মুদ্রানীতি-রুপির ব্যাপক দরপতন, টাকার কী হবে by মামুন রশীদ
বর্তমানে আমাদের অবস্থা ভারতের চেয়ে তেমন একটা আলাদা নয়। সে জন্য অর্থনীতির তত্ত্ব অনুযায়ীই ভারতের মতো বাংলাদেশেও একই ঘটনা ঘটতে পারে। এ অবস্থায় আমাদের সরকার ও সংশিল্গষ্ট সব সংস্থাকে অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সতর্ক থাকতে হবে। উন্নয়ন অংশীদারদের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করতে হবে।
জোরদার করতে হবে পাইপলাইনে থাকা বৈদেশিক সাহায্য ছাড়করণের কৌশল। ভর্তুকি কমানোর পাশাপাশি বেসরকারি খাতের বিকাশের বিষয়টিকেও গুরুত্ব দিতে হবে
বিশ্বের প্রধান মুদ্রাগুলোর বিপরীতে ভারতীয় মুদ্রা 'রুপির' দরপতন ঘটে চলেছে। বিশেষ করে মার্কিন ডলারের বিপরীতে যেভাবে রুপির মূল্যমান তথা বিনিময় হার কমছে তাতে ভারতজুড়ে এবং যারা বর্তমান ও ভবিষ্যতের 'ভারত'কে নিয়ে ভাবেন, কাজ করেন, তারা প্রায় সবাই এখন বেশ আতঙ্কিত। ভারতের একটি স্থানীয় ব্যাংকের একজন তহবিল ব্যবস্থাপকের বক্তব্যেও সেই আতঙ্কই যেন প্রতিধ্বনিত হয় যখন তিনি বলেন, 'রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া (আরবিআই) রুপির এহেন দ্রুত দরপতন রোধে অক্ষম। তাহলে আর কে পারবে রুপির দরপতন ঠেকাতে? ঈশ্বর রুপিকে রক্ষা করুন।' আমার সাবেক কর্মস্থল সিটি ব্যাংক এনএর সহকর্মীদের অভিমত হলো, মার্কিন ডলারের বিপরীতে রুপির বিনিময় হার স্বল্পমেয়াদে ৫৬-৫৭ রুপিতে দেখা যেতে পারে। আর মধ্যমেয়াদে প্রতি ডলারের বিপরীতে এই বিনিময় হার ৫২ থেকে ৬০ রুপির মধ্যে ওঠানামা করতে পারে।
বছরখানেক ধরেই মূলত মার্কিন ডলারের বিপরীতে ভারতীয় রুপির মূল্যমান কমছে। বিশেষ করে গত বছরের জুলাই থেকে এ পর্যন্ত ডলারের বিপরীতে ভারতীয় রুপির মূল্যমান প্রায় ২৭ শতাংশ কমেছে। গত শুক্রবার (২৫ মে) প্রতি ডলারের বিপরীতে ভারতীয় মুদ্রার বিনিময় হার ছিল ৫৫.৩০, যা ওই দিন সকালের দিকে ৫৬ ছাড়িয়ে যায়। বিশেল্গষকদের মতে, রুপির দরপতনের কারণগুলো হচ্ছে : ১. বিদেশি প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা (এফআইআই) তাদের বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নিচ্ছে অথবা ভারতীয় সম্পদে তাদের উৎসাহ হারিয়ে ফেলছে; ২. বর্তমান (টেলিযোগাযোগ) ও ভবিষ্যৎ প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) প্রবাহের ওপর প্রচলিত কর আইনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে; ৩. জ্বালানি তেল আমদানিতে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় হওয়ায় (প্রতি মাসে ৮৮০ কোটি ডলার) কাঠামোগতভাবেই চলতি হিসাবে ঘাটতি বাড়ছে; ৪. সার্বিকভাবে গ্রিসের ঋণ সংকটজনিত ঝুঁকি বৃদ্ধি এবং ৫. বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বা মজুদকে (বর্তমানে ছয় মাসের আমদানিমূল্যের সমান) একটি অবস্থানে রাখার ব্যাপারে রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া (আরবিআই) অনীহ বা অনিচ্ছুক থাকায় রুপির দরপতন ঘটেই চলেছে। এর পাশাপাশি আরও কিছু কারণ রয়েছে : ভারতে বাণিজ্য ঘাটতি, মূল্যস্ফীতি ও চলতি হিসাবের ঘাটতি ক্রমাগত বাড়ছে। সব মিলিয়ে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে ৬.৫ শতাংশ থেকে ৭ শতাংশে নতুন করে প্রাক্কলন করা হয়েছে। আর রাজস্ব ঘাটতি (ফিসক্যাল ডেফিসিট) বর্তমানে ৪.৬ শতাংশে থাকলেও সেটি বেশ বাড়তে পারে বলে বিশেল্গষকরা মনে করেন। এ ছাড়া মুদ্রাবাজারে রুপির বিনিময় হার নিয়ে ফটকাবাজি চলছে বলেও অভিযোগ আছে।
সমালোচকদের অনেকেই জনপ্রশাসনের বিরুদ্ধে 'অদক্ষতা বা অযোগ্যতা'র অভিযোগ তুলে সোচ্চার রয়েছেন। মনমোহন সিংয়ের সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া (আরবিআই) অবশ্য পরিস্থিতি সামাল দিতে অর্থাৎ রুপির দরপতন ঠেকাতে ইতিমধ্যে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। যেমন_ ১. অনিবাসী ভারতীয়দের (এনআরআই) জন্য আমানতের সুদহার বাড়ানো হয়েছে; ২. রফতানিকারকদের জন্য তাদের ফরেন কারেন্সি হোল্ডিংসের বা বৈদেশিক মুদ্রা সঞ্চিতির অর্ধেকটা ভারতীয় মুদ্রায় রূপান্তরের বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছে। ভারতের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন তেল কোম্পানিগুলো অনেক দিন ধরে ভর্তুকিমূল্যে তেল বিক্রি, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধি ও স্থানীয় মুদ্রার দরপতনের পরিস্থিতিতে তেলের দাম ১২ শতাংশ বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে, যাতে এসব প্রতিষ্ঠানের প্রায় এক দশক ধরে দেওয়া লোকসানটা কমিয়ে আনা যায়। এর ওপর ভারতের 'স্ট্রিট স্মার্ট' বা চৌকস রাজনীতিক অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি এখন আরেক দফা পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বিবেচনা করছেন। অন্যদিকে আবার অনিবাসী ভারতীয় (এনআরআই) যারা প্রতি বছর দেশে প্রায় ৩০ বিলিয়ন বা তিন হাজার কোটি ডলারের রেমিট্যান্স বা প্রবাসী-আয় পাঠান, তারা রুপির দরপতনের ফলে দেশে অধিক পরিমাণে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী-আয় পাঠাতে উৎসাহিত হচ্ছেন।
বাংলাদেশের অর্থনীতি সাম্প্রতিককালে ভারতীয় অর্থনীতির সঙ্গে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক উভয় দিক থেকেই অধিকতর সম্পৃক্ত হয়েছে। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক বাণিজ্যের পাশাপাশি অনানুষ্ঠানিক সীমান্ত বাণিজ্যও বেড়েছে। আনুষ্ঠানিক আমদানি ও রফতানি দুটিই বেড়েছে। তবে তুলনামূলকভাবে আমদানিটা ব্যাপকহারে বেড়েছে। সে জন্য ভারতীয় মুদ্রা রুপির দরপতনের কারণে বাংলাদেশের জন্যও একটি প্রশ্ন অনিবার্য হয়ে উঠছে, 'প্রতিবেশীর ঘরে আগুন লাগলে তার উত্তাপ থেকে আমরা কতক্ষণ পর্যন্ত নিজেদের রক্ষা করতে পারব?' কিংবা আমাদের আত্মরক্ষার শক্তিই-বা কতটা আছে? ইতিমধ্যে বিশেল্গষকরা বলেছেন, মার্কিন ডলারের বিপরীতে ভারতীয় রুপির মতো বাংলাদেশের টাকারও একই পরিণতি হতে পারে। প্রতি ডলার এখন বিক্রি হয় ৮২ টাকা দরে, যা বছরখানেক আগেও ছিল ৭০ টাকা। আমাদের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো প্রতি ডলার ৮১ টাকা দামে কিনে ৮২ টাকায় বিক্রি করছে। অন্যদিকে অনানুষ্ঠানিক বা 'হাওলা' মার্কেটে অবশ্য প্রতি ডলার ৮৪ টাকার ওপর বিক্রি হচ্ছে। আমরা যদিও ইউরোপের গ্রিক ও স্পেনের পরিস্থিতির মোটেই কাছাকাছি নই তবুও বাহ্যিক খাতে চাপ অনুভব করতে শুরু করেছি। আমাদের রফতানি আয়ে বড় ধরনের পতন না ঘটলেও এই খাতে গড় প্রবৃদ্ধির হার কমে এক অঙ্কে নেমে আসছে। অন্তর্মুখী রেমিট্যান্স বা প্রবাসী গড় আয়ে বড় কিছু বৃদ্ধি ঘটেনি। তবে বিশেল্গষকদের কেউ কেউ অবশ্য মনে করেন, বিশ্ববাজারে যদি জ্বালানি তেলের দাম বাড়ে তাহলে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর আয় বাড়বে এবং এর ফলে বাংলাদেশও অর্থনৈতিকভাবে উপকৃত হবে। কারণ, ওই সব দেশে বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি নাগরিক রয়েছেন, যারা আয় বৃদ্ধির ফলে বেশি করে রেমিট্যান্স পাঠাবেন বলে আশা করা যায়।
তবে আমাদের চলতি হিসাবের উদ্বৃত্ত দিন দিন সংকুচিত হয়ে এখন প্রায় ঘাটতির কাছাকাছি চলে এসেছে। ঊর্ধ্বমুখী মূল্যস্টম্ফীতির লাগামও প্রত্যাশা অনুযায়ী টেনে ধরা যাচ্ছে না। সংকটে পড়া অল্প কিছু ব্যাংককে স্থানীয় মুদ্রায় তারল্য সহায়তা দিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে অস্থায়ী ভিত্তিতে বাজার থেকে ডলার কিনতে দেখা গেছে। কিন্তু এটি যে নিছক একটি অস্থায়ী সমর্থন বা স্বস্তি সেটিও বিবেচনায় রাখতে হবে। বৈদেশিক সাহায্য ছাড় করার পরিমাণ ও প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের (এফডিআই) প্রবাহ কমে যাওয়ায় লেনদেনের ভারসাম্যও (বিওপি) চাপে পড়ার লক্ষণ দেখা দিয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার আশঙ্কা থাকার পরিস্থিতিতে সরকার জ্বালানি খাতে ভর্তুকি কমানোর ঘোষণা দেওয়ায় এই পণ্যের দাম আরও বাড়ার শঙ্কা ঘনীভূত হচ্ছে। আমাদের প্রতিবেশী ভারতে যেখানে ছয় মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বা মজুদ রয়েছে, সেখানে আমাদের এই ক্ষমতা আছে মাত্র তিন মাসের। এ ছাড়া আমাদের প্রধান রফতানি পণ্য তৈরি পোশাক নিয়ে বিশ্ববাজারে ভারতের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করার মুখেও রয়েছি আমরা। কারণ তারাও প্রায় একই বাজার বা দেশে এই পণ্য রফতানি করে।
বর্তমানে আমাদের অবস্থা ভারতের চেয়ে তেমন একটা আলাদা নয়। সে জন্য অর্থনীতির তত্ত্ব অনুযায়ীই ভারতের মতো বাংলাদেশেও একই ঘটনা ঘটতে পারে। এ অবস্থায় আমাদের সরকার ও সংশিল্গষ্ট সব সংস্থাকে অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সতর্ক থাকতে হবে। উন্নয়ন অংশীদারদের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করতে হবে। জোরদার করতে হবে পাইপলাইনে থাকা বৈদেশিক সাহায্য ছাড়করণের কৌশল। ভর্তুকি কমানোর পাশাপাশি বেসরকারি খাতের বিকাশের বিষয়টিকেও গুরুত্ব দিতে হবে। এ ছাড়া সরকার করণীয় নির্ধারণের লক্ষ্যে অর্থনীতিবিদ, বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠন ও ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দসহ সব স্টেকহোল্ডার বা সংশিল্গষ্টদের নিয়ে একটি 'আগাম সতর্কতা' বৈঠকও ডাকতে পারে। বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে ক্রমান্বয়ে বাজার সম্পৃক্ততা বাড়ছে, যেখানে নিঃসঙ্গ থাকা বা চলার কোনোই সুযোগ নেই। এ ছাড়া কোনো জনদুর্ভোগ সৃষ্টি হওয়া পর্যন্তও অপেক্ষা করা যাবে না। হাতে যা আছে তা নিয়ে এখনই আমাদের কাজে নেমে পড়তে হবে। যাতে বিপদ ঘনিয়ে আসতে না পারে বা এলেও তা সহজে মোকাবেলা করা যায়।
মামুন রশীদ : ব্র্যাক বিজনেস স্কুলের অধ্যাপক ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
বিশ্বের প্রধান মুদ্রাগুলোর বিপরীতে ভারতীয় মুদ্রা 'রুপির' দরপতন ঘটে চলেছে। বিশেষ করে মার্কিন ডলারের বিপরীতে যেভাবে রুপির মূল্যমান তথা বিনিময় হার কমছে তাতে ভারতজুড়ে এবং যারা বর্তমান ও ভবিষ্যতের 'ভারত'কে নিয়ে ভাবেন, কাজ করেন, তারা প্রায় সবাই এখন বেশ আতঙ্কিত। ভারতের একটি স্থানীয় ব্যাংকের একজন তহবিল ব্যবস্থাপকের বক্তব্যেও সেই আতঙ্কই যেন প্রতিধ্বনিত হয় যখন তিনি বলেন, 'রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া (আরবিআই) রুপির এহেন দ্রুত দরপতন রোধে অক্ষম। তাহলে আর কে পারবে রুপির দরপতন ঠেকাতে? ঈশ্বর রুপিকে রক্ষা করুন।' আমার সাবেক কর্মস্থল সিটি ব্যাংক এনএর সহকর্মীদের অভিমত হলো, মার্কিন ডলারের বিপরীতে রুপির বিনিময় হার স্বল্পমেয়াদে ৫৬-৫৭ রুপিতে দেখা যেতে পারে। আর মধ্যমেয়াদে প্রতি ডলারের বিপরীতে এই বিনিময় হার ৫২ থেকে ৬০ রুপির মধ্যে ওঠানামা করতে পারে।
বছরখানেক ধরেই মূলত মার্কিন ডলারের বিপরীতে ভারতীয় রুপির মূল্যমান কমছে। বিশেষ করে গত বছরের জুলাই থেকে এ পর্যন্ত ডলারের বিপরীতে ভারতীয় রুপির মূল্যমান প্রায় ২৭ শতাংশ কমেছে। গত শুক্রবার (২৫ মে) প্রতি ডলারের বিপরীতে ভারতীয় মুদ্রার বিনিময় হার ছিল ৫৫.৩০, যা ওই দিন সকালের দিকে ৫৬ ছাড়িয়ে যায়। বিশেল্গষকদের মতে, রুপির দরপতনের কারণগুলো হচ্ছে : ১. বিদেশি প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা (এফআইআই) তাদের বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নিচ্ছে অথবা ভারতীয় সম্পদে তাদের উৎসাহ হারিয়ে ফেলছে; ২. বর্তমান (টেলিযোগাযোগ) ও ভবিষ্যৎ প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) প্রবাহের ওপর প্রচলিত কর আইনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে; ৩. জ্বালানি তেল আমদানিতে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় হওয়ায় (প্রতি মাসে ৮৮০ কোটি ডলার) কাঠামোগতভাবেই চলতি হিসাবে ঘাটতি বাড়ছে; ৪. সার্বিকভাবে গ্রিসের ঋণ সংকটজনিত ঝুঁকি বৃদ্ধি এবং ৫. বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বা মজুদকে (বর্তমানে ছয় মাসের আমদানিমূল্যের সমান) একটি অবস্থানে রাখার ব্যাপারে রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া (আরবিআই) অনীহ বা অনিচ্ছুক থাকায় রুপির দরপতন ঘটেই চলেছে। এর পাশাপাশি আরও কিছু কারণ রয়েছে : ভারতে বাণিজ্য ঘাটতি, মূল্যস্ফীতি ও চলতি হিসাবের ঘাটতি ক্রমাগত বাড়ছে। সব মিলিয়ে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে ৬.৫ শতাংশ থেকে ৭ শতাংশে নতুন করে প্রাক্কলন করা হয়েছে। আর রাজস্ব ঘাটতি (ফিসক্যাল ডেফিসিট) বর্তমানে ৪.৬ শতাংশে থাকলেও সেটি বেশ বাড়তে পারে বলে বিশেল্গষকরা মনে করেন। এ ছাড়া মুদ্রাবাজারে রুপির বিনিময় হার নিয়ে ফটকাবাজি চলছে বলেও অভিযোগ আছে।
সমালোচকদের অনেকেই জনপ্রশাসনের বিরুদ্ধে 'অদক্ষতা বা অযোগ্যতা'র অভিযোগ তুলে সোচ্চার রয়েছেন। মনমোহন সিংয়ের সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া (আরবিআই) অবশ্য পরিস্থিতি সামাল দিতে অর্থাৎ রুপির দরপতন ঠেকাতে ইতিমধ্যে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। যেমন_ ১. অনিবাসী ভারতীয়দের (এনআরআই) জন্য আমানতের সুদহার বাড়ানো হয়েছে; ২. রফতানিকারকদের জন্য তাদের ফরেন কারেন্সি হোল্ডিংসের বা বৈদেশিক মুদ্রা সঞ্চিতির অর্ধেকটা ভারতীয় মুদ্রায় রূপান্তরের বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছে। ভারতের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন তেল কোম্পানিগুলো অনেক দিন ধরে ভর্তুকিমূল্যে তেল বিক্রি, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধি ও স্থানীয় মুদ্রার দরপতনের পরিস্থিতিতে তেলের দাম ১২ শতাংশ বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে, যাতে এসব প্রতিষ্ঠানের প্রায় এক দশক ধরে দেওয়া লোকসানটা কমিয়ে আনা যায়। এর ওপর ভারতের 'স্ট্রিট স্মার্ট' বা চৌকস রাজনীতিক অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি এখন আরেক দফা পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বিবেচনা করছেন। অন্যদিকে আবার অনিবাসী ভারতীয় (এনআরআই) যারা প্রতি বছর দেশে প্রায় ৩০ বিলিয়ন বা তিন হাজার কোটি ডলারের রেমিট্যান্স বা প্রবাসী-আয় পাঠান, তারা রুপির দরপতনের ফলে দেশে অধিক পরিমাণে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী-আয় পাঠাতে উৎসাহিত হচ্ছেন।
বাংলাদেশের অর্থনীতি সাম্প্রতিককালে ভারতীয় অর্থনীতির সঙ্গে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক উভয় দিক থেকেই অধিকতর সম্পৃক্ত হয়েছে। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক বাণিজ্যের পাশাপাশি অনানুষ্ঠানিক সীমান্ত বাণিজ্যও বেড়েছে। আনুষ্ঠানিক আমদানি ও রফতানি দুটিই বেড়েছে। তবে তুলনামূলকভাবে আমদানিটা ব্যাপকহারে বেড়েছে। সে জন্য ভারতীয় মুদ্রা রুপির দরপতনের কারণে বাংলাদেশের জন্যও একটি প্রশ্ন অনিবার্য হয়ে উঠছে, 'প্রতিবেশীর ঘরে আগুন লাগলে তার উত্তাপ থেকে আমরা কতক্ষণ পর্যন্ত নিজেদের রক্ষা করতে পারব?' কিংবা আমাদের আত্মরক্ষার শক্তিই-বা কতটা আছে? ইতিমধ্যে বিশেল্গষকরা বলেছেন, মার্কিন ডলারের বিপরীতে ভারতীয় রুপির মতো বাংলাদেশের টাকারও একই পরিণতি হতে পারে। প্রতি ডলার এখন বিক্রি হয় ৮২ টাকা দরে, যা বছরখানেক আগেও ছিল ৭০ টাকা। আমাদের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো প্রতি ডলার ৮১ টাকা দামে কিনে ৮২ টাকায় বিক্রি করছে। অন্যদিকে অনানুষ্ঠানিক বা 'হাওলা' মার্কেটে অবশ্য প্রতি ডলার ৮৪ টাকার ওপর বিক্রি হচ্ছে। আমরা যদিও ইউরোপের গ্রিক ও স্পেনের পরিস্থিতির মোটেই কাছাকাছি নই তবুও বাহ্যিক খাতে চাপ অনুভব করতে শুরু করেছি। আমাদের রফতানি আয়ে বড় ধরনের পতন না ঘটলেও এই খাতে গড় প্রবৃদ্ধির হার কমে এক অঙ্কে নেমে আসছে। অন্তর্মুখী রেমিট্যান্স বা প্রবাসী গড় আয়ে বড় কিছু বৃদ্ধি ঘটেনি। তবে বিশেল্গষকদের কেউ কেউ অবশ্য মনে করেন, বিশ্ববাজারে যদি জ্বালানি তেলের দাম বাড়ে তাহলে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর আয় বাড়বে এবং এর ফলে বাংলাদেশও অর্থনৈতিকভাবে উপকৃত হবে। কারণ, ওই সব দেশে বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি নাগরিক রয়েছেন, যারা আয় বৃদ্ধির ফলে বেশি করে রেমিট্যান্স পাঠাবেন বলে আশা করা যায়।
তবে আমাদের চলতি হিসাবের উদ্বৃত্ত দিন দিন সংকুচিত হয়ে এখন প্রায় ঘাটতির কাছাকাছি চলে এসেছে। ঊর্ধ্বমুখী মূল্যস্টম্ফীতির লাগামও প্রত্যাশা অনুযায়ী টেনে ধরা যাচ্ছে না। সংকটে পড়া অল্প কিছু ব্যাংককে স্থানীয় মুদ্রায় তারল্য সহায়তা দিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে অস্থায়ী ভিত্তিতে বাজার থেকে ডলার কিনতে দেখা গেছে। কিন্তু এটি যে নিছক একটি অস্থায়ী সমর্থন বা স্বস্তি সেটিও বিবেচনায় রাখতে হবে। বৈদেশিক সাহায্য ছাড় করার পরিমাণ ও প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের (এফডিআই) প্রবাহ কমে যাওয়ায় লেনদেনের ভারসাম্যও (বিওপি) চাপে পড়ার লক্ষণ দেখা দিয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার আশঙ্কা থাকার পরিস্থিতিতে সরকার জ্বালানি খাতে ভর্তুকি কমানোর ঘোষণা দেওয়ায় এই পণ্যের দাম আরও বাড়ার শঙ্কা ঘনীভূত হচ্ছে। আমাদের প্রতিবেশী ভারতে যেখানে ছয় মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বা মজুদ রয়েছে, সেখানে আমাদের এই ক্ষমতা আছে মাত্র তিন মাসের। এ ছাড়া আমাদের প্রধান রফতানি পণ্য তৈরি পোশাক নিয়ে বিশ্ববাজারে ভারতের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করার মুখেও রয়েছি আমরা। কারণ তারাও প্রায় একই বাজার বা দেশে এই পণ্য রফতানি করে।
বর্তমানে আমাদের অবস্থা ভারতের চেয়ে তেমন একটা আলাদা নয়। সে জন্য অর্থনীতির তত্ত্ব অনুযায়ীই ভারতের মতো বাংলাদেশেও একই ঘটনা ঘটতে পারে। এ অবস্থায় আমাদের সরকার ও সংশিল্গষ্ট সব সংস্থাকে অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সতর্ক থাকতে হবে। উন্নয়ন অংশীদারদের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করতে হবে। জোরদার করতে হবে পাইপলাইনে থাকা বৈদেশিক সাহায্য ছাড়করণের কৌশল। ভর্তুকি কমানোর পাশাপাশি বেসরকারি খাতের বিকাশের বিষয়টিকেও গুরুত্ব দিতে হবে। এ ছাড়া সরকার করণীয় নির্ধারণের লক্ষ্যে অর্থনীতিবিদ, বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠন ও ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দসহ সব স্টেকহোল্ডার বা সংশিল্গষ্টদের নিয়ে একটি 'আগাম সতর্কতা' বৈঠকও ডাকতে পারে। বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে ক্রমান্বয়ে বাজার সম্পৃক্ততা বাড়ছে, যেখানে নিঃসঙ্গ থাকা বা চলার কোনোই সুযোগ নেই। এ ছাড়া কোনো জনদুর্ভোগ সৃষ্টি হওয়া পর্যন্তও অপেক্ষা করা যাবে না। হাতে যা আছে তা নিয়ে এখনই আমাদের কাজে নেমে পড়তে হবে। যাতে বিপদ ঘনিয়ে আসতে না পারে বা এলেও তা সহজে মোকাবেলা করা যায়।
মামুন রশীদ : ব্র্যাক বিজনেস স্কুলের অধ্যাপক ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
No comments