সাক্ষাৎকার-ওবামা তেমন পরিবর্তন আনতে পারবেন না by নোয়াম চমস্কি
স্টিভেন ডুরেল :সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট পেয়ে বেশিদিন হয়নি প্রেসিডেন্ট ওবামা পুনর্নির্বাচিত হয়েছেন। প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার প্রথম মেয়াদকালকে আপনি কীভাবে দেখেন?
নোয়াম চমস্কি : খোলাখুলিভাবে বলতে গেলে আমি তার কাছ থেকে বেশি কিছু প্রত্যাশা করিনি। আমি তাকে খুব বেশি যে পছন্দ করি তা নয় এবং তার প্রেসিডেন্সিতে বিরাট কোনো পরিবর্তন সাধিত হবে, তা-ও আমি মনে করি না। বস্তুত ২০০৮ সালের প্রাইমারির আগে ওবামার ওয়েবসাইটে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত, বক্তব্যের ভিত্তিতে আমার লেখায় তার সম্পর্কে চাঁচাছোলা মন্তব্য করেছিলাম। তাই তার প্রথম মেয়াদের প্রেসিডেন্সিতে কিছু বিষয় বাদ দিলে আমার বিস্মিত হওয়ার মতো কিছু ঘটেছে বলে মনে করি না।
নাগরিক স্বাধীনতার ওপর তার আক্রমণ শানানোর বিষয়টি আমার ধারণার অতীত ছিল। রাজনৈতিক বা অন্য কোনোভাবে এর দ্বারা তিনি উপকৃত হয়েছেন বা সুবিধা পেয়েছেন বলে আমি মনে করি না।
তার জামানায় বিশ্বব্যাপী হত্যা অভিযান বিস্তৃত হবে, এমনটাও আমার মাথায় আসেনি। এর পদ্ধতি সম্পর্কেও আমি অজ্ঞ ছিলাম।
তার প্রথম মেয়াদকালে অবশ্য অর্ধ-ইতিবাচক কিছু বিষয় লক্ষ্য করা গেছে। বর্তমান অবস্থার চেয়ে স্বাস্থ্যসেবা সংস্কারটা একটা অগ্রগতি বলতে হবে। তবে এ ক্ষেত্রে আরও অনেক উন্নতি করার ছিল বলে আমি মনে করি। আরও কিছু ক্ষেত্রে অগ্রগতি রয়েছে। তবে সেগুলো তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। দ্বিতীয় মেয়াদেও তার কাছ থেকে বেশি কিছু প্রত্যাশা নেই।
ডুরেল : আপনি বলেছেন যে বিভিন্ন প্রশাসন প্রায় একই নীতি বা লক্ষ্যে কাজ করেছে। আপনার দৃষ্টিতে এমন কোনো প্রশাসন কি রয়েছে যাকে অন্যদের চেয়ে ভালো বলা যাবে?
চমস্কি : আমি মনে করি, ম্যাককেইন বা রমনির চেয়ে ওবামা ভালো। গত দুটি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আমি যদি কোনো স্যুয়িং রাজ্যে থাকতাম তবে আমি অস্বস্তি নিয়েও ওবামার পক্ষেই ভোট দিতাম। বছরের পর বছর ধরে কিছু ভালো গবেষণা হয়েছে প্রেসিডেন্সি নিয়ে। সেখানে দেখা গেছে, ডেমোক্র্যাট প্রশাসন রিপাবলিকান প্রশাসনের চেয়ে জনগণের জন্য বেশি উপকারী। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ল্যারি বারটিলস এ ব্যাপারে গভীর গবেষণা করেছেন। তাই নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, এ দুয়ের মধ্যে পার্থক্য তো রয়েছেই।
ডুরেল :এ দেশে কে সবচেয়ে ভালো প্রেসিডেন্ট ছিলেন তা কীভাবে বলা যায়?
চমস্কি :অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীর সঙ্গে এখনকার অবস্থা তুলনা করা কঠিন। তবে বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত বলা যায়, সম্ভবত রুজভেল্ট সবচেয়ে ভালো প্রেসিডেন্ট ছিলেন।
ডুরেল : ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট।
চমস্কি : হ্যাঁ, ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট, থিওডর নয়।
ডুরেল :কাকে সবচেয়ে খারাপ বলবেন?
চমস্কি : তাদের মধ্যে অনেকেই বাজে কিছু কাজ করেছেন। তবে ভোটাভুটি হলে আমার মনে হয় ওয়াকার বুশই নষ্টের শিরোমণি বিবেচিত হবেন।
ডুরেল :আপনি স্যুয়িং স্টেটের কথা উল্লেখ করেছিলেন। এ বছরের শুরুর দিকে আপনি গ্রিনপার্টি প্রার্থী জিল স্টেনকে সমর্থন করেছিলেন।
চমস্কি : প্রাইমারিতে এবং শেষাবধি আমি মনে করেছি যে, নিরাপদ রাজ্যে তার পক্ষে ভোট দেওয়াই ভালো এবং আমি তাই করেছি।
ডুরেল : যতদূর মনে পড়ে ২০০৪ সালে আপনি স্যুয়িং রাজ্যগুলোতে র্যালফ নাদেরের পক্ষে ভোট না দেওয়ার জন্য ভোটারদের উৎসাহিত করেছিলেন।
চমস্কি : আমি এবারও তাই করেছি। তবে এবার প্রার্থী ছিলেন স্টেইন, নাদের নয়।
ডুরেল : র্যালফ নাদের সম্পর্কে আপনি কী ভাবেন? তিনি আদৌ রাজনৈতিক সংলাপকে উৎসাহিত করেছেন বলে কি আপনি মনে করেন?
চমস্কি : তিনি খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন বলে আমি মনে করি এবং এখনও জনস্বার্থ সম্পর্কিত বিষয়ে তিনি কাজ করে চলেছেন। সারা জীবন ধরে তিনি একইভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।
রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কিছু ভালো দিক রয়েছে। যেসব বিষয় আলোচনায়ই আসত না তিনি সেসব ইস্যুকে আলোচনায় এনেছেন। তবে তিনি কাজটা সঠিক পদ্ধতিতে করেছেন বলে আমার মনে হয় না। যেমন আমি মনে করি, প্রাইমারিতে অংশ না নেওয়া ভুল। এটা এমন একটা জায়গা যেখানে আপনি কিছুটা কভারেজ পেতে পারেন। ডেনিস কুচিনিচ এভাবেই কভারেজ পেয়েছেন। এ ধরনের বিষয় নাদের এখানে তুলতে পারতেন।
এটা জানা কথা যে, প্রেসিডেন্সিয়াল প্রচারণায় তো আপনি তেমন কোনো কভারেজ পাবেনই না। সে সময় তো নির্বাচন সংক্রান্ত বিষয়ই প্রাধান্য পায় শতভাগ। প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীদের ওপরই মিডিয়ার দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকে।
নাদের ও তার অনেক সমর্থক যুক্তি দেখিয়েছেন যে, তাদের প্রচারণায় ডেমোক্রেটিক প্রার্থী খাটো হবেন না। আমি তাদের এই যুক্তি মেনে নিতে পারিনি। আমি মনে করেছি, এটা ডেমোক্রেটিক প্রার্থীর ক্ষতি করবে আর হয়েছেও তাই।
আমি জিল স্টেনের অবস্থাটাও বুঝি। তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবেন এই প্রত্যাশা নিয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে আসেননি। তার লক্ষ্য হচ্ছে দল গড়ে তোলা। তিনি একটা পার্টি গড়ে তুলেছেন।
কিন্তু এভাবে একজন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করার মধ্যে কোনো সার্থকতা রয়েছে কি? ধরা যাক আশ্চর্যজনকভাবে নাদের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে গেলেন। অথচ তার কোনো একজন নির্বাচিত কংগ্রেস সদস্য নেই, একজন নির্বাচিত গভর্নর নেই, প্রাতিষ্ঠানিক সমর্থন নেই, রাজ্যগুলোর আইনসভাতেও কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই, স্থানীয় শহর কাউন্সিলেও কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই। তারপরও নির্বাচিত হয়ে গেলে তিনি তো সম্পূর্ণ অক্ষম হয়ে পড়বেন।
ডুরেল :এবার প্রাইমারি আলোচনাতেই ফিরে যাওয়া যাক। দুই পার্টি পরিসরে অন্য পার্টি সম্পর্কে আলোচনা করা যাক। রিপাবলিকান পার্টির মধ্যে আলোচনায় রন পলের কোনো ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে বলে কি আপনি মনে করেন?
চমস্কি : রিপাবলিকান পার্টির পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। তাদের দুরবস্থাটা বর্ণনার অতীত। আসলে গত ২০ কি ৩০ বছর ধরে রিপাবলিকান পার্টি একটি পার্টি হিসেবে নিজেদের অবস্থান টিকিয়ে রাখার কোনো চেষ্টাই করেনি। তারা এখন আর কোনো জায়গার মতো সংসদীয় দলই নয়। করপোরেট সেক্টরে তারা সম্পূর্ণরূপে বড় বড় ধনীদের সেবাদাসে পরিণত হয়েছে। তাদের একই কথা, একই দাবি নিয়ে অনর্গল বকবক করে চলেছে। কালেভদ্রে অলিম্পিয়া স্নোয়ির মতো নেতার স্তরে কিছু ভালো কথা শোনা যায়, এ পর্যন্তই। এর ফলে তারা সম্ভাব্য ভোট বেস খোয়াচ্ছে। তাই তাদের ভবিষ্যতে নির্বাচন করতে হলে ভোট বেস সম্প্রসারণের দিকে নজর দিতে হবে। জনগণের বিভিন্ন গোষ্ঠী ও স্তর, গোত্র, বর্ণকে একসূত্রে গাঁথার বিদ্যা আয়ত্ত করতে হবে।
এটা অত্যন্ত আতঙ্কগ্রস্ত দেশ। গোটা ইতিহাসজুড়েই এ অবস্থা রয়েছে। অনেক মানুষ এখানে ভয়ের মধ্যে বসবাস করে। সম্ভবত এ কারণেই এখানে বন্দুক রাখার সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে আত্মরক্ষার বিষয়টি বিবেচনা করেই।
ডুরেল : আপনি অতীতে সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্পর্কে সমালোচনামুখর ছিলেন। তখন ওই দেশটি আপনার দৃষ্টিতে একদলীয় একনায়কত্ববাদী ও 'রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদী' ছিল। অন্য কমিউনিস্ট দেশ_ চীন, উত্তর কোরিয়া, কিউবা, ভিয়েতনাম সম্পর্কেও কি আপনি একই মনোভাব পোষণ করেন?
চমস্কি : এদেরও সমালোচনা রয়েছে। তবে এরা একটি থেকে অপরটি ভিন্ন প্রকৃতির। আমি তাদের কোনো গ্রেড দিচ্ছি না, তবে এরা কিছু ভালো কাজ করেছে যেটাকে অনুমোদন করা যায়।
মাওবাদী চীনের কথা উল্লেখ করা যায়। আপনি যদি দেশটির দিকে লক্ষ্য করেন তাহলে দেখবেন তারা গণতান্ত্রিক ভারতের তুলনায় অন্তত ১০ কোটি মানুষের জীবন রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছে। কেবল তাদের গ্রামীণ স্বাস্থ্য বীমার কারণেই এটা সম্ভব হয়েছে। ১০ কোটি সংখ্যাটা নিছক জোক নয়।
ডুরেল : কোন জাতি-রাষ্ট্র আপনার ধারণা অনুযায়ী 'উদারবাদী সমাজতান্ত্রিক' পথে চলছে?
চমস্কি : উদারবাদী সমাজতন্ত্রে সব ধরনের ডাইমেনশন রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রসঙ্গ উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরা যায়। ক্লিভল্যান্ডের আশপাশে একটি প্রকল্প রয়েছে, যেটাকে মডেল বলা যায়। আলপেরোভিজ এর ওপর কাজ করছেন। উদারবাদী সমাজতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণের উপাদান বিকাশের কাজ সেখানে চলছে। বেশ কিছু কর্মী-মালিকানাভিত্তিক এন্টারপ্রাইজ ও সমবায় সেখানে রয়েছে।
তবে এটাও লক্ষ্য রাখতে হবে, যুক্তরাষ্ট্র একটি তথাকথিত পুঁজিবাদী দেশ। বিশ্বের দিকে তাকালে আমরা কমবেশি সুন্দর সমাজ দেখতে পাব। অনেক দিক থেকেই নরওয়ে চমৎকার একটি দেশ। এমনকি সাংস্কৃতিকভাবেও এটা বলা যায়।
নির্বিচার হত্যার জন্য দায়ী ব্রেইভিক বিচারের প্রসঙ্গ এ ক্ষেত্রে উল্লেখ করা যায়। এই লোকটি ৮০ ব্যক্তিকে নির্বিচারে হত্যা করার পরও তার বিচার কেমন মানবিকভাবে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এতে বোঝা যায় তারা কতটা সুসভ্য।
ডুরেল : আপনি কি মনে করেন, মার্কিন ব্যতিক্রম্যতার পেছনে কোনো সত্য নিহিত রয়েছে? দেশটির ভাবাদর্শ বা অন্য কোনো বৈশিষ্ট্য কি রয়েছে, যে কারণে যুক্তরাষ্ট্রকে বাদবাকি বিশ্ব থেকে আলাদা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত বলে বিবেচনা করা যায়?
চমস্কি : ভাবাদর্শের কথা বললে অবশ্যই অষ্টাদশ শতাব্দীতে সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের সবচেয়ে মুক্ত দেশরূপে পরিগণিত ছিল। এ ব্যাপারে অবশ্য তেমন বলা হয় না। দাস, ভূমিপুত্র, নারীদের কথা বিবেচনা করলে অষ্টাদশ শতাব্দীর মানে তারা তখন যথেষ্ট স্বাধীন ছিল।
বেশ কিছু আদর্শ গড়ে উঠেছে। স্বাধীনতার অনেক দিক রয়েছে। যেমন, কথা বলার স্বাধীনতা, যেটা আমি মনে করি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আসলে নাগরিক অধিকার আন্দোলন থেকেই যুক্তরাষ্ট্র এ ক্ষেত্রে বিশ্বকে নেতৃত্ব দিচ্ছে। এরপর অনেক কিছুই পাল্টেছে। ষাটের দিকে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে কথা বলার স্বাধীনতাকে যেভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে, এটা ভালো দিক।
আমাদের বাকস্বাধীনতা, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা রয়েছে। এখানে বিভিন্ন ইস্যুতে সংবাদমাধ্যমে অ্যাড্রেস করা হয়, যেটা একদলীয় ব্যবস্থাধীনে দেখা যায় না। আবার ভিন্ন ধরনও দেখা যায়। প্রেসিডেন্সিয়াল বিতর্কে ইরান হুমকির বিষয়টি ঘুরেফিরে এসেছে। আবার এটা প্রেসেও বারবার উল্লেখ করা হয়েছে। আসলে ইরানকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের এক ধরনের আচ্ছন্নতার কারণেই এমনটা হয়েছে। আরবের একনায়কত্ববাদী শাসকরা হয়তো এ ধরনের মনোভাবের সঙ্গে সহমত পোষণ করবেন। তবে এসব দেশের জনগণ অবশ্যই একে সমর্থন করবেন না। আর জোটনিরপেক্ষ দেশগুলো তো নয়ই। এ ব্যাপারে ইউরোপীয়দের মতামতও হবে মিশ্র।
হুমকি মোকাবেলার উপায় কী? এর অত্যন্ত সহজ উপায় রয়েছে। তারা এই অঞ্চলে পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত এলাকা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে পর্যবেক্ষণ শর্ত থাকবে। এ ব্যবস্থা অবশ্যই নিরাপত্তা হুমকি হ্রাস করবে।
সম্ভবত অনেক বছর ধরেই সারাবিশ্ব এটাই চেয়ে আসছে। যুক্তরাষ্ট্র এসব প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করেছে। আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই হেলসিঙ্কিতে এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সম্মেলন বসবে। যাকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় হুমকি বলে বিবেচনা করা হচ্ছে সেটা কীভাবে মোকাবেলা করা যাবে তা নিয়ে ওখানে আলোচনা হবে।
প্রেসের প্রসঙ্গে ফিরে আসা যাক। আমার কিছু বন্ধু মিলে ডাটাবেস তৈরি করছে এ ব্যাপারে। একদলীয় দেশ হলে এটা সম্ভব হতো না। অথচ এটা করার ওপর সরকারের কোনো চাপ নেই এখানে। একনায়ত্ববাদী দেশে সরকার না চাইলে কিছু করা যায় না।
ডুরেল : আপনি কি মনে করেন বিশ্ব অর্থনীতি ভেঙে পড়ছে?
চমস্কি : আর্থিক বিপর্যয় ঘটতে পারে। তবে এটা মারাত্মক কোনো সংকট সৃষ্টি করবে না।
ডুরেল :আপনার ভাবনায় মারাত্মক সংকটটা কী?
চমস্কি : পরিবেশ সংকট মারাত্মক আকার নিতে পারে। দ্বিতীয়ত মারাত্মক বিপর্যয় সৃষ্টিকারী হতে পারে পারমাণবিক যুদ্ধ, যাকে মোটেই খাটো করে দেখা
যায় না।
নাগরিক স্বাধীনতার ওপর তার আক্রমণ শানানোর বিষয়টি আমার ধারণার অতীত ছিল। রাজনৈতিক বা অন্য কোনোভাবে এর দ্বারা তিনি উপকৃত হয়েছেন বা সুবিধা পেয়েছেন বলে আমি মনে করি না।
তার জামানায় বিশ্বব্যাপী হত্যা অভিযান বিস্তৃত হবে, এমনটাও আমার মাথায় আসেনি। এর পদ্ধতি সম্পর্কেও আমি অজ্ঞ ছিলাম।
তার প্রথম মেয়াদকালে অবশ্য অর্ধ-ইতিবাচক কিছু বিষয় লক্ষ্য করা গেছে। বর্তমান অবস্থার চেয়ে স্বাস্থ্যসেবা সংস্কারটা একটা অগ্রগতি বলতে হবে। তবে এ ক্ষেত্রে আরও অনেক উন্নতি করার ছিল বলে আমি মনে করি। আরও কিছু ক্ষেত্রে অগ্রগতি রয়েছে। তবে সেগুলো তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। দ্বিতীয় মেয়াদেও তার কাছ থেকে বেশি কিছু প্রত্যাশা নেই।
ডুরেল : আপনি বলেছেন যে বিভিন্ন প্রশাসন প্রায় একই নীতি বা লক্ষ্যে কাজ করেছে। আপনার দৃষ্টিতে এমন কোনো প্রশাসন কি রয়েছে যাকে অন্যদের চেয়ে ভালো বলা যাবে?
চমস্কি : আমি মনে করি, ম্যাককেইন বা রমনির চেয়ে ওবামা ভালো। গত দুটি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আমি যদি কোনো স্যুয়িং রাজ্যে থাকতাম তবে আমি অস্বস্তি নিয়েও ওবামার পক্ষেই ভোট দিতাম। বছরের পর বছর ধরে কিছু ভালো গবেষণা হয়েছে প্রেসিডেন্সি নিয়ে। সেখানে দেখা গেছে, ডেমোক্র্যাট প্রশাসন রিপাবলিকান প্রশাসনের চেয়ে জনগণের জন্য বেশি উপকারী। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ল্যারি বারটিলস এ ব্যাপারে গভীর গবেষণা করেছেন। তাই নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, এ দুয়ের মধ্যে পার্থক্য তো রয়েছেই।
ডুরেল :এ দেশে কে সবচেয়ে ভালো প্রেসিডেন্ট ছিলেন তা কীভাবে বলা যায়?
চমস্কি :অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীর সঙ্গে এখনকার অবস্থা তুলনা করা কঠিন। তবে বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত বলা যায়, সম্ভবত রুজভেল্ট সবচেয়ে ভালো প্রেসিডেন্ট ছিলেন।
ডুরেল : ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট।
চমস্কি : হ্যাঁ, ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট, থিওডর নয়।
ডুরেল :কাকে সবচেয়ে খারাপ বলবেন?
চমস্কি : তাদের মধ্যে অনেকেই বাজে কিছু কাজ করেছেন। তবে ভোটাভুটি হলে আমার মনে হয় ওয়াকার বুশই নষ্টের শিরোমণি বিবেচিত হবেন।
ডুরেল :আপনি স্যুয়িং স্টেটের কথা উল্লেখ করেছিলেন। এ বছরের শুরুর দিকে আপনি গ্রিনপার্টি প্রার্থী জিল স্টেনকে সমর্থন করেছিলেন।
চমস্কি : প্রাইমারিতে এবং শেষাবধি আমি মনে করেছি যে, নিরাপদ রাজ্যে তার পক্ষে ভোট দেওয়াই ভালো এবং আমি তাই করেছি।
ডুরেল : যতদূর মনে পড়ে ২০০৪ সালে আপনি স্যুয়িং রাজ্যগুলোতে র্যালফ নাদেরের পক্ষে ভোট না দেওয়ার জন্য ভোটারদের উৎসাহিত করেছিলেন।
চমস্কি : আমি এবারও তাই করেছি। তবে এবার প্রার্থী ছিলেন স্টেইন, নাদের নয়।
ডুরেল : র্যালফ নাদের সম্পর্কে আপনি কী ভাবেন? তিনি আদৌ রাজনৈতিক সংলাপকে উৎসাহিত করেছেন বলে কি আপনি মনে করেন?
চমস্কি : তিনি খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন বলে আমি মনে করি এবং এখনও জনস্বার্থ সম্পর্কিত বিষয়ে তিনি কাজ করে চলেছেন। সারা জীবন ধরে তিনি একইভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।
রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কিছু ভালো দিক রয়েছে। যেসব বিষয় আলোচনায়ই আসত না তিনি সেসব ইস্যুকে আলোচনায় এনেছেন। তবে তিনি কাজটা সঠিক পদ্ধতিতে করেছেন বলে আমার মনে হয় না। যেমন আমি মনে করি, প্রাইমারিতে অংশ না নেওয়া ভুল। এটা এমন একটা জায়গা যেখানে আপনি কিছুটা কভারেজ পেতে পারেন। ডেনিস কুচিনিচ এভাবেই কভারেজ পেয়েছেন। এ ধরনের বিষয় নাদের এখানে তুলতে পারতেন।
এটা জানা কথা যে, প্রেসিডেন্সিয়াল প্রচারণায় তো আপনি তেমন কোনো কভারেজ পাবেনই না। সে সময় তো নির্বাচন সংক্রান্ত বিষয়ই প্রাধান্য পায় শতভাগ। প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীদের ওপরই মিডিয়ার দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকে।
নাদের ও তার অনেক সমর্থক যুক্তি দেখিয়েছেন যে, তাদের প্রচারণায় ডেমোক্রেটিক প্রার্থী খাটো হবেন না। আমি তাদের এই যুক্তি মেনে নিতে পারিনি। আমি মনে করেছি, এটা ডেমোক্রেটিক প্রার্থীর ক্ষতি করবে আর হয়েছেও তাই।
আমি জিল স্টেনের অবস্থাটাও বুঝি। তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবেন এই প্রত্যাশা নিয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে আসেননি। তার লক্ষ্য হচ্ছে দল গড়ে তোলা। তিনি একটা পার্টি গড়ে তুলেছেন।
কিন্তু এভাবে একজন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করার মধ্যে কোনো সার্থকতা রয়েছে কি? ধরা যাক আশ্চর্যজনকভাবে নাদের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে গেলেন। অথচ তার কোনো একজন নির্বাচিত কংগ্রেস সদস্য নেই, একজন নির্বাচিত গভর্নর নেই, প্রাতিষ্ঠানিক সমর্থন নেই, রাজ্যগুলোর আইনসভাতেও কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই, স্থানীয় শহর কাউন্সিলেও কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই। তারপরও নির্বাচিত হয়ে গেলে তিনি তো সম্পূর্ণ অক্ষম হয়ে পড়বেন।
ডুরেল :এবার প্রাইমারি আলোচনাতেই ফিরে যাওয়া যাক। দুই পার্টি পরিসরে অন্য পার্টি সম্পর্কে আলোচনা করা যাক। রিপাবলিকান পার্টির মধ্যে আলোচনায় রন পলের কোনো ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে বলে কি আপনি মনে করেন?
চমস্কি : রিপাবলিকান পার্টির পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। তাদের দুরবস্থাটা বর্ণনার অতীত। আসলে গত ২০ কি ৩০ বছর ধরে রিপাবলিকান পার্টি একটি পার্টি হিসেবে নিজেদের অবস্থান টিকিয়ে রাখার কোনো চেষ্টাই করেনি। তারা এখন আর কোনো জায়গার মতো সংসদীয় দলই নয়। করপোরেট সেক্টরে তারা সম্পূর্ণরূপে বড় বড় ধনীদের সেবাদাসে পরিণত হয়েছে। তাদের একই কথা, একই দাবি নিয়ে অনর্গল বকবক করে চলেছে। কালেভদ্রে অলিম্পিয়া স্নোয়ির মতো নেতার স্তরে কিছু ভালো কথা শোনা যায়, এ পর্যন্তই। এর ফলে তারা সম্ভাব্য ভোট বেস খোয়াচ্ছে। তাই তাদের ভবিষ্যতে নির্বাচন করতে হলে ভোট বেস সম্প্রসারণের দিকে নজর দিতে হবে। জনগণের বিভিন্ন গোষ্ঠী ও স্তর, গোত্র, বর্ণকে একসূত্রে গাঁথার বিদ্যা আয়ত্ত করতে হবে।
এটা অত্যন্ত আতঙ্কগ্রস্ত দেশ। গোটা ইতিহাসজুড়েই এ অবস্থা রয়েছে। অনেক মানুষ এখানে ভয়ের মধ্যে বসবাস করে। সম্ভবত এ কারণেই এখানে বন্দুক রাখার সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে আত্মরক্ষার বিষয়টি বিবেচনা করেই।
ডুরেল : আপনি অতীতে সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্পর্কে সমালোচনামুখর ছিলেন। তখন ওই দেশটি আপনার দৃষ্টিতে একদলীয় একনায়কত্ববাদী ও 'রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদী' ছিল। অন্য কমিউনিস্ট দেশ_ চীন, উত্তর কোরিয়া, কিউবা, ভিয়েতনাম সম্পর্কেও কি আপনি একই মনোভাব পোষণ করেন?
চমস্কি : এদেরও সমালোচনা রয়েছে। তবে এরা একটি থেকে অপরটি ভিন্ন প্রকৃতির। আমি তাদের কোনো গ্রেড দিচ্ছি না, তবে এরা কিছু ভালো কাজ করেছে যেটাকে অনুমোদন করা যায়।
মাওবাদী চীনের কথা উল্লেখ করা যায়। আপনি যদি দেশটির দিকে লক্ষ্য করেন তাহলে দেখবেন তারা গণতান্ত্রিক ভারতের তুলনায় অন্তত ১০ কোটি মানুষের জীবন রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছে। কেবল তাদের গ্রামীণ স্বাস্থ্য বীমার কারণেই এটা সম্ভব হয়েছে। ১০ কোটি সংখ্যাটা নিছক জোক নয়।
ডুরেল : কোন জাতি-রাষ্ট্র আপনার ধারণা অনুযায়ী 'উদারবাদী সমাজতান্ত্রিক' পথে চলছে?
চমস্কি : উদারবাদী সমাজতন্ত্রে সব ধরনের ডাইমেনশন রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রসঙ্গ উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরা যায়। ক্লিভল্যান্ডের আশপাশে একটি প্রকল্প রয়েছে, যেটাকে মডেল বলা যায়। আলপেরোভিজ এর ওপর কাজ করছেন। উদারবাদী সমাজতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণের উপাদান বিকাশের কাজ সেখানে চলছে। বেশ কিছু কর্মী-মালিকানাভিত্তিক এন্টারপ্রাইজ ও সমবায় সেখানে রয়েছে।
তবে এটাও লক্ষ্য রাখতে হবে, যুক্তরাষ্ট্র একটি তথাকথিত পুঁজিবাদী দেশ। বিশ্বের দিকে তাকালে আমরা কমবেশি সুন্দর সমাজ দেখতে পাব। অনেক দিক থেকেই নরওয়ে চমৎকার একটি দেশ। এমনকি সাংস্কৃতিকভাবেও এটা বলা যায়।
নির্বিচার হত্যার জন্য দায়ী ব্রেইভিক বিচারের প্রসঙ্গ এ ক্ষেত্রে উল্লেখ করা যায়। এই লোকটি ৮০ ব্যক্তিকে নির্বিচারে হত্যা করার পরও তার বিচার কেমন মানবিকভাবে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এতে বোঝা যায় তারা কতটা সুসভ্য।
ডুরেল : আপনি কি মনে করেন, মার্কিন ব্যতিক্রম্যতার পেছনে কোনো সত্য নিহিত রয়েছে? দেশটির ভাবাদর্শ বা অন্য কোনো বৈশিষ্ট্য কি রয়েছে, যে কারণে যুক্তরাষ্ট্রকে বাদবাকি বিশ্ব থেকে আলাদা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত বলে বিবেচনা করা যায়?
চমস্কি : ভাবাদর্শের কথা বললে অবশ্যই অষ্টাদশ শতাব্দীতে সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের সবচেয়ে মুক্ত দেশরূপে পরিগণিত ছিল। এ ব্যাপারে অবশ্য তেমন বলা হয় না। দাস, ভূমিপুত্র, নারীদের কথা বিবেচনা করলে অষ্টাদশ শতাব্দীর মানে তারা তখন যথেষ্ট স্বাধীন ছিল।
বেশ কিছু আদর্শ গড়ে উঠেছে। স্বাধীনতার অনেক দিক রয়েছে। যেমন, কথা বলার স্বাধীনতা, যেটা আমি মনে করি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আসলে নাগরিক অধিকার আন্দোলন থেকেই যুক্তরাষ্ট্র এ ক্ষেত্রে বিশ্বকে নেতৃত্ব দিচ্ছে। এরপর অনেক কিছুই পাল্টেছে। ষাটের দিকে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে কথা বলার স্বাধীনতাকে যেভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে, এটা ভালো দিক।
আমাদের বাকস্বাধীনতা, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা রয়েছে। এখানে বিভিন্ন ইস্যুতে সংবাদমাধ্যমে অ্যাড্রেস করা হয়, যেটা একদলীয় ব্যবস্থাধীনে দেখা যায় না। আবার ভিন্ন ধরনও দেখা যায়। প্রেসিডেন্সিয়াল বিতর্কে ইরান হুমকির বিষয়টি ঘুরেফিরে এসেছে। আবার এটা প্রেসেও বারবার উল্লেখ করা হয়েছে। আসলে ইরানকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের এক ধরনের আচ্ছন্নতার কারণেই এমনটা হয়েছে। আরবের একনায়কত্ববাদী শাসকরা হয়তো এ ধরনের মনোভাবের সঙ্গে সহমত পোষণ করবেন। তবে এসব দেশের জনগণ অবশ্যই একে সমর্থন করবেন না। আর জোটনিরপেক্ষ দেশগুলো তো নয়ই। এ ব্যাপারে ইউরোপীয়দের মতামতও হবে মিশ্র।
হুমকি মোকাবেলার উপায় কী? এর অত্যন্ত সহজ উপায় রয়েছে। তারা এই অঞ্চলে পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত এলাকা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে পর্যবেক্ষণ শর্ত থাকবে। এ ব্যবস্থা অবশ্যই নিরাপত্তা হুমকি হ্রাস করবে।
সম্ভবত অনেক বছর ধরেই সারাবিশ্ব এটাই চেয়ে আসছে। যুক্তরাষ্ট্র এসব প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করেছে। আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই হেলসিঙ্কিতে এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সম্মেলন বসবে। যাকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় হুমকি বলে বিবেচনা করা হচ্ছে সেটা কীভাবে মোকাবেলা করা যাবে তা নিয়ে ওখানে আলোচনা হবে।
প্রেসের প্রসঙ্গে ফিরে আসা যাক। আমার কিছু বন্ধু মিলে ডাটাবেস তৈরি করছে এ ব্যাপারে। একদলীয় দেশ হলে এটা সম্ভব হতো না। অথচ এটা করার ওপর সরকারের কোনো চাপ নেই এখানে। একনায়ত্ববাদী দেশে সরকার না চাইলে কিছু করা যায় না।
ডুরেল : আপনি কি মনে করেন বিশ্ব অর্থনীতি ভেঙে পড়ছে?
চমস্কি : আর্থিক বিপর্যয় ঘটতে পারে। তবে এটা মারাত্মক কোনো সংকট সৃষ্টি করবে না।
ডুরেল :আপনার ভাবনায় মারাত্মক সংকটটা কী?
চমস্কি : পরিবেশ সংকট মারাত্মক আকার নিতে পারে। দ্বিতীয়ত মারাত্মক বিপর্যয় সৃষ্টিকারী হতে পারে পারমাণবিক যুদ্ধ, যাকে মোটেই খাটো করে দেখা
যায় না।
No comments