আদালতের রায় বাস্তবায়ন-প্রয়োজন সরকারের আন্তরিক উদ্যোগ
রাষ্ট্রের অন্যতম ভিত্তি হিসেবে আদালত ও সরকারের পারস্পরিক সম্পর্ক কী হওয়া উচিত তা নিয়ে সাম্প্রতিককালে বিস্তর আলোচনা উঠেছে। আদালত ও সরকারের দ্বৈরথে পাকিস্তানে গিলানি মন্ত্রিসভার পতন আলোচনায় নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। আদালতের রায়ে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা হারানোর নজিরবিহীন ঘটনাটি উপমহাদেশে তো বটেই, বিশ্বব্যাপী এক বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছে।
আইনজ্ঞ ও ওয়াকিবহাল ব্যক্তিরা বলছেন, এমন ঘটনা রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। বস্তুত, আধুনিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে চলতে হয়। জনকল্যাণ ও ন্যায়বিচার বড় বিবেচ্য, রাষ্ট্রীয় ও শাসনতান্ত্রিক স্থিতিশীলতাও অবজ্ঞার বিষয় নয়। বাংলাদেশে সম্প্রতি আদালত ও সংসদের মধ্যে জটিলতার আবহ রচিত হতে যাচ্ছিল। কিন্তু স্পিকারের বিজ্ঞজনোচিত রুলিংয়ে বিষয়টির সুষ্ঠু সমাধানের পথ খুলে গেছে। বস্তুত, আইনের শাসন, ন্যায়বিচার ও গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা নিশ্চিত করতে হলে রাষ্ট্রের ভিত্তিরূপী প্রতিষ্ঠানগুলোকে পারস্পরিক আস্থা ও সহযোগিতার ভিত্তিতেই কাজ করতে হবে। এক্ষেত্রে সরকার ও সরকারের নেতৃত্বে পরিচালিত নির্বাহী বিভাগের দায়িত্ব অনেক বড়। কোনো বিষয়ে আদালতের রায় পাওয়ার পর নির্বাহী বিভাগের দায়িত্ব হলো তা বাস্তবায়ন করা। রায় বাস্তবায়নের পথে অন্তরায় থাকলে তা আদালতকে অবহিত করে বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় সময় চেয়ে নেওয়া। কিন্তু জরুরি ও জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আদালতের রায় হওয়ার পর বাস্তবায়নের অপেক্ষায় মাসের পর মাস, বছরের পর বছর অতিক্রান্ত হলে তা নিয়ে জনমনে সংশয় দেখা দেয়। প্রথমত তা আদালতের আদেশ উপেক্ষা ও অমান্য করার শামিল। অন্যদিকে সরকারের আন্তরিকতা ও সদিচ্ছা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। ন্যায়বিচার, আইনের শাসন ও গণতান্ত্রিক রীতির জন্য এ পরিস্থিতি সুখকর নয়। দুঃখজনক হলেও সত্য, সাম্প্রতিককালে উচ্চ আদালত থেকে জনস্বার্থে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রায় এলেও বাস্তবায়িত হয়নি। বিশেষভাবে উল্লেখ্য, ঢাকা ও সংলগ্ন এলাকার চারটি নদী নিয়ে প্রাসঙ্গিক রায়। ২০০৯ সালের ২৫ জুন চার নদী রক্ষায় ১২ দফা নির্দেশনা সংবলিত রায় ঘোষণা হলেও সে রায় পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। রাজধানীকে বাসযোগ্য করা এবং এর পরিবেশ রক্ষার জন্য নদীগুলোকে দূষণ ও দখলমুক্ত করার দাবি দীর্ঘদিনের। এ নিয়ে নাগরিক আন্দোলন অব্যাহত রয়েছে। এ নিয়ে আদালতের রায়ের পর আর কোনো অজুহাতই কাজ করতে পারে না। কিন্তু কয়েক বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরও সরকারের তরফে উদ্যোগ সন্তোষজনক নয়। একই ধরনের সময়ক্ষেপণের ঘটনা ঘটেছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থান রক্ষা, শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতন, পাহাড় কাটা, সৈকত রক্ষা, ট্যানারি শিল্প স্থানান্তর, জেলায় জেলায় খাদ্য আদালত গঠন ও পাইরেসি বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার রায়ের ক্ষেত্রেও। প্রশ্ন উঠেছে, জনস্বার্থে দেওয়া আদালতের রায়গুলো নিয়ে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো কেন আন্তরিক নয়? এক্ষেত্রে সরকারের কোনো গাফিলতি আছে কি-না? রায় বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সরকার ও প্রশাসনের গাফিলতি থাকলে তা আদালত অবমাননার শামিল। এক্ষেত্রে সমস্যা কোথায় তা খতিয়ে দেখার দায়িত্ব সরকারের। একটি রায় ঘোষণার পর তা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অগ্রগতি তদারক করার অবকাঠামো ও লোকবল আদালতের নেই। দায়িত্বটি সরকারেরই। পরামর্শ এসেছে, আদালতের রায় যাতে নির্দেশিত পন্থায় বাস্তবায়িত হয় সেজন্য একটি মনিটরিং সেল গঠন করা যেতে পারে। এ সেল সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দফতরগুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধন করতে পারে। এ ধরনের উদ্যোগ দ্রুত হাতে নেওয়া উচিত। একের পর এক রায় অবাস্তবায়িত থাকা আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বড় ব্যত্যয় তৈরি করে। এ ধারাটি অব্যাহত থাকা উচিত নয়। আদালতের রায় বাস্তবায়নের জন্য সরকারের আন্তরিক উদ্যোগ দরকার। অতি দ্রুত যথোপযুক্ত নির্দেশনা দিয়ে আদালতের রায় বাস্তবায়ন করতে হবে।
No comments