আজ একুশের বইমেলা- অপূর্ব শর্মা
বছর ঘুরে আবার এসেছে ফেব্রুয়ারি মাস। ১৯৫২ সালের এই মাসেই আমরা অর্জন করেছিলাম মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার। সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ নাম জানা না জানা অসংখ্য প্রাণের বিনিময়ে আমরা আদায় করেছিলাম জননীর ভাষায় কথা বলার সক্ষমতা।
বিশ্ব ইতিহাসে ভাষার দাবিতে এমন আত্মত্যাগের নজির নেই তেমন একটা। এই অর্জন আমাদের স্বাধীনতার পথে অগ্রসর হতে প্রেরণা যুগিয়েছে, পৌঁছে দিয়েছে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে। সেই চেতনাকে লালন এবং ভাষার জন্য আত্মোৎসর্গকারীদের স্মৃতিকে অম্লান করে রাখতেই প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি মাসে আয়োজিত হচ্ছে ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’। মাসব্যাপী এই বইমেলা এখন শুধু বইমেলার মধ্যেই আর সীমাবদ্ধ নেই। গ্রন্থমেলা এখন আমাদের প্রাণের মেলায় পরিণত হয়েছে। উপলক্ষ হয়েছে লেখক, পাঠক এবং প্রকাশকদের মিলনমেলার।উৎসের সন্ধানে
স্বাধীন দেশে চিত্তরঞ্জন সাহা বইমেলার গোড়াপত্তন করেন। ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি বর্ধমান হাউজ প্রাঙ্গণের বটতলায় এক টুকরো চটের ওপর ৩২টি বই সাজিয়ে তিনি নতুন এ যাত্রাপথের সূচনা করেন। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত তিনি একাই চালিয়ে যান বইমেলা। চিত্তরঞ্জন সাহার সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ১৯৭৭ সাল থেকে তাঁর সঙ্গে বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণে বই বিক্রি শুরু করে। ১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমীর তৎকালীন মহাপরিচালক আশরাফ সিদ্দিকী বাংলা একাডেমীকে মেলার সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত করেন। ১৯৭৯ সালে মেলার সাথে যুক্ত হয় বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতি। ১৯৮৪ সালে বইমেলার নামকরণ করা হয় ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’। গুটি কয়েক প্রকাশক নিয়ে যে মেলার যাত্রা হয়েছিল কালপ্রবাহে আজ তা অর্জন করেছে বিশালতা। যত দিন যাচ্ছে ততই বাড়ছে লেখক, পাঠক ও প্রকাশকদের সংখ্যা।
প্রাণের মেলা, বইমেলা
শিশু থেকে বৃদ্ধ সব বয়সের মানুষের মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে বইমেলা। একুশের চেতনায় ভাস্বর এই মেলা আমাদের জাতীয় মননেরও প্রতীক হয়ে উঠেছে। মেলায় আসেন না বাংলাদেশে হয়তো এমন কোনো লেখকই খুঁজে পাওয়া যাবে না। প্রকাশকদের ক্ষেত্রেও তাই। লেখকরা মেলার জন্য কতটা আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষায় থাকেন তা উপলব্ধি করা যায় হরিশংকর জলদাসের বক্তব্য থেকে। মেলা প্রসঙ্গে তার অভিব্যক্তিÑ ‘বইমেলাকে আমি হৃদয়ের মেলা বলি। আমরা যারা ঢাকার বাইরে থাকি, তারা মেলার জন্য অধির আগ্রহে অপেক্ষ করি। কারণ মেলায় হৃদয়ের স্বাদ পাই। পাঠকরা বই স্পর্শ করছে, মন্তব্য করছে দেখে আপ্লুত হই। তিনি বলেন, এসব বিষয় আমাকে মুদ্ধ করে। চমৎকারিত্বে ডুবে থাকি। যতদিন চলার শক্তি থাকবে ততদিন মেলায় আসব।’ বইমেলা বিশ্বজাতিক মেলায় পরিণত হোক এমনটাই তাঁর চাওয়া।
কবি মহাদেব সাহা বলেন, বইমেলাকে আমি শুধু বইয়ের মেলা মনে করি না। বইমেলা হচ্ছে, বইপ্রেমী মানুষের মিলনক্ষেত্র। বইমেলাকে বাঙালির সাংস্কৃতিক উৎসবও বলা যায়। কারণ বইমেলার সঙ্গে বাঙালির চেতনা যুক্ত। আত্মত্যাগ এবং আবেগের বিষয়টি মেলার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। মেলা প্রেরণারও উৎস। বইমেলা বাংলা বর্ণমালার সঙ্গে একমাস বসবাসের সুযোগ করে দেয়। আমাদের প্রাণের মেলা, অমর একুশে গ্রন্থমেলা।
ভালো বই, সুন্দর বইয়ের প্রত্যাশা
ভালো এবং সুন্দর বইয়ের চাহিদা সব সময়ই বেশি। এসব বইয়ের ক্রেতাও অধিক। সৃজনশীল পাঠকরা উন্নতমানের বই কিনতে চান। এবারের মেলা যেহেতু প্রকাশকদের মেলা সে কারণে প্রকাশদের কাছে পাঠকদের প্রত্যাশাও বেশি। পাঠকরা চানÑউন্নতমানের বই। রুচিশীল বই। শুধু পাঠকরাই নন, লেখকদেরও অভিন্ন দাবি।
তরুণ লেখক সালেক খোকনের মতে, ভালো, ভালো এবং ভালো মানের বইয়ের কোনো বিকল্প নেই। একটি ভালো বই নতুন পাঠক সৃষ্টিতেও ভূমিকা রাখে। তিনি বলেন, বইমেলাকে ঘিরে যেমন নতুন লেখক তৈরি হয়, তেমনি নতুন পাঠকশ্রেণীর জন্ম হয়। তাই ভালো, মানসম্পন্ন, নির্ভুল ও রুচিশীল বই প্রকাশ ও বিক্রির দিকটি যদি সংশ্লিষ্টরা নজরে না আনেন তাহলে ভালো পাঠক-লেখক শ্রেণী তৈরি হবে না।
প্রকাশনা সংস্থা গদ্যপদ্যের স্বত্বাধিকারী শাহ আনোয়ারের মতে, আমরা সব সময়ই ভালো এবং সুন্দর বই পাঠকদের হাতে তুলে দিতে চাই। সেই প্রচেষ্টাই প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে চালিয়ে যাচ্ছি। ভালো মানের বইয়ের পাঠকই সবচেয়ে বেশি উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রকাশনা শিল্পকে কাক্সিক্ষত লক্ষে নিয়ে যেতে হলে এ ব্যাপারে ছাড় দিলে চলবে না। অন্যথায় গতি হারাবে এই শিল্প।
পাঠক যেন না ঠকে
‘নানাভাবে ঠকছি আমরা। নতুন বোতলে পুরনো মদের মতো অনেক লেখকের পুরনো লেখা নতুন নামে প্রকাশ হচ্ছে মেলায়। আকর্ষণীয় নাম দেখে, বই কিনে বিভ্রান্ত হতে হচ্ছে ক্রেতাদের। বিগত প্রায় প্রতিটি মেলায় এমনটি হয়েছে। বলছিলেন নিয়মিত মেলায় আসা পাঠক মিজানুর রহমান। এবারও মেলায় যোগ দিতে আগেভাগে এসেছেন রাজধানীতে। চট্টগ্রামের এই বাসিন্দা জানান, ‘এতে করে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন পাঠকরা। এজন্য সংশ্লিষ্ট প্রকাশকদের দায়ী করেন তিনি। এই পদ্ধতি পরিহার করারও আবেদন জানান মিজান।
শুধু এভাবেই নয়, আরও নানাভাবে ক্রেতারা ঠকছেন বলে জানালেন ঢাকার মেয়ে রিমা হোসেন। তার বক্তব্যÑ নিম্নমানের বাঁধাই ও কম দামি কাগজ, প্রুফ না দেখা, অনুন্নত মানের ছাপার বই প্রকাশিত হচ্ছে প্রতিবারই মেলায়। কিন্তু এসব বই ন্যায্যমূল্য দিয়ে কিনতে হচ্ছে ক্রেতাদের। এটা এক ধরনের প্রতারণা! এসব তদারক করা প্রয়োজন বলে অভিমত তার। নইলে গ্রাহকদের স্বার্থ সংরক্ষণ হবে না।
পাঠক আবেদিন জুয়েলের মতে, প্রকাশকরা মেলায় যে পরিমাণে কমিশন দেন অর্থাৎ ২৫% তা বইয়ের দোকান থেকেও পাওয়া যায়। কিন্তু রাজধানীতে ভাড়া দিয়ে এসে মেলায় একই কমিশনে বই কিনতে হচ্ছে পাঠকদের। যার ফলে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ক্রেতারা। এক্ষেত্রে মেলার জন্য কমিশন বৃদ্ধির প্রস্তাব করেন তিনি।
কবি স্বীকৃতি প্রসাদ বড়–য়া ফর্মা অনুযায়ী বইয়ের দাম নির্ধারণের দাবি জানিয়ে বলেন, ফর্মা অনুযায়ী দাম না রাখার কারণে ক্রেতাকে ঠকতে হচ্ছে। একই সাইজের বইয়ের দাম একেক দোকানে একেক রকমের। তাছাড়াও রিপ্রিন্টের নামে পাঠকদের পকেট কাটা হচ্ছে। এক বছর পূর্বে যে বইয়ের দাম ২শ’ টাকা ছিল তা পরের বছর আড়াই শ’ টাকা করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট প্রকাশকদের এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে কাগজের মূল্য বৃদ্ধির অজুহাত দেখান তারা। যা অসাধুতা ছাড়া আর কিছুই নয়। এসব বিষয় তদারক করা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।
অবহেলিত যেন না হয় ভাষা
প্রতিবছর অমর একুশে গ্রন্থমেলায় হাজার হাজার বই বের হচ্ছে। এবারের মেলায় চার হাজারেরও অধিক বই বের হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু সংখ্যার দিক থেকে এতসব বই বের হলেও মানগত দিক বিবেচনায় প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা একেবারেই কম। নামিদামি প্রকাশনা সংস্থাগুলো মানসম্মত বই প্রকাশের ব্যাপারে বদ্ধপরিকর থাকলেও অধিকাংশ প্রকাশনা সংস্থাই এর ধার ধারে না। সম্পাদনা এবং প্রুফ না দেখার কারণে ভুল বানানে ভরা বই প্রকাশ হচ্ছে মেলায়। এতে করে প্রকাশনা শিল্প সমৃদ্ধ হওয়ার বদলে অবনমনের দিকে ধাবিত হচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে পাঠকদের ওপর। বিশেষত মেলায় ছোটদের নিয়ে প্রকাশিত বইয়ে যে পরিমাণ বানান ভুল প্রত্যক্ষ করা যায় তা সত্যিই দুঃখজনক। ভুলে ভরা বানানের বই পড়ে কোমলমতি শিশুরা শিখছে ভুল বানান। কিন্তু এই ভুল দেখার কেউ নেই। পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশের প্রকাশকরাই সমৃদ্ধ প্রকাশনার ব্যাপারে বদ্ধপরিকর। তাদের প্রকাশনা সংস্থায় একজন করে সম্পাদক রয়েছেন। আছেন ভালো মানের প্রুফ রিডার। কিন্তু আমাদের দেশে তা নেই বললেই চলে। যার ফলে বইয়ের সংখ্যা বাড়ছে কিন্তু বাড়ছে না মানসম্মত বই।
এ ব্যাপারে ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশের জহিরুল আবেদীন জুয়েল বলেন, বাংলা একাডেমীর প্রমিত বানানরীতি ব্যবহার এবং প্রতিটি প্রকাশনা সংস্থায় অন্তত একজন করে সম্পাদক রাখা প্রয়োজন। আমাদের দেশে সম্পাদক এবং প্রুফ রিডারের অভাব রয়েছে। বাংলা একাডেমী যদি এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে, তাহলে প্রকাশকরা উপকৃত হবেন। তিনি বলেন, বইমেলায় শিশুদের উপযোগী প্রচুর বই বের হয়। বিক্রিতেও শীর্ষে থাকে এসব বই। অথচ এসব বই ভুলে ভরা থাকে, যা আমাদের শিশুদের ভুল শিক্ষা দিচ্ছে। বাংলা একাডেমী বানান বিষয়ে কঠোর হলে এ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
থাকবেন হুমায়ূন আহমেদ!
প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমদের নামে এবারের বইমেলা উৎসর্গ করা হয়েছে। এই প্রতিথযশা লেখক গত বছর দুরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করলে বাংলা একাডেমী ২০১৩ সালের মেলা হুমায়ূন আহমদের নামে উৎসর্গ করার সিদ্ধান্ত নেয়। এই সিদ্ধান্তেরই বাস্তবায়ন হচ্ছে এবার।
বইমেলায় সর্বাধিক বিক্রীত বইয়ের লেখক ছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। দল বেঁধে তাঁর বই কিনত পাঠকরা। মেলায় যেদিন আসতেন হুমায়ূন আহমেদ সেদিন তৈরি হতো অন্যরকম আবহ। তাঁর লেখা বইগুলোতে অটোগ্রাফ নিতে যে স্টলে তিনি বসতেন সেখানে ভিড় জমাতো পাঠকরা। বিগত এক দশকের প্রায় প্রতিটি মেলায়ই হুমায়ূন আহমেদের পাঁচের অধিক বই বেড়িয়েছে। কিন্তু এবারের মেলায় বের হচ্ছে তাঁর লেখা নতুন মাত্র একটি বই। তাঁর রাজনৈতিক উপন্যাস ‘দেয়াল’ বের করছে অন্যপ্রকাশ। মেলার প্রথম দিন থেকেই বইটি পাওয়া যাবে। হুমায়ূন আহমদের নিজের লেখা আর কোনো নতুন বই বের না হলেও তাঁকে নিয়ে লেখা প্রায় ডজন দুয়েক বই বের হবে মেলায়। হুমায়ূন আহমেদের নির্ধারিত যে ১৪ জন প্রকাশক আছেন তাদের প্রত্যেকের প্রকাশনা সংস্থা থেকে তাঁকে নিয়ে লেখা কোনো না কোনো বই বের হবে মেলায়। তাছাড়া বাংলা একাডেমীর উদ্যোগে বের হচ্ছে হুমায়য়ূন আহমেদ স্মারকগ্রন্থ।
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে
পৌঁছবে কি
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে অনেক আগেই স্বীকৃতি পেয়েছে মহান ২১ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু যে ভাষা অর্জনের জন্য রক্ত ঝরেছে, স্বীকৃতি পেয়েছি আমরা আন্তর্জাতিকভাবে সেই ভাষার সাহিত্য আজ বিশ্বপরিম-লে অপরিচিত। অথচ বাংলা ভাষার এমন অসংখ্য সাহিত্যিক রয়েছেন যারা বিশ্বমানের। তাদের রচনা অনুবাদের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পৌঁছে দেওয়া হলে নতুন মাত্রা পেতো আমাদের সাহিত্য। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য আজ অবদি এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগই নেওয়া হয়নি। বাংলা একাডেমীর এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়ার সুযোগ থাকলেও তা তারা করেনি। লেখিকা সেলিনা হোসেনের মতে, আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলা সাহিত্যকে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে বাংলা একাডেমীকেই উদ্যোগ নিতে হবে। তিনি বলেন, আমাদের সাহিত্য অনেক সমৃদ্ধ। বিশ্বমানের। কিন্তু যথাযথভাবে অনুবাদ না হওয়ায় অন্য ভাষাভাষিরা তা পড়তে পারছে না। তিনি বাংলা একাডেমীর অনুবাদ শাখাকে গতিশীল করার দাবি জানিয়ে বলেন, বাংলা একাডেমী অনুবাদকৃত বই আন্তর্জাতিক বইমেলাগুলোতে নিয়ে গিয়ে বাংলা সাহিত্যের প্রচার ও প্রসারে ভূমিকা রাখতে পারে। এসব ব্যাপারে যথাশীঘ্র উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।
আলোচিত লেখকদের যত বই
বাংলা সাহিত্যের প্রথিতযশা প্রায় সকল লেখকেরই একাধিক বই প্রকাশিত হচ্ছে এবারের মেলায়। প্রথম সপ্তাহে প্রকাশিত হতে পারে এমন কিছু বইয়ের কথা উল্লেখ করা হলো এখানে। কথা সাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকের আত্মজীবনীমূলক বই ‘টান’ বের হচ্ছে বেঙ্গল ফাউন্ডেশন থেকে। কথা প্রকাশ করছে তাঁর প্রবন্ধের বই ‘রবীন্দ্রনাথ ও অন্যান্য ভাবনা’। ‘যুক্ত’ থেকে বের হচ্ছে তার লেখা ‘লন্ডন ডায়েরি’। প্রবন্ধের বই ‘চিন্তনকণা’ ও উপন্যাস ‘সাবিত্রী’ উপাখ্যান’ প্রকাশ করছে ইত্যাদি। একই প্রকাশনা থেকে বের হচ্ছে সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের উপন্যাস কেরানীও দৌড়েছিল, যতীন সরকারের ‘মানবমন, মানবধর্ম ও সমাজ বিপ্লব’ এবং বেলাল মোহাম্মদের আত্মজীবনী ‘কতঘরে ঠাই’। হায়াৎ মামুদের ‘শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ’ প্রকাশ করছে গদ্যপদ্য।
বেলাল চৌধুরীর চারটি বই প্রকাশিত হচ্ছে মেলায়। প্রয়াত কবি শামসুর রাহমানকে নিয়ে লেখা বই ‘রূপালি আঙ্গুলের ঝর্ণাধারা’ বের করছে ‘বর্ষাদুপুর’। বিদেশী সাহিত্যের অনুবাদ নিয়ে লেখা ‘পূর্ণ মনিজালে’ আনছে ‘শুদ্ধস্বর’। তার গল্পের বই ‘দ্য গ্রেট হ্যারি এস’ প্রকাশিত হচ্ছে সালমা বুক ডিপো থেকে। এছাড়াও বের হচ্ছে তাঁর ছড়ার বই ‘সবুজ ভাষার ছড়া’।
মেলায় সেলিনা হোসেনের দুটি বই বের হচ্ছে। এর একটি উপন্যাস, অন্যটি প্রবন্ধের সংকলন। রাজনৈতিক উপন্যাস ‘আগস্টের একরাত’Ñ বের করছে সময় প্রকাশন। প্রবন্ধ গ্রন্থ ‘ভাষা মুক্তিযুদ্ধ সাহিত্য সংস্কৃতি’, বের করছে ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ।
অনিন্দ প্রকাশ মেলায় আনছে মইনুল আহসান সাবের-এর পাঁচ খ-ে ‘গল্পসমগ্র’। এ ছাড়া ‘মইনুল আহসান সাবেরের বাছাই গল্প’ বের হচ্ছে জয়তী প্রকাশন থেকে।
মেলায় কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলনের সাতটি নতুন বই বের হচ্ছে। উপন্যাস ‘পাঁচ নায়িকা’, কিশোর গল্প সংকলন ‘সাদা ঘোড়ার সওয়ারি’ হাসির রচনা ‘মোটকু মিয়ার গার্লফ্রেন্ড’, ‘মুক্তিযুদ্ধের গল্প’, উপন্যাস ‘শ্রাবণ জ্যোৎস্নায়’ বের হচ্ছে অনন্যা থেকে। হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে লেখা স্মৃতিচারণামূলক গ্রন্থ ‘প্রিয় হুমায়ূন আহমেদ’ মেলায় আনছে অন্যপ্রকাশ। নানন্দিক প্রকাশ করছে তার মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা উপন্যাস ‘সোনার মানুষ’।
কবি আল মাহমুদের তিনটি নতুন বই বের হচ্ছে এবার। ‘বুক কো-অপারেটিভ সোসাইটি’ বের করছে তাঁর উপন্যাস ‘পোড়া মাটির জোড়া হাঁস’। মহাকাল প্রকাশনী থেকে বের হচ্ছে তাঁর সাম্প্রতিক লেখা কলামের বই ‘ছায়ার সঙ্গে মায়ার লড়াই’ এবং ‘আমি ধরণীর মেয়ে’।
নির্মলেন্দু গুণের আত্মজীবনী ‘মহাজীবনের কাব্য’ বের করছে কথা প্রকাশ। এছাড়াও ফেসবুকে লেখা স্ট্যাটাস সমূহ নিয়ে ‘মুখপঞ্জির অনুভাষ্য’ নামে একটি বই বের করা কথা রয়েছে তাঁর।
কবি মহাদেব সাহার ৯টি বই বের হচ্ছে মেলায়। তারমধ্যে উল্লেখযোগ্যগুলো হচ্ছে, নান্দনিক থেকে ‘আত্মস্মৃতি ১৯৭৫ : সেই অন্ধকার সেই বিভীষিকা’, ঐতিহ্য থেকে প্রথম গল্পের বই ‘সেখানে গন্ধ ছিল ফুল ছিলো না’, বাংলা প্রকাশ থেকে গদ্যের বই ‘কেন ভালোবাসি’ এবং চর্চা গ্রন্থপ্রকাশ থেকে বের হচ্ছে তার ‘ভালোবাসার লিরিক’।
পাইরেটেড ঠেকাতে বদ্ধপরিকর
পাইরেটেড বইয়ের বিক্রি বন্ধ করতে সৃজনশীল প্রকাশকরা এবার বদ্ধপরিকর। তাদের মতে, পাইরেটেড বইয়ের কারণে দেশের প্রকাশকরা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। আর তা বিক্রি করে লাভবান হচ্ছে কতিপয় অসাধু ব্যবসায়ী। প্রতিবছরই বিপুল পরিমাণের পাইরেটেড বইমেলায় বিক্রি হয়। পাইরেটেড বই বিক্রি নিষিদ্ধ থাকলেও তা মানেনি অসাধুরা। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নাকের ডগাতেই দেদার বিক্রি হয়েছে এসব বই। যা দেশীয় প্রকাশনা শিল্পের জন্য হুমকিস্বরূপ।
বইমেলায় বই বিক্রি ও প্রদর্শনের একটি নীতিমালা আছে। তা হচ্ছেÑ বাংলাদেশে প্রাকশিত বাংলাদেশি লেখকদের বই। কিন্তু এই নীতিমালা বাস্তবায়নে উদ্যোগ নেওয়া হয় না। এবার বাংলা একাডেমী কঠোরভাবে বিষয়টি তদারক করবে। প্রকাশকরা নীতিমালা ভঙ্গ করে মেলায় যদি কেউ এ ধরনের বই বিক্রি করেন তাহলে তার স্টল তাৎক্ষণিকভাবে বন্ধের সুপারিশ করেছেন একাডেমীর কাছে। মেলায় পাইরেটেড বইয়ের বিক্রি বন্ধ করা সম্ভব হলে ভালো বইয়ের বিক্রি বাড়বেÑএমনটাই প্রত্যাশা প্রকাশকদের।
প্রসঙ্গ বইমেলা আয়োজন
প্রকাশকদের বইমেলা আয়োজনে উদ্যোগ নেওয়ার কথা থাকলেও সময়ের বিবর্তনে বাংলা একাডেমীর ওপর বর্তিয়েছে সেই দায়িত্ব। বইমেলার আয়োজন করতে গিয়ে বাংলা একাডেমী নিজের দায়িত্ব পালন করতে পারছে না যথাযথভাবে। একাডেমীর মহাপরিচালক থেকে শুরু করে অনেক লেখক, প্রকাশক মনে করেনÑপ্রকাশকদের ওপরই ছেড়ে দেওয়া উচিত বইমেলা আয়োজনের বিষয়টি। অথবা জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রকে দেওয়া যেতে পারে এই দায়িত্ব। তবে এবার প্রকৃত প্রকাশকদের নিয়ে বাংলা একাডেমী বইমেলার আয়োজন করায় বিষয়টি ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন অনেকে। লেখক সাংবাদিক, কামাল লোহানী শুধুমাত্র প্রকাশকদের নিয়ে বাংলা একাডেমীর বইমেলা আয়োজন করার বিষয়টিকে প্রশংসনীয় উদ্যোগ আখ্যায়িত করে বলেছেন, এতে বইয়ের মেলা হবে বইমেলা। এই প্রক্রিয়া যদি অব্যাহত রাখা যায় তাহলে প্রকাশনা শিল্পের সর্বাঙ্গীণ উন্নতি সাধিত হবে। তিনি ছোট ছোট এবং নতুন প্রকাশকদেরও মেলায় সুযোগ দেওয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, প্রয়োজনে নতুনদের মূল মেলার বাইরে রাখা যেতে পারে। কিন্তু তাদের সুযোগ না দিলে নতুন নতুন প্রকাশনা বের হবে না। বইমেলা বাংলা একাডেমী কর্তৃক আয়োজন প্রসঙ্গে লেখক হায়াৎ মামুদ বলেন, গ্রন্থমেলা বাংলা একাডেমীর বোঝা। বইমেলা বাংলা একাডেমীর ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। একাডেমী ঘোষিত নীতির মধ্যেও তা নেই। মেলা শুরুর পূর্ব থেকে শুরু করে পুরো ফেব্রুয়ারি মাস বাংলা একাডেমী মেলা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। যার ফলে বাংলা একাডেমীর মূল কাজ গবেষণা ব্যাহত হচ্ছে মারাত্মকভাবে। প্রকাশকদেরকেই মেলার দায়িত্ব দেওয়া উচিত। তারাই ঠিক করুক মেলা কিভাবে হবে, কোথায় হবে।
কমেছে পরিসর, বাড়বে চাপ
বাংলা একাডেমীর পক্ষ থেকে গত বছর ঘোষণা করা হয়েছিল, ২০১৩ সালের বইমেলা হবে শুধুমাত্র প্রকাশকদের। প্রকাশনা সংস্থার বাইরে কোনো সংগঠনকে স্টল বরাদ্দ দেওয়া হবে না। এবারের মেলা আয়োজনের শুরু থেকেই এ ব্যাপারে একাডেমীর পক্ষ থেকে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। শেষ পর্যন্ত নিজেদের সিদ্ধান্তে অনঢ় থেকেছে একাডেমী। দুই প্রকাশক সমিতির সুপারিশের আলোকে ২৩৬টি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। সরকারী এবং স্বায়ত্তশাসিত প্রকাশনা সংস্থার মধ্যে স্টল দেওয়া হয়েছে ১৮টি প্রতিষ্ঠানকে। এছাড়াও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর, সৌজন্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে মিডিয়া, স্পন্সর, ব্যবস্থাপনা, প্রবাসী প্রতিষ্ঠান মিলে অল্প কয়েকটি সংস্থাকে স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। গ্রন্থমেলার মর্যাদা বৃদ্ধি এবং দেশে বিরাজমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখে এবার এই কঠোরতা অবলম্বন করা হয়েছে। মেলার আয়োজন করা হয়েছে একাডেমী চত্বরে। রাস্তায় কোনো স্টল বসবে না এবার। যার ফলে প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে মেলার পরিধি। স্বভাবতভাবেই মানুষের চাপ সামলাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হবে সংশ্লিষ্টদের। মেলা নিয়ে কথা হয় বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খানের সাথে। তিনি অমর একুশে গ্রন্থমেলা সফলভাবে সম্পন্ন করার প্রত্যয় ব্যক্ত করে বলেন, সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে মেলা পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। তিনি বলেন, এবারের মেলা হবে অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে পরিচ্ছন্ন। বইমেলাকে বইমেলাই মনে হবে। বিগত বছরগুলোর মতো বারোয়ারি মেলা মনে হবে না। তিনি বইমেলা যথাযথভাবে সম্পন্ন করতে সকলের সহযোগিতা কামনা করেন।
No comments