বিজ্ঞানচর্চায় ইসলাম by মুফতি মুতীউর রাহমান

 জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাধনা এবং ব্যবহারিক প্রয়োগই উন্নতি ও প্রগতির মূল উৎস। প্রশ্ন হচ্ছে, ইসলাম কি বিজ্ঞানবিমুখ? পবিত্র কোরআন ও হাদিস কি প্রগতির জন্য অন্তরায়? অত্যন্ত সহজ সরল ভাষায় উত্তর এভাবে দেওয়া যায়_ বিজ্ঞান অর্থ যদি হয় সৃষ্টিকর্তাকে অস্বীকার ও সৃষ্টিকে ধ্বংসের উল্লাস, তাহলে ইসলাম নিশ্চয়ই এর বিরোধী।
কারণ, ইসলামের মূল লক্ষ্যই হচ্ছে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের আনুগত্য, তার সামনে মাথানত করা এবং তার সৃষ্টির কল্যাণ কামনা। গোটা সৃষ্টি-জগৎই মহান আল্লাহতায়ালার পরিবারতুল্য। সৃষ্টি-জগতের প্রতি সদয় আচরণ করাই পবিত্র ধর্ম ইসলামের মহান শিক্ষা ও আদর্শ। আর বিজ্ঞান যদি হয় প্রাকৃতিক রহস্য উদ্ঘাটন ও মানবকল্যাণে আত্মনিয়োগের জন্য, তাহলে ইসলাম নিঃসন্দেহে তার সূতিকাগার। বিজ্ঞানবিমুখ তো নয়ই, ইসলাম বরং বিজ্ঞানের উদ্ভাবক ও সদা সহায়ক। ইসলাম ও বিজ্ঞান পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বী নয় বরং একে অপরের পরিপূরক, আত্মোপলব্ধি ও আল্লাহভীতির প্রথম সোপানই হচ্ছে সৃষ্টির মাধ্যমে স্রষ্টার কুদরত ও মহিমা দর্শন এবং সম্যক জ্ঞানার্জন। এই আত্মোপলব্ধ জ্ঞান ছাড়া মানুষ কখনও সত্যিকার সমৃদ্ধি, সুনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন এবং আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের নৈকট্য লাভ করতে সক্ষম হয় না। পবিত্র কোরআনে তাই বিশ্ব-প্রকৃতিতে চিন্তা ও পর্যবেক্ষণের পুনঃ পুনঃ আহ্বান জানানো হয়েছে। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, নিশ্চয়ই আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টিতে এবং রাত-দিনের আবর্তনে নিদর্শন রয়েছে বোধসম্পন্ন লোকদের জন্য। যারা দাঁড়িয়ে, বসে ও শুয়ে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং চিন্তা-গবেষণা করে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টি নিয়ে, (তারা বলে) হে আমাদের প্রতিপালক! এসব তুমি অনর্থক সৃষ্টি করনি। তুমি পবিত্র। সুতরাং আমাদের জাহান্নামের শাস্তি থেকে রক্ষা কর। (আল ইমরান, ১৯০-৯১)
আরও কয়েকটি আয়াতেও বিশ্বপ্রকৃতিতে চিন্তাভাবনা করার আহ্বান জানানো হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে পবিত্র কোরআন হচ্ছে কল্যাণমুখী বিজ্ঞানের উৎস। হিলেয়ার বেলক বলেন, 'মুসলিম সভ্যতায় এমন কিছুই নেই, যা বৈজ্ঞানিক জ্ঞান-সাধনা বা যান্ত্রিক যোগ্যতা পরিপন্থী। ইসলাম ধর্মে সহজাত এমন কিছুই নেই, যা আধুনিক বিজ্ঞান ও আধুনিক যুগের অনুপযোগী।'
ইসলামকে বিজ্ঞানবিরোধী ও পশ্চাৎমুখী বলে উপহাস না করে বরং বর্তমান পথহারা মুসলমানদের সামনে ইসলামের চিরন্তন সৌন্দর্য ও উপযোগিতা তুলে ধরাটাই আমাদের কর্তব্য। কল্যাণমুখী বিজ্ঞানের সঙ্গে ইসলামের কোনো বিরোধ নেই। কারণ, কল্যাণধর্মিতা ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। পবিত্র কোরআন বিশ্বপ্রকৃতিকে পর্যবেক্ষণ করতে বলে খোদাভীতির দৃষ্টি দিয়ে, বিশ্বাসভরা হৃদয় দিয়ে। কিন্তু আজকের বিজ্ঞানচর্চা ও গবেষণায় ভক্তি-বিশ্বাসের স্থান দখল করে নিয়েছে পশুশক্তি ও ঘৃণ্য অহমিকা। বিশ্বপ্রকৃতি রহস্যের কতটুকুই-বা আবিষ্কার করতে পেরেছে আজকের বিজ্ঞান? মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ইরশাদ করেন_ তারা আপনাকে রুহ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। আপনি বলুন, রুহ আমার প্রতিপালকের আদেশঘটিত। আর তোমাদের খুব সামান্য জ্ঞানই দেওয়া হয়েছে। (বনি ইসরাইল-৮৫) এই অতি সামান্য জ্ঞান নিয়েই মানুষের কত বড়াই। এর অহমিকায় সৃষ্টিকর্তাকে অস্বীকার পর্যন্ত করে বসে। এই অহমিকা ধ্বংস ডেকে আনে, এখন বাস্তবে তা-ই হচ্ছে। টি এস এলিয়ট বলেন, আমাদের সমুদয় জ্ঞান আমাদের নিয়ে যাচ্ছে অজ্ঞতার কাছাকাছি। আমাদের তাবৎ অজ্ঞতা আমাদের নিয়ে যাচ্ছে মৃত্যুর কাছাকাছি। মৃত্যুর কাছাকাছি বলে কিন্তু আল্লাহর কাছাকাছি মোটেই নয়। হ্যাঁ, আমরা এখন ধ্বংসের সম্মুখীন। অ্যাটম বোমা নামের মারণাস্ত্রের জনক ছিলেন লিও জিলাত। আরব্য রজনীর জেলের মতো কলসির মুখ খুলে জিন বের করেছিলেন তিনি। আবার তিনিই জিনটিকে কলসিতে ঢোকানোর চেষ্টাও করেছিলেন। আইনস্টাইনকে বলেছিলেন, কলসির দৈত্যটি যেহেতু আমেরিকার বশীভূত, যেভাবেই হোক দৈত্যটিকে আবার কলসিতেই ঢোকানো দরকার। অ্যাটম বোমার জনকের আর্তনাদ চাপা পড়ে রইল ফাইলপত্রের স্তূপে। অসহায় বিজ্ঞানীর চোখের সামনে হিরোশিমায় ঘটে গেল মানবতার বহুক্র্যৎসব। বিজ্ঞানের আবিষ্কার আণবিক বোমা সম্পর্কে মার্কোয়েজ বলেছিলেন, 'কালান্তক বিস্ফোরণের মুহূর্তকালের মধ্যে সভ্যতা আবার ফিরে যাবে আদিম জমাট বরফের যুগে।' আবার রণোন্মাদনা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে মধ্যপ্রাচ্যে। সেখানকার আকাশের বর্ণ লাল হয়ে উঠেছে। বুক দুরুদুরু করে, কী জানি কোন মুহূর্তে এমন ধ্বংসলীলা ঘটে যায়, যা হিরোশিমার ধ্বংসলীলাকেও হার মানায়? অতীতের মতো বর্তমান সমস্যায়ও কোরআনভিত্তিক সমাধান বের করতে হবে। অতীতে মুসলমানরা আপন বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে গ্রিক ও রোমান জ্ঞান-সমুদ্র মন্থন করে বিশ্বকে উপহার দিয়েছিলেন গৌরবোজ্জ্বল সভ্যতা। বর্তমানে আমাদেরও স্বকীয়তা ও স্বাতন্ত্র্য অক্ষুণ্ন রেখে এগিয়ে যেতে হবে কল্যাণমুখী বিজ্ঞানচর্চায়।
 

No comments

Powered by Blogger.