ওঁরা স্বপ্ন দেখলেন, স্বপ্ন দেখালেন, হারালেন স্মৃতি রোমন্থনে ঢাবি ক্যাম্পাসে প্রাক্তনদেও মহামিলন

বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার কনকনে শীতের সকাল। এরই মধ্যে সকল ব্যসত্মতা ভুলে, বয়সের ভার কাটিয়ে প্রাণচঞ্চল হয়ে ওঠেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা একদল শিৰার্থী। কেউ কেউ ক্যাম্পাস ছেড়েছেন ৬০ বছর আগে, কেউবা তারও আগে।
এত বছর পর যেন আবার হারিয়ে গেলেন জীবনের সোনালী সময় বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে। পুরনো দিনের স্মৃতি রোমন্থন, কর্মৰেত্রের চ্যালেঞ্জ, অনাগত দিনের প্রজন্মের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়কে আরেকটু সমৃদ্ধ করে যাওয়ার প্রত্যাশা, কামনা বাসনায় উদ্বেলিত তাঁরা। সবাই স্ব স্ব ৰেত্রে প্রতিষ্ঠিত। স্বনামধন্য। আলোকিত জীবন থেকে এক ঝলক তির্যক কিরণ রশ্মিতে রাঙিয়ে গেলেন বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গন। স্বপ্ন দেখলেন, স্বপ্ন দেখালেন। হারিয়ে গেলেন ফেলে আসা সেই সব দিনগুলোতে। স্বপ্ন পূরণের, স্বপ্ন ভাঙ্গার ৰণগুলোতে। দূরনত্মপনার মাহেন্দ্রৰণে। হৃদস্পন্দনের সঙ্গে গভীর সম্পর্কের অদৃশ্য এ বন্ধন চির জাগরূক।
সে অদৃশ্য বন্ধনের টানেই ইট পাথরের যান্ত্রিক এই নগরের সব ব্যসত্মতা ভুলে একদিনের জন্য আবারও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রজীবনে ফিরে গিয়েছিলেন 'প্রাচ্যের অক্সফোর্ড' ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিৰার্থীরা। শনিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিৰার্থীদের সংগঠন ঢাকা ইউনিভার্সিটি এ্যালামনাই এ্যাসোসিয়েশনের মহামিলন উৎসবে যেন ধ্বনিত হয়েছে নব প্রাণের আহ্বান। দিনভর নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে শনিবার পালিত হলো এ মহামিলন উৎসব।
সকাল সাড়ে নয়টায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও এ্যাসোসিয়েশনের দলীয় পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে শুরু হয় মহামিলনের আনুষ্ঠানিকতা। এ্যালামনাই এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সৈয়দ মঞ্জুরে এলাহী জাতীয় পতাকা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক আআমস আরেফিন সিদ্দিক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পতাকা ও অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি মিছবাহুল বাহার চৌধুরী এ্যালামনাই এ্যাসোসিয়েশনের পতাকা উত্তোলন করেন। সেই সঙ্গে বেজে ওঠে জাতীয় সঙ্গীত।
সংগঠনের ঐতিহ্য অনুুযায়ী এবারের মহামিলনে উপস্থিত জ্যেষ্ঠতম সদস্য ১৯৪০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ ডিগ্রী অর্জনকারী মিছবাহুল বাহার চৌধুরীকে প্রধান অতিথি করা হয়। উদ্বোধনী পর্বে তিনি বলেন, আমাদের সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই ধরনের শিা ছিল। একটি পরিবেশ থেকে শিা। আর অন্যটি একাডেমিক শিা। এই দুইটি মিলেই শিার্থীরা প্রকৃত মানুষ হওয়ার দিকে এগিয়ে যেত। আজ দুইটি েেত্রই সঙ্কট চলছে। তিনি তাঁর সময়ের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, হলগুলোর পরিবেশ থেকে প্রাপ্ত শিার কারণে শিার্থীদের মন থেকে জড়তা ও সঙ্কীর্ণতা দূর হয়ে যেত। ছাত্রদের মতের পার্থক্য ছিল। কিন্তু তারপরও ২ বছরের হল জীবনের কোন দিনই মারামারি হতে দেখিনি। এ সময়ে এসে পেছনে ফিরে তাকালে দীর্ঘশ্বাস চলে আসে। মনে হয় সে সময় যেন মর্ত্যে থেকেও কিছু কালের জন্য স্বর্গে ছিলাম। তিনি বলেন, পুরনো সেই মূল্যবোধগুলো ফিরে এলে বর্তমান সমাজের বিদ্যমান সমস্যাগুলোর অধিকাংশই সমাধান হয়ে যেত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আআমস আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শুধু একটি বিশ্ববিদ্যালয়ই নয় এটি বাংলাদেশের ইতিহাসের জীবনত্ম কিংবদনত্মি। দেশ যখনই কোন সমস্যায় পড়েছে তখনই এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক শিার্থীরা এগিয়ে এসেছে। সর্বশেষ ১/১১ পরবর্তী দিনগুলোতে গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন সংগ্রামে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক-শিার্থী অতুলনীয় ত্যাগ স্বীকার করেছে। ইতিহাসের পথ পরিক্রমায় এ বিশ্ববিদ্যালয় ভবিষ্যতেও তার গৌরবোজ্জ্বল পথে এগিয়ে যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এ্যালামনাই এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো এবং শিার মান উন্নয়নে এ্যালামনাই এ্যাসোসিয়েশন ও প্রাক্তন শিৰার্থীদের ভূমিকা রাখা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান সঙ্কট নিরসনে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পরপরই শুরম্ন হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে রচিত গান ও স্মৃতিচারণ। চলে দুপুরের খাবারের পূর্ব পর্যনত্ম। দিনব্যাপী আয়োজনের মধ্যে ছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, র্যাফেল ড্র প্রভৃতি।
আনুষ্ঠানিক এসব আয়োজনের বাইরে ছিল বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের চিরচেনা আড্ডা। প্যান্ডেলজুড়ে দশক অনুযায়ী সাজানো ছিল টেবিল। দীর্ঘদিন পর পুরনো সব বন্ধুবান্ধব, বড় ভাইবোন, ছোট ভাইবোন, একসঙ্গে হয়ে যেন আবার তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। সেই ছাত্রজীবনের খুনসুঁটি। একে অন্যকে রাগানোর চেষ্টা। কে কী করত, কাকে কি বলে ৰেপানো হতো, এসব নিয়ে আলোচনা। আর সব শেষে দীর্ঘশ্বাস_ ইশ্্ যদি আজীবন ছাত্র থাকা যেত।
অনুষ্ঠানের সবচেয়ে বয়স্ক নারী এ্যালামনাই ছিলেন বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের অধিবাসী ইংরেজী বিভাগের ১৯৪২-৪৬ শিৰাবর্ষের ছাত্রী ড. আফিয়া দিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের টানে এসেছিলেন সুদূর আমেরিকা থেকে। ওই সময় ড. আফিয়াসহ মাত্র তিন ছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেন। অন্যদের মধ্যে একজন অর্থনীতি বিভাগের অপরজন আরবি বিভাগের ছাত্রী ছিলেন। ড. আফিয়া দিলকে মঞ্চে পরিচয় করে দেয়ার পরপরই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন তিনি। বলেন, আমি দীর্ঘকাল ধরে প্রবাসী। কিন্তু আমার মনপ্রাণ পড়ে আছে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক, সহপাঠী ও দেশের মানুষের মাঝে। আমাদের সময়ের আজকের দিনের বিরাট পার্থক্য রয়েছে আমরা শিকের সঙ্গে কাসে আসতাম। আবার কাস শেষ হলে চলে যেতাম। কাসের বাইরে কারও সঙ্গে কথা বলার সুযোগ ছিল না।
বিচারপতি, আইনজীবী, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, শিক, শিল্পপতি, ব্যাংকার, নাট্যকার, শিল্পী, ব্যবসায়ীসহ সব ৰেত্রের বিশিষ্টজনদের মিলনমেলায় পরিণত হয়েছিল এ মহামিলন উৎসব। বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রধান উপদেষ্টা ও প্রধান বিচারপতি হাবিবুর রহমান, বিচারপতি মোসত্মফা কামাল চৌধুরী, বাণিজ্যমন্ত্রী কর্নেল (অব) ফারুক খান এমপি, বিরোধী দলীয় চীফ হুইফ জয়নাল আবদীন ফারুক, নেত্রী সেলিমা রহমান, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন এমপি, মাইনউদ্দিন খান বাদল এমপি, ডাকসুর সাবেক ভিপি আসম আব্দুর রব, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্যদের মধ্যে অধ্যাপক মনিরুজ্জামান মিঞা, অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ, অধ্যাপক একে আজাদ চৌধুরী, অধ্যাপক এসএমএ ফায়েজ, বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান, ফজলুল হক মিলন, আমানউলস্নাহ আমান, খায়রুল কবির খোকন, ইলিয়াস আলী, , ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক খন্দকার বজলুল হক, সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক এবিএম ওবায়দুল হক, ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটির ভিসি অধ্যাপক আব্দুল মান্নান চৌধুরী, সাংবাদিক শফিক রেহমান, দৈনিক মানবজমিন পত্রিকার সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী, এনসিটিবির চেয়ারম্যান মোসত্মফা কামাল উদ্দিন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

No comments

Powered by Blogger.