সরল গরল-সংবিধান সংশোধনে কথা রাখবে আওয়ামী লীগ? by মিজানুর রহমান খান

বাহাত্তরের সংবিধানের অসাম্প্রদায়িক চেতনা ধারণ করি। সেটা ফিরে পেতে চাই। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই। ধর্মনিরপেক্ষতা চাই। প্রিয় কবি নির্মলেন্দু গুণ লিখেছিলেন, ‘তার আগে চাই সমাজতন্ত্র।’ তাঁর সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলি, তার আগে চাই ১৯৯১ সালে আওয়ামী লীগের নেতাদের সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাব বাস্তবায়ন।


এটা যদি না পাই, তাহলে ধরে নেব, আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করা হবে। বড় উপলক্ষ এলে অনেকেই দুই দলের মতৈক্য দেখতে ব্যাকুল হন। এটা একটা ফ্যাশন। মতৈক্যের বাগাড়ম্বর আশা করি না। ঢালাও মতৈক্যের বাগাড়ম্বর শাসকগোষ্ঠীর এজেন্ডা বাস্তবায়নে সহায়ক হয়। তাদের সংকীর্ণ চিন্তা-চেতনার বিকাশ ঘটায়। আধা গণতান্ত্রিক দ্বাদশ ও গণতন্ত্রবিরোধী ত্রয়োদশ সংশোধনী তার উৎকৃষ্ট নজির।
তাই সর্বোতভাবে মতৈক্যের বাগাড়ম্বর পরিহার করার আহ্বান জানাই। মতৈক্যের ঢোল পেটানো বন্ধ করুন। যেখানে যেটুকু ঐক্য দরকার, সেটা তারা না চাইলেও বজায় রেখে চলবে। সর্বাগ্রে দেখতে চাই, সভ্য দুনিয়ার মতো একটি সংবিধান আমরা পাচ্ছি কি পাচ্ছি না। আমি এখন পর্যন্ত তার কোনো আলামত দেখি না।
গণতন্ত্রের প্রতি আঘাত বলুন, আর সংসদীয় অভ্যুত্থান বলুন। সামরিক স্টাইলে সংবিধানের মৌলিক কাঠামো ধ্বংসের দায় আওয়ামী লীগকেও নিতে হবে। আর সেটা আওয়ামী লীগের নিজের স্বার্থে সবচেয়ে বেশি। তাদের ঐতিহাসিক ভুলগুলো শোধরানোর সুবর্ণ সময় এসেছে। চতুর্থ সংশোধনীতে প্রথম ক্যু ঘটেনি। বাহাত্তরের ৪ নভেম্বরে গণপরিষদীয় ক্যু হয়েছিল। এর দলিলপত্র আমাদের হাতে মজুদ আছে। এবং তা প্রমাণ দিচ্ছে যে, বাহাত্তরের সংবিধান দুধের নহর নয়। কোনো মৃতসঞ্জীবনী সুরা নয়। গণপরিষদীয় ওই ক্যুর মাধ্যমে প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী ক্ষমতা ব্যক্তির হাতে কুক্ষিগত করা হয়েছিল। বাহাত্তরের সংবিধান প্রণয়ন কমিটিকে সে জন্য দোষ দেব না। সব দোষ সামরিক শাসকদের দিলেও সত্য আড়ালে থাকবে।
বিশেষ সংসদীয় কমিটিতে বিএনপি না আসুক। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে বাদ দিয়ে সাজেদা চৌধুরীই সভাপতির পদ অলংকৃত করুক, তাতে কিছু আসে যায় না। কিন্তু বিল নেই, কমিটি হলো, কার্যপরিধি ঠিক হলো না। কী করে এটা বৈধ হলো— সে প্রশ্নও তুলব না। আইনমন্ত্রী বলেছিলেন, জামায়াত ইতিমধ্যেই অবৈধ হয়ে গেছে। অর্থাৎ ওটা লাশ হয়ে গেছে। রায় এলে দাফন হবে। সংবিধান নতুন করে ছাপা হবে। এরপর সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বললেন, সংবিধান সংশোধনের জন্য হাইকোর্টের দিকে তাকিয়ে থাকব না। বিল আনব। এরপর হঠাৎ প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা। আদালতের রায় বাস্তবায়নের জন্য সর্বদলীয় কমিটি হবে। বললেন, কোনো দল নিষিদ্ধ হবে না। এই স্ববিরোধিতাও চেপে যাব।
আদালতের রায় বাস্তবায়নের জন্য সংসদ কমিটি করে? শরিকদের নিয়ে সর্বদলীয় কমিটি? এসব নিয়েও এখন প্রশ্ন তুলব না। বলা হচ্ছে, আদালতের রায় এলে কার্যপরিধি ঠিক হবে। এটাও একটা বেঠিক কথা। কিন্তু তা নিয়েও প্রশ্ন তুলব না। শুধু অপেক্ষা করব, আওয়ামী লীগ কী ধরনের সংবিধান সংশোধন বিল আনে। আদালতের রায়ে কিছুটা মিলবে। অধিকাংশ প্রয়োজন মেটাবে না। তাই দেখার বিষয়, আওয়ামী লীগের তারকা নেতা-নেত্রীদের অতীতের সংশোধনী প্রস্তাবগুলো অন্তর্ভুক্ত হয় কি হয় না। নাকি বাহাত্তরের সংবিধানে ফেরার হুজুগে সব বরবাদ হয়ে যায়।
সৈয়দ আবুল মকসুদের লেখার আমি একজন মুগ্ধ পাঠক। তিনি ২২ জুলাই, ২০১০ লিখেছেন, রাষ্ট্রপতি পদ্ধতি থেকে সংসদীয় পদ্ধতিতে ফিরে আসা সম্ভব হয়েছে শেখ হাসিনার উদ্যোগেই। তিনি বেগম খালেদা জিয়াকে ‘আস্থায়’ নিয়েছিলেন। আমার মত হলো, শাসকগোষ্ঠী তখন একটা খোলস পাল্টিয়েছিল। ছিটেফোঁটা অগ্রগতি আছে। কিন্তু সংসদীয় পদ্ধতির নামে তারা কার্যত রাষ্ট্রপতি পদ্ধতিই বহাল রেখেছে। আগের রাষ্ট্রপতির যা ক্ষমতা, এখন প্রধানমন্ত্রীর তা-ই ক্ষমতা। রাষ্ট্রপতির যা চালচলন, প্রধানমন্ত্রীরও তা-ই। রবার দিয়ে ঘষার দাগ আছে। রাষ্ট্রপতি শব্দ মুছে প্রধানমন্ত্রী লেখা হয়।
সারা দেশে প্রত্যক্ষ গোপন ব্যালটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হতো। এই প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত হওয়া নিয়ে শেখ হাসিনার বেশি সংশয় ছিল। পাঁচ আসনে কখনো তিনি জেতেননি। এরশাদের জনপ্রিয়তা ফ্যাক্টর ছিল। বেগম খালেদা জিয়া ততক্ষণে জীবনে প্রথম প্রধানমন্ত্রী পদের দাবিদার। নাক কেটে যাত্রাভঙ্গ চাননি। কিংবা রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে নামার ঝুঁকিও হয়তো তিনি বিবেচনা করেছিলেন। এই সমীকরণে আমরা সেদিন ‘ঐকমত্য’ কিংবা তথাকথিত সংসদীয় গণতন্ত্র পেলাম। লেজুড় গণমাধ্যম ও বুদ্ধিজীবীরা যথারীতি ঐকমত্যের বাদ্য-বাদন বাজিয়েছিলেন।
গত দেড় দশকের সংবিধান-পাঠ ও সংবিধানের প্রয়োগ দেখে একটা কথা বলাতে আমাকে প্রায় বাধ্য করে। সেটা হলো বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠী তাদের সামরিক ও বেসামরিক লেবাস নির্বিশেষে মূলগতভাবে চতুর্থ সংশোধনীর শক্তি। এরা খামোখা পরস্পরকে গালাগালি করে। শাসক ও তদীয় স্তাবকদেরও শিরা-উপশিরায় চতুর্থ সংশোধনীর রক্ত বহমান। প্রমাণ চান? চতুর্থ সংশোধনীর কতিপয় বিধানাবলি টিকে আছে। পঞ্চম সংশোধনীর কতিপয় বিধানাবলি টিকে আছে। এটা কুঁজের মতো। কিন্তু তা বয়ে বেড়াতে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ লজ্জা পায় না। এবং পরিহাস হলো, এই কুঁজগুলোর অপসারণে আদালতেরও নজর এড়িয়ে যায়।
রাজনীতিকদের কাজ রাজনীতিকেরা করবেন। কিন্তু গণমাধ্যম ও লেখকেরা যেন এবার অহেতুক সাফাই না গাইতে বসেন। তাঁরা যেন শাসকের কায়েমি স্বার্থ হাসিলের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা থেকে বিরত থাকেন। বিএনপি কমিটিতে আসুক, সেটা চাইব। কিন্তু ততটা গুরুত্ব দেব না। দেখব, তাদের ঝোলা থেকে কী বেরোয়।
বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের রায় ঐতিহাসিক বলে বর্ণনা করেছেন প্রধানমন্ত্রী। কারণ এই রায় আওয়ামী লীগের চটকদার দলীয় এজেন্ডা সার্থক করার কাজে ব্যবহার করা সম্ভব হচ্ছে। সংবিধান সংশোধনীর নির্দেশনা রয়েছে—এমন বহু রায় আছে। সেসব নিয়ে দুই দলের কোনো মাতামাতি দেখি না। বিচারপতি খায়রুল হকের কথাই ধরা যাক। তিনি তো সিইসি আবদুল আজিজের মামলায় আরেকটি ঐতিহাসিক রায় দিয়েছেন। কিন্তু সেটা নিয়ে দৌড়ঝাঁপ নেই কেন? গণমাধ্যম সেটা ছাপতে জোশ পায় না। লেখকদেরও অরুচি। কারণ দুই নেত্রী ওটা এখনো ছুঁয়ে দেখেননি। ওঁদের ছোঁয়া না-ছোঁয়ার ওপর এই সমাজ-রাষ্ট্রে জাতে ওঠা কিংবা নামা নির্ভর করে।
ওই রায়কে ঐতিহাসিক বলে গণ্য করার কেউ নেই। কারণ কী? আমি বুঝি, এটা করলে বিচারকদের রাজনৈতিক ব্যবহারের পথ রুদ্ধ হবে। অবসরপ্রাপ্ত বিচারকদের পুরস্কৃত করার পথ বন্ধ হবে। প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। এমনকি এই রায় আমাদের বাহাত্তরের সংবিধানেও ফিরিয়ে নেবে। তাই বলি, আওয়ামী লীগ বাহাত্তরের সংবিধানে যাবে তার শর্তে। জনগণকে তা বুঝে নিতে হবে তার শর্তে।
সততার সঙ্গে রাজনৈতিক কর্মসূচি। আর ধূর্ততার সঙ্গে রাজনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণ এক কথা নয়। উভয়ের যাত্রা ও পরিণতি এক নয়। কোনো বুজরুকি গণতন্ত্রের জন্য সহায়ক হয় না। অনেকে বলবেন, গণতন্ত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে যাবে। অভিজ্ঞতা থেকে আমরা শিক্ষা নেব। ভুল করব। ছিটকে পড়ব। আবার উঠে দাঁড়াব। এই না হলে গণতন্ত্র! এর নাম যাঁরা গণতন্ত্র বলেন, আমি তাঁদের সমর্থন করতে পারি না। কারণ চালাকি দিয়ে গণতন্ত্র হয় না। কূটকৌশলের মাধ্যমে কোনো ভালো কিছু অর্জন সম্ভব নয়।
বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী সংবিধান সার্বভৌম। সংসদ সার্বভৌম নয়। সংবিধান ঠিক করে রেখেছে কার ক্ষমতা কত দূর। তদুপরি অন্তিমে সংসদই সার্বভৌম। রাজনীতির সৃষ্টি সংসদ। সংসদের সৃষ্টি সংবিধান। সংবিধানের সৃষ্টি সুপ্রিম কোর্ট। সুতরাং কূটতর্কে না গিয়ে বলা যায়, সংসদই বড়। তাই প্রস্তাবিত কমিটির কার্যপরিধি হবে সংবিধানের অধিকতর সংশোধন। সেটা করতে গিয়ে তারা শুধু আদালতের একটি নয়, সামগ্রিক রায় বিবেচনায় নেবে। বিবেচনায় নেবে সাংবিধানিক বিবর্তন। শুধু দেশের কেন, উপমহাদেশ কেন, গোটা বিশ্ব পড়ে থাকবে সামনে। কেবল দেখার মতো ডিজিটাল চশমা চাই।
বেশি দূরে নয়। ১৯৯১-তে ফেরা যাক। নূর হোসেনের রক্তের দাগ শুকায়নি। তখন আমরা কী দেখলাম। দেশ সংসদীয় গণতন্ত্রে ফিরছে। একটা শোরগোল তোলা হলো। ধূম্রজাল তৈরি করা হলো। শেখ মুজিবের প্রবর্তিত জিয়া-এরশাদের ব্যবহূত রাষ্ট্রপতি পদ্ধতিটাই বলির পাঁঠা হলো। সংবিধান সংশোধনের ভালো প্রস্তাবগুলো বিএনপি সেদিন নাকচ করেছিল। সেই প্রস্তাবগুলোকে ভবিষ্যদ্বাণী বলা যায়। এমনকি বলা চলে, বিশ্বকাপের মেরুদণ্ডহীন সুপারস্টার পল অক্টোপাসের মতো আমাদের তারকা নেতারা ওয়ান-ইলেভেন দেখতে পেয়েছিলেন।
শাসন ও শাসনতন্ত্রের গলদগুলো আমাদের অনেক রাজনীতিক ভালোই জানেন। সংবিধানের অসুখ কোথায়, তাও তাঁদের রপ্ত। প্রশ্ন একটাই, তাহলে তাঁরা ব্যর্থ হচ্ছেন কেন। কেন আজ তাঁরা বিশেষ কমিটির কার্যপরিধি ঠিক করতে অপারগ। কেন তবে ‘কণ্ঠ তাঁদের রুদ্ধ আজিকে বাঁশি সঙ্গীতহারা?’ ইহলোকে কাকে তাঁদের ভয়?
বিশেষ সংসদীয় কমিটির অনেকেরই আকর্ষণীয় অতীত রেকর্ড আছে। সেটা কীভাবে আছে, আসুন সেটা একটু দেখি। কৈয়ের তেলে কৈ ভাজি। বেগম মতিয়া চৌধুরীকে দিয়ে শুরু করি। যদিও সাজেদা চৌধুরী কমিটির সভাপতি। তদুপরি ধরে নেব মতিয়া চৌধুরীর কথা শেখ হাসিনা কিংবা সাজেদা চৌধুরী ঠেলতে পারবেন না।
বেগম মতিয়া চৌধুরী ৬ আগস্ট, ১৯৯১ সংসদে একটি সংবিধান সংশোধনী প্রস্তাব আনেন। তাতে বলা হলো, সাংসদদের গোপন ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হবেন। এটা একটি অতি উত্তম প্রস্তাব। কারণগুলো মতিয়া চৌধুরীর ভাষায় অবিকল এ রকম। ‘প্রথমত, আমার ভোট আমি দেব যাকে ইচ্ছা তাকে দেব। এটাই ভোটের প্রধান শর্ত। তাই আমি কারো সামনে আমার ভোটের গোপনীয়তা এবং পবিত্রতা লঙ্ঘন করতে পারি না। দ্বিতীয়ত, আমার দলীয় নেতার চোখের সামনে যদি আমাকে ভোট দিতে হয়, তাহলে অবস্থাটি কি হবে, তা বুঝতেই পারছেন। তৃতীয়ত, এটা শুধু রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ক্ষেত্রে নয়। আস্তে আস্তে সমস্ত ক্ষেত্রেই এটা প্রসারিত হবে। এটা একটা বাজে অনুশীলন। এটা ভোট ডাকাতির অপর একটি রূপ। চতুর্থত, আমাকে প্রকাশ্যে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করতে হচ্ছে। সেটার মাধ্যমে আমার দলের নেতাকে আল্লাহ তাআলার ওপরে স্থান দিতে হচ্ছে। আমার পার্টির নেতা অনেক বড় নেতা হতে পারেন, কিন্তু তিনি কিছুতেই আল্লাহ তাআলার ওপরে নন। বা সমকক্ষ হতে পারেন না।’
আমরা মনে করি, গোপন ব্যালটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হওয়া উচিত। রাশেদ মোশারফ সংসদে সাক্ষ্য দেন: ‘আমি ৭২-এর সংবিধান রচয়িতাদের একজন। ইলেকশন কমিশন গোপন ভোটের ব্যবস্থা করেছিল। যদিও একজন মাত্র প্রার্থী থাকায় ভোট হয়নি।’ তোফায়েল আহমেদ স্মরণ করিয়ে দেন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের জন্য সংবিধানে একটি তফসিল থাকতেই হবে। আওয়ামী লীগ সেদিন গণতন্ত্রের জন্য চোখের জল ফেলতে ফেলতে হাইকোর্টেও গিয়েছিল। আর এবার তারা কেমন হাসতে হাসতে বিএনপির তরিকায় উন্মুক্ত ব্যালটে জিল্লুর রহমানকে নির্বাচিত করেছে। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত পঞ্চম সংসদে বলেছিলেন, ‘এই রাষ্ট্রপতি পরবর্তীকালে ক্ষমতাচ্যুত হলে দরোজায় দারোজায় ফেরি করবেন।’ ১৬ বছর পর আমরা বন্দুকের নলে ‘ক্ষমতা-চ্যুত’ হতে দেখি শেখ হাসিনা বর্ণিত ইয়েসউদ্দিনকে। জরুরি অবস্থায় তাঁর কি ফেরি করা হয়নি?
মতিয়া চৌধুরীর আনা আরেকটি সংশোধন প্রস্তাব দেখুন। তিনি প্রস্তাব করেছিলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ সাপেক্ষে এই সংবিধান অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের নিকট ক্ষমতা রাষ্ট্রপতি কর্তৃক প্রযুক্ত হবে।’ লক্ষ করুন, বাহাত্তরের উল্লিখিত গণপরিষদীয় ক্যুর মাধ্যমে যে সর্বনাশ করা হয়েছিল, মতিয়া চৌধুরীর তা নজরে আসে ১৯ বছর পর। তবে তাঁর প্রচ্ছন্ন প্রস্তাবটি ঈষৎ ত্রুটিপূর্ণ। এখানেও ব্যক্তি তোষণ আছে। যেটা সঠিক সেটা হলো প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী ক্ষমতা থাকবে রাষ্ট্রপতির কাছে। আর সেটার প্রয়োগ ঘটবে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভার পরামর্শে। শুধু প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে নয়। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর যথার্থ মন্তব্য ছিল, পৃথিবীর কোনো সভ্য দেশের সংসদীয় ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর হাতে নির্বাহী ক্ষমতা থাকে না।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত গণতন্ত্রের পাঁচটি উপাদান সম্পর্কে মত দিয়েছিলেন। তিনি পাঁচ ধরনের সাংবিধানিক পদ পূরণে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার প্রয়োগ চেয়েছিলেন। এই দৃষ্টিভঙ্গি আমরা সমর্থন করি। প্রধান বিচারপতি ও সুপ্রিম কোর্টের বিচারক, সিইসি ও নির্বাচন কমিশনার, পিএসসির চেয়ারম্যান ও সদস্য, অ্যাটর্নি জেনারেল ও অডিটর জেনারেল। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছিলেন, এই পাঁচটি সাংবিধানিক পদে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতি যদি নিয়োগ দেন, তাহলে তাতে ভারসাম্য থাকবে। কেউ যদি বলেন, এখনো তো তা-ই হয়। রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করেই নিয়োগ দেন। কিন্তু এই রাষ্ট্রপতির কি কোনো ক্ষমতা আছে? এই রাষ্ট্রপতির কাছে কেউ কিছু আশা করে? বেনজির-নওয়াজ অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের মতো শুনানির মাধ্যমে এসব পদ পূরণে ঐক্য করেছিলেন। আমরা তেমন কোনো ব্যবস্থাও ভাবতে পারি। বিদ্যমান তুঘলকি নিয়োগব্যবস্থাটা অবশ্যই বদলাতে হবে। এখানে ‘বাহাত্তর’ ‘বাহাত্তর’ করলে চলবে না।
মন্ত্রিসভা যৌথভাবে সংসদের কাছে জবাবদিহি করবে। এটুকু সংবিধানে লেখা আছে। কিন্তু মন্ত্রীরা পৃথকভাবেও সংসদের কাছে দায়ী থাকবেন, সে কথা সংবিধানে বলা হয়নি। অথচ এ ক্ষেত্রে যথার্থ সংশোধনী প্রস্তাব দিয়েছিলেন বর্তমান বিশেষ কমিটির অন্যতম সদস্য আবদুল মতিন খসরু। অপর সদস্য ফজলে রাব্বী ঠিকই মনে করেন, ৭০(২) অনুচ্ছেদ গণতন্ত্রের পরিপন্থী। তিনি এর বিলুপ্তি চেয়ে নির্দিষ্ট প্রস্তাব আনেন। আওয়ামী লীগ দলগতভাবে প্রকাশ্যে ৭০ অনুচ্ছেদের অধিকতর সংশোধনের বিরোধিতা করে। এখানে যদিও একটা আঁতাতের খবর জানি। সাংসদদের কণ্ঠরোধের প্রচেষ্টায় শেখ হাসিনার সবুজ সংকেত ছিল। শেখ ফজলুল করিম সেলিমের প্রকাশ্য আহাজারি ছিল। সেটারই আজ আমরা মূল্য দেব। কারণ বৃক্ষ তোমার নাম কী, ফলে পরিচয়। শেখ সেলিম বলেছিলেন, ‘সংসদ সদস্যদের অধিকার খর্ব করে সার্বভৌম সংসদ প্রতিষ্ঠা করা যায় না। ভোটের সময় উপস্থিত না থাকলেই সংসদ সদস্যপদ খোয়া যাবে। এটা অগণতান্ত্রিকই নয়, অমানবিক বটে।’
এমন অনেক সুন্দর প্রস্তাবের খামতি নেই। তিয়াত্তরে ভুট্টোর সংবিধান মডেলে রাশেদ খান মেনন তো একটি বিল এনেছিলেন। লক্ষ্য—অবৈধ ক্ষমতা দখল প্রতিরোধ। পাঁচটি অনুচ্ছেদসংবলিত সালাহ উদ্দিন ইউসুফের সেই বিচারবিভাগের স্বাধীনতা বিল বিবেচনায় আনা হবে কি? প্রধানমন্ত্রী যে বিচারে বলেছেন, কমিটি হয়েছে আদালতের ‘নির্দেশনায়’। ভিন্ন মামলায় প্রায় তেমন ‘নির্দেশনা’ সংবিধানের ওই পাঁচ অনুচ্ছেদের বিষয়েও আছে। সাজেদা চৌধুরী বলেছেন, আমরা ‘ক্ষত সারিয়ে সুন্দর সংবিধান দেওয়ার চেষ্টা করব।’ তাঁর মুখে ফুলচন্দন পড়ুক। ২৯ জুলাইয়ের আসন্ন বৈঠকে যেন এই সিদ্ধান্ত হয় যে, আওয়ামী লীগ তার আগের সংশোধন প্রস্তাবগুলো আগে বিবেচনায় নেবে। ’৯১-তে তাদের আনা সংবিধান সংশোধন বিল ও পৃথক সংশোধনী প্রস্তাবগুলোর পূর্ণতা আমরা আশা করি।
বিশেষ কমিটির কার্যপরিধি নির্দিষ্ট হয়নি। কিন্তু আমি একটি বাক্য ধার দিচ্ছি। এটি চেতনাগতভাবে প্রায় অবিকল গ্রহণ করার দাবি রাখে। কারণ, এই বাক্যটিকে আমি যথেষ্ট নিরপেক্ষ বিবেচনা করি। বিরোধীদলীয় নেতাকেও অনুরোধ করি, এই বাক্যটি যেন তিনিও ধার নেন।
সেই বাক্যটি হলো: ‘আমি সংসদ নেত্রীকে আহ্বান জানাচ্ছি, আপনি একটি বিল নিয়ে আসুন, যে বিলে চতুর্থ সংশোধনী থেকে শুরু করে এরশাদের দশম সংশোধনী পর্যন্ত সব সংশোধনী বাতিলের ব্যবস্থা থাকবে। আমি দ্ব্যর্থহীনভাবে বলছি যে, এ ধরনের কোনো বিল আসলে আমরা অবশ্যই তাকে স্বাগত জানাবো এবং সে বিল পাস করার ব্যাপারে সব রকম সাহায্য সহযোগিতা করবো।’ ২ জুলাই, ১৯৯১ জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের নেতা শেখ হাসিনার উক্তি ছিল এটি। সংবিধান সংস্কারের বিরাট সুযোগ আমাদের সামনে। আমরা উভয় নেত্রীকে এই চেতনায় অগ্রসর হতে অনুরোধ জানাই।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.