আমার দেখা চিত্তরঞ্জন সাহা by মেজর (অব.) সুধীর সাহা
এক অভিনব পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে আমি ব্যক্তি চিত্তরঞ্জন সাহাকে জানার সুযোগ পাই। সম্ভবত ১৯৭৮ সালের কোনো একসময়। যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা করার জন্য যাওয়ার চেষ্টা করছিলাম। সব কিছু ঠিক ছিল; কিন্তু পরিবার গরিব হওয়ায় আর্থিক সচ্ছলতার দিকটি আমার সন্তোষজনক ছিল না।
স্পন্সরশিপের জন্য কার দ্বারস্থ হওয়া যায়- এমন প্রশ্ন নিয়ে ট্যাক্সের বিশিষ্ট আইনজ্ঞ আমার একই এলাকার মানুষ ফিরোজউদ্দিন ভুঁইয়ার কাছে ধরনা দিলাম। সব শুনে তিনি বললেন, টাকা-পয়সাওয়ালা একজন সাহা ব্যবসায়ী পাওয়া গেলে এ সময় তোমার কাজে লাগত। অনেক ভেবে তিনি মুক্তধারার চিত্তরঞ্জন সাহার নাম বললেন। কেননা ফিরোজ ভাই চিত্ত সাহার ট্যাঙ্ অ্যাডভাইজর। তবে যাওয়ার আগে ফিরোজ ভাই আমাকে সাবধান করে দিলেন এই বলে যে চিত্তবাবুকে দিয়ে হয়তো তোমার কাজটা হবে না। কেননা তিনি খুব নীতিবান, ট্র্যাডিশনাল এবং মহাব্যস্ত লোক। কিন্তু আমি আশায় বুক বেঁধে ঠিকই তাঁর কাছে গেলাম। ৭৪ নম্বর ফরাশগঞ্জে, পুঁথিঘর লিমিটেড এবং মুক্তধারার ব্যবস্থাপনা পরিচালক চিত্তরঞ্জন সাহার অফিস-কাম-বাড়িতে। বসার কক্ষটি অতি সাধারণ, একটি বড় টেবিল এবং সামনে অনেক চেয়ার। তবে ঘরটির বৈশিষ্ট্য হলো, চারদিকে বইয়ের আলমারি দিয়ে ঠাসা। ঘরটির পাশেই লম্বা বড় একটি বারান্দা এবং সেখানে বইয়ের আরো কয়েকটি আলমারি। মুক্তধারার প্রকাশিত সব বইয়ের এক কপি করে এসব আলমারিতে তো আছেই; এ ছাড়া বাংলা ভাষায় প্রকাশিত আরো কিছু দুর্লভ বইও স্থান পেয়েছে এই আলমারিগুলোতে। পরিবেশটা এমন যে মনে হলো, চিত্তরঞ্জন সাহা যেন বইয়ের এক সমুদ্রের মাঝখানে বসে আছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে দুরু দুরু বুকে বসলাম তাঁর সামনে। জানালাম, আমি যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে যেতে চাই এবং আমাকে সাহায্য করতে হবে। মুহূর্তের মধ্যে তাঁর সঙ্গে আমার এক যোগসূত্রের সৃষ্টি হলো। যেকোনোভাবেই তিনি আমাকে সাহায্য করতে প্রস্তুত হলেন। আমি জানালাম, আপনি আমার মায়ের ভাই সেজে যদি আমার জন্য আর্থিক সাহায্যের স্পন্সরশিপ অঙ্গীকারে স্বাক্ষর করেন তবে এটা সম্ভব। তিনি বললেন, তোমার জন্য করব। আমি অবাক হচ্ছিলাম। খুব সাহস করে আবার বললাম- শুধু তাই-ই নয়, আমার জন্য আপনাকে ওদের এম্বাসিতেও যেতে হবে এবং ইন্টারভিউ দিতে হবে। তিনি বললেন, তুমি সব ঠিক করো, আমি যাব।
আমি আমাকেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। মুক্তধারার চিত্তবাবু আমার মতো একজন অচেনা সাধারণ ছাত্রকে সাহায্য করার জন্য একেবারে এত সহজেই রাজি হলেন এবং এম্বাসিতেও যেতে রাজি হলেন, এটা যেন আমি ভাবতেই পারছিলাম না। যা হোক, বাস্তবে তাই-ই সম্ভব হলো। একদিন কাকডাকা ভোরে আমি আর তিনি একটি রিকশায় ফরাশগঞ্জ থেকে মতিঝিলে অবস্থিত আমেরিকান এম্বাসিতে গেলাম (এত সকালে তাঁর ড্রাইভার আসতে পারেনি)। তিনি বললেন, সুধীর আমার ভাগ্নে এবং আমি তাঁর বিদেশে পড়াশোনার খরচ বহন করব। তারপর তাঁর সঙ্গে আমার যোগাযোগ থেমে থাকেনি আর। মাঝেমধ্যেই তাঁর কাছে আমি গিয়েছি। তিনি আমার প্রতি কেন যেন আকৃষ্ট ছিলেন। বই নিয়ে, পড়াশোনা নিয়ে, প্রকাশনাভিত্তিক গবেষণা নিয়ে তিনি আমার সঙ্গে অনেক আলাপ করতেন। তাঁর সৃজনশীল কাজের প্রতি, তাঁর কাজের একাগ্রতার প্রতি, তাঁর সততার প্রতি আমি ক্রমাগত দুর্বল হয়ে পড়ি। তিনি প্রায়ই আমাকে বলতেন, তোমার মতো ছেলেদের দেশ ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত সঠিক নয়। একদিন সত্যি সত্যি আমার যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য যাওয়া হলো না। কিন্তু এর পরও তাঁর সঙ্গে আমার যোগাযোগ নিয়মিত চলতে থাকল। একদিন তিনি আমাকে বললেন, তুমি তো আমার আদর্শের উত্তরাধিকারী, আমার পুত্রসম। আমাকে মামা না বলে বাবাই তো বলতে পারো। হয়তো অনেকেই জানেন যে চিত্তবাবু নিঃসন্তান ছিলেন। তাই হয়তো আমার প্রতি তাঁর এত বেশি স্নেহ ছিল। যা হোক, তার পর থেকে আমি তাঁকে বাবা বলেই ডাকতাম।
মুক্তধারা এবং পুঁথিঘর লিমিটেডের চিত্তরঞ্জন সাহার শেষ দিকটি আমি সরাসরি দেখেছি। প্রকাশনা শিল্পের এক জাদুকরী মহাপুরুষ এই চিত্তরঞ্জন সাহা নোয়াখালীর চৌমুহনী থেকে তাঁর প্রকাশনা ব্যবসা শুরু করেছিলেন। চিত্ত সাহা বুঝতে পেরেছিলেন, চৌমুহনীর মতো একটি ছোট জায়গা থেকে তাঁর দেশজুড়ে বই ব্যবসা সুবিধাজনক হবে না। ১৯৫৬ সালে তিনি ঢাকায় বই ব্যবসা শুরু করেন। ১৯৬২ সালে ঢাকা প্রেস নামে একটি প্রেস স্থাপন করেন। এই প্রেস থেকেই পুঁথিঘর-এর বই ছাপা হতো। ১৯৬৭ সালে তিনি পুঁথিঘর লিমিটেড স্থাপন করে একই সালে প্রেস ও প্রকাশনা একই স্থান থেকে শুরু করেন। ৭৪ ফরাশগঞ্জ প্রথমে তিনি ভাড়ায় নেন এবং একসময় ওই বাড়িটি তিনি কিনে নেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের ভয়াল রাতে চিত্তবাবু প্রথমে ঢাকা ত্যাগ করে চৌমুহনী পৌঁছলেন। ইতিমধ্যে তাঁর আত্মীয়স্বজনের অনেকেই পালিয়ে গিয়েছিলেন ভারতে। ৫ মে তিনিও ভারতের আগরতলায় আশ্রয় নিলেন। ১০ মে তিনি প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের কলকাতার অফিসে আসেন। ২৮ মে কলকাতার পার্ক সার্কাসে সৈয়দ আলী আহসানের অস্থায়ী আবাসে ড. খান সরওয়ার মুরশিদ, ড. আনিসুজ্জামান, সত্যেন সেন, ড. সন্জিদা খাতুন, শওকত ওসমান, রণেশ দাসগুপ্ত, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, শিল্পী কামরুল হাসানসহ প্রায় ৫০ জন গুণী লেখক-কবি-সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবীর উপস্থিতিতে সিদ্ধান্ত হয়, তাঁরা সবাই লিখবেন এবং তা প্রকাশ করবেন পুঁথিঘরের চিত্তরঞ্জন সাহা। মুক্তির স্বপ্ন নিয়ে শুরু হয় মুক্তধারা। যুদ্ধ চলাকালীনই মুক্তধারা থেকে প্রকাশিত হলো ৩২টি বই। সেই মুক্তধারা চিত্তবাবুর হাত ধরে স্বাধীনতা-উত্তরকালে নানা বিষয় ও বৈচিত্র্যের প্রায় আড়াই হাজার গ্রন্থ প্রকাশ করে।
শেষের দিকে একটির পর একটি ব্যবসায়ে তিনি ক্ষতি দিচ্ছিলেন। বই ছাপাতেন তাঁর মনের সুখে; কিন্তু সে অনুযায়ী বিক্রি হতো না। পাঠ্য বইয়ের দৌরাত্ম্যের এবং অসাধু বই ব্যবসায়ীদের দাপটে মুক্তধারার সৃজনশীল বই প্রকাশনায় লাভের খাতায় ধস নামে। এ ব্যাপারে তাঁর সঙ্গে আমার অনেকবারই কথা হয়েছিল। প্রতিবারই আমি বুঝিয়েছিলাম, তাঁকে পুঁথিঘরের বই পাশাপাশি চালাতে হবে। তাঁর ব্যবসায়ের আসল দিক ছিল মোটামুটি এ রকম- পুঁথিঘর দিয়ে অর্থাৎ পাঠ্য পুস্তক এবং নোট বই ছাপিয়ে তিনি অর্থ উপার্জন করবেন এবং মুক্তধারার সৃজনশীল বই প্রকাশ করে সেই অর্জিত অর্থ ভর্তুকি দেবেন। কিন্তু তিনি ধীরে ধীরে পুঁথিঘরের নোট বই বা পাঠ্য পুস্তক ছাপানো বন্ধই করে দিচ্ছিলেন। তাই আমি তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করতাম, এভাবে তিনি তাঁর ব্যবসায়িক স্বার্থ রক্ষা করতে পারবেন না। তিনি আমার যুক্তি বুঝতেন এবং মেনেও নিতেন; কিন্তু বাস্তবে সে কাজটি করতেন না। নোট বই বা পাঠ্য বই ছাপানোর মধ্যে তিনি ব্যবসায়িক সাফল্য দেখতে পেতেন; কিন্তু মুক্তধারার সৃজনশীল বই ছাপানোর মধ্যে তিনি তাঁর মনের শান্তি খুঁজে পেতেন।
তিনি একদিকে যেমন সৃজনশীল লেখকদের সম্মান করতেন, অন্যদিকে তেমনি সেই লেখক ও সৃজনশীল মানুষদের নিমন্ত্রণ করে খাওয়াতে পছন্দ করতেন। মাঝেমধ্যেই যেকোনো ঠুনকো কারণেই ডেকে বসতেন শত শত লোককে। খাওয়াতে ভালোবাসতেন বড় বড় পাবদা, চিংড়ি, ইলিশসহ যাবতীয় মাছ। শেষের দিকে একদিকে তিনি ব্যাংক থেকে নতুন করে ঋণ নিয়েছেন আর অন্যদিকে প্রচুর টাকা খরচ করে তিনি তাঁর মনের কাছাকাছি মানুষদের নিমন্ত্রণ করে খাওয়াতেন। বইমেলা ছিল তাঁর আরেকটি সৃজনশীল কর্মকাণ্ড। প্রতি শহরে মুক্তধারার বইমেলা ও সভা করা ছিল তাঁর আরেকটি দিক। বিষয়টি এমন হতো যে বইমেলা করতে গিয়ে যে খরচ হতো, তার অর্ধেকও বই বিক্রি করে উঠত না। কিন্তু তবুও তিনি বইমেলা করতেন। তাঁর এই কাজটি অনেকে তাঁর শেষজীবনের পাগলামি মনে করতেন। তবে এই বইমেলা করার ফলে তিনি আমার কাছে অন্য একটি মাত্রায় ধরা পড়েছিলেন। ক্ষতি যাবে তা নিশ্চিত জেনেও ঋণ করে তিনি ৬৪টি জেলায় মুক্তধারার বইমেলা করে বেড়াতেন। বই পড়া মানুষদের একসঙ্গে দেখতে, তাদের সঙ্গে কথা বলতে তাঁর যে ব্যাকুলতা, তারই বহিঃপ্রকাশ ছিল এই বইমেলার উদ্যোগ।
চিত্তবাবু আজ হারিয়ে গেছেন আমাদের সবার কাছ থেকে। তাঁর সাধের মুক্তধারার অবস্থা করুণ থেকে করুণতর হয়েছে। কিন্তু প্রকাশনা জগতের বিকাশের পথে মুক্তধারার নাম এবং চিত্তরঞ্জন সাহার নাম মুছে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
লেখক : কলামিস্ট
আমি আমাকেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। মুক্তধারার চিত্তবাবু আমার মতো একজন অচেনা সাধারণ ছাত্রকে সাহায্য করার জন্য একেবারে এত সহজেই রাজি হলেন এবং এম্বাসিতেও যেতে রাজি হলেন, এটা যেন আমি ভাবতেই পারছিলাম না। যা হোক, বাস্তবে তাই-ই সম্ভব হলো। একদিন কাকডাকা ভোরে আমি আর তিনি একটি রিকশায় ফরাশগঞ্জ থেকে মতিঝিলে অবস্থিত আমেরিকান এম্বাসিতে গেলাম (এত সকালে তাঁর ড্রাইভার আসতে পারেনি)। তিনি বললেন, সুধীর আমার ভাগ্নে এবং আমি তাঁর বিদেশে পড়াশোনার খরচ বহন করব। তারপর তাঁর সঙ্গে আমার যোগাযোগ থেমে থাকেনি আর। মাঝেমধ্যেই তাঁর কাছে আমি গিয়েছি। তিনি আমার প্রতি কেন যেন আকৃষ্ট ছিলেন। বই নিয়ে, পড়াশোনা নিয়ে, প্রকাশনাভিত্তিক গবেষণা নিয়ে তিনি আমার সঙ্গে অনেক আলাপ করতেন। তাঁর সৃজনশীল কাজের প্রতি, তাঁর কাজের একাগ্রতার প্রতি, তাঁর সততার প্রতি আমি ক্রমাগত দুর্বল হয়ে পড়ি। তিনি প্রায়ই আমাকে বলতেন, তোমার মতো ছেলেদের দেশ ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত সঠিক নয়। একদিন সত্যি সত্যি আমার যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য যাওয়া হলো না। কিন্তু এর পরও তাঁর সঙ্গে আমার যোগাযোগ নিয়মিত চলতে থাকল। একদিন তিনি আমাকে বললেন, তুমি তো আমার আদর্শের উত্তরাধিকারী, আমার পুত্রসম। আমাকে মামা না বলে বাবাই তো বলতে পারো। হয়তো অনেকেই জানেন যে চিত্তবাবু নিঃসন্তান ছিলেন। তাই হয়তো আমার প্রতি তাঁর এত বেশি স্নেহ ছিল। যা হোক, তার পর থেকে আমি তাঁকে বাবা বলেই ডাকতাম।
মুক্তধারা এবং পুঁথিঘর লিমিটেডের চিত্তরঞ্জন সাহার শেষ দিকটি আমি সরাসরি দেখেছি। প্রকাশনা শিল্পের এক জাদুকরী মহাপুরুষ এই চিত্তরঞ্জন সাহা নোয়াখালীর চৌমুহনী থেকে তাঁর প্রকাশনা ব্যবসা শুরু করেছিলেন। চিত্ত সাহা বুঝতে পেরেছিলেন, চৌমুহনীর মতো একটি ছোট জায়গা থেকে তাঁর দেশজুড়ে বই ব্যবসা সুবিধাজনক হবে না। ১৯৫৬ সালে তিনি ঢাকায় বই ব্যবসা শুরু করেন। ১৯৬২ সালে ঢাকা প্রেস নামে একটি প্রেস স্থাপন করেন। এই প্রেস থেকেই পুঁথিঘর-এর বই ছাপা হতো। ১৯৬৭ সালে তিনি পুঁথিঘর লিমিটেড স্থাপন করে একই সালে প্রেস ও প্রকাশনা একই স্থান থেকে শুরু করেন। ৭৪ ফরাশগঞ্জ প্রথমে তিনি ভাড়ায় নেন এবং একসময় ওই বাড়িটি তিনি কিনে নেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের ভয়াল রাতে চিত্তবাবু প্রথমে ঢাকা ত্যাগ করে চৌমুহনী পৌঁছলেন। ইতিমধ্যে তাঁর আত্মীয়স্বজনের অনেকেই পালিয়ে গিয়েছিলেন ভারতে। ৫ মে তিনিও ভারতের আগরতলায় আশ্রয় নিলেন। ১০ মে তিনি প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের কলকাতার অফিসে আসেন। ২৮ মে কলকাতার পার্ক সার্কাসে সৈয়দ আলী আহসানের অস্থায়ী আবাসে ড. খান সরওয়ার মুরশিদ, ড. আনিসুজ্জামান, সত্যেন সেন, ড. সন্জিদা খাতুন, শওকত ওসমান, রণেশ দাসগুপ্ত, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, শিল্পী কামরুল হাসানসহ প্রায় ৫০ জন গুণী লেখক-কবি-সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবীর উপস্থিতিতে সিদ্ধান্ত হয়, তাঁরা সবাই লিখবেন এবং তা প্রকাশ করবেন পুঁথিঘরের চিত্তরঞ্জন সাহা। মুক্তির স্বপ্ন নিয়ে শুরু হয় মুক্তধারা। যুদ্ধ চলাকালীনই মুক্তধারা থেকে প্রকাশিত হলো ৩২টি বই। সেই মুক্তধারা চিত্তবাবুর হাত ধরে স্বাধীনতা-উত্তরকালে নানা বিষয় ও বৈচিত্র্যের প্রায় আড়াই হাজার গ্রন্থ প্রকাশ করে।
শেষের দিকে একটির পর একটি ব্যবসায়ে তিনি ক্ষতি দিচ্ছিলেন। বই ছাপাতেন তাঁর মনের সুখে; কিন্তু সে অনুযায়ী বিক্রি হতো না। পাঠ্য বইয়ের দৌরাত্ম্যের এবং অসাধু বই ব্যবসায়ীদের দাপটে মুক্তধারার সৃজনশীল বই প্রকাশনায় লাভের খাতায় ধস নামে। এ ব্যাপারে তাঁর সঙ্গে আমার অনেকবারই কথা হয়েছিল। প্রতিবারই আমি বুঝিয়েছিলাম, তাঁকে পুঁথিঘরের বই পাশাপাশি চালাতে হবে। তাঁর ব্যবসায়ের আসল দিক ছিল মোটামুটি এ রকম- পুঁথিঘর দিয়ে অর্থাৎ পাঠ্য পুস্তক এবং নোট বই ছাপিয়ে তিনি অর্থ উপার্জন করবেন এবং মুক্তধারার সৃজনশীল বই প্রকাশ করে সেই অর্জিত অর্থ ভর্তুকি দেবেন। কিন্তু তিনি ধীরে ধীরে পুঁথিঘরের নোট বই বা পাঠ্য পুস্তক ছাপানো বন্ধই করে দিচ্ছিলেন। তাই আমি তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করতাম, এভাবে তিনি তাঁর ব্যবসায়িক স্বার্থ রক্ষা করতে পারবেন না। তিনি আমার যুক্তি বুঝতেন এবং মেনেও নিতেন; কিন্তু বাস্তবে সে কাজটি করতেন না। নোট বই বা পাঠ্য বই ছাপানোর মধ্যে তিনি ব্যবসায়িক সাফল্য দেখতে পেতেন; কিন্তু মুক্তধারার সৃজনশীল বই ছাপানোর মধ্যে তিনি তাঁর মনের শান্তি খুঁজে পেতেন।
তিনি একদিকে যেমন সৃজনশীল লেখকদের সম্মান করতেন, অন্যদিকে তেমনি সেই লেখক ও সৃজনশীল মানুষদের নিমন্ত্রণ করে খাওয়াতে পছন্দ করতেন। মাঝেমধ্যেই যেকোনো ঠুনকো কারণেই ডেকে বসতেন শত শত লোককে। খাওয়াতে ভালোবাসতেন বড় বড় পাবদা, চিংড়ি, ইলিশসহ যাবতীয় মাছ। শেষের দিকে একদিকে তিনি ব্যাংক থেকে নতুন করে ঋণ নিয়েছেন আর অন্যদিকে প্রচুর টাকা খরচ করে তিনি তাঁর মনের কাছাকাছি মানুষদের নিমন্ত্রণ করে খাওয়াতেন। বইমেলা ছিল তাঁর আরেকটি সৃজনশীল কর্মকাণ্ড। প্রতি শহরে মুক্তধারার বইমেলা ও সভা করা ছিল তাঁর আরেকটি দিক। বিষয়টি এমন হতো যে বইমেলা করতে গিয়ে যে খরচ হতো, তার অর্ধেকও বই বিক্রি করে উঠত না। কিন্তু তবুও তিনি বইমেলা করতেন। তাঁর এই কাজটি অনেকে তাঁর শেষজীবনের পাগলামি মনে করতেন। তবে এই বইমেলা করার ফলে তিনি আমার কাছে অন্য একটি মাত্রায় ধরা পড়েছিলেন। ক্ষতি যাবে তা নিশ্চিত জেনেও ঋণ করে তিনি ৬৪টি জেলায় মুক্তধারার বইমেলা করে বেড়াতেন। বই পড়া মানুষদের একসঙ্গে দেখতে, তাদের সঙ্গে কথা বলতে তাঁর যে ব্যাকুলতা, তারই বহিঃপ্রকাশ ছিল এই বইমেলার উদ্যোগ।
চিত্তবাবু আজ হারিয়ে গেছেন আমাদের সবার কাছ থেকে। তাঁর সাধের মুক্তধারার অবস্থা করুণ থেকে করুণতর হয়েছে। কিন্তু প্রকাশনা জগতের বিকাশের পথে মুক্তধারার নাম এবং চিত্তরঞ্জন সাহার নাম মুছে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
লেখক : কলামিস্ট
No comments