গীতাঞ্জলির নোবেল ॥ ‘পুরানো সেই দিনের কথা...’ by নিয়ামত হোসেন
সেদিন সকালবেলা। রবীন্দ্রনাথ বোলপুরের শান্তি নিকেতনে খুব ভোরে হাঁটতে
গিয়েছিলেন। ফিরে এসে সেখানে একটা নর্দমার অবস্থা দেখছিলেন। নর্দমাটা পাকা
করা দরকার। এইসব ভাবছিলেন। সঙ্গে আরও কয়েকজন।
ঠিক এমন সময় দেখা গেল, বেশ
খানিকটা তাড়াহুড়ো করে মাঠের মাঝখান দিয়ে এগিয়ে আসছেন ক্ষিতিমোহন সেন।
বর্ণনাটি দিয়েছেন প্রমথনাথ বিশী। ক্ষিতিমোহন খানিকটা রাশভারি মানুষ। তাছাড়া
বেশ খানিকটা মোটাসোটা মানুষ। তাঁর মতো মানুষের হন্তদন্ত হয়ে দ্রুত হেঁটে
আসা খুব একটা স্বাভাবিক নয়। তাই তাঁকে ওভাবে আসতে দেখে রবীন্দ্রনাথ এবং
তাঁর সঙ্গীরা বেশ কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে রইলেন ক্ষিতিমোহনের আগমনের দিকে।
ক্ষিতিমোহন রবীন্দ্রনাথকে খুঁজতে খুঁজতে ওই জায়গায় দেখতে পেয়ে দ্রুত আসছেন
তাঁর দিকে। রবীন্দ্রনাথও বুঝতে পেরেছেন ক্ষিতিমোহন ওভাবে আসছেন কেন। তিনি
বেশ মজা অনুভব করছেন তখন মনে মনে। ক্ষিতিমোহন রবীন্দ্রনাথের কাছে পৌঁছেই
জানালেন, খবরটা কি শুনেছেন?রবীন্দ্রনাথ এরই মধ্যে শুনেছেন খবরটা। তিনি মিটিমিটি হেসে মন্তব্য করলেন : ক্ষিতি যখন টলেছে, তখন কিছু একটা যে ঘটেছে তা বুঝতেই পারছি!
খবরটা রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কার পাওয়ার। খবরটা সকালে ক্ষিতিমোহনের কানে যখনই গেছে, তখনই তিনি ছুটেছেন রবীন্দ্রনাথকে জানাতে। খুঁজতে খুঁজতে কোথাও না পেয়ে অবশেষে ওই জায়গায় দেখতে পেয়ে হন্তদন্ত হয়ে প্রায় ছুটেই আসছেন কবিকে জানাতে। কিন্তু কবি আগেই জেনে গেছেন। কলকাতা থেকে খবর পেয়েছেন। কেউ কেউ সেখান থেকে শান্তি নিকেতনের দিকে রওনাও দিয়েছেন। কবি সত্যেন দত্ত খবরটি শোনামাত্র টেলিগ্রামও পাঠিয়েছেন। ক্ষিতিবাবু যখন খবরটি দিলেন ততক্ষণে একটু দেরি হয়ে গেছে। কিন্তু ক্ষিতিমোহন খবরটি তাঁকে জানালে কবি হেসে শুধু মন্তব্য করলেন : ক্ষিতি যখন টলেছে তখন কিছু যে একটা ঘটেছে তা বুঝতেই পারছি। সে সময় রবীন্দ্রনাথ আরও একটি কথা জানালেন। এই নর্দমা অর্থাৎ ড্রেনটি পাকা করার কথা ভাবা হচ্ছিল। এবার তা করার একটা সুরাহা হলো বোধহয়।
প্রমথ বিশীর বর্ণনায় রয়েছে অনেকটা এই রকম : ক্ষিতি বাবু মোটাসোটা মানুষ। গায়ে সাদা চাদর। খোলা মাঠের মাঝখান দিয়ে যখন দ্রুতপদে হেঁটে আসছেন তখন মনে হবে একটি শাদা পালতোলা নৌকা যেন এগিয়ে আসছে। তাঁর দ্রুত হাঁটা দেখে রবীন্দ্রনাথ ওই মজার মন্তব্য করেছিলেন। ক্ষিতি যখন টলে তখন ভূমিকম্প হয়। কিন্তু ক্ষিতি তো সচরাচর টলে না।
তারপর ধীরে ধীরে সে খবর ছড়িয়ে গেল সবখানে। তখন এত টেলিফোন মোবাইল ফেসবুক কম্পিউটার ইত্যাদি ছিল কল্পনাতীত ব্যাপার। তাই খানিকটা সময় লেগেছে তৎকালীন সারা বঙ্গভারত এবং বিশ্বে খবরটি পৌঁছতে।
ওদিকে কলকাতায় লেখক কবি সাংবাদিক বুদ্ধিজীবী তথা সুধীজনের সিদ্ধান্ত, তাঁরা শান্তিনিকেতনে যাবেন। সেখানে সংবর্ধনা হবে। ইংরেজ সরকার বোলপুর স্টেশন পর্যন্ত বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা করল। ফ্রি ট্রেন। কামরা ভরে ভরে কলকাতা থেকে লোক ছুটল বোলপুরের দিকে। শান্তি নিকেতনে কবিকে সংবর্ধনা দেয়া হলো। সভায় অনেকে অনেক কথা বললেন। প্রতি-উত্তরে রবীন্দ্রনাথ যে ভাষণ দিলেন তাতে ছিল কিছুটা অনুযোগের সুর। খানিকটা অভিমান। তাঁর অভিমান ছিল এই কারণে যে, এতদিন তিনি যে সাহিত্য চর্চা করছেন তার জন্য অনেক সমালোচনা শুনতে হয়েছে তাঁকে। অনেক কটূক্তি নিন্দা সইতে হয় তাঁকে। ঠিক যেন ফুল না দিয়ে তার বদলে কাঁটার খোঁচা দেয়ার মতো। এখন যেহেতু বিদেশীরা তাঁকে সম্মানিত করেছে, তাই স্বদেশবাসীর কাছে এলো এই সম্মান।
রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। পেয়েছেন তার বিপুল অঙ্কের টাকাও। সেই টাকা তিনি লাগিয়েছিলেন একটি চমৎকার কাজে। এখনকার নওগাঁর পতিসরে কৃষকদের ঋণ দেবার জন্য তিনি একটি কৃষিব্যাংক স্থাপন করেছিলেন। কৃষকের ঋণ দেবার জন্য নোবেলের টাকা সেই ব্যাংকে দিয়েছিলেন।
এশিয়াতে অনেক দেশ। অনেক জাতি। অনেক ভাষা। এই গোটা এশিয়ায় প্রথম নোবেল পেলেন রবীন্দ্রনাথ তাঁর গীতাঞ্জলির জন্য। বাঙালী কবির বাংলাভাষার বইয়ের জন্য নোবেল পুরস্কার পাওয়ার অর্থ বাংলাভাষার জন্য এবং বাংলাভাষী সবার জন্য সম্মানের বিষয়। গীতাঞ্জলি নোবেল পেলে রবীন্দ্রনাথের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে দুনিয়াব্যাপী, রবীন্দ্রনাথের লেখা পড়ার জন্য অনেকে তাঁর অনুবাদ হওয়া বই পড়া শুরু করেন। বহু বিদেশী রবীন্দ্রনাথের ভাষায় তাঁর মূল লেখা পড়ার জন্য বাংলাভাষা শিখতে শুরু করেন। নানা দেশে শুরু হয় রবীন্দ্রচর্চা। এখনও সে ধারা অব্যাহত রয়েছে।
ক্ষিতিমোহন সেন ঢাকার বিক্রমপুরের মানুষ। তিনি ছিলেন শান্তিনিকেতনের একজন অধ্যাপক। তাঁর কন্যাও থাকতেন শান্তিনিকেতনে। সেই কন্যার ঘরে ছেলে হলে রবীন্দ্রনাথকে একটি নাম দেয়ার অনুরোধ জানালে তিনি নাম দেন অমর্ত্য। সেই অর্মত্য সেন আজ নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ হিসেবে দুনিয়াজোড়া খ্যাতির অধিকারী।
১৯১৩ সালে বরীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলি পেয়েছিল নোবেল পুরস্কার। দিনটি ছিল ১৯ জানুয়ারি। গীতাঞ্জলির নোবেলের ১০০ বছর পূরণ হলো গত পরশু।
বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। এ ভাষার মর্যাদা তথা সম্মান রক্ষার জন্য এদেশের মানুষ জীবন দিয়েছে। গীতাঞ্জলির নোবেল পাওয়ায় আমাদের মাতৃভাষারই সম্মান বেড়েছে। তাই গীতাঞ্জলির নোবেল পাওয়ার শতবর্ষে আমরা গর্ববোধ করছি আমাদের মাতৃভাষার জন্য। শ্রদ্ধা জানাচ্ছি গীতাঞ্জলির কবির স্মৃতির উদ্দেশে।
গীতাঞ্জলির কোন কোন কবিতা বা কিছু গান আমাদের নবীন প্রজন্মের অনেকেই শুনেছে, কিন্তু তাদের অনেকেই বইটি হাতে পায়নি। নোবেল পাওয়ার এক শ’ বছর উপলক্ষে সস্তায় বা ভর্তুকি দিয়ে বইটি কি সরকারের কোন মন্ত্রণালয় বা সংস্থার উদ্যোগে প্রকাশ করা যায় না? তাহলে আমাদের হাজার হাজার ছেলেমেয়ে ছাত্রছাত্রী বইটি সহজে, সস্তায় পেতে পারত। বাংলা একাডেমীও বিষয়টি ভাবতে পারে। সামনে বইমেলা। গীতাঞ্জলির ব্যাপারে সেখানে বা অন্যত্র অন্যভাবে কিছু করা যায় না?
No comments