এক নমস্য গ্রন্থপ্রেমী by নাসির আহমেদ

একুশের গ্রন্থমেলা দেশে এক বিশাল উৎসব। বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত মাসব্যাপী এ উৎসব আজ আমাদের এক বড় সাংস্কৃতিক উৎসবেই পরিণত। দেশে যে সৃজনশীল প্রকাশনার জোয়ার বইমেলাকে কেন্দ্র করে, তারও গুরুত্ব অপরিসীম। লেখকদের মধ্যে যে তাগিদ সৃষ্টি হয়, তার উৎসাহ জাগায় বইমেলা।
অথচ এ মেলা এবং সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে সৃজনশীল সাহিত্য প্রকাশনার ক্ষেত্রে যার ভূমিকা পথিকৃতের; আমরা অনেকেই তার কথা ভুলে গেছি যেন। তিনি মুক্তধারার স্বত্বাধিকারী গ্রন্থ-অন্তপ্রাণ চিত্তরঞ্জন সাহা। ২০০৭ সালের ২৬ ডিসেম্বর তিনি চিরবিদায় নিয়েছেন; কিন্তু রেখে গেছেন এক উজ্জ্বল সৃজনের ক্ষেত্র একুশের গ্রন্থমেলা আর প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান মুক্তধারা। মুক্তধারা ততদিনই ঔজ্জ্বল্যে দেদীপ্যমান ছিল, যতদিন তিনি বেঁচে ছিলেন। নিঃসন্তান এ মানুষটি গ্রন্থকেই লালন করেছেন আজীবন। লালন করেছেন সুস্থ সংস্কৃতি আর মুক্তবুদ্ধিও।
পঞ্চাশের দশকে পাঠ্যপুস্তকের সহায়ক গ্রন্থের প্রকাশক হিসেবে 'পুঁথিঘর' নামের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান দিয়ে চৌমুহনী, নোয়াখালী থেকে যার যাত্রা; সেই প্রতিষ্ঠানকে দক্ষ সংগঠক চিত্তরঞ্জন সাহা এমন নৈপুণ্যে অগ্রগামী করেছিলেন যে, দেশের নামকরা শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে তার প্রতিষ্ঠান পুঁথিঘর থেকে বের হতো রচনা, ব্যাকরণ আর নানা বিষয়ের নোটবইসহ যাবতীয় পাঠ্যপুস্তক। সেই লভ্যাংশের অর্থ থেকেই একটি অংশ বিনিয়োগ করেছিলেন তিনি সৃজনশীল সাহিত্যের জন্য। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় কলকাতায় বসে শরণার্থী চিত্তরঞ্জন সাহা প্রতিষ্ঠা করেন স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ। মুক্তিযুদ্ধের মধ্যেই প্রকাশ করেন একাধিক গ্রন্থ। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলে ঢাকায় ফিরে তিনি প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করেন 'মুক্তধারা'। সম্বল কলকাতায় স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ প্রকাশিত ৩৩টি বই। যেসব বইয়ের মধ্যে ছিল সত্যেন সেনের মহাবিদ্রোহের কাহিনী, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর বাংলাদেশ কথা কয়, আহমদ ছফার জাগ্রত বাংলাদেশ, আবদুল হাফিজ সম্পাদিত রক্তাক্ত মানচিত্র ইত্যাদি গ্রন্থ। বিশেষভাবে মনে পড়ে রক্তাক্ত বাংলা শিরোনামের সম্পাদনা গ্রন্থটির কথা_ যেখানে একাত্তরের সচিত্র বিবরণ জীবন্ত।
'পুঁথিঘরে'র লভ্যাংশ থেকে সাবসিডি দিয়ে চিত্তরঞ্জন সাহা সাহিত্য প্রকাশনার ক্ষেত্রে যে অসাধারণ কৃতির পরিচয় দিয়ে গেছেন, তার তুলনা বিরল। দেশের প্রগতিশীল কবি, সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, পণ্ডিত, গবেষক, বুদ্ধিজীবীদের মুক্তধারার প্লাটফর্মে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন তিনি। আজকাল যে কেউ (ইউপিএলের মতো দু'একটি অভিজাত প্রকাশনা বাদে) যে কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে বই বের করে ফেলতে পারেন। কিন্তু মুক্তধারা থেকে বই বের করা খুব সহজ ছিল না। কবি আহসান হাবীব লেখা ছাপলে যেমন লেখক স্বীকৃতি হতো, তেমনি মুক্তধারা থেকে বই বের হলে লেখক বলে জাতে ওঠা যেত। সেই গৌরব ছিল আশির দশক পর্যন্ত।
আমার সৌভাগ্য হয়েছিল মুক্তধারার সঙ্গে, চিত্তদার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার। মুক্তধারা থেকে বই বের হতো একটি দক্ষ রিভিউ বোর্ডের হাত দিয়ে। কার বই বিচার করছেন, জানতেন না স্বয়ং রিভিউয়ারও। মানসম্পন্ন লেখা হলেই রিভিউ বোর্ডের অনুমোদন মিলত। লেখকদের সম্মানী দান, চুক্তি স্বাক্ষরও ছিল তার প্রকাশনার বৈশিষ্ট্য। দশ টাকা মাত্র দাম যে কাব্যগ্রন্থের, তার রয়্যালটিও তরুণ কবির কাছে ৩১ চৈত্রে হিসাব-নিকাশ শেষে ঠিকানামতো পাঠিয়ে দিতেন চিত্তদা। প্রকাশনার আদ্যোপান্ত সব দেখতেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। লেখকরা গেলে আপ্যায়ন ছিল তার আমলে একরকম অনিবার্য রীতি। এই সৌজন্যবোধ, ভদ্রতাবোধের পাশাপাশি লেখকদের সম্মানিত করার নানা চেষ্টা দেখেছি তার মধ্যে। যেমন মুক্তধারা সাহিত্য পুরস্কার প্রবর্তন নিয়মিত 'সাহিত্যপত্র' প্রকাশনাসহ বিভিন্ন উদ্যোগ ছিল তার। যার সঙ্গে জড়িত থাকতেন দেশের বরেণ্য লেখকরা। বইয়ের প্রচারেও নিয়েছিলেন দেশজুড়ে মেলা। এমনকি ১৯৭১ সালে বাংলা একাডেমীর খোলা চত্বরে মাদুর আর চাদর বিছিয়ে একুশে ফেব্রুয়ারি যে বইমেলার সূচনা করে গেছেন তিনি, আজ তারই ফল এই বিশাল অমর একুশে গ্রন্থমেলা। চিত্তদা লেখক নির্বিশেষ মুক্তধারার প্রতিটি গ্রন্থ দুটি করে কপি সব পত্রিকায় পাঠাতেন। যিনি রিভিউ করতেন তাকেও সম্মানী দিয়ে উৎসাহিত করতেন আলোচনা লেখার জন্য। বইয়ের বিজ্ঞাপন দেওয়াসহ প্রচারের জন্য একটা বড় বাজেটই রেখেছিলেন তিনি। এমন একজন গ্রন্থপ্রেমী কি আর আসবেন আমাদের সমাজে? তাকে গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করি।

নাসির আহমেদ : কবি ও সাংবাদিক
nasirahmed1971@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.