সেচ সঙ্কটের মুখে বরেন্দ্র অঞ্চলঃ ব্যবস্থা নিন বোরো আবাদের শুরুতেই

প্রতি বছরের মতো এবারও বরেন্দ্র অঞ্চলে বোরো মৌসুমে সেচ সঙ্কট দেখা দেয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিভিন্ন কারণে পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়তে পারে মৌসুমের প্রধান ফসল ধানের উত্পাদন। স্বভাবতই তার বিরূপ প্রভাব পড়বে এ অঞ্চলের কৃষিজীবী মানুষের জীবন-জীবিকার ওপর।
বছরের পর বছর ধরে অব্যাহতভাবে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় এরই মধ্যে অসংখ্য নলকূপে পানি না পাওয়ার আলামত দেখা যাচ্ছে। ভূ-প্রাকৃতিক অবস্থার এ সঙ্কট এতটাই প্রকট হয়ে উঠেছে যে, পরিস্থিতি মোকাবিলায় বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ) এবার রবি মৌসুমে তুলনামূলক সেচ কম লাগে এমন সব ফসলের চাষ করতে পরামর্শ দিয়েছে কৃষকদের। যেসব এলাকায় সেচ সঙ্কট অবধারিত বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে, সেখানে গম ও ছোলা চাষের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে বিএমডিএ।
প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে এবার বোরো মৌসুমে বিএমডিএ’র প্রকল্প এলাকায় গভীর নলকূপে পানি না পাওয়ার আশঙ্কা প্রবল। এমনকি কিছু কিছু নলকূপ থেকে এ মৌসুমে না ওঠার লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এর কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, এ বছর বর্ষায় বৃষ্টিপাত কম হয়েছে, উল্লেখ করার মতো পর্যাপ্ত বন্যাও হয়নি। এতে অপূর্ণ থেকে গেছে ভূগর্ভস্থ জলাধার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এভাবে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার ঘটনা নজিরবিহীন। স্থানবিশেষে পানির স্তর নেমে গেছে ৩০ ফুট। এছাড়া এবার আমন মৌসুমেও ব্যাপকভাবে সেচের প্রয়োজন হয়েছে। ফলে পানির স্তর আরও নিচে নেমে যাওয়ার এ ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। স্থানীয় কৃষকরা আশঙ্কা করছেন, এ অবস্থায় ঝুঁকি নিয়ে অনেক অঞ্চলে ধানের আবাদ করা হবে না।
বরেন্দ্র অঞ্চলে সেচ সঙ্কট নতুন কোনো বিপদসঙ্কেত নয়। অনেক আগে থেকেই ক্রমাগত এ অঞ্চল খরাপ্রবণ হয়ে উঠছে। অব্যাহতভাবে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের কারণে এখন তা এতটাই মারাত্মক আকার নিয়েছে যে, প্রধান ফসল ধান উত্পাদন কমিয়ে অন্যান্য ফসল ফলানোর চিন্তা করা হচ্ছে। তবে শুধু পানি উত্তোলনই পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার একমাত্র কারণ নয়। বরং এটি সার্বিক ভূ-প্রাকৃতিক পরিবেশ-পরিস্থিতির একটি অনিবার্য পরিণাম।
উল্লেখ্য, সারা বিশ্বই এখন জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের আওতায় চলে এসেছে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সম্মেলন হচ্ছে, বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে গলদঘর্ম হচ্ছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার মূল কারণ বিশ্ব জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব। এতে দেশে বৃষ্টিপাত কমেছে। প্রতি বছর বর্ষায় দেশে যে স্বাভাবিক বন্যা দেখা দেয় সেই ধারাবাহিকতায়ও বজায় থাকছে না। পরিমিত বৃষ্টিপাত ও বন্যা হলে প্রাকৃতিক নিয়মেই পূর্ণ হয়ে যায় ভূগর্ভস্থ পানির আধার। তা না হওয়ায় সেচ সঙ্কট ক্রমেই প্রকট হয়ে উঠছে বরেন্দ্রসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। এদিকে সেচের অন্যতম উত্স নদ-নদী প্রকৃতি ও মানুষের অবিমৃষ্যকারিতায় ভরাট হয়ে শুকনো মৌসুমে সেচের পানি জোগান দেয়ার ক্ষমতা হারাচ্ছে। এরই মধ্যে মরে গেছে কিংবা মৃতপ্রায় অবস্থায় পরিণত হয়েছে অসংখ্য নদী। সব মিলিয়ে সঙ্কটের আয়তন বিস্তৃত হচ্ছে দিনকে দিন। বরেন্দ্র অঞ্চলে পানির অভাব তারই একটি জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত।
এত সব প্রতিকূলতার মধ্যেই আমাদের উত্পাদন ব্যবস্থাকে উদ্ভূত পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ রাখার চেষ্টা করে যেতে হবে। তারই অংশ হিসেবে বিএমডিএ বরেন্দ্র অঞ্চলে ধানের বিকল্প হিসেবে অঞ্চলবিশেষে অন্যান্য ফসল চাষে কৃষকদের আগ্রহী করার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছে। গম, ছোলাসহ সরিষা ও অন্যান্য তেলবীজ, ডাল জাতীয় শস্য উত্পাদনে সেচের প্রয়োজন কম। এগুলোর চাষ বাড়লে আগামী মৌসুমে বোরো ধান চাষে অনেক বেশি সেচ দেয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে। তবে সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, কোনো সঙ্কটকেই সাময়িকভাবে উতরে গেলে চলবে না বরং তাকে স্থায়ীভাবে মোকাবিলা করার ব্যবস্থা নিতে হবে। এ ব্যাপারে কোমর কষে এগিয়ে আসতে হবে সরকারকে। কেননা আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের লক্ষ্যে সরকার বারবার যে আশার কথা শোনাচ্ছে তা পূরণ করা খুব সহজ নয়। কাজেই বোরো মৌসুমের সূচনাপর্বেই বরেন্দ্র অঞ্চলের সেচ সঙ্কট মোকাবিলায় কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। বের করতে হবে সার্বিক সঙ্কট উত্তরণের লাগসই উপায়।

No comments

Powered by Blogger.