বীজের অধিকার-জলবায়ু পরিবর্তন প্লাস খাদ্যনিরাপত্তা ইকুয়েল টু জিএম ধান! by ফরিদা আখতার
জলবায়ু পরিবর্তন যতই দুর্দশা বা সর্বনাশ বয়ে আনুক, কারও কারও ক্ষেত্রে পৌষ মাস হয়ে গেছে। আবহাওয়ার এই মতিগতি তাদের জন্য বড় ধরনের সুযোগ এনে দিয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের দোহাই দিয়ে প্রকৃতির এই বিরূপ মনোভাব যেন শুধু প্রযুক্তি ব্যবহার করলেই সমাধান হয়ে যাবে।
প্রকৃতি এমন বিরূপ আচরণ কেন করছে, তা যেন আর জানার বা বোঝার কোনো দরকার নেই। বৃষ্টি তো শুধু ক্যালেন্ডারের তারিখ দেখে হয় না, এর জন্য যে প্রাকৃতিক পরিবেশ দরকার তা কি আছে? গত বছর (২০০৯) ডিসেম্বর মাসে কোপেনহেগেনের ভেস্তে যাওয়া সম্মেলনের মূল বিষয় ছিল, ধনী দেশের প্রযুক্তিনির্ভর অতি ভোগবাদী জীবনব্যবস্থা পরিবর্তন করতে হবে, নইলে পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া চলতেই থাকবে, আর গরিব দেশ ডুবে মরবে।
যারা সুযোগ নিতে চায়, তাদের বড় একটি বিষয় হচ্ছে খাদ্যনিরাপত্তা। সম্প্রতি এ নিয়ে বেশ কথা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা কেন্দ্র (ইরি) ৫০ বছর পূর্তি বাংলাদেশে পালন করেছে, ভালো কথা, কিন্তু তাই বলে একেবারে আমাদের দেশে জিএম ধান (জেনেটিক্যালি মডিফাইড ধান) প্রবর্তনের সুযোগ নিতে হবে কেন? ১৩ জুলাই ২০১০ বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ইরি ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের যৌথ আয়োজনে এক বিশাল অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। এ অনুষ্ঠানে ইরির মহাপরিচালক রবার্ট জিগলারও উপস্থিত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই সভা উদ্বোধনকালে দেশের ১৫ কোটি মানুষের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রতিকূল পরিবেশ-সহনীয় নতুন জাতের ধান উদ্ভাবনের জন্য বিজ্ঞানীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি জানান, ইরির সহযোগিতায় ব্রির বিজ্ঞানীরা ব্রি ধান-৫১ ও ব্রি ধান-৫২ উদ্ভাবন করেছেন, যা বর্ষার পানিতে ডুবে গেলেও ফলন দেবে। অন্যদিকে কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী জানিয়েছেন, ইরির সহযোগিতায় বাংলাদেশ এ পর্যন্ত পাঁচটি হাইব্রিড ও ৫০টি উচ্চফলনশীল জাতের ধান উদ্ভাবন করেছে। দেশের ৭৫ শতাংশ জমিতে উফশী জাতের ধান চাষ হয় এবং ৮৭ শতাংশ চাল আসে এই জাত থেকে। তিনি ইরির কাছে অল্প দিনে উৎপাদিত হয় ও লবণাক্তসহিষ্ণু জাত উদ্ভাবনে সহযোগিতা চান। খাদ্যমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক আরেক ধাপ এগিয়ে ইরির বিজ্ঞানীদের সুপার রাইস ও গোল্ডন রাইস উদ্ভাবনের কথা বলতে গিয়ে বললেন, বাংলাদেশের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এই জাতগুলো কাজে লাগানোর ব্যাপারে ইরির সহযোগিতার প্রয়োজন।
প্রথমত বলে রাখি, ইরির ৫০ বছর পূর্তির অনুষ্ঠান বাংলাদেশে করা ইরির জন্য খুব লাভ হয়েছে বটে, কিন্তু বাংলাদেশের জন্য ক্ষতি হয়েছে। খোদ ইরি যে দেশে অবস্থিত, সেই ফিলিপাইনসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ২০০৯ সাল থেকে ইরির ৫০ বছর উপলক্ষে কৃষক সংগঠনের পক্ষ থেকে পরিষ্কারভাবে বলা হচ্ছে, ৫০ বছর যথেষ্ট, আর নয়; এবার আমাদের রেহাই দাও। তার কারণ, গত শতাব্দীর ষাটের দশকে আধুনিক কৃষি প্রবর্তন করে কৃষকদের উপকারের চেয়ে অপকার হয়েছে অনেক বেশি। এশিয়ার হাজার হাজার জাতের ধান ইরির জিন ব্যাংকে রেখে মাত্র ৫০টি ধান তারা দিয়েছে, যা উৎপাদন করতে গিয়ে অতি মাত্রায় রাসায়নিক সার, কীটনাশক, ভূগর্ভস্থ পানি তুলে পরিবেশের বারোটা বেজে গেছে। ইরির বিরুদ্ধে প্রধান আপত্তি হচ্ছে, ইরি তার জিন ব্যাংকের সংগ্রহের জন্য ভারত, বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়াসহ এশিয়ার সব ধান উৎপাদনকারী দেশ থেকে হাজার হাজার জাতের ধান নিয়ে দিয়েছে মাত্র ৫০টি। শুধু তাই নয়, এ কাজ করার জন্য বিশ্বব্যাংকের মতো দাতারা শুধু ইরির বামুন জাতের উফশী ধান (যা সার-কীটনাশক ছাড়া উৎপাদিত হবে না) উপহার দিয়েছে এবং সেই ধানই উৎপাদন করতে কৃষকদের বলা যায় বাধ্য করা হয়েছে। এর ফলে ধানের বৈচিত্র্য হ্রাস পেয়েছে। ইরি কৃষকদের বীজ দিয়ে সহায়তা না করে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের নামে বহুজাতিক কোম্পানি যেমন—মনসান্তো, সিনজন্তার হাতে ধানের বীজ সহজলভ্য করে দিয়েছে। তা ছাড়া নিজের প্রযুক্তির ভুল স্বীকার না করে একটির পর একটি প্রযুক্তিনির্ভর ধান দিয়ে যাচ্ছে। উফশী ধানের পর দেওয়া হলো হাইব্রিড ধান। এখন জলবায়ু পরিবর্তনের দোহাই দিয়ে জিএম ধান বাংলাদেশের মতো দেশে প্রবর্তনের চেষ্টা করা হচ্ছে। ইরি উফশী ধান শেষ পর্যন্ত উচ্চ ফলনের মাত্রা ধরে রাখতে পারেনি। হাইব্রিড বীজ আনার পর কৃষক বীজ হাতে রাখতে পারছেন না। জিএম ধান আনা হলে কৃষকের ধান বলে কিছুই থাকবে না। কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। আমরা কি তাই চাই?
রবার্ট জিগলার প্রথম আলোর কাছে একটি সাক্ষাৎকারে (১৬ জুলাই, ২০১০ প্রকাশিত) ইরির অনেক গুণগান করেছেন। মহাপরিচালক হিসেবে তাঁর তা করারই কথা। এতে আমার বলার কিছু নেই। কিন্তু ইরি যদি এতই সফল হবে, তাহলে এখনো এত খাদ্যঘটতি থাকে কেন? ধান উৎপাদনকারী দেশ ধান আমদানিকারী হয় কেন? ভেতো বাঙালিকে রুটি আর আলু খেতে বলা হয় কেন? ইফতেখার মাহমুদের নেওয়া এই সাক্ষাৎকারের একটি বাক্য পড়ে খুব কৌতুক অনুভব করেছি, তা হচ্ছে, ‘কোন ধরনের জিন-বৈশিষ্ট্যের কারণে দুই সপ্তাহ পানির নিচে থাকলেও ধান নষ্ট হবে না, তা ইরির কাছ থেকেই ব্রির বিজ্ঞানীরা জেনে কাজে লাগিয়েছেন। তবে এই জ্ঞানকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে হলে আরও উচ্চতর প্রশিক্ষণ প্রয়োজন।’ এ ধরনের কথার বিরুদ্ধে আমাদের বিজ্ঞানীরা কোনো প্রতিবাদ কেন করেননি, আমি জানি না। তবে আমাদের কৃষকদের যে জ্ঞান আছে, তার জন্য ইরির কাছে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। আমি এই লেখাটি লেখার সময় টাঙ্গাইলের মামুদপুর গ্রামের কৃষক মাইনুদ্দিনের কাছ থেকে জানলাম, এমন জাতের ধান অনেক আছে; যেমন—পাট জাগ, লাল ঢেপা, সাদা ঢেপা, চামারা, হিজল দিঘা, কার্তিক ঝুল ইত্যাদি। তিনি বললেন, এই ধান দু-তিন সপ্তাহ পানিতে থাকলেও নষ্ট হয় না, কুশি থাকলেই আবার ধান হবে। এ তথ্য পেতে আমার পাঁচ মিনিট সময়ও লাগেনি। তাহলে বিজ্ঞানীরা কষ্ট করে নিজের মানমর্যাদা বিসর্জন দিয়ে কেন ইরির কাছে জ্ঞান নিতে যাচ্ছেন? ইরি তাদের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ছাড়া আর কী দেবে, তাই তো উচ্চতর প্রশিক্ষণের কথা উঠছে। জিগলার অবশ্য শুধু ধানের জিন নয়, আমাদের বিজ্ঞানীদের জিন সম্পর্কেও জেনে ফেলেছেন। একই দিনের প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠায় উদ্ধৃতিতে বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের সম্পর্কে জিগলারের একটি মন্তব্য দেওয়া হয়েছে, ‘তাঁদের অনেকেই উচ্চতর ডিগ্রি ও প্রশিক্ষণ নিতে বিদেশে গেলে আর দেশে ফেরেন না।’
এ বছরের বাজেটে (২০১০-১১) বিআর-৪৭ ধানের চাষের জন্য নির্দিষ্ট বরাদ্দ রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণের কথা বলে উপকূলীয় অঞ্চলের ১০ লাখ হেক্টর লবণাক্ত এলাকার ৫০ শতাংশ জমিতে লবণাক্ততা প্রতিরোধক বিআর-৪৭ ধান আবাদের কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে। নয়া কৃষি আন্দোলনের পক্ষ থেকে বাজেটের পর সংবাদ সম্মেলন (১৭ জুন, ২০১০) করে আমরা বলেছিলাম, আমাদের দেশের দক্ষিণাঞ্চলে বেশ কয়েকটি স্থানীয় জাতের ধান, যার মধ্যে অনেকগুলোরই উচ্চ ফলনের সম্ভাবনা আছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে কালা বোরো, খৈয়া বোরো, চৈতা বোরো ও টোপা বোরো। এসব দেশীয় জাতের ধান স্থানীয় আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলা করতে পারে। সরকার এমন ধান উৎপাদনে সহযোগিতা না করে নতুন ধান প্রচলন করছে, যা ইতিমধ্যে কৃষকের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। ২০০৯-১০ সালে বিআর-৪৭ উপকূলীয় অঞ্চলে সাফল্য দেখাতে পারেনি। এ তথ্য সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে, আবার দক্ষিণাঞ্চলের বিজ্ঞানীরাও বলেছেন। আমরা দাবি করেছি, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে কৃষকের জন্য গ্রহণযোগ্য এবং এলাকার পরিবেশের সঙ্গে খাপ খায়—এমন স্থানীয় জাতের ধান উৎপাদন করার জন্য সহায়তা দেওয়া হোক। জিগলার সাহেবও ধানটি পছন্দ করেননি। তিনি সমালোচনা করে বলেছেন, ‘এই জাতটির প্রধান সমস্যা হচ্ছে, তা পাকার পর কেটে আনার সময় মাটিতে ঝরে যায়, ফলে প্রচুর ধান নষ্ট হয়।’ দেখা যাক, সরকার এখন কী করে। তবে ইরি এই ধানকে জেনেটিক্যালি পরিবর্তন করতে চায় কি না, তা দেখার বিষয়।
সাক্ষাৎকারে জিগলারের মাধ্যমে বাংলাদেশে ইরির ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা জানা গেল। তিনি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রে উদ্ভাবিত গোল্ডেন রাইস বা সোনালি ধানকে বাংলাদেশের কৃষকের কাছে পরিচয় করিয়ে দেওয়া ও চাষে উদ্বুদ্ধ করা হবে ইরির সামনের দিনের সবচেয়ে বড় পরিকল্পনা। তাঁর মতে, এই ধানটি কৃষকদের ভিটামিন ‘এ’-এর চাহিদাও পূরণ করবে। এর অর্থ হচ্ছে, ইরিকে ৫০ বছর পালন করার সুযোগ দিয়ে আমরা তাদের নিজস্ব এজেন্ডা বাস্তবায়নের সুযোগ করে দিচ্ছি। সেই এজেন্ডা আর কিছুই নয়, ধানের বৈচিত্র্যের এই দেশে জিএম ধান প্রবর্তন, যা এই দেশের ধানের প্রতি হুমকি সৃষ্টি করবে। গোল্ডেন রাইসের কাজ শুরু হয়েছে চারদলীয় জোট সরকারের আমলে। জোট সরকারের কৃষিমন্ত্রী এম কে আনোয়ার ২০০৫ সালের জানুয়ারি মাসে বিবিসিকে বলেছিলেন, তাঁর সরকার এই ধান প্রবর্তন করতে চান। আমরা তখন প্রতিবাদ করেছিলাম। বর্তমান সরকারের কাছে জোট সরকারের সব কিছু খারাপ; তাহলে কি আশা করতে পারি যে অন্তত এই সরকার তাদের ঘোষিত একটি কর্মসূচি পালনের দায়িত্ব নেবে না?
ফরিদা আখতার: নারীনেত্রী, উন্নয়নকর্মী।
যারা সুযোগ নিতে চায়, তাদের বড় একটি বিষয় হচ্ছে খাদ্যনিরাপত্তা। সম্প্রতি এ নিয়ে বেশ কথা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা কেন্দ্র (ইরি) ৫০ বছর পূর্তি বাংলাদেশে পালন করেছে, ভালো কথা, কিন্তু তাই বলে একেবারে আমাদের দেশে জিএম ধান (জেনেটিক্যালি মডিফাইড ধান) প্রবর্তনের সুযোগ নিতে হবে কেন? ১৩ জুলাই ২০১০ বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ইরি ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের যৌথ আয়োজনে এক বিশাল অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। এ অনুষ্ঠানে ইরির মহাপরিচালক রবার্ট জিগলারও উপস্থিত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই সভা উদ্বোধনকালে দেশের ১৫ কোটি মানুষের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রতিকূল পরিবেশ-সহনীয় নতুন জাতের ধান উদ্ভাবনের জন্য বিজ্ঞানীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি জানান, ইরির সহযোগিতায় ব্রির বিজ্ঞানীরা ব্রি ধান-৫১ ও ব্রি ধান-৫২ উদ্ভাবন করেছেন, যা বর্ষার পানিতে ডুবে গেলেও ফলন দেবে। অন্যদিকে কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী জানিয়েছেন, ইরির সহযোগিতায় বাংলাদেশ এ পর্যন্ত পাঁচটি হাইব্রিড ও ৫০টি উচ্চফলনশীল জাতের ধান উদ্ভাবন করেছে। দেশের ৭৫ শতাংশ জমিতে উফশী জাতের ধান চাষ হয় এবং ৮৭ শতাংশ চাল আসে এই জাত থেকে। তিনি ইরির কাছে অল্প দিনে উৎপাদিত হয় ও লবণাক্তসহিষ্ণু জাত উদ্ভাবনে সহযোগিতা চান। খাদ্যমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক আরেক ধাপ এগিয়ে ইরির বিজ্ঞানীদের সুপার রাইস ও গোল্ডন রাইস উদ্ভাবনের কথা বলতে গিয়ে বললেন, বাংলাদেশের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এই জাতগুলো কাজে লাগানোর ব্যাপারে ইরির সহযোগিতার প্রয়োজন।
প্রথমত বলে রাখি, ইরির ৫০ বছর পূর্তির অনুষ্ঠান বাংলাদেশে করা ইরির জন্য খুব লাভ হয়েছে বটে, কিন্তু বাংলাদেশের জন্য ক্ষতি হয়েছে। খোদ ইরি যে দেশে অবস্থিত, সেই ফিলিপাইনসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ২০০৯ সাল থেকে ইরির ৫০ বছর উপলক্ষে কৃষক সংগঠনের পক্ষ থেকে পরিষ্কারভাবে বলা হচ্ছে, ৫০ বছর যথেষ্ট, আর নয়; এবার আমাদের রেহাই দাও। তার কারণ, গত শতাব্দীর ষাটের দশকে আধুনিক কৃষি প্রবর্তন করে কৃষকদের উপকারের চেয়ে অপকার হয়েছে অনেক বেশি। এশিয়ার হাজার হাজার জাতের ধান ইরির জিন ব্যাংকে রেখে মাত্র ৫০টি ধান তারা দিয়েছে, যা উৎপাদন করতে গিয়ে অতি মাত্রায় রাসায়নিক সার, কীটনাশক, ভূগর্ভস্থ পানি তুলে পরিবেশের বারোটা বেজে গেছে। ইরির বিরুদ্ধে প্রধান আপত্তি হচ্ছে, ইরি তার জিন ব্যাংকের সংগ্রহের জন্য ভারত, বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়াসহ এশিয়ার সব ধান উৎপাদনকারী দেশ থেকে হাজার হাজার জাতের ধান নিয়ে দিয়েছে মাত্র ৫০টি। শুধু তাই নয়, এ কাজ করার জন্য বিশ্বব্যাংকের মতো দাতারা শুধু ইরির বামুন জাতের উফশী ধান (যা সার-কীটনাশক ছাড়া উৎপাদিত হবে না) উপহার দিয়েছে এবং সেই ধানই উৎপাদন করতে কৃষকদের বলা যায় বাধ্য করা হয়েছে। এর ফলে ধানের বৈচিত্র্য হ্রাস পেয়েছে। ইরি কৃষকদের বীজ দিয়ে সহায়তা না করে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের নামে বহুজাতিক কোম্পানি যেমন—মনসান্তো, সিনজন্তার হাতে ধানের বীজ সহজলভ্য করে দিয়েছে। তা ছাড়া নিজের প্রযুক্তির ভুল স্বীকার না করে একটির পর একটি প্রযুক্তিনির্ভর ধান দিয়ে যাচ্ছে। উফশী ধানের পর দেওয়া হলো হাইব্রিড ধান। এখন জলবায়ু পরিবর্তনের দোহাই দিয়ে জিএম ধান বাংলাদেশের মতো দেশে প্রবর্তনের চেষ্টা করা হচ্ছে। ইরি উফশী ধান শেষ পর্যন্ত উচ্চ ফলনের মাত্রা ধরে রাখতে পারেনি। হাইব্রিড বীজ আনার পর কৃষক বীজ হাতে রাখতে পারছেন না। জিএম ধান আনা হলে কৃষকের ধান বলে কিছুই থাকবে না। কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। আমরা কি তাই চাই?
রবার্ট জিগলার প্রথম আলোর কাছে একটি সাক্ষাৎকারে (১৬ জুলাই, ২০১০ প্রকাশিত) ইরির অনেক গুণগান করেছেন। মহাপরিচালক হিসেবে তাঁর তা করারই কথা। এতে আমার বলার কিছু নেই। কিন্তু ইরি যদি এতই সফল হবে, তাহলে এখনো এত খাদ্যঘটতি থাকে কেন? ধান উৎপাদনকারী দেশ ধান আমদানিকারী হয় কেন? ভেতো বাঙালিকে রুটি আর আলু খেতে বলা হয় কেন? ইফতেখার মাহমুদের নেওয়া এই সাক্ষাৎকারের একটি বাক্য পড়ে খুব কৌতুক অনুভব করেছি, তা হচ্ছে, ‘কোন ধরনের জিন-বৈশিষ্ট্যের কারণে দুই সপ্তাহ পানির নিচে থাকলেও ধান নষ্ট হবে না, তা ইরির কাছ থেকেই ব্রির বিজ্ঞানীরা জেনে কাজে লাগিয়েছেন। তবে এই জ্ঞানকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে হলে আরও উচ্চতর প্রশিক্ষণ প্রয়োজন।’ এ ধরনের কথার বিরুদ্ধে আমাদের বিজ্ঞানীরা কোনো প্রতিবাদ কেন করেননি, আমি জানি না। তবে আমাদের কৃষকদের যে জ্ঞান আছে, তার জন্য ইরির কাছে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। আমি এই লেখাটি লেখার সময় টাঙ্গাইলের মামুদপুর গ্রামের কৃষক মাইনুদ্দিনের কাছ থেকে জানলাম, এমন জাতের ধান অনেক আছে; যেমন—পাট জাগ, লাল ঢেপা, সাদা ঢেপা, চামারা, হিজল দিঘা, কার্তিক ঝুল ইত্যাদি। তিনি বললেন, এই ধান দু-তিন সপ্তাহ পানিতে থাকলেও নষ্ট হয় না, কুশি থাকলেই আবার ধান হবে। এ তথ্য পেতে আমার পাঁচ মিনিট সময়ও লাগেনি। তাহলে বিজ্ঞানীরা কষ্ট করে নিজের মানমর্যাদা বিসর্জন দিয়ে কেন ইরির কাছে জ্ঞান নিতে যাচ্ছেন? ইরি তাদের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ছাড়া আর কী দেবে, তাই তো উচ্চতর প্রশিক্ষণের কথা উঠছে। জিগলার অবশ্য শুধু ধানের জিন নয়, আমাদের বিজ্ঞানীদের জিন সম্পর্কেও জেনে ফেলেছেন। একই দিনের প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠায় উদ্ধৃতিতে বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের সম্পর্কে জিগলারের একটি মন্তব্য দেওয়া হয়েছে, ‘তাঁদের অনেকেই উচ্চতর ডিগ্রি ও প্রশিক্ষণ নিতে বিদেশে গেলে আর দেশে ফেরেন না।’
এ বছরের বাজেটে (২০১০-১১) বিআর-৪৭ ধানের চাষের জন্য নির্দিষ্ট বরাদ্দ রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণের কথা বলে উপকূলীয় অঞ্চলের ১০ লাখ হেক্টর লবণাক্ত এলাকার ৫০ শতাংশ জমিতে লবণাক্ততা প্রতিরোধক বিআর-৪৭ ধান আবাদের কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে। নয়া কৃষি আন্দোলনের পক্ষ থেকে বাজেটের পর সংবাদ সম্মেলন (১৭ জুন, ২০১০) করে আমরা বলেছিলাম, আমাদের দেশের দক্ষিণাঞ্চলে বেশ কয়েকটি স্থানীয় জাতের ধান, যার মধ্যে অনেকগুলোরই উচ্চ ফলনের সম্ভাবনা আছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে কালা বোরো, খৈয়া বোরো, চৈতা বোরো ও টোপা বোরো। এসব দেশীয় জাতের ধান স্থানীয় আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলা করতে পারে। সরকার এমন ধান উৎপাদনে সহযোগিতা না করে নতুন ধান প্রচলন করছে, যা ইতিমধ্যে কৃষকের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। ২০০৯-১০ সালে বিআর-৪৭ উপকূলীয় অঞ্চলে সাফল্য দেখাতে পারেনি। এ তথ্য সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে, আবার দক্ষিণাঞ্চলের বিজ্ঞানীরাও বলেছেন। আমরা দাবি করেছি, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে কৃষকের জন্য গ্রহণযোগ্য এবং এলাকার পরিবেশের সঙ্গে খাপ খায়—এমন স্থানীয় জাতের ধান উৎপাদন করার জন্য সহায়তা দেওয়া হোক। জিগলার সাহেবও ধানটি পছন্দ করেননি। তিনি সমালোচনা করে বলেছেন, ‘এই জাতটির প্রধান সমস্যা হচ্ছে, তা পাকার পর কেটে আনার সময় মাটিতে ঝরে যায়, ফলে প্রচুর ধান নষ্ট হয়।’ দেখা যাক, সরকার এখন কী করে। তবে ইরি এই ধানকে জেনেটিক্যালি পরিবর্তন করতে চায় কি না, তা দেখার বিষয়।
সাক্ষাৎকারে জিগলারের মাধ্যমে বাংলাদেশে ইরির ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা জানা গেল। তিনি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রে উদ্ভাবিত গোল্ডেন রাইস বা সোনালি ধানকে বাংলাদেশের কৃষকের কাছে পরিচয় করিয়ে দেওয়া ও চাষে উদ্বুদ্ধ করা হবে ইরির সামনের দিনের সবচেয়ে বড় পরিকল্পনা। তাঁর মতে, এই ধানটি কৃষকদের ভিটামিন ‘এ’-এর চাহিদাও পূরণ করবে। এর অর্থ হচ্ছে, ইরিকে ৫০ বছর পালন করার সুযোগ দিয়ে আমরা তাদের নিজস্ব এজেন্ডা বাস্তবায়নের সুযোগ করে দিচ্ছি। সেই এজেন্ডা আর কিছুই নয়, ধানের বৈচিত্র্যের এই দেশে জিএম ধান প্রবর্তন, যা এই দেশের ধানের প্রতি হুমকি সৃষ্টি করবে। গোল্ডেন রাইসের কাজ শুরু হয়েছে চারদলীয় জোট সরকারের আমলে। জোট সরকারের কৃষিমন্ত্রী এম কে আনোয়ার ২০০৫ সালের জানুয়ারি মাসে বিবিসিকে বলেছিলেন, তাঁর সরকার এই ধান প্রবর্তন করতে চান। আমরা তখন প্রতিবাদ করেছিলাম। বর্তমান সরকারের কাছে জোট সরকারের সব কিছু খারাপ; তাহলে কি আশা করতে পারি যে অন্তত এই সরকার তাদের ঘোষিত একটি কর্মসূচি পালনের দায়িত্ব নেবে না?
ফরিদা আখতার: নারীনেত্রী, উন্নয়নকর্মী।
No comments