাছাকাছি হলাম মামুন সংবাদে যোগ দেয়ার পর। শহীদ তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং সংবাদে আমার সহকর্মী। সংবাদে আমার সহকর্মী ছিল একাত্তরের শহীদ আ ন ম গোলাম মোস্তফা। মোস্তফাও তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ পড়ছে। নাটকের সুবাদে মামুনের সঙ্গে ওর ঘনিষ্ঠতা। মোস্তফাই একদিন এসে বলল, মামুনের একটা চাকরি দরকার। সংবাদে ওকে ঢোকানোর ব্যবস্থা করা যায় কিনা। আমি, শহীদ, মোস্তফা তিনজনই উত্সাহী হয়ে উঠলাম সংবাদে মামুনের একটা চাকরির ব্যবস্থা করতে। সফলও হলাম। মামুন ঢুকল তখনকার নিয়ম অনুযায়ী প্রথমে অ্যাপ্রেন্টিস হিসেবে। ওকে ঢোকানো গেলেও আমার মনে কিন্তু কেমন এক অস্বস্তি রয়ে গেল। কেন যেন মনে হয়েছিল এটা ওর ক্ষেত্র নয়, ওর ক্ষেত্র অন্যতর। মনে হয়েছিল, নিউজ টেবিলে বসে অনুবাদ করা কিংবা রিপোর্টার হিসেবে সারাদিন খবরের পেছনে দৌড়ানোর জন্য ও নিজেকে তৈরি করেনি। ও তৈরি হয়েছে ভিন্ন কিছুর জন্য। কথাটা অবশ্য ওকে কখনও বলিনি। দ্বিধা ছিল, ওর সম্পর্কে আমার এমন ধারণা ও সহজভাবে নেবে কিনা।
সংবাদে মামুন আমার সহকর্মী হয়ে গেল। একই টেবিলে বসে কাজ করতে করতে আমরা খুব কাছাকাছি চলে এলাম। দুজনে ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠলাম। এ সম্পর্ক আরও গাঢ় হয়েছিল একটি বিশেষ কারণে। মাঝে মাঝে মামুন আর আমার ডিউটি পড়ত বিকালের পালায়। বিকালের পালা মানে দুপুর দুটা থেকে রাত আটটা। এই পালায় মূলত দেড় পাতার কাজ আমাদের করতে হতো। তুলনামূলকভাবে কম কাজ বলে এই পালায় মাত্র দুজন সাব-এডিটরকেই রাখা হতো। যেদিন আমাদের দুজনের একসঙ্গে এই পালায় ডিউটি পড়ত, সেদিন সিনিয়র হিসেবে আমাকেই পালাপ্রধানের দায়িত্ব পালন করতে হতো। আমার কাছে মামুন একটাই অনুরোধ জানিয়ে রেখেছিল। ও বলেছিল, আমাকে যা কাজ দেবেন একবারে দিয়ে দেবেন। আমি কাজগুলো শেষ করেই কেটে পড়ব।
আমি তার প্রস্তাব মেনে নিয়েছিলাম। কাজ শেষ করে দিয়ে চলে যাবে তাতে আমার অসুবিধা হওয়ার কোনো কারণ নেই। কিন্তু কেন? শিফট শেষ না করেই কেন চলে যেতে হবে? মামুন আমাকে খোলাখুলিই বলেছিল। বলেছিল, ও একটা মেয়েকে পছন্দ করেছে। তাকে বিয়ে করবে। বিকালে একটু আগেভাগে বেরোতে পারলে মেয়েটার সঙ্গে দেখা করতে যেতে পারে। তার সেই পছন্দের মেয়েটি ফরিদা, পরে তার স্ত্রী। ফরিদাকে কেন্দ্র করে আমাদের সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হলো। ফরিদা থাকত নারায়ণগঞ্জে নদীর ওপারে। একটু সময় বের করে নিয়ে মামুন ছুটত সেখানেই। দ্রুত লেখার আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল মামুনের। দ্রুত অনুবাদ করতে পারত। বিকালের পালার সব কাজ ওকে একসঙ্গেই ধরিয়ে দিতাম। ঝড়ের মতো সব কাজ সে শেষ করে ফেলত। দুই বা তিন ঘণ্টার মধ্যে। তারপরই ছুট। একদিন দেরি হয়ে গেল। সেদিন কপি লাগছিল বেশি। পাতায় বিজ্ঞাপন কম থাকলে কপির চাহিদা বেড়ে যায়। এদিন কাজ যেন শেষ হচ্ছিল না। ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে চলছিল। এরই মধ্যে টেলিফোন। টেলিফোনে ফরিদা। মামুনের সঙ্গে কথা শেষ করে আমাকে ধরল। প্রথম কথাটাই তার ছিল, আর কতক্ষণ আটকে রাখবেন ওকে? ছাড়েন না।
এভাবেই ফরিদা আমার পরিচিত হয়ে গেল। খুব ভালো লাগল। প্রথম আলাপটাই এত আন্তরিক, এত স্বচ্ছন্দ। এই আন্তরিকতাটাই অক্ষুণ্ন ছিল তার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। হ্যাঁ, শেষ দিন। মাত্র কুড়ি বছরের বিবাহিত জীবন কাটিয়ে ফরিদা আমাদের চোখের সামনেই ইহজগত ত্যাগ করল।
মামুন বিয়ে করেছিল ১৯৬৪ সালের শেষ দিকে। ওর মাস দুয়েক আগে আমি বিয়ে করেছি। হঠাত্ এক সকালে মামুনের ছোট ভাই হারুন আমার শান্তিবাগের বাসায় এসে হাজির। জানাল, সেই দিনই মামুনের বিয়ে। আমি যেন ওর বাসায় যাই। আর আমার পাঞ্জাবিটা দরকার বিয়েতে মামুনের পরার জন্য। অফিসের কাজ ফেলে ওর বিয়েতে যেতে পারিনি। আর বিয়েতে পরার জন্য পাঞ্জাবিটাও দিতে পারিনি, কারণ ওটা ধোয়ানো ছিল না। সংবাদে একটা অনুবাদের ভুলের জন্য ওর চাকরি নিয়ে টানাটানি পড়ে। ঠিক অনুবাদের ভুল নয়। মওলানা ভাসানীর একটি বক্তৃতার অনুবাদে ‘ইম্পিরিয়ালিস্ট’ শব্দটির বাংলা অসতর্কতাবশত ও লিখেছিল ‘সমাজতন্ত্রী’। ফলে মওলানার বক্তব্যের অর্থই একেবারে বিপরীত হয়ে যায়। তখন আমাদের বার্তা সম্পাদক ছিলেন তোয়াব খান। অত্যন্ত সহৃদয়, অত্যন্ত সহানুভূতিশীল ব্যক্তি। আমাদের হাতে ধরে কাজ শিখিয়ে সাংবাদিক বানিয়েছেন। তাকে আমরা বলি সাংবাদিক গড়ার কারিগর। তোয়াব ভাইয়ের সঙ্গে এক পালায় একসঙ্গে কাজ করা ছিল আমাদের জন্য এক বড় আকর্ষণ। মামুনও তার কাছে সাংবাদিকতার শিক্ষা পেয়েছে। কিন্তু এই ভুলটা তোয়াব ভাই কিছুতেই মেনে নিতে পারলেন না। কাজের ব্যাপারে কোনো গাফিলতি তিনি সহ্য করতে পারতেন না। অফিসের ডিসিপ্লিনের ব্যাপারে তিনি ছিলেন অত্যন্ত কড়া। ব্যাপারটা নিয়ে মামুনকে কয়েকটা দিন বেশ ধকল পোহাতে হয়েছিল। পরে সংবাদের তখনকার যুগ্ম-সম্পাদক শহীদুল্লাহ কায়সারের হস্তক্ষেপে একটা সুরাহা হলো। শহীদুল্লাহ কায়সার লক্ষ্য করেছিলেন মামুনকে। খুব পছন্দ করেছিলেন তাকে। তিনিই একদিন মামুনকে নিউজ টেবিল থেকে সরিয়ে নিয়ে গেলেন সম্পাদকীয় বিভাগে। টেলিভিশনে যোগ দেয়ার আগে পর্যন্ত মামুন সংবাদের সম্পাদকীয় বিভাগেই ছিল।
টেলিভিশনই ছিল মামুনের সত্যিকার জগত্। এখানে যোগ দেয়ার পর থেকেই মামুন দিনে দিনে খ্যাতিমান হয়ে উঠল। নাটক অন্তপ্রাণ মামুন মঞ্চ, টেলিভিশন, চলচ্চিত্র, বেতার প্রতিটি মাধ্যমেই নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করে গেল। ও টেলিভিশনে যোগ দেয়াতে আমি খুব খুশি হয়েছিলাম। ওর সাংবাদিকতা করা নিয়ে আমার মনে যে একটু দ্বিধা ছিল, টেলিভিশনে যাওয়ায় তা দূর হয়ে গেল। মামুনকে বলেছিলাম, এতদিনে আপনি ঠিক জায়গাতে পৌঁছালেন।
টেলিভিশনে নাটক প্রয়োজনায় মামুন দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। ১৯৬৭-তে মামুন আমার দুটি নাটকও টেলিভিশনে প্রযোজনা করেছিল। ছাদ আর চোরা ছাদ-এ অভিনয় করেছিলেন মোস্তফা আর চোর-এ আনোয়ার হোসেন। সে সময় ডিআইটি ভবনের স্টুডিও থেকে সরাসরি প্রচারিত নাটক প্রযোজনা যে কত কষ্টকর ছিল, আজকের দিনের শিল্পী বা কলাকুশলীরা তা কল্পনাও করতে পারবেন না। স্টুডিওর ভেতরে ছাদের সেট তৈরি করা ছিল একটা দুরূহ কাজ। এই সময় আমার স্ত্রী রেখা মঞ্চে অভিনয় করছিল। মামুনের বিপরীতেও মঞ্চে মামুনেরই লেখা ‘উজান পবন’-এ গ্রাম্য রমণীর ভূমিকায় অভিনয় করে প্রশংসা পেয়েছিল। ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট মঞ্চে অভিনীত নাটকটি পরিচালনা করেছিলেন কামাল লোহানী। নাগরিকের আতাউর রহমানও এই নাটকে অভিনয় করেছিলেন। মামুনই এদিন রেখাকে টেলিভিশনে নাটকের জন্য অডিশন দিতে বলল। অডিশনের পর টেলিভিশনে মামুনের নাটকেই রেখার প্রথম অভিনয়। স্বাধীনতার পর গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনের সূচনায় মামুন রেখাকে বলেছিল থিয়েটার নাট্যগোষ্ঠী গঠনের চিন্তা-ভাবনার কথা, এই গ্রুপে তাকে যোগ দেয়ার কথা। তখন থেকেই রেখা থিয়েটারে।
রেখার সঙ্গে সঙ্গে আমিও অল্প-স্বল্প জড়িয়ে পড়েছিলাম থিয়েটারের সঙ্গে। সদস্য ছিলাম না, তবে থিয়েটারের সবাই আমাকে তাদের এক আপনজন বলেই গ্রহণ করেছিল। আপনজন হিসেবেই তাদের কিছু কিছু কথা বলতাম। কিছু সুপারিশ-পরামর্শ দিতাম। মামুনের স্ত্রী ফরিদার মৃত্যুর পর তার নামে থিয়েটারের পরবর্তী উত্সবটি উত্সর্গ করার একটি প্রস্তাব আমি দিয়েছিলাম। তারা আমার প্রস্তাবটি গ্রহণ করে উত্সবটি ফরিদার নামে উত্সর্গ করেছিলেন।
এভাবেই এগিয়ে চলেছিল মামুনের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা। দুজন ছিলাম দুই জগতে, দুই মাধ্যমে। তবুও নানান সূত্রে ছিল আমাদের যোগাযোগ। সুযোগ-সুবিধামত চলে যেতাম মামুনের বাসায়। মামুন এসেছে আমার বাসায়। এসেছে ফরিদাও। অনেক মজার মজার ঘটনা আছে মামুনের পরিবারের সঙ্গে আমাদের। মামুনের ছেলের জন্মদিনে গেছি ওর সিদ্ধেশ্বরীর বাসায়। মামুন বাসায় ছিল না। টেলিভিশনে কাজ শেষ করে আসতে দেরি হচ্ছিল। দোতলার সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়েছিল ফরিদা আমাদের অভ্যর্থনা জানাতে। কোলে ছিল তার ছেলে। অদ্ভুত এক ঘটনা ঘটাল ওই ছেলে। আমাকে দেখেই আব্বা আব্বা করে হাত বাড়িয়ে মায়ের কোল থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার কোলে। ফরিদা তো লজ্জায় লাল। বাবার চেহারার সঙ্গে আমার চেহারার মিল পেয়েছিল ছোট্ট ছেলেটি। আরও একটি কারণ ছিল তার বিভ্রান্তির। আমার গায়ে যে জামাটি ছিল, হুবহু তেমনই একটা জামা ছিল মামুনের। ঠিক এর বিপরীত ঘটনা ঘটেছিল আমার বাসায়। টেলিভিশনে একটি নাটকে অভিনয় করছিল মামুন আর আমার স্ত্রী রেখা। আমার ছেলে তখন খুব ছোট। টেলিভিশনের পর্দায় রেখার সঙ্গে মামুনকে দেখে আমার ছেলে আব্বা আব্বা বলে চিত্কার দিয়ে উঠেছিল। অবুঝ শিশুদের এই বিভ্রান্তিতে আমাদের এটা বিশ্বাস করার কারণ ঘটেছিল যে আমাদের চেহারায় কোথাও মিল আছে।
মামুন চলে গেছে এক বছরের বেশি হয়ে গেল। শরীরে চেপে বসা একের পর এক রোগের ধকল ও আর সামাল দিতে পারেনি। আসলে রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করে বলতে হয়, ‘জীবনেরে কে রাখিতে পারে, আকাশের প্রতি তারা ডাকিছে তাহারে।’ ওই ডাকে আমাদের সবাইকে তো একদিন সাড়া দিতে হবে। কেউ আগে, কেউ পরে। যারা আগে যায় তাদের স্মৃতি আঁকড়ে অন্যদের শুধু অপেক্ষা করতে হয়। মামুন এখন আমাদের কাছে শুধুই স্মৃতি। এই স্মৃতি রোমন্থন করেই আমাদের এখন জীবনের অবশিষ্ট দিনগুলোর দিকে এগিয়ে যাওয়া।
নিউ ইয়র্ক থেকে
No comments