গণমাধ্যম-সাংবাদিকের নিরাপত্তা ও রাষ্ট্রের জবাবদিহি by জহিরুল আলম
সাংবাদিকদের নিরাপত্তার কী অবস্থা এবং দোষী ব্যক্তিরা কেন, কীভাবে, কাদের প্রশ্রয়ে রেহাই পেয়ে যায় অথবা আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে—এই বিষয়গুলো জোরালোভাবে আলোচিত হয়েছিল গত মার্চে প্যারিসে ইউনেসকোর দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে।
আশা করা হচ্ছিল, সদস্য দেশগুলো এ-সংক্রান্ত একটি পরিকল্পনা ‘ইউএন প্ল্ল্যান অব অ্যাকশন অন দ্য সেফটি অব জার্নালিস্টস অ্যান্ড দ্য ইস্যু অব ইমপিউনিটি’ শিরোনামে একটি প্রস্তাব আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদন করবে। কিন্তু বেশ কটি দেশ তাতে প্রবল আপত্তি জানাল। আলোচনাটি শুরু হয়েছিল জাতিসংঘের ১৭৩৮ নম্বর প্রস্তাবটিকে আরও বিস্তৃত করে সাংবাদিক নির্যাতন রোধ এবং নিরাপত্তার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করার জন্য। যার লক্ষ্য ছিল, সদস্য দেশগুলো যাতে সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে এবং নির্যাতন বা হত্যাকাণ্ডে জড়িত ব্যক্তিদের যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত করতে সর্বজনীন ও নিজস্ব আইন কার্যকরভাবে প্রয়োগ করতে পারে।
কিন্তু দেখা গেল, ব্রাজিল, ভেনেজুয়েলা, কিউবার মতো দেশ তো বটেই, এমনকি ভারত ও পাকিস্তানও অবস্থান নিল ওই উদ্যোগের বিপক্ষে। প্রস্তাবটি আরও ঘষা-মাজার পরামর্শ দিয়ে লিখিত মতামত উপস্থাপন করল বাংলাদেশও। কাজেই মার্চে পরিকল্পনাটি আর গৃহীত হলো না। আশার কথা, শেষ পর্যন্ত গত ১৩ এপ্রিল ২০১২ ইউএন প্রধান নির্বাহীদের বোর্ড এই প্রস্তাবটি অনুমোদন করে। আশা করা যায়, এর ফলে বিশ্বজুড়ে সাংবাদিকদের জন্য নিরাপদ কাজের পরিবেশ তৈরির ক্ষেত্রে ঐক্যবদ্ধভাবে কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়া হবে। সাংবাদিকদের জন্য এই সময়ে পাকিস্তান, আফগানিস্তান, নাইজেরিয়া, লিবিয়া, ইরাকের ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতির কথা কারও অজানা নয়। বাংলাদেশের নামও এর সঙ্গে যুক্ত হবে কি না বলা মুশকিল। অতীতের ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড এবং সাম্প্রতিক সাংবাদিক নির্যাতনের আরও কিছু ঘটনাপ্রবাহ আমাদের সত্যিই বিচলিত ও বিমর্ষ করে তুলেছে। সাগর-রুনিসহ এমন বহু হত্যার বিচার না হওয়া যেমন উদ্বেগের ও দুর্ভাগ্যের, তেমনই বিষয়টি খুবই স্পষ্ট যে দোষী বা দায়ী ব্যক্তিদের ছাড় দেওয়ার লক্ষণ বা আইনের আওতায় না আনার বাস্তবতা গণমাধ্যমকর্মীদের নিরাপত্তাকে আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। একটি জবাবদিহি গণতান্ত্রিক সমাজ তৈরির ক্ষেত্রে বাক ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য সাংবাদিকদের জীবনের নিরাপত্তা দেওয়া অত্যন্ত জরুরি। সর্বজনীন মানবাধিকার সনদের আর্টিকেল-১৯ সমুন্নত রাখতেও এটি প্রয়োজন। গত এক দশকে গোটা বিশ্বে পাঁচ শতাধিক সাংবাদিক ও মিডিয়াকর্মী পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নিহত হন। কেবল ২০১১ সালেই প্রাণ হারিয়েছেন ৬২ জন সাংবাদিক। ইন্টারন্যাশনাল ফ্রিডম অব এক্সপ্রেশনস এক্সচেঞ্জ আইএফইএক্সের হিসাবমতে, বিশ্বে যত সাংবাদিক হত্যা, নির্যাতন ও হামলার শিকার হয়েছেন, গড়ে এর ১০টি ঘটনার মধ্যে ৯টিরই বিচার হয়নি। বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা ব্যতিক্রম কিছু নয়।
সংবাদমাধ্যম নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি হাবিবুর রহমান তাঁর এক লেখায় ১০টি প্রধান জাতীয় দৈনিকের দেওয়া তথ্য উল্ল্লেখ করে সম্প্রতি বলেছেন: ২০১১ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ১৫৪টি। এসব ঘটনার শিকার হয়েছেন ২৮৮ জন সাংবাদিক। চলতি বছরের গত কয়েক মাসে ৩২টি ঘটনায় ৭৪ জন সাংবাদিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। সর্বশেষ খুন হলেন সাগর ও রুনি দম্পতি।
যে সমাজে সাংবাদিকেরা নিরাপদ নয়, সেখানে জনগণের তথ্য পাওয়ার অধিকার সীমিত হয়ে পড়ে—লঙ্ঘিত হয় সর্বজনীন মানবাধিকার। বাধাগ্রস্ত হয় সব শুভ উদ্যোগ। দারিদ্র্য বিমোচনের চেষ্টা, সুশাসনের আকাঙ্ক্ষা, শিক্ষা বিস্তার, ব্যবসা-বাণিজ্য-বিনিয়োগ, কাজের সুযোগ, জলবায়ু সুরক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন—কোনো কিছুই আর সঠিক পথে এগোতে পারে না। সমাজকে দুর্নীতি গ্রাস করে। সে অর্থে সাংবাদিকদের নিরাপত্তাহীনতা গোটা সমাজকেই বঞ্চিত ও অরক্ষিত করে ফেলে। সেই ভীতি থেকে তৈরি হয় এক ধরনের সেলফ সেন্সরশিপ। একটি গণতান্ত্রিক সমাজে এটা কিছুতেই কাম্য হতে পারে না। আর সে জন্যই সাংবাদিকদের ভয়-ভীতি প্রদর্শন, নির্যাতন, নিপীড়ন বা হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়ার পরই কেবল শুধু বিচারের দাবি তোলা এবং সে দাবি আদায়ের জন্য সংগ্রাম করাই যথেষ্ঠ নয়, প্রয়োজন এসব ঘটনা প্রতিরোধের জন্য আগাম রক্ষাকবচ। সাম্প্রতিককালে সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা নিয়ে সাংবাদিক সমাজের ঐক্যবদ্ধ উচ্চারণ অনেককেই আশাবাদী করেছে। বিচারপতি হাবিবুর রহমান বলেন, ‘সুবিচার পাওয়ার ব্যাপারে সাংবাদিকদের দুই ইউনিয়ন এক হবে—এ ব্যাপারে আশাবাদী হয়ে বেঁচে থাকতে চাই।’ সাংবাদিক নির্যাতন, প্রহারের ঘটনার প্রতিবাদে সাংবাদিকেরা যখন এক হওয়ার চেষ্টা করছেন, ঠিক সেই সময় ‘...রসুনের কোয়ার এক গুট্টি’ অভিহিত করে সাংবাদিকদের ঐক্যকে কটাক্ষ করলেন একজন মন্ত্রী। সম্ভবত এই ঐক্য তাঁর পছন্দ হয়নি। এই ঐক্য সম্ভবত স্বার্থান্বেষী এমন আরও বহু মানুষেরই পছন্দ নয়।
আরেকটি বিষয়, সম্প্রতি মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমানের কিছু কথা শুনে মনটা খুব খারাপ হয়। তাঁর মতে, আজকাল অনেকেই সাংবাদিকতার পরিচয়ে দুর্বৃত্তায়ন শুরু করেছে। তাঁকে ধন্যবাদ যে তিনি তাঁর মূল্যায়ন তুলে ধরেছেন। সাংবাদিকতা এবং সাংবাদিকদের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছেন আত্মজিজ্ঞাসার। বর্তমানে সাংবাদিকতা একদিকে যেমন কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে, তেমনি গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও নীতি-নৈতিকতার বিষয়টি আগের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বের সঙ্গে আলোচিত হচ্ছে। কাজেই এই বিষয়গুলো নিয়ে আরও আলোচনা হওয়া দরকার। খুঁজে দেখা দরকার, সংবাদপত্র বা ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সততা ও পেশাদারি কেন প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে? সন্দেহ নেই, আরও অনেক পেশার মতো এখানেও ওপরে-নিচে, ভেতর-বাইরে সুবিধাবাদিতা আশ্রয় নিয়েছে, শিকড় গেড়েছে অন্যায়, প্রশ্রয় পেয়েছে ব্যক্তিচিন্তা ও স্বার্থ।
এ দেশে রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের বিরুদ্ধে গণমাধ্যম ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছে। সব সময় গণতন্ত্রের পক্ষে থেকেছে। এখন যদি কোনো কোনো ক্ষেত্রে সাংবাদিকতার পরিচয়ে দুর্বৃত্তায়নের অভিযোগ ওঠে, তা মোটেই স্বস্তিদায়ক নয়। হালে কিছু প্রভাবশালী মহলের মুখপত্রে পরিণত হয়েছে কিছু কিছু গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে যারা নিজেদের জাহির করতে পারছেন না, এমন ব্যক্তিরা দ্বারস্থ হচ্ছেন মিডিয়ার, আর সেই সুবাদে মিডিয়া তাঁদের জন্য হয়ে উঠছে শক্তিশালী অস্ত্র। পূর্বাপর ক্ষমতাসীনেরা এই অস্ত্রের সংখ্যা যত বেশি সম্ভব বাড়িয়ে তোলার ব্যাপারেও সচেষ্ট।
আমাদের মতো উন্নয়নশীল সমাজে দারিদ্র্য বিমোচন কিংবা দুর্নীতির শিকড় উৎপাটনের পক্ষে কথা বলা, সামাজিক অন্যায়-অনাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করা, তথা একটি আলোকিত বাংলাদেশ গড়ার পক্ষে গণমাধ্যম নিরন্তর কাজ করে চলেছে। যদিও স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের ধারাবাহিকতায় গণতান্ত্রিক শাসনেও অন্য অনেক প্রতিষ্ঠানের মতো গণমাধ্যমকেও ক্ষতিগ্রস্ত করা হচ্ছে নানামুখী চাপে, প্রভাবে এবং প্রলোভনে। এতসব বিপত্তি-বিড়ম্বনা ও ঝুঁকির মধ্যে নিজেদের নিরাপত্তা, অস্তিত্ব ও সম্মান রক্ষার জন্য সাংবাদিকদের কণ্ঠ উচ্চকিত করা এবং নিরবচ্ছিন্ন লড়াই চালিয়ে যাওয়ার বিকল্প নেই।
জহিরুল আলম: সাংবাদিক।
কিন্তু দেখা গেল, ব্রাজিল, ভেনেজুয়েলা, কিউবার মতো দেশ তো বটেই, এমনকি ভারত ও পাকিস্তানও অবস্থান নিল ওই উদ্যোগের বিপক্ষে। প্রস্তাবটি আরও ঘষা-মাজার পরামর্শ দিয়ে লিখিত মতামত উপস্থাপন করল বাংলাদেশও। কাজেই মার্চে পরিকল্পনাটি আর গৃহীত হলো না। আশার কথা, শেষ পর্যন্ত গত ১৩ এপ্রিল ২০১২ ইউএন প্রধান নির্বাহীদের বোর্ড এই প্রস্তাবটি অনুমোদন করে। আশা করা যায়, এর ফলে বিশ্বজুড়ে সাংবাদিকদের জন্য নিরাপদ কাজের পরিবেশ তৈরির ক্ষেত্রে ঐক্যবদ্ধভাবে কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়া হবে। সাংবাদিকদের জন্য এই সময়ে পাকিস্তান, আফগানিস্তান, নাইজেরিয়া, লিবিয়া, ইরাকের ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতির কথা কারও অজানা নয়। বাংলাদেশের নামও এর সঙ্গে যুক্ত হবে কি না বলা মুশকিল। অতীতের ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড এবং সাম্প্রতিক সাংবাদিক নির্যাতনের আরও কিছু ঘটনাপ্রবাহ আমাদের সত্যিই বিচলিত ও বিমর্ষ করে তুলেছে। সাগর-রুনিসহ এমন বহু হত্যার বিচার না হওয়া যেমন উদ্বেগের ও দুর্ভাগ্যের, তেমনই বিষয়টি খুবই স্পষ্ট যে দোষী বা দায়ী ব্যক্তিদের ছাড় দেওয়ার লক্ষণ বা আইনের আওতায় না আনার বাস্তবতা গণমাধ্যমকর্মীদের নিরাপত্তাকে আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। একটি জবাবদিহি গণতান্ত্রিক সমাজ তৈরির ক্ষেত্রে বাক ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য সাংবাদিকদের জীবনের নিরাপত্তা দেওয়া অত্যন্ত জরুরি। সর্বজনীন মানবাধিকার সনদের আর্টিকেল-১৯ সমুন্নত রাখতেও এটি প্রয়োজন। গত এক দশকে গোটা বিশ্বে পাঁচ শতাধিক সাংবাদিক ও মিডিয়াকর্মী পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নিহত হন। কেবল ২০১১ সালেই প্রাণ হারিয়েছেন ৬২ জন সাংবাদিক। ইন্টারন্যাশনাল ফ্রিডম অব এক্সপ্রেশনস এক্সচেঞ্জ আইএফইএক্সের হিসাবমতে, বিশ্বে যত সাংবাদিক হত্যা, নির্যাতন ও হামলার শিকার হয়েছেন, গড়ে এর ১০টি ঘটনার মধ্যে ৯টিরই বিচার হয়নি। বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা ব্যতিক্রম কিছু নয়।
সংবাদমাধ্যম নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি হাবিবুর রহমান তাঁর এক লেখায় ১০টি প্রধান জাতীয় দৈনিকের দেওয়া তথ্য উল্ল্লেখ করে সম্প্রতি বলেছেন: ২০১১ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ১৫৪টি। এসব ঘটনার শিকার হয়েছেন ২৮৮ জন সাংবাদিক। চলতি বছরের গত কয়েক মাসে ৩২টি ঘটনায় ৭৪ জন সাংবাদিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। সর্বশেষ খুন হলেন সাগর ও রুনি দম্পতি।
যে সমাজে সাংবাদিকেরা নিরাপদ নয়, সেখানে জনগণের তথ্য পাওয়ার অধিকার সীমিত হয়ে পড়ে—লঙ্ঘিত হয় সর্বজনীন মানবাধিকার। বাধাগ্রস্ত হয় সব শুভ উদ্যোগ। দারিদ্র্য বিমোচনের চেষ্টা, সুশাসনের আকাঙ্ক্ষা, শিক্ষা বিস্তার, ব্যবসা-বাণিজ্য-বিনিয়োগ, কাজের সুযোগ, জলবায়ু সুরক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন—কোনো কিছুই আর সঠিক পথে এগোতে পারে না। সমাজকে দুর্নীতি গ্রাস করে। সে অর্থে সাংবাদিকদের নিরাপত্তাহীনতা গোটা সমাজকেই বঞ্চিত ও অরক্ষিত করে ফেলে। সেই ভীতি থেকে তৈরি হয় এক ধরনের সেলফ সেন্সরশিপ। একটি গণতান্ত্রিক সমাজে এটা কিছুতেই কাম্য হতে পারে না। আর সে জন্যই সাংবাদিকদের ভয়-ভীতি প্রদর্শন, নির্যাতন, নিপীড়ন বা হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়ার পরই কেবল শুধু বিচারের দাবি তোলা এবং সে দাবি আদায়ের জন্য সংগ্রাম করাই যথেষ্ঠ নয়, প্রয়োজন এসব ঘটনা প্রতিরোধের জন্য আগাম রক্ষাকবচ। সাম্প্রতিককালে সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা নিয়ে সাংবাদিক সমাজের ঐক্যবদ্ধ উচ্চারণ অনেককেই আশাবাদী করেছে। বিচারপতি হাবিবুর রহমান বলেন, ‘সুবিচার পাওয়ার ব্যাপারে সাংবাদিকদের দুই ইউনিয়ন এক হবে—এ ব্যাপারে আশাবাদী হয়ে বেঁচে থাকতে চাই।’ সাংবাদিক নির্যাতন, প্রহারের ঘটনার প্রতিবাদে সাংবাদিকেরা যখন এক হওয়ার চেষ্টা করছেন, ঠিক সেই সময় ‘...রসুনের কোয়ার এক গুট্টি’ অভিহিত করে সাংবাদিকদের ঐক্যকে কটাক্ষ করলেন একজন মন্ত্রী। সম্ভবত এই ঐক্য তাঁর পছন্দ হয়নি। এই ঐক্য সম্ভবত স্বার্থান্বেষী এমন আরও বহু মানুষেরই পছন্দ নয়।
আরেকটি বিষয়, সম্প্রতি মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমানের কিছু কথা শুনে মনটা খুব খারাপ হয়। তাঁর মতে, আজকাল অনেকেই সাংবাদিকতার পরিচয়ে দুর্বৃত্তায়ন শুরু করেছে। তাঁকে ধন্যবাদ যে তিনি তাঁর মূল্যায়ন তুলে ধরেছেন। সাংবাদিকতা এবং সাংবাদিকদের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছেন আত্মজিজ্ঞাসার। বর্তমানে সাংবাদিকতা একদিকে যেমন কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে, তেমনি গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও নীতি-নৈতিকতার বিষয়টি আগের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বের সঙ্গে আলোচিত হচ্ছে। কাজেই এই বিষয়গুলো নিয়ে আরও আলোচনা হওয়া দরকার। খুঁজে দেখা দরকার, সংবাদপত্র বা ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সততা ও পেশাদারি কেন প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে? সন্দেহ নেই, আরও অনেক পেশার মতো এখানেও ওপরে-নিচে, ভেতর-বাইরে সুবিধাবাদিতা আশ্রয় নিয়েছে, শিকড় গেড়েছে অন্যায়, প্রশ্রয় পেয়েছে ব্যক্তিচিন্তা ও স্বার্থ।
এ দেশে রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের বিরুদ্ধে গণমাধ্যম ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছে। সব সময় গণতন্ত্রের পক্ষে থেকেছে। এখন যদি কোনো কোনো ক্ষেত্রে সাংবাদিকতার পরিচয়ে দুর্বৃত্তায়নের অভিযোগ ওঠে, তা মোটেই স্বস্তিদায়ক নয়। হালে কিছু প্রভাবশালী মহলের মুখপত্রে পরিণত হয়েছে কিছু কিছু গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে যারা নিজেদের জাহির করতে পারছেন না, এমন ব্যক্তিরা দ্বারস্থ হচ্ছেন মিডিয়ার, আর সেই সুবাদে মিডিয়া তাঁদের জন্য হয়ে উঠছে শক্তিশালী অস্ত্র। পূর্বাপর ক্ষমতাসীনেরা এই অস্ত্রের সংখ্যা যত বেশি সম্ভব বাড়িয়ে তোলার ব্যাপারেও সচেষ্ট।
আমাদের মতো উন্নয়নশীল সমাজে দারিদ্র্য বিমোচন কিংবা দুর্নীতির শিকড় উৎপাটনের পক্ষে কথা বলা, সামাজিক অন্যায়-অনাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করা, তথা একটি আলোকিত বাংলাদেশ গড়ার পক্ষে গণমাধ্যম নিরন্তর কাজ করে চলেছে। যদিও স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের ধারাবাহিকতায় গণতান্ত্রিক শাসনেও অন্য অনেক প্রতিষ্ঠানের মতো গণমাধ্যমকেও ক্ষতিগ্রস্ত করা হচ্ছে নানামুখী চাপে, প্রভাবে এবং প্রলোভনে। এতসব বিপত্তি-বিড়ম্বনা ও ঝুঁকির মধ্যে নিজেদের নিরাপত্তা, অস্তিত্ব ও সম্মান রক্ষার জন্য সাংবাদিকদের কণ্ঠ উচ্চকিত করা এবং নিরবচ্ছিন্ন লড়াই চালিয়ে যাওয়ার বিকল্প নেই।
জহিরুল আলম: সাংবাদিক।
No comments