বহে কাল নিরবধি-অবরোধ কি ইরানকে কোনো 'পরিবর্তনে' বাধ্য করবে? by এম আবদুল হাফিজ

ইরানে মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বিশ্ব আরোপিত অবরোধ দেশটির অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করেছে ঠিকই, কিন্তু এ পর্যন্ত তা তাদের ঘোষিত ইরানের নীতি পরিবর্তনে ব্যর্থ হয়েছে। তা ছাড়া অবরোধ আরোপকারীদের অঘোষিত অভিলাষ যে এতে দেশটির অভ্যন্তরে শাসক বদলের (Regime change) পক্ষে একটি জনপ্রিয় আবহ তৈরি হবে, যা বর্তমান সরকারের পতন ঘটাবে এমন আশাও বাস্তবায়িত হয়নি।


বরং আরোপিত অবরোধ সত্ত্বেও ইরানিরা তাদের সরকারের অনুসৃত নীতিকে আরো সংহত করেছে।
তবে ইরান অবশ্যই এতে করে একটি প্রচণ্ড সংকটের মোকাবিলা করছে। কেননা, দেশটিতে চালু রিয়ালের অনেক অবমূল্যায়ন হয়েছে এবং মুদ্রাটির দরপতন অব্যাহত আছে। গত বছরের তুলনায় এই দরপতন এখন শতকরা ৪০ ভাগেরও বেশি। ইরানের ওপর দীর্ঘদিনের ভাষ্যকার রবার্ট ড্রেফাসের অবরোধ আরোপের ফলে ইরানের সংকট এখনো বৈপ্লবিকভাবে মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছায়নি। যদিও রিয়ালের অবমূল্যায়ন দেশটিকে আরো সংকটের মুখে ফেলার আশঙ্কা আছে। ফলে অভ্যন্তরীণভাবেই দ্রব্যমূল্য আকাশচুম্বী হতে থাকবে। লোকজন তখন বৈদেশিক মুদ্রা আহরণে পাগল হয়ে উঠবে।
এ ছাড়া অবরোধ ইরানের জ্বালানি রপ্তানিকে সঙিন অবস্থায় পৌঁছে দিয়েছে। একসময় এই রপ্তানির পরিমাণ ছিল দিনে প্রায় চার মিলিয়ন ব্যারেল, কিন্তু এখন তা দিনে এক মিলিয়নে নেমে এসেছে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে ইরান যে ঘাটতির মুখে পড়েছে, তাতে প্রেসিডেন্ট আহমাদিনেজাদ তাঁর ভর্তুকিনির্ভর অর্থনীতির জন্য যথেষ্ট অর্থ অর্জনে হিমশিম খাবেন। ইতিমধ্যে বেকারত্বের হার বেড়েছে অপ্রতিরোধ্যভাবে, দেশের অপেক্ষাকৃত দরিদ্র অঞ্চলে এ হার ভয়াবহ।
কিন্তু বিরাজমান অর্থনৈতিক দুরবস্থা বা নৈরাশ্যে ইরানে কোনো পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা নেই। কেননা রবার্ট ড্রেফাসের যুক্তিতেই ইরান তো কোনো গণতান্ত্রিক দেশ নয়, যেখানে জনগণ যেকোনো দুর্ভোগ বা দুরবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে পারে। সুতরাং সরকার বিশ্বের মূলধারায় ফেরার যেকোনো প্রচেষ্টা, উদ্যোগ বা সেই লক্ষ্যে আন্দোলন-বিক্ষোভকে সহজেই স্তব্ধ করে দিতে পারে। শোনা যায়, সাবেক প্রেসিডেন্ট রাফসানজানি, বিশ্ব নেতৃত্বের বিরুদ্ধে মারমুখী অবস্থান না গ্রহণের পক্ষপাতী, কিন্তু তাঁর সমর্থকরা ক্ষমতাসীনদের হাতে প্রবলভাবে আক্রান্ত হয়েছে।
একইভাবে 'গ্রিন মুভমেন্ট'কে ২০০৯ সালের নির্বাচনে ভালো করার অপরাধে ক্ষমতাসীনদের নিষ্ঠুর আক্রমণের মুখোমুখি হতে হয়েছে। অভিন্ন ভাগ্য বরণ করতে হয়েছে প্রভাবশালী ব্যবসায়ী সম্প্রদায়কে, যা নাকি অত্যন্ত উদ্বিগ্ন ছিল রিয়ালের অব্যাহত দরপতনে। প্রতি ডলারে সরকারি ১২ হাজার ২৬০ রিয়ালের বিনিময় হার অতি অল্প আনুকূল্যপ্রাপ্ত আমদানিকারক এবং মাত্র কিছু অতি প্রয়োজনীয় দ্রব্য আমদানির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
এমন পটভূমিকায় বরার্ট ড্রেফাস ইরানের জন্য তিনটি সম্ভাব্য দৃশ্যপটের অবতারণা করেছেন। প্রথমত, অবরোধে সৃষ্ট জনদুর্ভোগ সত্যি সত্যিই একটি রাজনৈতিক অভ্যুত্থানের জন্ম দেবে, যা ইমাম খামেনিকে নীতি পরিবর্তনে বাধ্য করবে। এমনকি সেই অভ্যুত্থানের তোড়ে ধসে পড়বে ইরানের ধর্মভিত্তিক ইসলামী শাসনব্যবস্থার ভিত। দ্বিতীয়ত, চলমান গণ-অসন্তোষ আরো ছড়িয়ে পড়লে সরকার তা অবদমন করবে। তবে তৃতীয় দৃশ্যপট হবে একটি অস্থিতিশীল সরকারের বেপরোয়া সামরিক অ্যাডভেঞ্চার। এই পর্বে তড়িঘড়ি করে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে একটি চূড়ান্ত রূপদান। এর পরের ইরানের পদক্ষেপ ভয়াবহ হতে পারে।
ড্রেফাস এ ব্যাপারে স্পষ্ট যে প্রথম দৃশ্যপটটি প্রায় অসম্ভব। ইরানের ইসলামী বিপ্লব কোনো দিনই কোনো ঠুনকো বিষয় ছিল না এবং এত দিনে দেশটিতে তা একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পরিগ্রহ করেছে। ইরানের বর্তমান শাসকগোষ্ঠী যে রাষ্ট্রীয় নীতি গ্রহণ করেছে এবং তা কায়মনোবাক্যে অনুসরণ করছে, তা তারা ভেবেচিন্তেই করছে। কোনো মহলের ধমক বা হুমকিতে তা তারা পরিবর্তন করবে না।
তৃতীয় দৃশ্যপটের সম্ভাবনা সম্পর্কে ড্রেফাস বলেন, ইরানি নাগরিক ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা কখনোই একটি আত্মঘাতী পথ বেছে নেবেন না। কেননা তাঁরা তো উন্মাদ নন এবং তাঁরা তাঁদের নীতি অগ্র-পশ্চাৎ বিবেচনা করেই গ্রহণ করেছেন। তাই এ নিয়ে তাঁদের কোনো স্নায়ুবৈকল্য নেই যে তাঁরা কোনো বেপরোয়া পদক্ষেপ নেবেন। অতএব ড্রেফাসসহ ইরান বিষয়ে একাধিক বিশ্লেষকের মতে, ইরানিরা কিছু রদবদল সাপেক্ষে নিজেদের মধ্যে একটি আপস-মীমাংসার পথেই এগোবে এবং ইরানি মধ্যপন্থীদের জন্যও একটি ভূমিকা বিবেচিত হবে। অনেকেই মনে করেন, তাতে পশ্চিমা মহলের ইরান বিষয়ে প্রভাব আরো হ্রাস পেতে পারে এবং তা ২০১৩ সালে অনুষ্ঠিতব্য ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিফলিত হবে।
একজন শক্তিশালী সাবেক প্রেসিডেন্ট রাফসানজানিকে ইরানের হার্ডলাইনার যে তীব্র সমালোচনার ঝড় বইছে- এখন তা থেকেই পশ্চিমা মতামতকে উপেক্ষা করার প্রবণতা বোঝা যায়। উল্লেখ্য, রাফসানজানির ছেলে মাহদি ও মেয়ে ফায়েজেহ্, যাঁরা তাঁদের বাবার রাজনৈতিক দর্শনে বিশ্বাসী, সাম্প্রতিক সময়ে আটক হয়েছেন। এদিকে রাফসানজানি একটি 'একতা' সরকারের ডাক দিয়েছেন এবং পাশাপাশি আমেরিকার সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার তৎপরতা চালাচ্ছেন।
আরেকজন শ্রদ্ধেয় ইরান পর্যবেক্ষক ফারিদেহ্ ফারাহ এ বিষয়ে সহমত পোষণ করেন যে আমেরিকার নেতৃত্বাধীন অবরোধ অকার্যকর থাকবে। কেননা অবরোধের কেন্দ্রীয় অসমঝোতা, যা ইরানের নেতৃত্বকে কোনোভাবে আঘাত করে না; বরং তা তাদেরই আঘাত করে, যারা অভ্যন্তরীণ পরিবর্তনের পক্ষে। ভার্জিনিয়ার অর্থনীতিবিদ জাভেদ সালেহি ইস্পাহানি (সম্ভবত ইরানি অভিবাসী) জেমস বলের সঙ্গে যৌথভাবে রচিত ও ওয়াশিংটন পোস্টে প্রকাশিত নিবন্ধে উল্লেখ করেছেন, মার্কিন নেতৃত্বাধীন অবরোধ ইরানের মধ্যবিত্ত এবং বেসরকারি সেক্টরকেই শুধু ক্ষতিগ্রস্ত করে। অথচ এরাই মুক্ত বিশ্বের সঙ্গে সুসম্পর্ক চায়। সরকার তো অবরোধ সত্ত্বেও তার প্রয়োজনের অর্থ অবরোধের ফাঁকফোকর দিয়ে সংগ্রহ করতে সক্ষম।
ফারাহ এই যুক্তিতে অবরোধ আরোপের বিরোধী যে এতে সরকার বা তার অনুসৃত নীতিতে কোনো পরিবর্তন আসবে না। বরং তা বিপুলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে ইরানের সামাজিক বন্ধনবিন্যাস ও বুননকে। আরো ক্ষতিগ্রস্ত করবে দেশটির অর্থনীতিকে। তাতে কি অবরোধ আরোপকারীদের কোনো লাভ হবে? ফারাহ নির্বোধ আমেরিকানদের ধারণাগত বিশ্বাস ও আশাবাদকে কটাক্ষ করে বলেন, স্বাধীনতাপ্রিয় ইরানিরা কোনো না কোনোভাবে মার্কিনিদের কাঙ্ক্ষিত পথেই উপায় খুঁজে বের করবে, যদিও আমেরিকা ইরানিদের সেই পথকেই বাধাগ্রস্ত করছে অর্থহীন ও উদ্দেশ্যহীন অবরোধের ভেতর দিয়ে।

লেখক : সাবেক মহাপরিচালক বিআইএসএস

No comments

Powered by Blogger.