কঠোর আইন শুধুই পরিহাস-ধর্ষণসহ নারী নির্যাতনের ঘটনা দেশে উদ্বেগজনক by আশরাফ-উল-আলম
দেশে নারী নির্যাতনের ঘটনা যে উদ্বেগজনক, তা গত এক বছরের চিত্রই বলে দেয়। গত বছর কমপক্ষে পাঁচ হাজার ৬১৬ জন নারী নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছে। হয়রানির শিকার হয়েছে ৬৬২ জন নারী, আর উত্ত্যক্ত করায় আত্মহত্যা করেছে ১৭ জন।
ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৭৭১ জন নারী। এর মধ্যে গণধর্ষণের শিকার ১৫৭ জন, ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ১০৬ জনকে, আর ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে ১৩৩ জনকে। এই হিসাব বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের আইন সহায়তা শাখার।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই ভয়াল অবস্থার অন্যতম কারণ নির্যাতনকারীর শাস্তি না হওয়া। এ দেশে নারী নির্যাতনের বিচারের জন্য কঠোর আইন থাকা সত্ত্বেও শুধু আইনের সঠিক প্রয়োগ, আর অপরাধীর প্রাপ্য শাস্তি না হওয়ার কারণে নির্যাতন কমছে না। বিশেষজ্ঞদের মতে, এর পেছনের কারণ আবার রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন। অপরাধীদের রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে সঠিক বিচার হয় না। এর সঙ্গে রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীদের অসাধুতা। নানা স্বার্থের টানে তারা অপরাধীদের পক্ষ নিয়ে বিচারপ্রার্থীদের হয়রানি করে। এ ছাড়া সাক্ষী ও ক্ষতিগ্রস্তদের নিরাপত্তা রাষ্ট্র নিশ্চিত করতে না পারাও বিচার না হওয়ার আরেকটি কারণ। এসবের পাশাপাশি বিভিন্ন মহলের সচেতনতার অভাব তো রয়েছেই। মহিলা আইনজীবী সমিতির এক জরিপে জানা যায়, এসব কারণে ধর্ষণ মামলার প্রায় ৯০ শতাংশ আসামি খালাস পেয়ে যায়। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধিত ২০০৩)-এর ৯(১) ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো পুরুষ কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে তবে সে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে। একই আইনের ৯(২) ধারায় বলা হয়েছে, ধর্ষণ বা ধর্ষণ-পরবর্তী অন্যবিধ কার্যকলাপের ফলে ধর্ষিতা নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটলে ধর্ষকের মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হবে। একই সঙ্গে জরিমানাও করা যাবে। সর্বনিম্ন জরিমানা হবে এক লাখ টাকা। আইনে দলবদ্ধভাবে ধর্ষণের (গণধর্ষণ) শাস্তি নির্ধারণ করা হয়েছে মৃত্যুদণ্ড। আইনের ৯(৩) ধারায় বলা হয়েছে, যদি একাধিক ব্যক্তি দলবদ্ধভাবে কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে এবং উক্তরূপ ধর্ষণের ফলে যদি কোনো নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটে বা আহত হয় তাহলে ওই দলের প্রত্যেক ব্যক্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হবে। কমপক্ষে এক লাখ টাকা জরিমানার দণ্ডও হবে।
পাশের দেশ ভারতেও এমন কঠোর আইন নেই। সে দেশের দণ্ডবিধির ৩৭৬ ধারার ২(জি) উপধারায় গণধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। সম্প্রতি চলন্ত বাসে গণধর্ষণের শিকার এক মেডিক্যালছাত্রীর মৃত্যুর ঘটনায় সে দেশে তোলপাড় হলে আইন সংশোধনের জোর দাবি উঠেছে। মেয়েটির বাবাসহ আইন বিশেষজ্ঞ, সাধারণ মানুষ, আইন প্রণেতা, এমনকি ক্ষমতাসীন সরকারও এখন ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করার পক্ষে কথা বলছেন। সে দেশের প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি নিয়ে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়েছেন। ১৪৪ ধারা জারি করতে হয়েছে প্রশাসনকে। আর জনসচেতনতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে সে দেশের কোনো আইনজীবী অপরাধীদের পক্ষে না দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন।
অথচ বাংলাদেশে কঠোর আইনও পারছে না অবস্থা বদলাতে। টাঙ্গাইলের স্কুলছাত্রী ১৪ বছরের কিশোরী গণধর্ষণের শিকার হয়ে এখন মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে। পুরুষ মানুষ দেখলেই সে ভয়ে আঁৎকে উঠছে। কয়েক দিন ধরে সে চিকিৎসাধীন। গত ৬ ডিসেম্বর ধর্ষিত হয় মেয়েটি। প্রথমদিকে ঘটনাটি সম্মান রক্ষার দিক বিবেচনা করে জানানো হয়নি কাউকে। যখন জানাজানি হয়, তখনো প্রশাসনের পক্ষ থেকে নীরব থাকা হয়। পরে গণমাধ্যমে সংবাদটি আসার পর প্রশাসন তৎপর হয়। পাঁচ আসামিকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে তাদের। সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহায়তার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আদৌ এ ঘটনার বিচার হবে কি না তা নিয়ে যথারীতি সংশয় প্রকাশ করা হচ্ছে। কারণ বাংলাদেশে গণধর্ষণের দৃষ্টান্তমূলক কোনো শাস্তি হয়েছে কি না তা মনে করতে পারছে না সংশ্লিষ্ট কেউ।
এমন এক গণধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন এক গার্মেন্টকর্মী। ২০০৬ সালের ১৯ অক্টোবর সকাল সাড়ে ১০টার দিকে মিরপুর ১৬ নম্বর রোডের মাথায় একটি ব্যাগের ভেতর থেকে অজ্ঞাতপরিচয় এক মহিলার দুই হাত, দুই পা ও মাথা উদ্ধার করে পুলিশ। মামলার তদন্তে জানা যায়, গার্মেন্ট মালিক নজরুল ইসলাম ও মোস্তফা ওই মহিলা ও তাঁর এক সহকর্মীকে বাসায় নিয়ে ধর্ষণ করে। পরে একজনকে হত্যার পর লাশ টুকরা টুকরা করে রাস্তায় ফেলে দেওয়া হয়। আসামি নজরুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হলেও মোস্তফা পালিয়ে যায়।
মামলাটি ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৫-এ এখনো বিচারাধীন। প্রায় সাত বছর পার হলেও এখনো রায় হয়নি। জানা যায়, আসামি নজরুল উচ্চ আদালতে ভুয়া তথ্য দিয়ে জামিন নিয়ে পলাতক। তাকে আর গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।
ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৫-এর বিশেষ সরকারি কৌঁসুলি (স্পেশাল পিপি) আলী আসগর স্বপন কালের কণ্ঠকে বলেন, এই মামলার বিচার শেষ পর্যায়ে। কিন্তু বিচারক বদলি হওয়ায় এখনো রায় ঘোষণা হচ্ছে না। নতুন বিচারক নিয়োগ না দেওয়া পর্যন্ত রায়ের জন্য এটি ঝুলে থাকবে। তিনি জানান, তাঁর ট্রাইব্যুনালেই ৩০টির বেশি গণধর্ষণের মামলা বিচারাধীন। ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে মামলাগুলো চলছে। সাক্ষীরা সাক্ষ্য দিচ্ছে না বলে মামলাও নিষ্পত্তি হচ্ছে না। পিপি বলেন, গণধর্ষণের মামলার বিচারে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান থাকলেও দেশে এ অপরাধের জন্য কারো মৃত্যুদণ্ড হয়েছে বলে তিনি কখনো শোনেননি।
গত বছরের ৩১ আগস্ট এক কলেজছাত্রীকে ফুঁসলিয়ে সুনামগঞ্জের লাউড়ের গড়ে নিয়ে যায় মলি্লকপুর গ্রামের ছাত্রলীগ নেতা আনোয়ার হোসেন খোকন। সেখানে নিয়ে ধর্ষণ করার পর এলাকার ছয়জন বখাটের কাছে মেয়েটিকে ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে আসে খোকন। শেষে ওই বখাটেরা মেয়েটিকে পালাক্রমে ধর্ষণ করে তার ভিডিও ক্লিপ স্থানীয় কম্পিউটার দোকানদারদের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়। স্থানীয় লোকজন মুমূর্ষু অবস্থায় মেয়েটিকে উদ্ধার করে প্রথমে আপস-মীমাংসা করে। এলাকার লোকজন ঘটনার পর পুলিশকে খবর দিলেও পুলিশ প্রথমে এড়িয়ে যায়। সাত দিন পর সংবাদপত্রে খবর প্রকাশিত হলে এবং জেলাজুড়ে বিক্ষোভ ও মানববন্ধনের পর তাহিরপুর থানা পুলিশ আট ধর্ষকের বিরুদ্ধে মেয়েটিকে বাদী করে থানায় মামলা নেয়। ধর্ষক আব্দুর রহমান খোকন, সইদুল্লাহ, সাইদুর রহমান, শফিকুল মিয়া, আতাউর রহমান, শামায়ুন আহমদ, মোশাহিদ আহমদ, রুবেল মিয়াসহ আটজনের বিরুদ্ধে মামলা হয়।
তাহিরপুর থানার ওসি আবুল হাশেমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, পুলিশ মামলার পরপরই সাত আসামিকে গ্রেপ্তার করে। সবার বিরুদ্ধে চার্জশিট দেওয়া হলেও প্রধান আসামি খোকনকে এখনো গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি।
গত ২১ নভেম্বর রাতে ছাতকের সিংচাপইড় ইউনিয়নের সৈদেরগাঁও গ্রামের এক নারীকে জোর করে ধরে জঙ্গলে নিয়ে ধর্ষণ করে একই গ্রামের সমুজ মিয়া, সুক মিয়া, আজিজুলসহ পাঁচজন। ভোরে অজ্ঞান অবস্থায় তাঁকে উদ্ধার করে প্রথমে ছাতক হাসপাতাল, পরে সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এ ঘটনায় ধর্ষিতা বাদী হয়ে মামলা করেন। কিন্তু গত ১৬ ডিসেম্বর বাদীকে থানায় ডেকে মামলার এজাহারসহ বিভিন্ন কাগজপত্রে তাঁর স্বাক্ষর নিয়ে ওসি মামলার এজাহার বদল করেছেন বলে ধর্ষিতা অভিযোগ করেন।
ছাতক থানার ওসি মোস্তাফিজুর রহমানের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, মামলার তদন্ত চলছে। এজাহার বদলের বিষয়টি তিনি অস্বীকার করে বলেন, আসামি গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
গত আগস্ট মাসে দিনাজপুরের খানসামা উপজেলার খামারপাড়া ইউনিয়নের এক গৃহবধূকে মুঠোফোনে জিনের বাদশা পরিচয়ে ফুসলিয়ে এক ব্যক্তি কাহারোল উপজেলার বলেয়া বাজারে ডেকে নেয়। সেখান থেকে কৌশলে একটি বাড়িতে নিয়ে আটকে রেখে সাত যুবক তাঁকে ধর্ষণ করে। গৃহবধূ বাদী হয়ে কাহারোল থানায় একটি ধর্ষণ মামলা দায়ের করেন। গণধর্ষণ মামলার আসামি জিনের বাদশা জয়ন্ত রায়কে গ্রেপ্তারও করে পুলিশ। মামলাটি তদন্তাধীন আছে বলে কাহারোল থানার ওসি সুকুমার মহন্ত কালের কণ্ঠকে জানান।
জানা গেছে, জয়ন্তকে গ্রেপ্তার নিয়ে নানা নাটক চলে। তাকে ছেড়ে দেওয়ারও চেষ্টা করা হয়।
বিশিষ্ট ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ অ্যাডভোকেট এ বি এম শরফুদ্দিন খান মুকুল কালের কণ্ঠকে বলেন, রাজনৈতিক ও আঞ্চলিক প্রভাবের কারণে গণধর্ষণের মামলাগুলোর সঠিক তদন্ত হয় না। আবার তদন্ত করে চার্জশিট দেওয়া হলেও এসব প্রভাবের কারণে আদালতে কেউ সাক্ষ্য দেয় না। যে কারণে ধর্ষিতা বা তার পরিবার বিচার পায় না। তিনি আরো বলেন, ভারতে যেভাবে প্রতিবাদে সাধারণ মানুষ অংশ নিচ্ছে, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সেটা সম্ভব হচ্ছে না। এর কারণও কিন্তু রাজনৈতিক। বাংলাদেশের রাজনীতিকরা সব কিছুর মধ্যে রাজনৈতিক ফায়দা নেওয়ার চেষ্টা করেন। সাধারণ মানুষের মধ্যেও সচেতনতা সৃষ্টি হয়নি। এ কারণে ধর্ষিতার পাশে কেউ দাঁড়ায় না।
নারী নেত্রী ও মানবাধিকারকর্মী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেন, ১৯৯৫ সালে দিনাজপুরে ইয়াসমিন গণধর্ষণের শিকার হয়েছিল। কাছাকাছি সময়ে চট্টগ্রামে পুলিশ হেফাজতে ধর্ষিত হয়েছিলেন সীমা। এখনকার মতো তখন এত গণমাধ্যম ছিল না। তখন কিন্তু গোটা নারীসমাজ এসব ঘটনার নিন্দা করেছে। অপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে আন্দোলন করেছে। কিন্তু এখন তা হচ্ছে না। এর মূল কারণ রাজনীতি।
এলিনা খান আরো বলেন, ধর্ষণের ঘটনায় করা মামলার তদন্ত ও বিচারের জন্য আইনে নির্ধারিত সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে; কিন্তু তা মানা হয় না। নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে যদি তদন্ত ও বিচার না করা হয়, তবে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বা বিচারকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার কথা আইনে নেই। যদি থাকত তবে বিচার হতো। আর বিচার সঠিকভাবে হলে গণধর্ষণের ঘটনা কমত। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের মামলাগুলোর বিচারে দীর্ঘসূত্রতা বন্ধ না হলে এ ঘটনা আরো বাড়বে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সালাহউদ্দিন দোলন বলেন, যেদিন দিলি্লতে গণধর্ষণের ঘটনা ঘটে, সে দিন তিনি সেখানে ছিলেন। তিনি বলেন, 'ঘটনা জানাজানির পর দোকানের সেলসম্যান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র-শিক্ষক, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী আর সাধারণ মানুষ কেঁদেছে। মানুষ রাস্তায় নেমেছে। দিলি্লর সবাইকে মনে হয়েছে একটি পরিবার। আমাদের দেশে এমন হয় না। কারণ ধর্ষকরা প্রভাবশালী। রাজনীতি তাদের পাশে থাকে।' তিনি বলেন, বছরে দুই-চারজন ধর্ষকের যদি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হতো, তাহলে এমন ঘটনা ঘটাতে দুর্বৃত্তরা ভয় পেত।
[প্রতিবেদনটির জন্য তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন আমাদের সুনামগঞ্জ ও দিনাজপুর প্রতিনিধি।]
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই ভয়াল অবস্থার অন্যতম কারণ নির্যাতনকারীর শাস্তি না হওয়া। এ দেশে নারী নির্যাতনের বিচারের জন্য কঠোর আইন থাকা সত্ত্বেও শুধু আইনের সঠিক প্রয়োগ, আর অপরাধীর প্রাপ্য শাস্তি না হওয়ার কারণে নির্যাতন কমছে না। বিশেষজ্ঞদের মতে, এর পেছনের কারণ আবার রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন। অপরাধীদের রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে সঠিক বিচার হয় না। এর সঙ্গে রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীদের অসাধুতা। নানা স্বার্থের টানে তারা অপরাধীদের পক্ষ নিয়ে বিচারপ্রার্থীদের হয়রানি করে। এ ছাড়া সাক্ষী ও ক্ষতিগ্রস্তদের নিরাপত্তা রাষ্ট্র নিশ্চিত করতে না পারাও বিচার না হওয়ার আরেকটি কারণ। এসবের পাশাপাশি বিভিন্ন মহলের সচেতনতার অভাব তো রয়েছেই। মহিলা আইনজীবী সমিতির এক জরিপে জানা যায়, এসব কারণে ধর্ষণ মামলার প্রায় ৯০ শতাংশ আসামি খালাস পেয়ে যায়। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধিত ২০০৩)-এর ৯(১) ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো পুরুষ কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে তবে সে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে। একই আইনের ৯(২) ধারায় বলা হয়েছে, ধর্ষণ বা ধর্ষণ-পরবর্তী অন্যবিধ কার্যকলাপের ফলে ধর্ষিতা নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটলে ধর্ষকের মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হবে। একই সঙ্গে জরিমানাও করা যাবে। সর্বনিম্ন জরিমানা হবে এক লাখ টাকা। আইনে দলবদ্ধভাবে ধর্ষণের (গণধর্ষণ) শাস্তি নির্ধারণ করা হয়েছে মৃত্যুদণ্ড। আইনের ৯(৩) ধারায় বলা হয়েছে, যদি একাধিক ব্যক্তি দলবদ্ধভাবে কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে এবং উক্তরূপ ধর্ষণের ফলে যদি কোনো নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটে বা আহত হয় তাহলে ওই দলের প্রত্যেক ব্যক্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হবে। কমপক্ষে এক লাখ টাকা জরিমানার দণ্ডও হবে।
পাশের দেশ ভারতেও এমন কঠোর আইন নেই। সে দেশের দণ্ডবিধির ৩৭৬ ধারার ২(জি) উপধারায় গণধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। সম্প্রতি চলন্ত বাসে গণধর্ষণের শিকার এক মেডিক্যালছাত্রীর মৃত্যুর ঘটনায় সে দেশে তোলপাড় হলে আইন সংশোধনের জোর দাবি উঠেছে। মেয়েটির বাবাসহ আইন বিশেষজ্ঞ, সাধারণ মানুষ, আইন প্রণেতা, এমনকি ক্ষমতাসীন সরকারও এখন ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করার পক্ষে কথা বলছেন। সে দেশের প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি নিয়ে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়েছেন। ১৪৪ ধারা জারি করতে হয়েছে প্রশাসনকে। আর জনসচেতনতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে সে দেশের কোনো আইনজীবী অপরাধীদের পক্ষে না দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন।
অথচ বাংলাদেশে কঠোর আইনও পারছে না অবস্থা বদলাতে। টাঙ্গাইলের স্কুলছাত্রী ১৪ বছরের কিশোরী গণধর্ষণের শিকার হয়ে এখন মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে। পুরুষ মানুষ দেখলেই সে ভয়ে আঁৎকে উঠছে। কয়েক দিন ধরে সে চিকিৎসাধীন। গত ৬ ডিসেম্বর ধর্ষিত হয় মেয়েটি। প্রথমদিকে ঘটনাটি সম্মান রক্ষার দিক বিবেচনা করে জানানো হয়নি কাউকে। যখন জানাজানি হয়, তখনো প্রশাসনের পক্ষ থেকে নীরব থাকা হয়। পরে গণমাধ্যমে সংবাদটি আসার পর প্রশাসন তৎপর হয়। পাঁচ আসামিকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে তাদের। সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহায়তার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আদৌ এ ঘটনার বিচার হবে কি না তা নিয়ে যথারীতি সংশয় প্রকাশ করা হচ্ছে। কারণ বাংলাদেশে গণধর্ষণের দৃষ্টান্তমূলক কোনো শাস্তি হয়েছে কি না তা মনে করতে পারছে না সংশ্লিষ্ট কেউ।
এমন এক গণধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন এক গার্মেন্টকর্মী। ২০০৬ সালের ১৯ অক্টোবর সকাল সাড়ে ১০টার দিকে মিরপুর ১৬ নম্বর রোডের মাথায় একটি ব্যাগের ভেতর থেকে অজ্ঞাতপরিচয় এক মহিলার দুই হাত, দুই পা ও মাথা উদ্ধার করে পুলিশ। মামলার তদন্তে জানা যায়, গার্মেন্ট মালিক নজরুল ইসলাম ও মোস্তফা ওই মহিলা ও তাঁর এক সহকর্মীকে বাসায় নিয়ে ধর্ষণ করে। পরে একজনকে হত্যার পর লাশ টুকরা টুকরা করে রাস্তায় ফেলে দেওয়া হয়। আসামি নজরুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হলেও মোস্তফা পালিয়ে যায়।
মামলাটি ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৫-এ এখনো বিচারাধীন। প্রায় সাত বছর পার হলেও এখনো রায় হয়নি। জানা যায়, আসামি নজরুল উচ্চ আদালতে ভুয়া তথ্য দিয়ে জামিন নিয়ে পলাতক। তাকে আর গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।
ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৫-এর বিশেষ সরকারি কৌঁসুলি (স্পেশাল পিপি) আলী আসগর স্বপন কালের কণ্ঠকে বলেন, এই মামলার বিচার শেষ পর্যায়ে। কিন্তু বিচারক বদলি হওয়ায় এখনো রায় ঘোষণা হচ্ছে না। নতুন বিচারক নিয়োগ না দেওয়া পর্যন্ত রায়ের জন্য এটি ঝুলে থাকবে। তিনি জানান, তাঁর ট্রাইব্যুনালেই ৩০টির বেশি গণধর্ষণের মামলা বিচারাধীন। ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে মামলাগুলো চলছে। সাক্ষীরা সাক্ষ্য দিচ্ছে না বলে মামলাও নিষ্পত্তি হচ্ছে না। পিপি বলেন, গণধর্ষণের মামলার বিচারে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান থাকলেও দেশে এ অপরাধের জন্য কারো মৃত্যুদণ্ড হয়েছে বলে তিনি কখনো শোনেননি।
গত বছরের ৩১ আগস্ট এক কলেজছাত্রীকে ফুঁসলিয়ে সুনামগঞ্জের লাউড়ের গড়ে নিয়ে যায় মলি্লকপুর গ্রামের ছাত্রলীগ নেতা আনোয়ার হোসেন খোকন। সেখানে নিয়ে ধর্ষণ করার পর এলাকার ছয়জন বখাটের কাছে মেয়েটিকে ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে আসে খোকন। শেষে ওই বখাটেরা মেয়েটিকে পালাক্রমে ধর্ষণ করে তার ভিডিও ক্লিপ স্থানীয় কম্পিউটার দোকানদারদের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়। স্থানীয় লোকজন মুমূর্ষু অবস্থায় মেয়েটিকে উদ্ধার করে প্রথমে আপস-মীমাংসা করে। এলাকার লোকজন ঘটনার পর পুলিশকে খবর দিলেও পুলিশ প্রথমে এড়িয়ে যায়। সাত দিন পর সংবাদপত্রে খবর প্রকাশিত হলে এবং জেলাজুড়ে বিক্ষোভ ও মানববন্ধনের পর তাহিরপুর থানা পুলিশ আট ধর্ষকের বিরুদ্ধে মেয়েটিকে বাদী করে থানায় মামলা নেয়। ধর্ষক আব্দুর রহমান খোকন, সইদুল্লাহ, সাইদুর রহমান, শফিকুল মিয়া, আতাউর রহমান, শামায়ুন আহমদ, মোশাহিদ আহমদ, রুবেল মিয়াসহ আটজনের বিরুদ্ধে মামলা হয়।
তাহিরপুর থানার ওসি আবুল হাশেমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, পুলিশ মামলার পরপরই সাত আসামিকে গ্রেপ্তার করে। সবার বিরুদ্ধে চার্জশিট দেওয়া হলেও প্রধান আসামি খোকনকে এখনো গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি।
গত ২১ নভেম্বর রাতে ছাতকের সিংচাপইড় ইউনিয়নের সৈদেরগাঁও গ্রামের এক নারীকে জোর করে ধরে জঙ্গলে নিয়ে ধর্ষণ করে একই গ্রামের সমুজ মিয়া, সুক মিয়া, আজিজুলসহ পাঁচজন। ভোরে অজ্ঞান অবস্থায় তাঁকে উদ্ধার করে প্রথমে ছাতক হাসপাতাল, পরে সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এ ঘটনায় ধর্ষিতা বাদী হয়ে মামলা করেন। কিন্তু গত ১৬ ডিসেম্বর বাদীকে থানায় ডেকে মামলার এজাহারসহ বিভিন্ন কাগজপত্রে তাঁর স্বাক্ষর নিয়ে ওসি মামলার এজাহার বদল করেছেন বলে ধর্ষিতা অভিযোগ করেন।
ছাতক থানার ওসি মোস্তাফিজুর রহমানের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, মামলার তদন্ত চলছে। এজাহার বদলের বিষয়টি তিনি অস্বীকার করে বলেন, আসামি গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
গত আগস্ট মাসে দিনাজপুরের খানসামা উপজেলার খামারপাড়া ইউনিয়নের এক গৃহবধূকে মুঠোফোনে জিনের বাদশা পরিচয়ে ফুসলিয়ে এক ব্যক্তি কাহারোল উপজেলার বলেয়া বাজারে ডেকে নেয়। সেখান থেকে কৌশলে একটি বাড়িতে নিয়ে আটকে রেখে সাত যুবক তাঁকে ধর্ষণ করে। গৃহবধূ বাদী হয়ে কাহারোল থানায় একটি ধর্ষণ মামলা দায়ের করেন। গণধর্ষণ মামলার আসামি জিনের বাদশা জয়ন্ত রায়কে গ্রেপ্তারও করে পুলিশ। মামলাটি তদন্তাধীন আছে বলে কাহারোল থানার ওসি সুকুমার মহন্ত কালের কণ্ঠকে জানান।
জানা গেছে, জয়ন্তকে গ্রেপ্তার নিয়ে নানা নাটক চলে। তাকে ছেড়ে দেওয়ারও চেষ্টা করা হয়।
বিশিষ্ট ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ অ্যাডভোকেট এ বি এম শরফুদ্দিন খান মুকুল কালের কণ্ঠকে বলেন, রাজনৈতিক ও আঞ্চলিক প্রভাবের কারণে গণধর্ষণের মামলাগুলোর সঠিক তদন্ত হয় না। আবার তদন্ত করে চার্জশিট দেওয়া হলেও এসব প্রভাবের কারণে আদালতে কেউ সাক্ষ্য দেয় না। যে কারণে ধর্ষিতা বা তার পরিবার বিচার পায় না। তিনি আরো বলেন, ভারতে যেভাবে প্রতিবাদে সাধারণ মানুষ অংশ নিচ্ছে, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সেটা সম্ভব হচ্ছে না। এর কারণও কিন্তু রাজনৈতিক। বাংলাদেশের রাজনীতিকরা সব কিছুর মধ্যে রাজনৈতিক ফায়দা নেওয়ার চেষ্টা করেন। সাধারণ মানুষের মধ্যেও সচেতনতা সৃষ্টি হয়নি। এ কারণে ধর্ষিতার পাশে কেউ দাঁড়ায় না।
নারী নেত্রী ও মানবাধিকারকর্মী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেন, ১৯৯৫ সালে দিনাজপুরে ইয়াসমিন গণধর্ষণের শিকার হয়েছিল। কাছাকাছি সময়ে চট্টগ্রামে পুলিশ হেফাজতে ধর্ষিত হয়েছিলেন সীমা। এখনকার মতো তখন এত গণমাধ্যম ছিল না। তখন কিন্তু গোটা নারীসমাজ এসব ঘটনার নিন্দা করেছে। অপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে আন্দোলন করেছে। কিন্তু এখন তা হচ্ছে না। এর মূল কারণ রাজনীতি।
এলিনা খান আরো বলেন, ধর্ষণের ঘটনায় করা মামলার তদন্ত ও বিচারের জন্য আইনে নির্ধারিত সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে; কিন্তু তা মানা হয় না। নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে যদি তদন্ত ও বিচার না করা হয়, তবে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বা বিচারকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার কথা আইনে নেই। যদি থাকত তবে বিচার হতো। আর বিচার সঠিকভাবে হলে গণধর্ষণের ঘটনা কমত। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের মামলাগুলোর বিচারে দীর্ঘসূত্রতা বন্ধ না হলে এ ঘটনা আরো বাড়বে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সালাহউদ্দিন দোলন বলেন, যেদিন দিলি্লতে গণধর্ষণের ঘটনা ঘটে, সে দিন তিনি সেখানে ছিলেন। তিনি বলেন, 'ঘটনা জানাজানির পর দোকানের সেলসম্যান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র-শিক্ষক, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী আর সাধারণ মানুষ কেঁদেছে। মানুষ রাস্তায় নেমেছে। দিলি্লর সবাইকে মনে হয়েছে একটি পরিবার। আমাদের দেশে এমন হয় না। কারণ ধর্ষকরা প্রভাবশালী। রাজনীতি তাদের পাশে থাকে।' তিনি বলেন, বছরে দুই-চারজন ধর্ষকের যদি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হতো, তাহলে এমন ঘটনা ঘটাতে দুর্বৃত্তরা ভয় পেত।
[প্রতিবেদনটির জন্য তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন আমাদের সুনামগঞ্জ ও দিনাজপুর প্রতিনিধি।]
No comments