গণতন্ত্রের স্বার্থেই ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ প্রয়োজন by গাজীউল হাসান খান
দেশে যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রশ্নে আগামী সংসদ নির্বাচনের ভবিষ্যৎ ঝুলে আছে সম্পূর্ণ এক অনিশ্চয়তার দোলাচলে, তখন কোনো কোনো চিন্তাশীল প্রবীণ নাগরিক প্রশ্ন তুলেছেন আমাদের সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর অপরিসীম ক্ষমতা নিয়ে।
তাঁরা মনে করেন, আমাদের সংবিধানে অর্থাৎ বর্তমান সংসদীয় পদ্ধতির সরকারব্যবস্থায় দেশের প্রধানমন্ত্রীকে অতিরিক্ত নির্বাহী ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। দেশের বেশ কিছু প্রবীণ চিন্তাবিদ কিংবা নেতৃস্থানীয় বুদ্ধিজীবীরা গণতন্ত্রের বৃহত্তর স্বার্থে এবং রাষ্ট্র পরিচালনার সুষ্ঠু ব্যবস্থা হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর সেই নির্বাহী ক্ষমতার কিছু বিকেন্দ্রীকরণ দাবি করেছেন। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে কিংবা জাতীয় ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রীকে প্রদত্ত কিছু ক্ষমতা প্রয়োজন অনুসারে কর্তন করে গণতান্ত্রিক বিধিব্যবস্থাকে আরো রাজনীতিবান্ধব, যুক্তিগ্রাহ্য ও বিতর্কের উর্ধ্বে নিয়ে যাওয়াই তাঁদের মূল উদ্দেশ্য। চূড়ান্ত রাজনৈতিক ক্ষমতা যেমন কাউকে ভয়ানকভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত করে তুলতে পারে, তেমনি সৃষ্টি করতে পারে অসহনীয় স্বৈরাচার। এ বিষয়টি এখন আন্তর্জাতিকভাবেই একটি অত্যন্ত প্রচলিত এবং জনপ্রিয় রাজনৈতিক প্রবাদবাক্যে পরিণত হয়ে গেছে। মূলত সে কারণেই রাজনৈতিক নির্বাহী ক্ষমতার প্রশ্নে সাংবিধানিকভাবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে তৈরি করা হয় 'চেক অ্যান্ড ব্যালান্স' অর্থাৎ বাধা ও সমন্বয়ের ব্যবস্থা। ক্ষমতার অপব্যবহারের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সাংবিধানিক বাধা ও সমন্বয়সাধন একটি দেশের প্রশাসনিক বিধিব্যবস্থাকে অত্যন্ত গণতান্ত্রিক নীতিসম্মত করে তুলতে পারে। সে নজির বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সংবিধান ও গণতান্ত্রিক রীতিনীতিতে (Convention) খুঁজে পাওয়া যাবে। একটি দেশের সংবিধানে যেমন কোনো নির্বাচিত সরকারের প্রধানমন্ত্রীর নির্বাহী ক্ষমতা লিপিবদ্ধ করা হয়, অন্যদিকে আবার একটি রাজনৈতিক দলের গঠনতন্ত্রেও সেই দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা-নেত্রীকে প্রদত্ত সাংগঠনিক ক্ষমতা বর্ণনা করা হয়ে থাকে। বিশ্বের কোনো কোনো দেশে একই ব্যক্তিকে ক্ষমতাসীন দলের প্রধান নেতা এবং রাষ্ট্র কিংবা সরকারের প্রধান নির্বাহী হতে দেখা যায়। আবার কোথাও কোথাও দেখা যায় ক্ষমতাসীন দলের প্রধান নেতা এবং রাষ্ট্র কিংবা সরকারের প্রধান নির্বাহী দুজন আলাদা বা পৃথক ব্যক্তি। তাতে রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার কিংবা অপব্যবহারের প্রশ্নে যথেষ্ট তারতম্য পরিলক্ষিত হয়ে থাকে।
বাংলাদেশের গত ৪১ বছরের রাজনৈতিক ইতিহাসে দেখা গেছে, আওয়ামী লীগ, বিএনপি কিংবা জাতীয় পার্টি, যখন যে দল ক্ষমতায় ছিল, তাদের দলীয় প্রধানরাই হয়েছিলেন দেশের প্রেসিডেন্ট কিংবা প্রধানমন্ত্রী। অর্থাৎ প্রেসিডেন্ট কিংবা সংসদীয় পদ্ধতির অধীনে রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী ক্ষমতার অধিকারী। সামরিক শাসনের কালটা বাদ দিলে একাত্তরের পর থেকে পাকিস্তানেও এর বিশেষ ব্যতিক্রম ঘটেনি। ব্যতিক্রম ঘটেছে ভারতে। ব্রিটিশ শাসনের অবসান থেকে গত ৬৫ বছরের সংসদীয় পদ্ধতির রাজনীতির ইতিহাসে ভারতের রাষ্ট্রক্ষমতায় বেশির ভাগ সময় অধিষ্ঠিত ছিল জাতীয় কংগ্রেস দল। পণ্ডিত জওয়াহেরলাল নেহরু তাঁর জীবদ্দশায় ভারত রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হলেও একাধারে ক্ষমতাসীন কংগ্রেস দলের প্রধান ছিলেন না। সেই ধারা ভারতে এখনো অব্যাহত রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষমতাসীন দল ও রাষ্ট্রের একচ্ছত্র ক্ষমতা থেকে কিছুটা নিরাপদ দূরত্বে রাখার জন্য। ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংকে তাঁর দলনেত্রী সোনিয়া গান্ধী এবং দলের নির্বাচনী অঙ্গীকার অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হয়। তা ছাড়া ভারতের বিভিন্ন রাজ্য সরকার ও কেন্দ্রীয় সরকারের মধ্যে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের কারণে সেখানে প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী হলেও তিনি যা খুশি তা করতে পারেন না। সেখানে বিভিন্ন সাংবিধানিক বিধিনিষেধ রয়েছে। যুক্তরাজ্যে মোটামুটি একই ধারা প্রচলিত থাকলেও ব্রিটিশ লেবার পার্টির সাবেক দীর্ঘস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার অনেকটা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের মতোই দেশ পরিচালনা করেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নয়া সাম্রাজ্যবাদী রাজনৈতিক গাঁটছড়ার কারণে প্রধানমন্ত্রী ব্লেয়ার যুক্তরাজ্যকে ইরাক ও আফগানিস্তান আক্রমণের পথে নিয়ে গিয়েছিলেন। অনেকটা তাঁর একগুঁয়েমি ও নিজস্ব আধিপত্যের কারণে। নিজ দলের ভেতর থেকে প্রবল বাধাবিপিত্ত ও চাপ উপেক্ষা করেও ব্লেয়ার যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। লেবার পার্টিকে নিয়ে গিয়েছিলেন এক ব্যাপক অন্তর্দলীয় বিরোধ ও রাজনৈতিক সংঘর্ষের মুখোমুখি। ফলে তাঁর দলের কয়েকজন প্রবীণ কেবিনেট সদস্য পদত্যাগ করেছিলেন। সে কারণে শেষ পর্যন্ত তাঁর অর্থমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউনের কাছে প্রধানমন্ত্রিত্ব ছেড়ে দিয়েও দলীয় ক্ষমতা ধরে রাখতে পারেননি তিনি। বহুদলীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় পদ্ধতিগতভাবে প্রেসিডেন্ট কিংবা সংসদীয় ধরনের কাঠামোগত ক্ষমতার বিন্যাসে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন তারতম্য দেখা যায়। সব কিছুই জনগণের অধিকার ও গণতান্ত্রিক পদ্ধতির দোহাই দিয়ে করা হলেও শেষ পর্যন্ত তা কতটুকু তত্ত্বগত আর কতটুকু বাস্তবসম্মতভাবে প্রতিফলিত হয়, তা বোঝা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে।
বিভিন্ন কায়েমি স্বার্থ ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-সংঘাতের দিকে দৃষ্টি রেখেই যুক্তরাষ্ট্রের দুই কক্ষবিশিষ্ট প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির শাসনব্যবস্থায় ক্ষমতাগতভাবে মোটামুটি একটি সমন্বয়সাধনের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা হয়েছে। ফলে সেখানে একজন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট যত শক্তিশালীই হোন না কেন, যুক্তরাষ্ট্রের দুই কক্ষবিশিষ্ট কংগ্রেসের মধ্যে বৃহত্তর সমঝোতা এবং তাদের সমর্থন ছাড়া শেষ পর্যন্ত অনেক কিছুই করতে পারেন না। যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের সিনেট ও প্রতিনিধি পরিষদে নিজ দলীয় সদস্যরাও বিভিন্ন ইস্যুতে একজন নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের গৃহীত কোনো পদক্ষেপ কিংবা সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করার সাংবিধানিক অধিকার রাখেন। আমাদের দেশে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার থাকলেও সংসদ সদস্যদের সে ক্ষমতা নেই। অর্থাৎ দলীয় সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করা যাবে না। আর আমাদের দেশে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দলীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকেন প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং। ফলে একদিকে দলের প্রধান এবং অন্যদিকে সরকারের প্রধান নির্বাহীর কোনো সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করার পরিণাম একজন সংসদ সদস্য কিংবা বিভিন্ন পর্যায়ের দলীয় নেতা-নেত্রীর ভালো করেই জানা আছে। তা ছাড়া সাংবিধানিকভাবেই জাতীয় সংসদে ফ্লোর ক্রস করার অর্থ হলো নিজ দলীয় সদস্য পদ হারানো। সুতরাং নিজের ইচ্ছার সম্পূর্ণ বিরুদ্ধে হলেও নিজ দলের আনীত সব বিলের পক্ষে তাঁকে ভোট দিতেই হবে। এ বিধান যেমন যুক্তরাষ্ট্রের নেই, তেমনি সংসদীয় গণতন্ত্রের সূতিকাগার ওয়েস্টমিনস্টার পার্লামেন্ট অর্থাৎ ব্রিটিশ সংসদেও সেভাবে নেই। সে অর্থে আমাদের সংসদ সদস্যদের ঠুঁটো জগন্নাথ বানিয়ে রাখা হয়েছে। নিজেরা আইনপ্রণেতা হিসেবে পরিচিত হলেও আইন প্রণয়নের আসল ক্ষেত্রটি বাদ দিয়ে তাঁরা নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় ধান-গম বিতরণ কিংবা রাস্তাঘাট মেরামতের ক্ষেত্রে উপজেলা চেয়ারম্যানদের ওপর খবরদারি নিয়ে সদা ব্যস্ত থাকেন। তা ছাড়া দলের ভেতরেও অনেকটা একই অবস্থা বিরাজ করছে। দলীয় প্রধান বা সভাপতি বা চেয়ারপারসনের ইচ্ছার ওপরই নির্ভর করে কোনো ব্যক্তির সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পাওয়া কিংবা না পাওয়ার বিষয়টি। দলীয় সংগঠনের বিভিন্ন পদে স্থান পাওয়ার বিষয়টিও একইভাবে বিবেচিত হতে দেখা গেছে অনিয়মিতভাবে অনুষ্ঠিত দলীয় সম্মেলন শেষে। তা ছাড়া নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকার দলীয় সদস্যদের গোপন ব্যালটের ওপর সংসদ নির্বাচনে কারো মনোনয়ন লাভ করার বিষয়টি মোটেও নির্ভর করে না। শুধু তা-ই নয়, দলীয় সদস্যদের গোপন ব্যালটে কোনো উপজেলা কিংবা জেলা পর্যায়ের নেতাও নির্বাচিত হন না। সব কিছুই নির্ভর করে সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতা এবং বিশেষ করে দলীয় প্রধানের রাজনৈতিক বিবেচনার ওপর। আর সে ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন কোনো দলের প্রধান যদি দেশের প্রধানমন্ত্রী হন তাহলে তো কথাই নেই। ওই এক ব্যক্তির হাতেই নির্ভর করে সম্পূর্ণ দলীয় রাজনীতি এবং নিবেদিতপ্রাণ নেতা-কর্মীদের ভবিষ্যৎ। গণতন্ত্রের বৃহত্তর স্বার্থে এ অবস্থার অবসান চান অনেকে, কিন্তু তা নিয়ে কোনো দলের অভ্যন্তরে সুপরিকল্পিত কোনো আন্দোলন নেই। দলীয় কাউন্সিল অধিবেশন শেষে নির্ধারিত সময় দলের কেন্দ্রীয় পর্যায়ে কমিটি গঠনকালে নেতৃত্বের দ্বিতীয় কোনো প্যানেলও উপস্থাপন করা হয় না। অর্থাৎ কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ঠিক করার ব্যাপারে কোনো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় না। বরং দায়িত্বপ্রাপ্ত দলীয় প্রধানের হাতেই ছেড়ে দেওয়া হয় কেন্দ্রীয় কমিটি গঠনের সম্পূর্ণ বিষয়টি।
এ কথা ঠিক যে একটি দলে জনপ্রিয়তা কিংবা নির্ভরযোগ্যতার ভিত্তিতেই সাধারণত দলীয় নেতা-নেত্রী ঠিক করা হয়ে থাকে। তবে সে জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের মাধ্যমটি কী? বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-নেত্রী নির্ধারণে দলীয় সদস্যদের কিংবা কেন্দ্রীয় পর্যায়ে প্রতিনিধিদের গোপন ব্যালটে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচনটি সম্পন্ন হয় না কেন? এ প্রশ্ন এখন প্রায় সর্বত্রই শোনা যায়। দেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলে দলীয় নেতা-নেত্রী নির্বাচনের ক্ষেত্রে সাধারণত গণতান্ত্রিক পদ্ধতির কোনো আশ্রয় নেওয়া হয় না। বিভিন্ন দলে বৃহত্তরভাবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রাজনৈতিক সংস্কারের কথা বলা হলেও সংস্কারকে দলের অনেকে ক্ষমতাসীন নেতা-নেত্রীদের বিরুদ্ধে একটি চক্রান্তের অংশ বলে মনে করে। সে কারণে কোনো দলেই রাজনীতিগতভাবে কোনো কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আসছে না। দলের সাংগঠনিক কিংবা নেতৃত্বের ক্ষেত্রে কোনো প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হচ্ছে না। রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের মধ্যে গণতন্ত্রের চর্চা কিংবা মূল্যবোধগত কোনো বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হচ্ছে না। সব পর্যায়ে নেতৃত্বসংক্রান্ত দলীয় ক্ষমতার কেন্দ্রটি কুক্ষিগত হয়ে আছে একটি দুর্ভেদ্য বৃত্তের মধ্যে। নির্বাচন কমিশনের সুস্পষ্ট নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও ছাত্র, যুবকসহ বিভিন্ন সংগঠন এখনো বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি করে চলেছে। দেশে গণতন্ত্র একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাওয়া দূরে থাকুক, কোনো দলেই প্রকৃত অর্থে গণতন্ত্রের চর্চা নেই। যা আছে তা হচ্ছে ব্যক্তিতন্ত্র। ফলে জাতীয় পরিসরে অসহনীয়ভাবে বেড়ে যাচ্ছে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন। এ অবস্থায় রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রয়োজনীয় সংস্কার ছাড়া দেশে প্রকৃত অর্থে গণতন্ত্রের চর্চা যেমন ত্বরান্বিত করা যাবে না, তেমনি দেশকেও উদ্ধার করা যাবে না দুর্নীতি ও অপশাসনের নিগড় থেকে। সংস্কারবিহীন রাজনৈতিক দলগুলোতে ব্যক্তিপ্রভাব, আধিপত্য, সন্ত্রাস, দুর্নীতি ও অনিয়ম শুধু দিন দিন বেড়েই যাবে এবং তার প্রতিফলন ঘটবে জাতীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে। বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকে একটি শিশুরাষ্ট্র হিসেবে আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব টিকিয়ে রাখার নামে অনেক অগণতান্ত্রিক কার্যকলাপ সংঘটিত হয়েছে। তাতে আর যা-ই হোক, বিভিন্ন সময় সামরিক অভ্যুত্থানকে ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি। গণতন্ত্রের ভিত শক্তিশালী হলে দেশে সামরিক অভ্যুত্থানের আশঙ্কা থাকে না। এ কথাটি বুঝেও আমরা স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা অত্যন্ত দুর্বল করে রেখেছি। রাজনৈতিক ক্ষমতা আটকে রেখেছি রাজধানীর অরক্ষিত চার দেয়ালের মধ্যে। এখানে যে একবার ক্ষমতায় যাওয়ার সুযোগ পায় সব কিছু যেন তাঁরই হয়ে যায়। আর কারো কোনো ভূমিকা থাকে না। বিরোধী দলের ভূমিকা নিতান্তই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। তাই রাজনীতি সংসদে নয়, রাজপথে নেমে আসে গণতান্ত্রিক বিভিন্ন বিধিবিধানের অকার্যকারিতার কারণে। প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক সংশোধনীর অভাবে।
পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনী বাতিল করে সুপ্রিম কোর্ট রায় দেওয়ার পর ২০১১ সালের ৩ জুলাই সংবিধান সংশোধন করে পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করা হয়েছিল। তাতে দেশের অনেক আইনই অবৈধ হয়ে পড়েছে। সংবিধানের সপ্তম সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করায় ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ থেকে ১৯৮৬ সালের ১১ নভেম্বর পর্যন্ত প্রায় সাড়ে চার বছরে করা দুই শতাধিক আইন বাতিল হয়ে গেছে। তবে সেসব বাতিল আইনে সরকারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম এখনো চলছে বলে জানা গেছে। যেসব আইন বাতিল ও অবৈধ ঘোষিত হয়েছে, সেগুলোর বৈধতা দিতে শিগগিরই আবার আইন পাস করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন প্রসঙ্গে এখনো চিন্তাভাবনা করার অবকাশ বর্তমান সরকারের রয়েছে। বিরোধীদলীয় জোটের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে দেশে একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য আর যেসব ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে তা তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। বিরোধী জোটের এ দাবি মেনে নিলে সরকারের কোনো ক্ষতির আশঙ্কা নেই। বরং তাতে একটি স্থিতিশীল দেশ বিভিন্নভাবে উপকৃত হবে। নতুবা নৈরাজ্য সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সম্প্রতি পাকিস্তানেও একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য একটি অন্তর্বর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন বর্তমান মহাজোট সরকারের পক্ষে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এটি পুনর্বিবেচনা করা কোনো অগণতান্ত্রিক কাজ হবে না। এর পাশাপাশি দেশের প্রবীণ চিন্তাশীল ব্যক্তিদের বক্তব্য অনুযায়ী বাংলাদেশে গণতন্ত্রের বৃহত্তর স্বার্থে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ নিয়েও সময়োচিতভাবে কিছুটা চিন্তাভাবনা করা একান্তই আবশ্যক বলে মনে করি। প্রধানমন্ত্রীর হাতে অতিরিক্ত রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত না করে সরকারের অন্যান্য পর্যায়ে তা বিকেন্দ্রীকরণ করা যেতে পারে। প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি ক্ষমতাসীন দলের মানুষ হিসেবে তাঁর হাতে রাষ্ট্রের কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক ক্ষমতা প্রদান করা যেতে পারে বলে অতীতেও অনেকে মতামত ব্যক্ত করেছেন। তা ছাড়া রাজধানী ঢাকাকেন্দ্রিক সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ কিছু দপ্তর ও অধিদপ্তর সুবিধামতো দেশের বিভিন্ন বিভাগীয় শহরে ছড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে। পাশাপাশি স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে বর্তমান মহাজোট সরকার তাদের মেয়াদকালেই অত্যন্ত শক্তিশালী করবে বলে দেশব্যাপী গণতন্ত্রমনা মানুষের আশা ছিল। তাতে দেশের কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য, যোগাযোগ ও উন্নয়ন কার্যক্রম আরো অনেক বেশি বেগবান হবে বলে তথ্যাভিজ্ঞ মহলের ধারণা। স্থানীয় সরকারকে একটি শক্তিশালী প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো দেওয়ার জন্য আওয়ামী লীগ সরকার অতীতেও অনেক কাজ করেছে এবং আইন প্রণয়ন করেছে। কিন্তু স্থানীয় সংসদ সদস্যদের অযাচিত হস্তক্ষেপের কারণে এ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি কিছুতেই আর অগ্রসর হতে পারছে না। এ ব্যাপারেও বর্তমান সরকারের একটি বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নেওয়া আবশ্যক বলে আমরা মনে করি।
লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক gaziulhkhan@gmail.com
বাংলাদেশের গত ৪১ বছরের রাজনৈতিক ইতিহাসে দেখা গেছে, আওয়ামী লীগ, বিএনপি কিংবা জাতীয় পার্টি, যখন যে দল ক্ষমতায় ছিল, তাদের দলীয় প্রধানরাই হয়েছিলেন দেশের প্রেসিডেন্ট কিংবা প্রধানমন্ত্রী। অর্থাৎ প্রেসিডেন্ট কিংবা সংসদীয় পদ্ধতির অধীনে রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী ক্ষমতার অধিকারী। সামরিক শাসনের কালটা বাদ দিলে একাত্তরের পর থেকে পাকিস্তানেও এর বিশেষ ব্যতিক্রম ঘটেনি। ব্যতিক্রম ঘটেছে ভারতে। ব্রিটিশ শাসনের অবসান থেকে গত ৬৫ বছরের সংসদীয় পদ্ধতির রাজনীতির ইতিহাসে ভারতের রাষ্ট্রক্ষমতায় বেশির ভাগ সময় অধিষ্ঠিত ছিল জাতীয় কংগ্রেস দল। পণ্ডিত জওয়াহেরলাল নেহরু তাঁর জীবদ্দশায় ভারত রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হলেও একাধারে ক্ষমতাসীন কংগ্রেস দলের প্রধান ছিলেন না। সেই ধারা ভারতে এখনো অব্যাহত রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষমতাসীন দল ও রাষ্ট্রের একচ্ছত্র ক্ষমতা থেকে কিছুটা নিরাপদ দূরত্বে রাখার জন্য। ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংকে তাঁর দলনেত্রী সোনিয়া গান্ধী এবং দলের নির্বাচনী অঙ্গীকার অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হয়। তা ছাড়া ভারতের বিভিন্ন রাজ্য সরকার ও কেন্দ্রীয় সরকারের মধ্যে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের কারণে সেখানে প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী হলেও তিনি যা খুশি তা করতে পারেন না। সেখানে বিভিন্ন সাংবিধানিক বিধিনিষেধ রয়েছে। যুক্তরাজ্যে মোটামুটি একই ধারা প্রচলিত থাকলেও ব্রিটিশ লেবার পার্টির সাবেক দীর্ঘস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার অনেকটা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের মতোই দেশ পরিচালনা করেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নয়া সাম্রাজ্যবাদী রাজনৈতিক গাঁটছড়ার কারণে প্রধানমন্ত্রী ব্লেয়ার যুক্তরাজ্যকে ইরাক ও আফগানিস্তান আক্রমণের পথে নিয়ে গিয়েছিলেন। অনেকটা তাঁর একগুঁয়েমি ও নিজস্ব আধিপত্যের কারণে। নিজ দলের ভেতর থেকে প্রবল বাধাবিপিত্ত ও চাপ উপেক্ষা করেও ব্লেয়ার যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। লেবার পার্টিকে নিয়ে গিয়েছিলেন এক ব্যাপক অন্তর্দলীয় বিরোধ ও রাজনৈতিক সংঘর্ষের মুখোমুখি। ফলে তাঁর দলের কয়েকজন প্রবীণ কেবিনেট সদস্য পদত্যাগ করেছিলেন। সে কারণে শেষ পর্যন্ত তাঁর অর্থমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউনের কাছে প্রধানমন্ত্রিত্ব ছেড়ে দিয়েও দলীয় ক্ষমতা ধরে রাখতে পারেননি তিনি। বহুদলীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় পদ্ধতিগতভাবে প্রেসিডেন্ট কিংবা সংসদীয় ধরনের কাঠামোগত ক্ষমতার বিন্যাসে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন তারতম্য দেখা যায়। সব কিছুই জনগণের অধিকার ও গণতান্ত্রিক পদ্ধতির দোহাই দিয়ে করা হলেও শেষ পর্যন্ত তা কতটুকু তত্ত্বগত আর কতটুকু বাস্তবসম্মতভাবে প্রতিফলিত হয়, তা বোঝা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে।
বিভিন্ন কায়েমি স্বার্থ ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-সংঘাতের দিকে দৃষ্টি রেখেই যুক্তরাষ্ট্রের দুই কক্ষবিশিষ্ট প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির শাসনব্যবস্থায় ক্ষমতাগতভাবে মোটামুটি একটি সমন্বয়সাধনের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা হয়েছে। ফলে সেখানে একজন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট যত শক্তিশালীই হোন না কেন, যুক্তরাষ্ট্রের দুই কক্ষবিশিষ্ট কংগ্রেসের মধ্যে বৃহত্তর সমঝোতা এবং তাদের সমর্থন ছাড়া শেষ পর্যন্ত অনেক কিছুই করতে পারেন না। যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের সিনেট ও প্রতিনিধি পরিষদে নিজ দলীয় সদস্যরাও বিভিন্ন ইস্যুতে একজন নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের গৃহীত কোনো পদক্ষেপ কিংবা সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করার সাংবিধানিক অধিকার রাখেন। আমাদের দেশে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার থাকলেও সংসদ সদস্যদের সে ক্ষমতা নেই। অর্থাৎ দলীয় সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করা যাবে না। আর আমাদের দেশে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দলীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকেন প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং। ফলে একদিকে দলের প্রধান এবং অন্যদিকে সরকারের প্রধান নির্বাহীর কোনো সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করার পরিণাম একজন সংসদ সদস্য কিংবা বিভিন্ন পর্যায়ের দলীয় নেতা-নেত্রীর ভালো করেই জানা আছে। তা ছাড়া সাংবিধানিকভাবেই জাতীয় সংসদে ফ্লোর ক্রস করার অর্থ হলো নিজ দলীয় সদস্য পদ হারানো। সুতরাং নিজের ইচ্ছার সম্পূর্ণ বিরুদ্ধে হলেও নিজ দলের আনীত সব বিলের পক্ষে তাঁকে ভোট দিতেই হবে। এ বিধান যেমন যুক্তরাষ্ট্রের নেই, তেমনি সংসদীয় গণতন্ত্রের সূতিকাগার ওয়েস্টমিনস্টার পার্লামেন্ট অর্থাৎ ব্রিটিশ সংসদেও সেভাবে নেই। সে অর্থে আমাদের সংসদ সদস্যদের ঠুঁটো জগন্নাথ বানিয়ে রাখা হয়েছে। নিজেরা আইনপ্রণেতা হিসেবে পরিচিত হলেও আইন প্রণয়নের আসল ক্ষেত্রটি বাদ দিয়ে তাঁরা নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় ধান-গম বিতরণ কিংবা রাস্তাঘাট মেরামতের ক্ষেত্রে উপজেলা চেয়ারম্যানদের ওপর খবরদারি নিয়ে সদা ব্যস্ত থাকেন। তা ছাড়া দলের ভেতরেও অনেকটা একই অবস্থা বিরাজ করছে। দলীয় প্রধান বা সভাপতি বা চেয়ারপারসনের ইচ্ছার ওপরই নির্ভর করে কোনো ব্যক্তির সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পাওয়া কিংবা না পাওয়ার বিষয়টি। দলীয় সংগঠনের বিভিন্ন পদে স্থান পাওয়ার বিষয়টিও একইভাবে বিবেচিত হতে দেখা গেছে অনিয়মিতভাবে অনুষ্ঠিত দলীয় সম্মেলন শেষে। তা ছাড়া নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকার দলীয় সদস্যদের গোপন ব্যালটের ওপর সংসদ নির্বাচনে কারো মনোনয়ন লাভ করার বিষয়টি মোটেও নির্ভর করে না। শুধু তা-ই নয়, দলীয় সদস্যদের গোপন ব্যালটে কোনো উপজেলা কিংবা জেলা পর্যায়ের নেতাও নির্বাচিত হন না। সব কিছুই নির্ভর করে সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতা এবং বিশেষ করে দলীয় প্রধানের রাজনৈতিক বিবেচনার ওপর। আর সে ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন কোনো দলের প্রধান যদি দেশের প্রধানমন্ত্রী হন তাহলে তো কথাই নেই। ওই এক ব্যক্তির হাতেই নির্ভর করে সম্পূর্ণ দলীয় রাজনীতি এবং নিবেদিতপ্রাণ নেতা-কর্মীদের ভবিষ্যৎ। গণতন্ত্রের বৃহত্তর স্বার্থে এ অবস্থার অবসান চান অনেকে, কিন্তু তা নিয়ে কোনো দলের অভ্যন্তরে সুপরিকল্পিত কোনো আন্দোলন নেই। দলীয় কাউন্সিল অধিবেশন শেষে নির্ধারিত সময় দলের কেন্দ্রীয় পর্যায়ে কমিটি গঠনকালে নেতৃত্বের দ্বিতীয় কোনো প্যানেলও উপস্থাপন করা হয় না। অর্থাৎ কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ঠিক করার ব্যাপারে কোনো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় না। বরং দায়িত্বপ্রাপ্ত দলীয় প্রধানের হাতেই ছেড়ে দেওয়া হয় কেন্দ্রীয় কমিটি গঠনের সম্পূর্ণ বিষয়টি।
এ কথা ঠিক যে একটি দলে জনপ্রিয়তা কিংবা নির্ভরযোগ্যতার ভিত্তিতেই সাধারণত দলীয় নেতা-নেত্রী ঠিক করা হয়ে থাকে। তবে সে জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের মাধ্যমটি কী? বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-নেত্রী নির্ধারণে দলীয় সদস্যদের কিংবা কেন্দ্রীয় পর্যায়ে প্রতিনিধিদের গোপন ব্যালটে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচনটি সম্পন্ন হয় না কেন? এ প্রশ্ন এখন প্রায় সর্বত্রই শোনা যায়। দেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলে দলীয় নেতা-নেত্রী নির্বাচনের ক্ষেত্রে সাধারণত গণতান্ত্রিক পদ্ধতির কোনো আশ্রয় নেওয়া হয় না। বিভিন্ন দলে বৃহত্তরভাবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রাজনৈতিক সংস্কারের কথা বলা হলেও সংস্কারকে দলের অনেকে ক্ষমতাসীন নেতা-নেত্রীদের বিরুদ্ধে একটি চক্রান্তের অংশ বলে মনে করে। সে কারণে কোনো দলেই রাজনীতিগতভাবে কোনো কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আসছে না। দলের সাংগঠনিক কিংবা নেতৃত্বের ক্ষেত্রে কোনো প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হচ্ছে না। রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের মধ্যে গণতন্ত্রের চর্চা কিংবা মূল্যবোধগত কোনো বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হচ্ছে না। সব পর্যায়ে নেতৃত্বসংক্রান্ত দলীয় ক্ষমতার কেন্দ্রটি কুক্ষিগত হয়ে আছে একটি দুর্ভেদ্য বৃত্তের মধ্যে। নির্বাচন কমিশনের সুস্পষ্ট নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও ছাত্র, যুবকসহ বিভিন্ন সংগঠন এখনো বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি করে চলেছে। দেশে গণতন্ত্র একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাওয়া দূরে থাকুক, কোনো দলেই প্রকৃত অর্থে গণতন্ত্রের চর্চা নেই। যা আছে তা হচ্ছে ব্যক্তিতন্ত্র। ফলে জাতীয় পরিসরে অসহনীয়ভাবে বেড়ে যাচ্ছে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন। এ অবস্থায় রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রয়োজনীয় সংস্কার ছাড়া দেশে প্রকৃত অর্থে গণতন্ত্রের চর্চা যেমন ত্বরান্বিত করা যাবে না, তেমনি দেশকেও উদ্ধার করা যাবে না দুর্নীতি ও অপশাসনের নিগড় থেকে। সংস্কারবিহীন রাজনৈতিক দলগুলোতে ব্যক্তিপ্রভাব, আধিপত্য, সন্ত্রাস, দুর্নীতি ও অনিয়ম শুধু দিন দিন বেড়েই যাবে এবং তার প্রতিফলন ঘটবে জাতীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে। বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকে একটি শিশুরাষ্ট্র হিসেবে আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব টিকিয়ে রাখার নামে অনেক অগণতান্ত্রিক কার্যকলাপ সংঘটিত হয়েছে। তাতে আর যা-ই হোক, বিভিন্ন সময় সামরিক অভ্যুত্থানকে ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি। গণতন্ত্রের ভিত শক্তিশালী হলে দেশে সামরিক অভ্যুত্থানের আশঙ্কা থাকে না। এ কথাটি বুঝেও আমরা স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা অত্যন্ত দুর্বল করে রেখেছি। রাজনৈতিক ক্ষমতা আটকে রেখেছি রাজধানীর অরক্ষিত চার দেয়ালের মধ্যে। এখানে যে একবার ক্ষমতায় যাওয়ার সুযোগ পায় সব কিছু যেন তাঁরই হয়ে যায়। আর কারো কোনো ভূমিকা থাকে না। বিরোধী দলের ভূমিকা নিতান্তই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। তাই রাজনীতি সংসদে নয়, রাজপথে নেমে আসে গণতান্ত্রিক বিভিন্ন বিধিবিধানের অকার্যকারিতার কারণে। প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক সংশোধনীর অভাবে।
পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনী বাতিল করে সুপ্রিম কোর্ট রায় দেওয়ার পর ২০১১ সালের ৩ জুলাই সংবিধান সংশোধন করে পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করা হয়েছিল। তাতে দেশের অনেক আইনই অবৈধ হয়ে পড়েছে। সংবিধানের সপ্তম সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করায় ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ থেকে ১৯৮৬ সালের ১১ নভেম্বর পর্যন্ত প্রায় সাড়ে চার বছরে করা দুই শতাধিক আইন বাতিল হয়ে গেছে। তবে সেসব বাতিল আইনে সরকারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম এখনো চলছে বলে জানা গেছে। যেসব আইন বাতিল ও অবৈধ ঘোষিত হয়েছে, সেগুলোর বৈধতা দিতে শিগগিরই আবার আইন পাস করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন প্রসঙ্গে এখনো চিন্তাভাবনা করার অবকাশ বর্তমান সরকারের রয়েছে। বিরোধীদলীয় জোটের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে দেশে একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য আর যেসব ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে তা তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। বিরোধী জোটের এ দাবি মেনে নিলে সরকারের কোনো ক্ষতির আশঙ্কা নেই। বরং তাতে একটি স্থিতিশীল দেশ বিভিন্নভাবে উপকৃত হবে। নতুবা নৈরাজ্য সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সম্প্রতি পাকিস্তানেও একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য একটি অন্তর্বর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন বর্তমান মহাজোট সরকারের পক্ষে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এটি পুনর্বিবেচনা করা কোনো অগণতান্ত্রিক কাজ হবে না। এর পাশাপাশি দেশের প্রবীণ চিন্তাশীল ব্যক্তিদের বক্তব্য অনুযায়ী বাংলাদেশে গণতন্ত্রের বৃহত্তর স্বার্থে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ নিয়েও সময়োচিতভাবে কিছুটা চিন্তাভাবনা করা একান্তই আবশ্যক বলে মনে করি। প্রধানমন্ত্রীর হাতে অতিরিক্ত রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত না করে সরকারের অন্যান্য পর্যায়ে তা বিকেন্দ্রীকরণ করা যেতে পারে। প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি ক্ষমতাসীন দলের মানুষ হিসেবে তাঁর হাতে রাষ্ট্রের কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক ক্ষমতা প্রদান করা যেতে পারে বলে অতীতেও অনেকে মতামত ব্যক্ত করেছেন। তা ছাড়া রাজধানী ঢাকাকেন্দ্রিক সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ কিছু দপ্তর ও অধিদপ্তর সুবিধামতো দেশের বিভিন্ন বিভাগীয় শহরে ছড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে। পাশাপাশি স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে বর্তমান মহাজোট সরকার তাদের মেয়াদকালেই অত্যন্ত শক্তিশালী করবে বলে দেশব্যাপী গণতন্ত্রমনা মানুষের আশা ছিল। তাতে দেশের কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য, যোগাযোগ ও উন্নয়ন কার্যক্রম আরো অনেক বেশি বেগবান হবে বলে তথ্যাভিজ্ঞ মহলের ধারণা। স্থানীয় সরকারকে একটি শক্তিশালী প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো দেওয়ার জন্য আওয়ামী লীগ সরকার অতীতেও অনেক কাজ করেছে এবং আইন প্রণয়ন করেছে। কিন্তু স্থানীয় সংসদ সদস্যদের অযাচিত হস্তক্ষেপের কারণে এ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি কিছুতেই আর অগ্রসর হতে পারছে না। এ ব্যাপারেও বর্তমান সরকারের একটি বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নেওয়া আবশ্যক বলে আমরা মনে করি।
লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক gaziulhkhan@gmail.com
No comments