সমাজ-জন্মনিবন্ধন ও একটি মানবিক প্রসঙ্গ by রানা ভিক্ষু
সৈয়দপুর শহরের মতো নিশ্চয় বাংলাদেশের অন্যান্য শহরের ভাসমান যৌনকর্মীদের পরিস্থিতি ভিন্ন হওয়ার কথা নয়। নিছক বাস্তবায়ন সমস্যার কারণে সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম থেকে বঞ্চিত হচ্ছে জন্মনিবন্ধন সনদ সংগ্রহে অসমর্থ যৌনকর্মীর সন্তানরা।
রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে সর্বজনীন জন্মনিবন্ধন নিশ্চিত না হলে এ পরিস্থিতি পাল্টাবে না
বাল্যবিবাহ নিরোধ, শিশুশ্রম বিলোপ, পাচার, পতিতাবৃত্তি বন্ধ, ধর্ষিতার বয়স নির্ধারণ প্রভৃতি ক্ষেত্রে প্রকৃত বয়স নিশ্চিত করতে ১৮৭৩ সালের জন্মনিবন্ধনের পুরনো আইন সংশোধন করে 'জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন আইন-২০০৪' প্রণয়ন করা হয়, যা ২০০৬ সালের ৩ জুলাই থেকে কার্যকর হয়েছিল। এ আইনে বলা হয়_ 'যে কোনো ব্যক্তির বয়স, জন্ম ও মৃত্যুবৃত্তান্ত প্রমাণের ক্ষেত্রে কোনো অফিস বা আদালতে বা স্কুল বা সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে এই আইনের অধীন প্রদত্ত জন্ম বা মৃত্যু সনদ দেখাতে হবে। অন্য কোনো আইনে যা-ই থাকুক না কেন, নিম্নবর্ণিত বিষয়াদির ক্ষেত্রে বয়স প্রমাণের জন্য এই আইনের প্রদত্ত জন্ম সনদ অবশ্যই ব্যবহার করতে হবে_ ১. পাসপোর্ট ইস্যু, ২. বিবাহ রেজিস্ট্রেশন, ৩. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি, ৪. সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নিয়োগদান, ৫. ড্রাইভিং লাইসেন্স ইস্যু, ৭. জমি রেজিস্ট্রেশন এবং ৮. বিধি দ্বারা নির্ধারিত অন্য যে কোনো ক্ষেত্রে।' আবার বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে বলা হয়েছে_ জন্ম সনদ না থাকার কারণে কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি প্রত্যাখ্যান করা যাবে না। জন্ম সনদ ছাড়া ভর্তির ক্ষেত্রে ভর্তির তিন মাসের মধ্যে জন্ম সনদ ওই প্রতিষ্ঠানে জমা দেওয়ার নিয়ম রাখা হয়েছে এ আইনে।
'জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন আইন-২০০৪' অনুযায়ী জন্মনিবন্ধনের যে প্রক্রিয়া, তাতে জন্মনিবন্ধন আবেদনপত্রের (২) নং ছকে পিতামাতার জাতীয়তার পরিচয় সংক্রান্ত তথ্য লিপিবদ্ধ করতে হয়। এর ব্যাখ্যায় স্পষ্ট করে বলা হয়েছে যে_ 'কোনো কারণে শিশুর পিতৃপরিচয় না পাওয়া গেল শুধু মাতার নামই লিপিবদ্ধ করা যাবে। অথবা পিতা বা মাতা কারও নাম পাওয়া না গেলে, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার পরিচয়ে লিপিবদ্ধ করা যাবে।'
সে মোতাবেক ২০০৬ সালের ১৪ আগস্ট স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে ২০০৮ সালের মধ্যে সর্বজনীন জন্মনিবন্ধনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। সর্বজনীন জন্মনিবন্ধন সফল করতে ইউনিয়ন ও পৌরসভার ওয়ার্ড পর্যায়ে 'জন্মনিবন্ধন টাস্কফোর্স' গঠন করা হয়। ওয়ার্ড কমিশনার/ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য, এনজিও কর্মী, স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিরা এই টাস্কফোর্সের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। টাস্কফোর্সের সদস্যদের নিজ নিজ ওয়ার্ডের সর্বজনীন জন্মনিবন্ধন নিশ্চিত করার কথা। কিন্তু কোনো প্রকার পরিসংখ্যান ছাড়াই বলা যায়, সর্বজনীন জন্মনিবন্ধনের উদ্যোগ সফল হয়নি। আজও বাংলাদেশে এমন কোনো ইউনিয়ন বা পৌরসভার এমন কোনো ওয়ার্ড পাওয়া যাবে না, যেখানে সব নাগরিকের জন্মনিবন্ধন নিশ্চিত হয়েছে।
জন্মনিবন্ধন আইনের বাস্তবায়ন সমস্যায় ভাসমান যৌনকর্মী এবং তাদের সন্তানরা যে ক্ষতির শিকার হয়েছে তা প্রায় অপূরণযোগ্য। একটি উন্নয়ন কার্যক্রম পরিদর্শনের সুবাদে রংপুর বিভাগের নীলফামারী জেলার সৈয়দপুর পৌরসভায় কয়েকজন ভাসমান যৌনকর্মীর সঙ্গে কথা হয়। উলেল্গখ্য, রেলওয়ে কারখানার জন্য সৈয়দপুর পৌরসভা ব্রিটিশ আমল থেকে উত্তরবঙ্গের অন্যতম বাণিজ্যিক এলাকা। এ ছাড়া ১৮৭৭ সালের দিকে সৈয়দপুর বিশেষভাবে পরিচিত ছিল সরকারিভাবে স্বীকৃত পতিতাপল্লীর জন্য। সরকার স্বীকৃত এক হাজার যৌনকর্মী ছাড়াও অস্বীকৃত অনেক যৌনকর্মী সৈয়দপুর পল্লীতে থাকত। সরকারি আদেশবিহীন এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি ছাড়াই চিহ্নিত একটি মহল পতিতাপল্লীর জমি দখলের অভিপ্রায়ে ১৯৯৩ সালে পল্লীটি উচ্ছেদ করে।
সাক্ষাৎকারে তারা জন্মনিবন্ধন আইনের বিড়ম্বনায় সন্তানদের নানা সমস্যার তথ্য তুলে ধরে করুণ কণ্ঠে। বলা প্রয়োজন, তথ্যদাতাদের সবাই পূর্ব পেশায় জড়িত কিন্তু বর্তমানে তারা আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী। নিজ পরিচয় গোপন রেখে তারা তাদের সন্তানদের শিক্ষিত করে সম্মানজনক জীবিকা নিশ্চিত করে সামাজিক অগ্রহণযোগ্য পরিস্থিতি থেকে মুক্ত রাখতে চায়। কিন্তু জন্মনিবন্ধন আইন সে স্বপ্ন পূরণে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশের বেশিরভাগ ভাসমান যৌনকর্মীর সন্তানদের হাঁটাচলা শেখার পর থেকেই পেটের খাবার জোগানোর ভার নিতে হয় কঠোর পরিশ্রম করে। সৈয়দপুরের বেশিরভাগ ভাসমান যৌনকর্মীর সন্তানদেরও একই অবস্থা। এখানকার পড়ালেখার খরচ চালাতে সমর্থ মায়েদের স্কুলগামী সন্তানদেরও স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়েছে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জন্মনিবন্ধন সনদের জন্য চাপ দেওয়ার কারণে। কেউ কেউ ভুয়া পিতৃপরিচয়ে সন্তানের জন্য জন্ম সনদ সংগ্রহ করে স্কুলে পাঠালেও মায়ের পরিচয় প্রকাশিত হওয়ার পর তার সন্তানরা সহপাঠীদের বৈরী আচরণ ও নিজ হীনমন্যতার কারণে আর স্কুলে টিকতে পারে না।
কিছু বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ভাসমান যৌনকর্মীর সন্তানদের নিয়ে স্বতস্ত্র স্কুল পরিচালনা করছে। এতে তাদের পঠনপাঠনের কাজটি হলেও মানসিক বিকাশ কি স্বাভাবিক হবে? তারা কি বিদ্যালয়ের ভেতরেই একঘরে হয়ে যায়নি?
ভাসমান পতিতাদের নিয়ে এইচআইভি/এইডস বিষয়ক সচেতনতার কাজ করে এমন এনজিওগুলো যৌনকর্মী ও তাদের সন্তানের জন্মনিবন্ধনের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এমন এনজিও প্রতিনিধিদের মতে_ সুবিধাভোগী ভাসমান যৌনকর্মীরা ছাড়া দালালদের দ্বারা যারা একেক দিন একেক শহরে চালান হয় বা যারা বাস টার্মিনাল, রেলস্টেশন, ট্রাকস্ট্যান্ড ছাড়াও শহরের বিভিন্ন স্থানে দিনের বেলায় ঘুমিয়ে কাটায় তাদের ও তাদের সন্তানদের জন্মনিবন্ধন নয়।
সৈয়দপুর শহরের মতো নিশ্চয় বাংলাদেশের অন্যান্য শহরের ভাসমান যৌনকর্মীদের পরিস্থিতি ভিন্ন হওয়ার কথা নয়। নিছক বাস্তবায়ন সমস্যার কারণে সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম থেকে বঞ্চিত হচ্ছে জন্মনিবন্ধন সনদ সংগ্রহে অসমর্থ যৌনকর্মীর সন্তানরা। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে সর্বজনীন জন্মনিবন্ধন নিশ্চিত না হলে এ পরিস্থিতি পাল্টাবে না। কাজেই রাষ্ট্রকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে সর্বজনীন জন্মনিবন্ধন নিশ্চিত করা হবে নাকি ভাসমান যৌনকর্মীর সন্তানরা পাসপোর্ট ইস্যু, বিবাহ রেজিস্ট্রেশন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি, সরকারি বা বেসরকারি প্রনিষ্ঠানে নিয়োগপ্রাপ্তি, ড্রাইভিং লাইসেন্স ইস্যুসহ অন্যান্য নাগরিক সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তি প্রভৃতির আওতাবহির্ভূত থেকে যাবে চিরকাল?
রানা ভিক্ষু : পিএইচডি গবেষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
বাল্যবিবাহ নিরোধ, শিশুশ্রম বিলোপ, পাচার, পতিতাবৃত্তি বন্ধ, ধর্ষিতার বয়স নির্ধারণ প্রভৃতি ক্ষেত্রে প্রকৃত বয়স নিশ্চিত করতে ১৮৭৩ সালের জন্মনিবন্ধনের পুরনো আইন সংশোধন করে 'জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন আইন-২০০৪' প্রণয়ন করা হয়, যা ২০০৬ সালের ৩ জুলাই থেকে কার্যকর হয়েছিল। এ আইনে বলা হয়_ 'যে কোনো ব্যক্তির বয়স, জন্ম ও মৃত্যুবৃত্তান্ত প্রমাণের ক্ষেত্রে কোনো অফিস বা আদালতে বা স্কুল বা সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে এই আইনের অধীন প্রদত্ত জন্ম বা মৃত্যু সনদ দেখাতে হবে। অন্য কোনো আইনে যা-ই থাকুক না কেন, নিম্নবর্ণিত বিষয়াদির ক্ষেত্রে বয়স প্রমাণের জন্য এই আইনের প্রদত্ত জন্ম সনদ অবশ্যই ব্যবহার করতে হবে_ ১. পাসপোর্ট ইস্যু, ২. বিবাহ রেজিস্ট্রেশন, ৩. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি, ৪. সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নিয়োগদান, ৫. ড্রাইভিং লাইসেন্স ইস্যু, ৭. জমি রেজিস্ট্রেশন এবং ৮. বিধি দ্বারা নির্ধারিত অন্য যে কোনো ক্ষেত্রে।' আবার বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে বলা হয়েছে_ জন্ম সনদ না থাকার কারণে কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি প্রত্যাখ্যান করা যাবে না। জন্ম সনদ ছাড়া ভর্তির ক্ষেত্রে ভর্তির তিন মাসের মধ্যে জন্ম সনদ ওই প্রতিষ্ঠানে জমা দেওয়ার নিয়ম রাখা হয়েছে এ আইনে।
'জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন আইন-২০০৪' অনুযায়ী জন্মনিবন্ধনের যে প্রক্রিয়া, তাতে জন্মনিবন্ধন আবেদনপত্রের (২) নং ছকে পিতামাতার জাতীয়তার পরিচয় সংক্রান্ত তথ্য লিপিবদ্ধ করতে হয়। এর ব্যাখ্যায় স্পষ্ট করে বলা হয়েছে যে_ 'কোনো কারণে শিশুর পিতৃপরিচয় না পাওয়া গেল শুধু মাতার নামই লিপিবদ্ধ করা যাবে। অথবা পিতা বা মাতা কারও নাম পাওয়া না গেলে, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার পরিচয়ে লিপিবদ্ধ করা যাবে।'
সে মোতাবেক ২০০৬ সালের ১৪ আগস্ট স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে ২০০৮ সালের মধ্যে সর্বজনীন জন্মনিবন্ধনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। সর্বজনীন জন্মনিবন্ধন সফল করতে ইউনিয়ন ও পৌরসভার ওয়ার্ড পর্যায়ে 'জন্মনিবন্ধন টাস্কফোর্স' গঠন করা হয়। ওয়ার্ড কমিশনার/ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য, এনজিও কর্মী, স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিরা এই টাস্কফোর্সের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। টাস্কফোর্সের সদস্যদের নিজ নিজ ওয়ার্ডের সর্বজনীন জন্মনিবন্ধন নিশ্চিত করার কথা। কিন্তু কোনো প্রকার পরিসংখ্যান ছাড়াই বলা যায়, সর্বজনীন জন্মনিবন্ধনের উদ্যোগ সফল হয়নি। আজও বাংলাদেশে এমন কোনো ইউনিয়ন বা পৌরসভার এমন কোনো ওয়ার্ড পাওয়া যাবে না, যেখানে সব নাগরিকের জন্মনিবন্ধন নিশ্চিত হয়েছে।
জন্মনিবন্ধন আইনের বাস্তবায়ন সমস্যায় ভাসমান যৌনকর্মী এবং তাদের সন্তানরা যে ক্ষতির শিকার হয়েছে তা প্রায় অপূরণযোগ্য। একটি উন্নয়ন কার্যক্রম পরিদর্শনের সুবাদে রংপুর বিভাগের নীলফামারী জেলার সৈয়দপুর পৌরসভায় কয়েকজন ভাসমান যৌনকর্মীর সঙ্গে কথা হয়। উলেল্গখ্য, রেলওয়ে কারখানার জন্য সৈয়দপুর পৌরসভা ব্রিটিশ আমল থেকে উত্তরবঙ্গের অন্যতম বাণিজ্যিক এলাকা। এ ছাড়া ১৮৭৭ সালের দিকে সৈয়দপুর বিশেষভাবে পরিচিত ছিল সরকারিভাবে স্বীকৃত পতিতাপল্লীর জন্য। সরকার স্বীকৃত এক হাজার যৌনকর্মী ছাড়াও অস্বীকৃত অনেক যৌনকর্মী সৈয়দপুর পল্লীতে থাকত। সরকারি আদেশবিহীন এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি ছাড়াই চিহ্নিত একটি মহল পতিতাপল্লীর জমি দখলের অভিপ্রায়ে ১৯৯৩ সালে পল্লীটি উচ্ছেদ করে।
সাক্ষাৎকারে তারা জন্মনিবন্ধন আইনের বিড়ম্বনায় সন্তানদের নানা সমস্যার তথ্য তুলে ধরে করুণ কণ্ঠে। বলা প্রয়োজন, তথ্যদাতাদের সবাই পূর্ব পেশায় জড়িত কিন্তু বর্তমানে তারা আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী। নিজ পরিচয় গোপন রেখে তারা তাদের সন্তানদের শিক্ষিত করে সম্মানজনক জীবিকা নিশ্চিত করে সামাজিক অগ্রহণযোগ্য পরিস্থিতি থেকে মুক্ত রাখতে চায়। কিন্তু জন্মনিবন্ধন আইন সে স্বপ্ন পূরণে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশের বেশিরভাগ ভাসমান যৌনকর্মীর সন্তানদের হাঁটাচলা শেখার পর থেকেই পেটের খাবার জোগানোর ভার নিতে হয় কঠোর পরিশ্রম করে। সৈয়দপুরের বেশিরভাগ ভাসমান যৌনকর্মীর সন্তানদেরও একই অবস্থা। এখানকার পড়ালেখার খরচ চালাতে সমর্থ মায়েদের স্কুলগামী সন্তানদেরও স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়েছে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জন্মনিবন্ধন সনদের জন্য চাপ দেওয়ার কারণে। কেউ কেউ ভুয়া পিতৃপরিচয়ে সন্তানের জন্য জন্ম সনদ সংগ্রহ করে স্কুলে পাঠালেও মায়ের পরিচয় প্রকাশিত হওয়ার পর তার সন্তানরা সহপাঠীদের বৈরী আচরণ ও নিজ হীনমন্যতার কারণে আর স্কুলে টিকতে পারে না।
কিছু বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ভাসমান যৌনকর্মীর সন্তানদের নিয়ে স্বতস্ত্র স্কুল পরিচালনা করছে। এতে তাদের পঠনপাঠনের কাজটি হলেও মানসিক বিকাশ কি স্বাভাবিক হবে? তারা কি বিদ্যালয়ের ভেতরেই একঘরে হয়ে যায়নি?
ভাসমান পতিতাদের নিয়ে এইচআইভি/এইডস বিষয়ক সচেতনতার কাজ করে এমন এনজিওগুলো যৌনকর্মী ও তাদের সন্তানের জন্মনিবন্ধনের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এমন এনজিও প্রতিনিধিদের মতে_ সুবিধাভোগী ভাসমান যৌনকর্মীরা ছাড়া দালালদের দ্বারা যারা একেক দিন একেক শহরে চালান হয় বা যারা বাস টার্মিনাল, রেলস্টেশন, ট্রাকস্ট্যান্ড ছাড়াও শহরের বিভিন্ন স্থানে দিনের বেলায় ঘুমিয়ে কাটায় তাদের ও তাদের সন্তানদের জন্মনিবন্ধন নয়।
সৈয়দপুর শহরের মতো নিশ্চয় বাংলাদেশের অন্যান্য শহরের ভাসমান যৌনকর্মীদের পরিস্থিতি ভিন্ন হওয়ার কথা নয়। নিছক বাস্তবায়ন সমস্যার কারণে সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম থেকে বঞ্চিত হচ্ছে জন্মনিবন্ধন সনদ সংগ্রহে অসমর্থ যৌনকর্মীর সন্তানরা। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে সর্বজনীন জন্মনিবন্ধন নিশ্চিত না হলে এ পরিস্থিতি পাল্টাবে না। কাজেই রাষ্ট্রকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে সর্বজনীন জন্মনিবন্ধন নিশ্চিত করা হবে নাকি ভাসমান যৌনকর্মীর সন্তানরা পাসপোর্ট ইস্যু, বিবাহ রেজিস্ট্রেশন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি, সরকারি বা বেসরকারি প্রনিষ্ঠানে নিয়োগপ্রাপ্তি, ড্রাইভিং লাইসেন্স ইস্যুসহ অন্যান্য নাগরিক সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তি প্রভৃতির আওতাবহির্ভূত থেকে যাবে চিরকাল?
রানা ভিক্ষু : পিএইচডি গবেষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
No comments