অধিকাংশ নারী শ্রমিকের চাকরি নিয়মিতকরণ চুক্তি নেই- লিঙ্গবৈষম্য (২) by শাহ আলম খান
শ্রম আইন ২০০৬ এর ৫ ধারা অনুযায়ী কোন
মালিক কোন শ্রমিককে নিয়োগপত্র প্রদান না করে চাকরিতে নিয়োগ করতে পারবে না।
শুধু তাই নয়, নিয়োগকৃত প্রত্যেক শ্রমিককে ছবিসহ নিয়োগপত্র দিতে হবে।
এর ব্যতিক্রম করলে মালিক আইন অমান্য করেছে বলে গণ্য করা হবে। এৰেত্রে উক্ত
মালিকের বিরম্নদ্ধে ৩০৭ ধারা অনুযায়ী আইন অমান্যের ব্যবস্থা নেয়া যাবে।
শ্রমিক কর্মচারীর চাকরির নিরাপত্তায় এ রকম শর্তই রয়েছে। তবে জানা গেছে,
রাজধানীসহ সারাদেশের বিভিন্ন শিল্পকারখানা ও গার্মেন্ট সেক্টরে কর্মরত
শ্রমিকদের অধিকাংশের বেলায়ই এই শর্ত পূরণ করা হয় না। বিশেষ করে নারী
শ্রমিকের ৰেত্রে এ প্রবণতা বেশি। অধিকাংশ কারখানার মালিকই তার শ্রমিককে
নিয়োগপত্র দিতে আগ্রহ দেখায় না। বাসাবাড়িতে কর্মচারী নিয়োগের বেলায়
শিল্পকারখানার চেয়ে এই প্রবণতা আরও বেশি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, একজন গৃহভৃত্যকে যখন তখন বাদ দিতে পারেন মালিক। এদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন করতে পারেন। দীর্ঘদিন ধরে তাদের সেবায় নিয়োজিত থেকেছেন এমন গৃহভৃত্যকেও তারা পান থেকে চুন খসার সুযোগ দেন না। গৃহকর্তা কিংবা গৃহকত্রর্ীর অন্যায় আচরণ কিংবা অযৌক্তিক সিদ্ধানত্মের প্রতিবাদ করতে গেলেই তাৎৰণিক সিদ্ধানত্মে ওই গৃহভৃত্যকে বাসা থেকে নামিয়ে দেয়া হয় রাসত্মায়। বিনিময়ে তাকে কোন ৰতিপূরণও দেয়া হয় না। কখনও কখনও মাসের পাওনা পরিশোধ না করেই গৃহভৃত্যকে বিদায় করেন অবিবেচক মালিক। এজন্য কখনও কোন মালিককে আইনের মুখোমুখি হতে হয়নি।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ জানান, গ্রাম থেকে এসে কোন কিশোর-কিশোরী কিংবা সম্পূর্ণ অপরিচিত পরিবেশে একজন গৃহভৃত্য অসহায় হয়েই কোনমতে একটি কাজ জুটিয়ে নিচ্ছে। সেৰেত্রে মালিকের সঙ্গে ওই কিশোর-কিশোরীর অভিভাবক কিংবা গৃহভৃত্যের কোন আনুষ্ঠানিক চুক্তি হয় না। বাসা-বাড়ির চাকরি হয় সাধারণত মৌখিক আলোচনার ভিত্তিতে। এৰেত্রে কাউকেই কোন নিয়োগপত্র দেয়া হয় না। ফলে এসব গৃহ শ্রমিককে মালিকের মর্জির ইচ্ছাতেই চলতে হয়।
এ ব্যাপারে তিনি গৃহশ্রমিকের চাকরির নিরাপত্তায় শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় থেকে একটি প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট মানদ- ঘোষণার দাবি করেন।
তবে গবেষকদের মতে, বাসাবাড়িতে কর্মরতদের চাকরির নিরাপত্তা ঝুঁকি বেশি হলেও সংখ্যায় কম। মূলত কলকারখানার কর্মরত অধসত্মন কর্মচারী শ্রমিকরাই এই ৰেত্রে প্রতিনিয়ত ঝুঁকির মুখে থাকেন। নারী শ্রমিকের বেলায় এই হার কয়েকগুণ বেশি। গার্মেন্ট সেক্টর ও ইপিজেডে নারী শ্রমিকের উপস্থিতি বেশি। স্বল্প মজুরির জন্য এসব শিল্পকারখানায় এদের কাজের সুযোগ হলেও কোথাও নেই চাকরির নিরাপত্তা। নেই শ্রমিকের নিয়োগে চুক্তির প্রয়োগ ও চাকরির নিরাপত্তা।
একটি বেসরকারী সংস্থার উদ্যোগে ২০০৯ সালে এ ব্যাপারে একটি জরিপ চালানো হয়েছে। রাজধানী ও তার আশপাশ এলাকায় অবস্থিত মোট ৪৪০ গার্মেন্ট প্রতিষ্ঠানের ওপর চালানো জরিপে দেখা গেছে, জরিপকারীরা মাত্র ২৫.২০ শতাংশ কারখানায় নিয়োগপত্র ও পরিচয়পত্র দেয়ার কথা জানতে পেরেছেন। বাকি শ্রমিক নিয়োগপত্র হাতে পায়নি। এ ব্যাপারে জরিপকৃত কারখানায় কর্মরত ৭৪.৫০ শতাংশ শ্রমিক জরিপকারীদের জানিয়েছে, কোন কোন কারখানার মালিক শ্রমিকদের নিয়োগপত্রে স্বাৰর করিয়ে তা নিজেদের কাছেই রেখে দিয়েছে। ইচ্ছেমাফিক ছাঁটাই, ৰতিপূরণ না দেয়া এবং অহেতুক ঝুট-ঝামেলা এড়াতেই শ্রমিকের হাতে নিয়োগপত্র তুলে দেয়া হয়নি বলে তারা জানতে পেরেছেন। জরিপকারী ওই প্রতিষ্ঠানের মতে, নিয়োগপত্র হাতে না পাওয়া এসব শ্রমিকদের বেশির ভাগই নারী।
এ ব্যাপারে ভুক্তভোগী নারী শ্রমিকদের অভিযোগ, একটি স্বাধীন-সভ্য দেশেও তারা ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত এবং বৈষম্য ও শোষণের শিকার। বিভিন্ন সময় গবেষণায় ভুক্তভোগী এসব নারীর অভিযোগের সত্যতা পেয়েছেন গবেষকরাও। তাদের গবেষণায় নারী বৈষম্যের নিষ্ঠুরতম সত্যটি উঠে এসেছে। গবেষকরা জানতে পেরেছেন, রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রায় সব ৰেত্রেই পুরম্নষের চেয়ে একজন নারী ৫ গুণ বেশি মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকেন। তারা বিনা মজুরি, অর্ধমজুরির পাশাপাশি কর্মস্থলে সহকমর্ী ও মালিকদের দ্বারা শারীরিকভাবেও নির্যাতিত হচ্ছেন। এত কিছুর পরেও একজন নারী শ্রমিকের নেই চাকরির নিশ্চয়তা।
অসংখ্য নারী শ্রমিকের ভাষ্য, চাকরির প্রথম দিন থেকেই তারা প্রতিকূল পরিবেশে কাজ করছেন। এদের অনেকেই জানিয়েছেন নিয়োগপত্র না পাওয়ার কথা। তবে পরিচয়পত্র প্রদান করা হয়েছে। এতেও রয়েছে মালিকের স্বার্থসিদ্ধির মনোভাব। শ্রমিকদের অভিমত, শুধুমাত্র নিরাপত্তা রৰায় বহিরাগতদের প্রবেশ ঠেকাতেই মালিকরা এই পরিচয়পত্র দিতে বাধ্য হচ্ছেন।
চাকরির নিরাপত্তা না থাকার কারণে প্রায় প্রতিমাসেই নতুন মুখ দেখতে অভ্যসত্ম হয়ে পড়েছে তারা। তাই নিজেদের চাকরির নিরাপত্তা নিয়েও দুশ্চিনত্মায় রয়েছে অনেকে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েক নারী শ্রমিক জানায়, অত্যনত্ম প্রতিকূল ও রম্নদ্ধদ্বার পরিবেশে তারা কাজ করছে। নিম্ন মজুরি ও অনিয়মিত বেতন অথচ প্রতিদিন নির্ধারিত সময়ে কর্মস্থলে হাজির হওয়া এবং অতিরিক্ত কাজ ও নির্ধারিত সময়ের চেয়ে বেশি কাজ করাই তাদের নিয়তি হয়ে পড়েছে। সারা মাস নিদারম্নণ শ্রম দিয়ে গেলেও শ্রমের মূল্য পাচ্ছে না সময়মতো। মালিকের কাছে কিংবা উর্ধতন কর্মকর্তাদের কাছে গিয়ে চাইতেও পারছে না মন্দের ভাল হিসেবে একমাত্র অবলম্বন চাকরিটি হারানোর ভয়ে। কারণ এখানে চাকরিচু্যতির ঘটনাকে অতি স্বাভাবিক বলেই মনে করা হয়।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ১৫ থেকে ৩৫ বছর বয়সী নারী শ্রমিক বিশেষ করে যারা অবিবাহিত কিংবা স্বামী পরিত্যক্তা যারা নিজেরাই নিজেদের জীবিকার প্রয়োজন মেটাচ্ছে। অথবা যাদের ওপর নির্ভরশীল রয়েছে বৃদ্ধ বাবা-মা, সনত্মান_ মূলত তারাই চাকরির নিরাপত্তা, স্বল্প বেতন ও অনিয়মিত বেতনের জন্য সবচেয়ে বেশি দুর্বিষহ জীবন-যাপন করছে। ফলে এদের অনেকে জীবন ও জীবিকার তাগিদেই নির্ভরশীল হতে শুরম্ন করে তাদের বাড়িওয়ালা, স্থানীয় মুদি দোকানদার বা টাকা ধার নেয়া যায় এমন অনেকের করম্নণার ওপর। অসহায় নারী শ্রমিক এদের কাছে ভিড়ার সুযোগে সাহায্যের কথা বলে কেউ কেউ অসৎ উদ্দেশ্যও চরিতার্থ করার চেষ্টা করছে। ফলে পুরম্নষের লালসারও শিকার হচ্ছে এরা।
এ ব্যাপারে গবেষকদের অভিমত, শ্রমিকের নিয়োগপত্রহীন চাকরি ও অনিয়মিত মজুরি শুধু তাদের আর্থিক অনিশ্চয়তারই জন্ম দেয় না, সৃষ্টি করে বিভিন্ন মানসিক সমস্যারও। আর এই মানসিক সমস্যা ধীরে ধীরে শ্রমিককে শারীরিকভাবে অৰম করে তোলে এবং কাজ করার ৰমতা কমিয়ে দেয়। যা তাকে ও তার ওপর নির্ভরশীল সবাইকেই চরম দারিদ্র্যে নামিয়ে আনে। এই চক্রাকার সমস্যা সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নেও বাধার সৃষ্টি করে।
এত কিছু সত্ত্বেও নারী শ্রমিকদের মধ্যে চাকরির নিশ্চয়তায় নেই প্রয়োজনীয় উদ্যোগ। বরং চাকরি হারানোর আশঙ্কা আরও বাড়ছে। বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য গার্মেন্টস সেক্টর ধীরে ধীরে ঝুঁকে পড়ছে তাঁত বুনন থেকে সুতা বুননের দিকে। আর এ সেক্টরে অধিকহারে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে পুরম্নষ শ্রমিকদেরই। ফলে অনেক নারী শ্রমিক বেকার হতে শুরম্ন করেছে।
সূত্রমতে, বিশ্বায়ন সমস্যায় গত কয়েক বছরে রাজধানীর দু'হাজার কারখানার মধ্যে এ পর্যনত্ম প্রায় আড়াই শ' কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে চাকরি হারিয়েছে অসংখ্য নারী শ্রমিক। কিন্তু অধিকাংশ ৰেত্রেই দেয়া হয়নি চাকরিচু্যতির সুবিধাদি।
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন শ্রমিকের চাকরির নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টিকে সরাসরি মানতে নারাজ। তিনি জানান, এখন শোষক আর শোষিতের সময় নেই। শ্রমিকদের পৰে ইউনিটি তৈরি হয়েছে। তারা দাবি-দাওয়া আদায়ে মালিকদের সঙ্গে দরকষাকষি করতে পারে। তা ছাড়া দেশের অধিকাংশ কারখানায় কমপস্নায়েন্স সুযোগ-সুবিধা বিদ্যমান। সেখানে নিয়োগ, বেতন পরিশোধ ও কাজের সুযোগ-সুবিধা সবকিছুই কমপস্নায়েন্সের আওতায় হয়ে থাকে। তবে কিছু ব্যতিক্রম থাকতে পারে বলে তিনি স্বীকার করেন।
কর্মজীবী নারী নেত্রী শিরীন আখতার এ ব্যাপারে জানান, শ্রমিকের অধিকারবঞ্চিত রেখে কখনও শিল্পকে রৰা করা যায় না। সরকারের নীতিনির্ধারক ও কারখানার মালিকদের এই সত্যটি উপলব্ধি করতে হবে।
এই প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, লাখ লাখ নারী শ্রমিকের কান্না, বঞ্চনা, ক্রোধ, ৰোভ, দুঃখ, ভালবাসা বুকে লালন করেই একজন নারী মেশিনে সেলাই কাজ করছে। সেলাই করে চলেছে তার স্বপ্ন। সে নারীর শ্রমে যখন পণ্য জাহাজে পার হয়ে সমুদ্রবন্দর, অর্জিত হয় বৈদেশিক মুদ্রা; তা দিয়ে শ্রমিকের বেঁচে থাকার নূ্যনতম শর্ত পূরণ হবে না এটি চলতে পারে না। অন্যান্য খাতেও নারী শ্রমিকের মূল্যায়ন এর ব্যতিক্রম নয়। যে নারী শ্রমিক কৃষি কাজ করছে, মাঠে ধান বোনা থেকে শুরম্ন করে বীজ সংরৰণ পর্যনত্ম সমসত্ম প্রক্রিয়াতেই নিজের শ্রম ঢেলে দিচ্ছে, সেই কৃষকের গায়ে কাপড় থাকবে না, ৰুধা মিটবে না, সেই উৎপাদন ব্যবস্থা কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, একজন গৃহভৃত্যকে যখন তখন বাদ দিতে পারেন মালিক। এদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন করতে পারেন। দীর্ঘদিন ধরে তাদের সেবায় নিয়োজিত থেকেছেন এমন গৃহভৃত্যকেও তারা পান থেকে চুন খসার সুযোগ দেন না। গৃহকর্তা কিংবা গৃহকত্রর্ীর অন্যায় আচরণ কিংবা অযৌক্তিক সিদ্ধানত্মের প্রতিবাদ করতে গেলেই তাৎৰণিক সিদ্ধানত্মে ওই গৃহভৃত্যকে বাসা থেকে নামিয়ে দেয়া হয় রাসত্মায়। বিনিময়ে তাকে কোন ৰতিপূরণও দেয়া হয় না। কখনও কখনও মাসের পাওনা পরিশোধ না করেই গৃহভৃত্যকে বিদায় করেন অবিবেচক মালিক। এজন্য কখনও কোন মালিককে আইনের মুখোমুখি হতে হয়নি।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ জানান, গ্রাম থেকে এসে কোন কিশোর-কিশোরী কিংবা সম্পূর্ণ অপরিচিত পরিবেশে একজন গৃহভৃত্য অসহায় হয়েই কোনমতে একটি কাজ জুটিয়ে নিচ্ছে। সেৰেত্রে মালিকের সঙ্গে ওই কিশোর-কিশোরীর অভিভাবক কিংবা গৃহভৃত্যের কোন আনুষ্ঠানিক চুক্তি হয় না। বাসা-বাড়ির চাকরি হয় সাধারণত মৌখিক আলোচনার ভিত্তিতে। এৰেত্রে কাউকেই কোন নিয়োগপত্র দেয়া হয় না। ফলে এসব গৃহ শ্রমিককে মালিকের মর্জির ইচ্ছাতেই চলতে হয়।
এ ব্যাপারে তিনি গৃহশ্রমিকের চাকরির নিরাপত্তায় শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় থেকে একটি প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট মানদ- ঘোষণার দাবি করেন।
তবে গবেষকদের মতে, বাসাবাড়িতে কর্মরতদের চাকরির নিরাপত্তা ঝুঁকি বেশি হলেও সংখ্যায় কম। মূলত কলকারখানার কর্মরত অধসত্মন কর্মচারী শ্রমিকরাই এই ৰেত্রে প্রতিনিয়ত ঝুঁকির মুখে থাকেন। নারী শ্রমিকের বেলায় এই হার কয়েকগুণ বেশি। গার্মেন্ট সেক্টর ও ইপিজেডে নারী শ্রমিকের উপস্থিতি বেশি। স্বল্প মজুরির জন্য এসব শিল্পকারখানায় এদের কাজের সুযোগ হলেও কোথাও নেই চাকরির নিরাপত্তা। নেই শ্রমিকের নিয়োগে চুক্তির প্রয়োগ ও চাকরির নিরাপত্তা।
একটি বেসরকারী সংস্থার উদ্যোগে ২০০৯ সালে এ ব্যাপারে একটি জরিপ চালানো হয়েছে। রাজধানী ও তার আশপাশ এলাকায় অবস্থিত মোট ৪৪০ গার্মেন্ট প্রতিষ্ঠানের ওপর চালানো জরিপে দেখা গেছে, জরিপকারীরা মাত্র ২৫.২০ শতাংশ কারখানায় নিয়োগপত্র ও পরিচয়পত্র দেয়ার কথা জানতে পেরেছেন। বাকি শ্রমিক নিয়োগপত্র হাতে পায়নি। এ ব্যাপারে জরিপকৃত কারখানায় কর্মরত ৭৪.৫০ শতাংশ শ্রমিক জরিপকারীদের জানিয়েছে, কোন কোন কারখানার মালিক শ্রমিকদের নিয়োগপত্রে স্বাৰর করিয়ে তা নিজেদের কাছেই রেখে দিয়েছে। ইচ্ছেমাফিক ছাঁটাই, ৰতিপূরণ না দেয়া এবং অহেতুক ঝুট-ঝামেলা এড়াতেই শ্রমিকের হাতে নিয়োগপত্র তুলে দেয়া হয়নি বলে তারা জানতে পেরেছেন। জরিপকারী ওই প্রতিষ্ঠানের মতে, নিয়োগপত্র হাতে না পাওয়া এসব শ্রমিকদের বেশির ভাগই নারী।
এ ব্যাপারে ভুক্তভোগী নারী শ্রমিকদের অভিযোগ, একটি স্বাধীন-সভ্য দেশেও তারা ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত এবং বৈষম্য ও শোষণের শিকার। বিভিন্ন সময় গবেষণায় ভুক্তভোগী এসব নারীর অভিযোগের সত্যতা পেয়েছেন গবেষকরাও। তাদের গবেষণায় নারী বৈষম্যের নিষ্ঠুরতম সত্যটি উঠে এসেছে। গবেষকরা জানতে পেরেছেন, রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রায় সব ৰেত্রেই পুরম্নষের চেয়ে একজন নারী ৫ গুণ বেশি মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকেন। তারা বিনা মজুরি, অর্ধমজুরির পাশাপাশি কর্মস্থলে সহকমর্ী ও মালিকদের দ্বারা শারীরিকভাবেও নির্যাতিত হচ্ছেন। এত কিছুর পরেও একজন নারী শ্রমিকের নেই চাকরির নিশ্চয়তা।
অসংখ্য নারী শ্রমিকের ভাষ্য, চাকরির প্রথম দিন থেকেই তারা প্রতিকূল পরিবেশে কাজ করছেন। এদের অনেকেই জানিয়েছেন নিয়োগপত্র না পাওয়ার কথা। তবে পরিচয়পত্র প্রদান করা হয়েছে। এতেও রয়েছে মালিকের স্বার্থসিদ্ধির মনোভাব। শ্রমিকদের অভিমত, শুধুমাত্র নিরাপত্তা রৰায় বহিরাগতদের প্রবেশ ঠেকাতেই মালিকরা এই পরিচয়পত্র দিতে বাধ্য হচ্ছেন।
চাকরির নিরাপত্তা না থাকার কারণে প্রায় প্রতিমাসেই নতুন মুখ দেখতে অভ্যসত্ম হয়ে পড়েছে তারা। তাই নিজেদের চাকরির নিরাপত্তা নিয়েও দুশ্চিনত্মায় রয়েছে অনেকে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েক নারী শ্রমিক জানায়, অত্যনত্ম প্রতিকূল ও রম্নদ্ধদ্বার পরিবেশে তারা কাজ করছে। নিম্ন মজুরি ও অনিয়মিত বেতন অথচ প্রতিদিন নির্ধারিত সময়ে কর্মস্থলে হাজির হওয়া এবং অতিরিক্ত কাজ ও নির্ধারিত সময়ের চেয়ে বেশি কাজ করাই তাদের নিয়তি হয়ে পড়েছে। সারা মাস নিদারম্নণ শ্রম দিয়ে গেলেও শ্রমের মূল্য পাচ্ছে না সময়মতো। মালিকের কাছে কিংবা উর্ধতন কর্মকর্তাদের কাছে গিয়ে চাইতেও পারছে না মন্দের ভাল হিসেবে একমাত্র অবলম্বন চাকরিটি হারানোর ভয়ে। কারণ এখানে চাকরিচু্যতির ঘটনাকে অতি স্বাভাবিক বলেই মনে করা হয়।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ১৫ থেকে ৩৫ বছর বয়সী নারী শ্রমিক বিশেষ করে যারা অবিবাহিত কিংবা স্বামী পরিত্যক্তা যারা নিজেরাই নিজেদের জীবিকার প্রয়োজন মেটাচ্ছে। অথবা যাদের ওপর নির্ভরশীল রয়েছে বৃদ্ধ বাবা-মা, সনত্মান_ মূলত তারাই চাকরির নিরাপত্তা, স্বল্প বেতন ও অনিয়মিত বেতনের জন্য সবচেয়ে বেশি দুর্বিষহ জীবন-যাপন করছে। ফলে এদের অনেকে জীবন ও জীবিকার তাগিদেই নির্ভরশীল হতে শুরম্ন করে তাদের বাড়িওয়ালা, স্থানীয় মুদি দোকানদার বা টাকা ধার নেয়া যায় এমন অনেকের করম্নণার ওপর। অসহায় নারী শ্রমিক এদের কাছে ভিড়ার সুযোগে সাহায্যের কথা বলে কেউ কেউ অসৎ উদ্দেশ্যও চরিতার্থ করার চেষ্টা করছে। ফলে পুরম্নষের লালসারও শিকার হচ্ছে এরা।
এ ব্যাপারে গবেষকদের অভিমত, শ্রমিকের নিয়োগপত্রহীন চাকরি ও অনিয়মিত মজুরি শুধু তাদের আর্থিক অনিশ্চয়তারই জন্ম দেয় না, সৃষ্টি করে বিভিন্ন মানসিক সমস্যারও। আর এই মানসিক সমস্যা ধীরে ধীরে শ্রমিককে শারীরিকভাবে অৰম করে তোলে এবং কাজ করার ৰমতা কমিয়ে দেয়। যা তাকে ও তার ওপর নির্ভরশীল সবাইকেই চরম দারিদ্র্যে নামিয়ে আনে। এই চক্রাকার সমস্যা সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নেও বাধার সৃষ্টি করে।
এত কিছু সত্ত্বেও নারী শ্রমিকদের মধ্যে চাকরির নিশ্চয়তায় নেই প্রয়োজনীয় উদ্যোগ। বরং চাকরি হারানোর আশঙ্কা আরও বাড়ছে। বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য গার্মেন্টস সেক্টর ধীরে ধীরে ঝুঁকে পড়ছে তাঁত বুনন থেকে সুতা বুননের দিকে। আর এ সেক্টরে অধিকহারে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে পুরম্নষ শ্রমিকদেরই। ফলে অনেক নারী শ্রমিক বেকার হতে শুরম্ন করেছে।
সূত্রমতে, বিশ্বায়ন সমস্যায় গত কয়েক বছরে রাজধানীর দু'হাজার কারখানার মধ্যে এ পর্যনত্ম প্রায় আড়াই শ' কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে চাকরি হারিয়েছে অসংখ্য নারী শ্রমিক। কিন্তু অধিকাংশ ৰেত্রেই দেয়া হয়নি চাকরিচু্যতির সুবিধাদি।
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন শ্রমিকের চাকরির নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টিকে সরাসরি মানতে নারাজ। তিনি জানান, এখন শোষক আর শোষিতের সময় নেই। শ্রমিকদের পৰে ইউনিটি তৈরি হয়েছে। তারা দাবি-দাওয়া আদায়ে মালিকদের সঙ্গে দরকষাকষি করতে পারে। তা ছাড়া দেশের অধিকাংশ কারখানায় কমপস্নায়েন্স সুযোগ-সুবিধা বিদ্যমান। সেখানে নিয়োগ, বেতন পরিশোধ ও কাজের সুযোগ-সুবিধা সবকিছুই কমপস্নায়েন্সের আওতায় হয়ে থাকে। তবে কিছু ব্যতিক্রম থাকতে পারে বলে তিনি স্বীকার করেন।
কর্মজীবী নারী নেত্রী শিরীন আখতার এ ব্যাপারে জানান, শ্রমিকের অধিকারবঞ্চিত রেখে কখনও শিল্পকে রৰা করা যায় না। সরকারের নীতিনির্ধারক ও কারখানার মালিকদের এই সত্যটি উপলব্ধি করতে হবে।
এই প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, লাখ লাখ নারী শ্রমিকের কান্না, বঞ্চনা, ক্রোধ, ৰোভ, দুঃখ, ভালবাসা বুকে লালন করেই একজন নারী মেশিনে সেলাই কাজ করছে। সেলাই করে চলেছে তার স্বপ্ন। সে নারীর শ্রমে যখন পণ্য জাহাজে পার হয়ে সমুদ্রবন্দর, অর্জিত হয় বৈদেশিক মুদ্রা; তা দিয়ে শ্রমিকের বেঁচে থাকার নূ্যনতম শর্ত পূরণ হবে না এটি চলতে পারে না। অন্যান্য খাতেও নারী শ্রমিকের মূল্যায়ন এর ব্যতিক্রম নয়। যে নারী শ্রমিক কৃষি কাজ করছে, মাঠে ধান বোনা থেকে শুরম্ন করে বীজ সংরৰণ পর্যনত্ম সমসত্ম প্রক্রিয়াতেই নিজের শ্রম ঢেলে দিচ্ছে, সেই কৃষকের গায়ে কাপড় থাকবে না, ৰুধা মিটবে না, সেই উৎপাদন ব্যবস্থা কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না।
No comments